প্রকৃতির মাঝে অমরত্বের সন্ধান
Science

প্রকৃতির মাঝে অমরত্বের সন্ধান

Apr 26, 2025   |    121


বছর দুয়েক আগে এক নিকট আত্মীয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছি। ক্যান্সার তার স্তনে বাসা বেধেঁছে। সার্জারীর পর মাসে একবার কেমোথেরাপি নিতে হচ্ছে। আমার ষাটোর্ধ আত্মীয়া মুহুর্মুহু হাসপাতাল ভ্রমণে একেবারে বিষিয়ে উঠেছেন। একদিন মুখ ফুটে বলেই ফেললেন, ‘ইঞ্জেকশনের পর ইঞ্জেকশন নিয়ে আমি আর বাঁচতে চাই না। এর থেকে মরে যাওয়াতেই শান্তি।

 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার অনেক ওষুধ রয়েছে। তবুও রোগ খুঁজে পেতেকখনো বা চিকিৎসা খুঁজে পেতে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। তখন বিষিয়ে ওঠে রোগীর জীবনহারিয়ে যায় তার বাঁচার আগ্রহ। কতগুলো রোগ যেন একেবারেই অপ্রতিরোধ্য যমদূত। পঞ্চাশে হৃদরোগষাটে ক্যান্সারসত্তরে আলজেইমার। আচ্ছাএই বার্ধক্যজনিত অসুখগুলোর কী আসলেই কোন প্রতিকার নেইটিকা যেমন গুটিবসন্ত আটকে দিয়েছেকোয়ারান্টাইন থামিয়ে দিয়েছে প্লেগের মতো ব্যধিবার্ধক্যকে থামাতে পারে এমন কি কোন প্রতিষেধক আছেআমরা যেমন ইতিহাসের পাতায় পড়েছি প্রস্তর যুগে হিংস্র পশুর আক্রমণ কিংবা মধ্যযুগে প্লেগের প্রকোপে লাখো মৃত্যুর গল্পকখনো কি এমন সময় আসবে যেদিন বার্ধক্যে মরে যাওয়াটা কেবলই ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া গল্প হয়ে যাবে?বিজ্ঞানীরা কি পারবে বার্ধক্যকে থামিয়ে দিতেঘুমপাড়ানি গল্পে ছোট মেয়েকে বুকে জড়িয়ে একদিন বাবা হয়তো বলবে, ‘জানিস একটা সময় ছিল যখন মানুষ বুড়িয়ে যেতচামড়া কুঁচকে যেতক্যান্সারে মারা যেত!’ 

 

এই অধ্যায়ের শুরুতে আমরা আলোচনা করবো চিকিৎসাবিজ্ঞানের বর্তমান গবেষকরা অনিদ্র নাবিকের মত দীর্ঘায়ু জীবনের সন্ধানে বেরিয়ে কতটুকু পথ পাড়ি দিয়েছেন। কোথায় তাদের মূল সীমাবদ্ধতাঅধ্যায়ের দ্বিতীয়ভাগে আমরা জানবোএই ছোট্ট পৃথিবীটাকে আমাদের সাথে ভাগ করে নেয়া অন্য পশুপাখিগুলোও কি প্রবীণ বয়সে রোগেশোকে আক্রান্ত থাকেনাকি তাদের মাঝে কেউ কেউ ইতোমধ্যেই খুঁজে পেয়েছে বার্ধক্য মোকাবিলা করার সমাধান

 

বর্তমান গবেষণার সীমাবদ্ধতা

চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের রোগের প্রতিকার করা। তবে ল্যাবে উদ্ভাবিত নতুন ওষুধ শুরুতেই মানুষের শরীরে প্রয়োগ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণনতুন ওষুধের অজানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মানুষের ভীষণ ক্ষতি হতে পারে। তাইনতুন কোন ওষুধ আবিষ্কারের পর প্রথমে অন্য একটি প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করে তার নিরাপত্তা যাচাই করা হয়। এই সকল প্রাণীকে বলা হয় গবেষণার জন্য ব্যবহৃত মডেল। আজকের বিশ্বে নানাবিধ রোগের গবেষণায় যে সকল প্রাণী মডেল হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়তাদের মাঝে ইঁদুরের অবস্থান তালিকার ওপর দিকে। ইঁদুর খুব ছোট একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী যাকে খুব অল্প খরচে ল্যাবে বড় করা যায়। প্রাণীটি খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং মানুষের সাথে তাদের ডিএনএ-র বেশ মিল রয়েছে। প্রায় একশ বছরের গবেষণার ফলস্বরূপ স্তন‍্যপায়ীদের মাঝে ইঁদুরের জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সর্বাধিক জ্ঞান রয়েছে। এসকল কারণে গবেষণায় মডেল হিসেবে ইঁদুরকে বিজ্ঞানীদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু এতসব কারণ সত্ত্বেও ইঁদুর আর মানুষের মাঝে রয়েছে বিস্তৃত তফাৎ। 

 

শিকারি প্রাণীর হাতে কম বয়সে প্রাণ হারানো ইঁদুরমহলের মাঝে বুড়ো বয়সের ক্যান্সার কিংবা আলজেইমার নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই। এসকল বার্ধক্যজনিত জটিলতা জীবনে আসার অনেক আগেই অধিকাংশ ইঁদুর বিড়াল কিংবা বাজপাখির  আহারে পরিণত হয়। মাংসাশী এই শিকারিদের নিত্যদিনের খাদ্যের যোগান দিয়েও প্রকৃতির বুকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাই খুব অল্প বয়স থেকেই (জন্মের মাত্র দুই মাসের মধ্যে) ইঁদুর বাচ্চা প্রসবের ক্ষমতা অর্জন করে। ভেবে দেখুনইঁদুরকে যদি প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করতে হাতির মত বারো বছর অপেক্ষা করতে হতকিংবা হাতির মত ২২ মাসব্যাপী গর্ভে একটি মাত্র বাচ্চাধারণ করতে হততবে বংশবিস্তারের আগেই সে অন্য কোন প্রাণীর আহারে পরিণত হয়ে প্রকৃতির বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারত। 

 

অন্যদিকে মানুষ বাঁচে সত্তর-আশি বছর পর্যন্তপ্রাকৃতিকভাবে মানুষকে ভক্ষণ করে খাবে এমন জন্তু-জানোয়ার এখন লোকালয়ে আসে না বললেই চলে। উপরন্তুবিজ্ঞানের অগ্রগতির বদৌলতে মানুষের আয়ুষ্কাল গত একশ বছরে বেড়েই চলেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে শিশুমৃত্যু হ্রাস এবং টিকার ব্যবহারে সংক্রামক রোগ দমনের ফলে আজ আমরা স্বপ্ন দেখি ভালোবাসার মানুষটির সাথে বুড়ো হবারযা গত শতকেও ছিলো অচিন্তনীয়। আয়ুষ্কালের অভূতপূর্ব বৃদ্ধির কারণেই বুড়ো বয়সের রোগ বালাই মনুষ্যসমাজে আজ বেশী চোখে ধরা পরে। মানুষসহ যে সকল প্রাণী প্রকৃতির বুকে বুড়ো হতে পেরেছেবার্ধক্যজনিত রোগ কেবলমাত্র তাদের জীবনেই বড় সমস্যা। সুতরাং মানুষ এবং ইঁদুরের জীবনের সংগ্রামটা বেশ ভিন্ন। ইঁদুরের সংগ্রামটা বংশবৃদ্ধিরমানুষের সংগ্রাম এখন বার্ধ্যকের সাথে।

 

অতএবঅসংখ্য রোগের গবেষণায় ব্যাবহৃত হলেওবুড়ো বয়সের রোগ নিয়ে গবেষণা করবার জন্য ইঁদুর খুব একটা উৎকৃষ্ট মডেল নয়। যে প্রাণী বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচেই থাকতে পারে নাতার শরীরে বার্ধক্যজনিত রোগের প্রতিকার আবিষ্কার করা একটু কষ্টসাধ‍্য। 

 

এখন প্রশ্ন আসতে পারেপৃথিবীর একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ যে ক্যান্সারে ভুগে মারা যাচ্ছেসেই ক্যান্সার কি ইঁদুরেও হয়নাকি অল্পবয়সে বিড়ালের থাবায় মরে যাচ্ছে বলে তাদের ক্যান্সার নেইকৌতূহলোদ্দীপক বটে,  আয়ুষ্কাল মাত্র দুই-তিন বছর হলেও এই ছোট্ট-চঞ্চল প্রাণীটির দেহে খুব জোরেশোরে ক্যান্সার বাসা বাঁধে (প্রতি চারটি ইঁদুরে একটি)! কেন প্রকৃতির এই বিচারতার উত্তরটা আমরা আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। মনে আছেশারীরিক বৃদ্ধির জন্য যত বেশী কোষ বিভাজিত হচ্ছে ততবেশী ডিএনএ-র কপি তৈরি হয় এবং প্রোটিন তৈরির রেসিপিতে ভুল (মিউটেশন) করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়শিকারির প্রাদুর্ভাবে জর্জরিত এই পৃথিবীতে অস্তিত্ব টেকানোর জন্য একটা বাচ্চা ইঁদুরকে অত্যন্ত দ্রুত কোষ বিভাজনের মাধ্যমে পূর্নাঙ্গ ইঁদুরে পরিণত হতে হয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাই ইঁদুরের বাচ্চার বড় হওয়ার গতি মানবশিশুর চেয়ে ৪৫ গুণ বেশী। এই দ্রুত কোষ বিভাজনের অত্যাবশ্যকীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে অল্প বয়সের মধ্যেই ইঁদুরের ডিএনএ-র রেসিপিতে গোলমাল (মিউটেশন) বাঁধেযা তাদের দেহে সৃষ্টি করে নানারকম ক্যান্সার। 

 

এখন আমরা যদি প্রকৃতির মাঝে মানব ক্যান্সারের প্রতিকার খুঁজতে চাই তাহলে অবশ্যই ইঁদুরের মাঝে সেই উত্তর পাওয়াটা একটু কঠিন হবে। কারণইঁদুরের জীবনে ক্যান্সার হয় অল্পবয়সে অতিদ্রুত কোষ বিভাজনের ফলে। আর মানুষের জীবনে ক্যান্সার হয় দীর্ঘ আয়ুষ্কালে ধীরে ধীরে জমা হওয়া মিউটেশনের কারণে। এর ফলে দেখা যায়ইঁদুরের দেহে গবেষণা করে আবিষ্কার করা ওষুধের মাত্র ১০-১৫% মানুষের শরীরে কাজ করে। সুতরাংক্যান্সারের মতো বার্ধক্যজনিত রোগের প্রতিকার খুঁজতে হবে এমন সকল প্রাণীর মাঝে যারা বেশী দিন বাঁচে। কারণ এধরণের প্রাণীর দেহে গবেষণা করে উদঘাটিত ওষুধ মানবদেহে ভালো কাজ করার সম্ভাবনা বেশী। 

 

আমার কথা শুনে মনে হতে পারেআমি গবেষণায় ইঁদুর ব্যবহারে নারাজ! ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। ক্যান্সারের উপর আমার বর্তমান গবেষণাতেও আমি প্রতিনিয়ত ইঁদুর ব্যবহার করি। দীর্ঘদিন ধরে রোগসংক্রান্ত গবেষণার কাজে ইঁদুর ব্যবহৃত হয়েছে বলে আমরা তাদের দেহের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে বিস্তর জানতে পেরেছি। গবেষণার পরিধিতে তাই ইঁদুরের তথ্য অত্যন্ত সহজলভ্য এবং গবেষকমহলে তা বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু উন্নত গবেষণা-প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে দাঁড়িয়ে আমরা যখন গবেষণায় ইঁদুর ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে পারছিতখন আমাদের উচিত গবেষণার পরিধিকে নতুন কিছু প্রাণীর মাঝে বিস্তৃত করাযাদের সাথে মানুষের জৈবিক প্রক্রিয়া অধিক তুলনীয়।

 

কিন্তুআমরা কীভাবে বুঝবো কোন প্রাণীগুলোর উপর আরো বেশী গবেষণা করা উচিতএর উত্তর আছে পিটোস প্যারাডক্সে। একটা সহজ উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বোঝার চেষ্টা করব যেমানুষের তুলনায় ছোট্ট ইঁদুর কিংবা অতিকায় হাতির ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা আদৌ কি অঙ্ক কষে অনুমান করা যায় কিনা। 

 

পিটোস প্যারাডক্স

চলুনছোটবেলায় শেখা পাটিগণিত ব্যবহার করে ছোট্ট একটা অঙ্ক কষার চেষ্টা করি। আপনাকে আমি বলে দিলামএকটি ইঁদুরের শরীরে ১০০টি কোষ আছেআর একজন মানুষের শরীরে কোষ আছে ১০,০০০টি। হিসাবের সুবিধায় মোটা দাগে ধরে নেইএকটি ইঁদুর বাঁচে ৩ বছরআর একজন মানুষ বাঁচে ৮০ বছর। প্রশ্নে আমি আরও বলে দিলাম যে ইঁদুর আর মানুষ উভয়ের কোষই প্রতিদিন একবার করে বিভাজিত হয়। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন হলো:


 একটি ইঁদুর আর একটি মানুষের জীবদ্দশায় তাদের দেহে মোট কতবার কোষ বিভাজন ঘটে?


উত্তর:

ইঁদুরের কোষ = ১০০ টি

১০০টি কোষে ১ দিনে বিভাজন ঘটে = ১০০ × ১ = ১০০ বার

১০০টি কোষে ৩ বছরে বিভাজন ঘটে = ১০০ × ৩ × ৩৬৫ = ৩৬,৫০০ বার

 

অন্যদিকে,

মানুষের কোষ = ১০,০০০ টি

১০,০০০টি কোষে ১ দিনে বিভাজন ঘটে = ১০,০০০ × ১ = ১০,০০০ বার

১০,০০০টি কোষে ৮০ বছরে বিভাজন ঘটে = ১০,০০০ × ৮০ × ৩৬৫ = ২৯,২০,০০,০০০ বার

 

সুতরাংআমাদের এই কাল্পনিক গাণিতিক অনুশীলনে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষের জীবদ্দশায় একটি ইঁদুরের তুলনায় ৮,০০০ গুণ বেশী কোষ বিভাজন ঘটে। আমরা আগেই জেনেছিকোষ বিভাজন যত বেশী হবেডিএনএ-র রেসিপিতে মিউটেশন তথা ক্যান্সার ও বার্ধক্যজনিত রোগ হবার সম্ভবনা তত বাড়তে থাকবে। বোঝার খাতিরে প্রথমে ধরে নেয়া যাকপ্রতি কোষ বিভাজনে মানুষ আর ইঁদুরের কোষে সমপরিমাণ মিউটেশন জমা হয়অর্থাৎ ডিএনএ কপি করার সময় উভয়ের রেসিপিতে সমান সংখ্যক ভুল হয়। এখনআমাদের এই ধরে নেয়া কথাগুলো যদি সত্যি হয়তবে মানুষের শরীরে ইঁদুরের তুলনায় ৮,০০০ গুন বেশী ক্যান্সার ধরা পড়ার কথা! কিন্তুবাস্তবে তা একেবারেই দেখা যায় না। ইঁদুর আর মানুষ উভয় প্রজাতিতেই প্রতি চার জনে একজনের ক্যান্সার হয়। লক্ষ্য করুনমানুষের শরীরে ইঁদুরের তুলনায় অনেক বেশী কোষ রয়েছে এবং মানুষ ইঁদুরের তুলনায় অনেক বেশী দিন বাঁচে। তা সত্ত্বেও যত বেশী ক্যান্সার আমাদের হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে বরং কম হচ্ছে। কিন্তু কেন?

 

মানুষ একাই যে ব্যাতিক্রমতা কিন্তু না। একটা হাতির ওজন প্রায় ৬,৫০০ কেজিবাঁচে প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত। Bowhead Whale নামক তিমির ওজন ৮০,০০০ কেজিবাঁচে প্রায় ২০০ বছর! অবাক করা ব্যাপার হলোএই বিশালদেহী প্রাণীগুলোর দেহে অত্যাধিক কোষ থাকলেওকিংবা তারা বহুবছর বেঁচে থাকলেওতিমি এবং হাতির ক্যান্সার প্রায় নেই বললেই চলে। সরল গাণিতিক বিচারে যে সকল প্রাণীর ক্যান্সার অনেক বেশী হবার কথা ছিল,বাস্তবে তাদের দেহে ক্যান্সার পাওয়া যায় সবচেয়ে কম! অতএবসরল অঙ্কের যুক্তিতে এসকল প্রাণীর ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা সঠিকভাবে অনুমান করা দুঃসাধ্য।

 

যুক্তির বিপরীতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাকে ইংরেজিতে বলা হয় প্যারাডক্স। ১৯৭৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানবিদ (এবং বর্তমানে আমার প্রতিবেশী) রিচার্ড পিটো গবেষণা করে বিভিন্ন প্রজাতির মাঝে ক্যান্সার হবার প্রবণতার এই বিপরীতমুখিতাকে  গাণিতিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে সর্বপ্রথম বর্ননা করেন। তার নামানুসারে দীর্ঘজীবী প্রাণীদের দেহে ক্যান্সারের অপ্রতুলতার এই বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণের নামকরণ করা হয় পিটোস প্যারাডক্স। কিন্তু কেন এই বিপরীতমুখিতাকেন মানুষ কিংবা হাতির ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা তত্ত্বীয় অনুমানের চেয়ে বাস্তবে অনেক কমবিজ্ঞানীরা আজ পর্যন্ত এই প্যারাডক্সের দুটি প্রধান ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

 

ব্যাখ্যা ১: কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেক্স কেইগান ও তার সহকর্মীদের করা একটি চমৎকার গবেষণা ২০২২ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৬টি প্রজাতির মাঝে তুলনা করে তারা দেখিয়েছেন-- স্তন্যপায়ী প্রাণীরা যত বেশীদিন বাঁচেতাদের বাৎসরিক মিউটেশনের হার তত কম হয়:

 

 


উৎস: Cagan et al. Somatic mutation rates scale with lifespan across mammals. Nature 604, 517–524 (2022). CC-BY 4.0 লাইসেন্সের আওতায় ছবিটিকে এখানে সংযুক্ত করা হলো।

 

তাদের সাড়াজাগানো এই গবেষণার সারমর্ম যেই গ্রাফটির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় তা সরাসরি এখানে তুলে ধরা হল।  গ্রাফটিতে দেখা যাচ্ছেমাত্র ৩.৭ বছর আয়ুষ্কালের ইঁদুরের কোষে বছরে ৮০০টি নতুন মিউটেশন সঞ্চিত হয়। অন্যদিকে ৮৩.৬ বছর আয়ুষ্কালের মানুষের কোষে বছরে মাত্র ৪৫টি নতুন মিউটেশন সঞ্চিত হয়। 

 

সোজা কথায়মানুষ ইঁদুরের তুলনায় বেশী দিন বাঁচলেওকিংবা মানুষের দেহে মোট কোষের সংখ্যা ইঁদুরের চেয়ে অনেক বেশী হলেও মানবদেহে ইঁদুরের ন্যায় অধিক মিউটেশন কিংবা ক্যান্সার দেখা যায় না। কোন এক অজানা কারণে মানুষের কোষের ডিএনএ-তে গোলমাল তথা মিউটেশন সঞ্চারণের হার ইঁদুরের তুলনায় কম। আমাদের গাণিতিক অনুশীলনের সময় প্রতি বিভাজনে মানুষ আর ইঁদুরের কোষে সমপরিমাণ মিউটেশন জমা হয় বলে যে কল্পনা আমরা করেছিলামতা বাস্তবে একেবারেই সত্য নয়! তাই তত্ত্বীয় গাণিতিক হিসাব ক্যান্সারের বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

 

ব্যাখ্যা ২: দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি এসেছে আমার পিএইচডি গবেষণা থেকে। ২০২৩ সালে নেচার কমিউনিকেশন্স পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণায় আমি এবং আমার সহকর্মীরা পিটোস প্যারাডক্সের ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছি দীর্ঘজীবী প্রাণীদের স্টেমসেলের মাঝে। আপনার হয়তো মনে আছে প্রথম অধ্যায়ে আমরা জেনেছিলাম স্টেমসেল হচ্ছে সেসকল কোষ যাদের থেকে পৌনঃপুনিকভাবে অন্যান্য কোষ তৈরি হতে থাকেএবং এই ক্রমাগত কোষ বিভাজনের ফলে ডিএনএ-র রেসিপিতে মিউটেশন জমা হবার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। আমাদের গবেষণায় যে বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছে তা হলো  একটা প্রাণী যত বেশী দিন বাঁচেতার স্টেমসেল গুলো তত ধীরে বিভাজিত হয়।


আমাদের পেপার থেকে নিচের লেখচিত্রটি হুবহু তুলে ধরা হলো।  লগস্কেলে প্রকাশিত এই গ্রাফের সারমর্ম হলোস্বল্পজীবী ইঁদুরের স্টেমসেল দিনে একবার করে বিভাজিত হয়। অন্যদিকে দীর্ঘজীবী মানুষ কিংবা নেকেড মোল র‍্যাটের স্টেমসেল সপ্তাহে মাত্র একবার বিভাজিত হয়। 


উৎস: Montazid et al. Adult stem cell activity in naked mole rats for long-term tissue maintenance. Nat Commun 14, 8484 (2023). CC-BY 4.0 লাইসেন্সের আওতায় ছবিটিকে এখানে সংযুক্ত করা হলো। 

 

সুতরাংঅংক কষার সময় আমরা ইঁদুর আর মানুষের কোষে প্রতিদিন একটি করে বিভাজন হয় বলে যে অনুমান করেছিলাম তা সঠিক হয়নি। এখন পিটোস প্যারাডক্সের এই দুই ব্যাখ্যাকে এক সাথে করে বলা যায়: ক্ষীণজীবী প্রাণীদের তুলনায় দীর্ঘজীবী প্রাণীদের কোষে দুটি মূল পার্থক্য রয়েছে-- একস্টেমসেলের বিভাজনের হার কম। দুইপ্রতি বিভাজনে আরোহিত মিউটেশনের সংখ্যা কম। তাইমানুষ ইঁদুরের তুলনায় অনেক বেশীদিন বাঁচলেও তার জীবদ্দশায় তুলনামূলকভাবে তত বেশী মিউটেশন/ক্যান্সার হয় না।

 

পিটোস প্যারাডক্সের এই দুই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়একটি প্রাণী যখন বেশী দিন বাঁচে তখন সে কোষের ভেতর জমা হওয়া মিউটেশনের সংখ্যা এবং কোষ বিভাজনের হারকে কোন-না-কোন ভাবে কমিয়ে আনতে পারে। আমরা যদি কোনভাবে সে উপায়গুলো আবিষ্কার করতে পারি তাহলে মানুষের দেহে অযাচিত মিউটেশনগুলো বন্ধের মাধ্যমে ক্যান্সারসহ অন্যান্য বার্ধক্যজনিত রোগ প্রতিরোধ করতে পারবো। অন্তত সেটাই আমার মতো গবেষকদের মূল লক্ষ্য।

 

এখন আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগতে পারে: 


 ‘একটা প্রাণী কীভাবে নিজ কোষের মিউটেশনের হার ও কোষ বিভাজনের হারকে কমিয়ে আনেমানুষ তো দুবছর আগেও প্রমাণ করতে পারেনি এসব তথ্য! তিমি কিংবা হাতি কী উপায়ে তাদের মিউটেশনের সংখ্যা কমালোইঁদুর কেন তা পারল না?’ 

 

এই সকল প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হলো- বিবর্তন। মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের বিবর্তন।

 

বিবর্তন

আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি পলিমারেজ নামক এক প্রোটিনের কথা। কোষ বিভাজনের সময় পলিমারেজ প্রোটিনটি ডিএনএ-র দুটি প্রতিলিপি তৈরি করে। আমরা পলিমারেজের একটি বদঅভ্যাসের কথাও আলোচনা করেছি। সে কিছুক্ষণ পর পর ডিএনএ-র রেসিপি কপি করার সময় একটু ভুল করেযাকে বলা হয় মিউটেশন। এই মিউটেশনই বিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি।

 

মিউটেশনের কারণে প্রায় ৯৯.৯৯% সময়ে প্রাণীদেহে রোগের সূচনা ঘটতে পারে। এই ধরণের মিউটেশনকে বলা হয় ক্ষতিকর মিউটেশন। কদাচিৎ হলেওবাকি ০.০১% সময়ে মিউটেশনের ফলে এমন একটা প্রোটিন তৈরি হতে পারেযা কিনা আগের প্রোটিনের চেয়েও ভালোভাবে কাজ করে। এই অতিবিরল মিউটেশনগুলোকে বলা হয় লাভজনক মিউটেশন। ক্ষতিকর মিউটেশন শরীরে সঞ্চিত হলে একটি প্রাণী তার প্রজাতির অন্য সদস্যদের তুলনায় দ্রুত মৃত্যুবরণ করবে। অন্যদিকে লাভজনক মিউটেশনের লটারী জিতে গেলে একটি প্রাণী তার প্রজাতির অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশীদিন বাঁচবে।

 

এবার আসুন একটি কাল্পনিক উদাহরণ চিন্তা করি। এই ধরণের চিন্তাকে বলা হয় ‘thought experiment’। ধরুনএকটি ইঁদুরের ডিএনএ-তে নেহায়েত ভাগ্যের জোড়ে এমন একটি লাভজনক মিউটেশন সৃষ্টি হলো যার ফলশ্রুতিতে তার কম ক্যান্সার হবে। আরেকটি ইঁদুরের ডিএনএ-তে ভিন্ন একটা লাভজনক মিউটেশন হল যার বদৌলতে সে জোরে দৌড়াতে পারবে। এখন চিন্তা করুনইঁদুর সমাজে কোন লাভজনক মিউটেশনটির কদর বেশী হবে?

 

আমরা আগেই আলোচনা করেছিক্যান্সার হওয়া ইঁদুরের মৃত্যুর প্রধান প্রাকৃতিক কারণ নয়। ইঁদুরের মৃত্যুর প্রধান কারণ শিকারি বিড়াল কিংবা বাজপাখির ছোবল।  তাই ক্যান্সারমুক্ত প্রথম ইঁদুরটি হয়তো তার বাচ্চা জন্ম দেবার আগেই বিড়ালের মধ্যাহ্নভোজে পরিণত হবে। পরিণামে আপাতদৃষ্টিতে লাভজনক এই মিউটেশনটি হয়ত পরবর্তী প্রজন্মে ডিএনএ-র মাধ্যমে প্রবাহিত হতেই পারবে না।

 

অন্যদিকে মিউটেশনের কারণে যে ইঁদুরটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী জোরে দৌড়াচ্ছেসে কিন্তু বিড়ালের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে যাবে এবং বেশী বাচ্চা প্রসব করার সুযোগ পাবে। সুতরাংতার এই লাভজনক মিউটেশনটি বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে বাচ্চাদের দেহে প্রবাহিত হতে পারবে। পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত লাভজনক এই মিউটেশনের বদৌলতে বাচ্চা ইঁদুরগুলোও পূর্বপুরুষের মতো জোরে দৌড়াবেবেশী দিন বাঁচবে এবং তাদের পরের প্রজন্মে লাভজনক মিউটেশনটি পুনরায় সঞ্চালিত করবে। অপরদিকে গোত্রের অন্য ইঁদুরগুলো (যাদের এই লাভজনক মিউটেশানটি নেই) জোরে দৌড়াতে না পারায় সহজেই বিড়ালের শিকারে পরিণত হবে। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে গেলে দেখা যাবেযারা জন্মসূত্রে দ্রুতগামিতার লাভজনক মিউটেশন লাভ করছেতারাই বেশীদিন বেঁচে থাকছে ও বংশবিস্তার করছে। কয়েক হাজার বছর পর দেখা যাবেসেই এলাকায় নতুন প্রজন্মের বেশীরভাগ ইঁদুর ছানা জোরে দৌড়াতে সক্ষম। 

 

সুতরাংআমাদের এই কাল্পনিক উদাহরণে দ্রুতগামিতা সৃষ্টিকারী মিউটেশন ইঁদুরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লাভজনক। বিড়াল এখানে প্রকৃতির ভূমিকা পালন করে সবচেয়ে দ্রুতগামী ইঁদুরটিকে বাঁচার জন্য নির্বাচন করছে এবং বাকি ইঁদুরগুলোকে খেয়ে ফেলছে। বিবর্তনের এই ধীর প্রক্রিয়াটিকে তাই বলা হয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন’ যার মাধ্যমে সবচেয়ে উপযুক্ত লাভজনক মিউটেশনটি পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করে। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন এ বৈজ্ঞানিক সত্যটিকে প্রথম ব্যাখ্যা করার সময় বলেছিলেন- ‘survival of the fittest’.

এবার চিন্তা করুন হাতির কথা। ধরুন একটি হাতি কোষ বিভাজনের সময় এমন একটি লাভজনক মিউটেশন অর্জন করেছে যার ফলে তার আলজেইমার (একধরণের মস্তিষ্কের রোগ যার ফলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়) হবার প্রবণতা কমে গিয়েছে। ভেবে দেখুন তোএই হাতিটি কি অন্য হাতিদের তুলনায় বেশী দিন বাঁচবে?

 

উত্তরটা সম্ভবত হ্যাঁ। হাতিকে শিকার করে খায় এমন প্রাণীর সংখ্যা খুব কম। বনে-বাদাড়ে হাতি প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তাহলে বনের হাতিগুলো মারা যায় কীভাবেমূলত তিনটি কারণে- বার্ধক্যমানুষের আক্রমণ আর ছোঁয়াচে রোগ। এর মাঝে বার্ধক্যজনিত রোগের (আলজেইমারবাতের ব্যাথাশ্বাসকষ্টডায়াবেটিস ইত্যাদি) পেছনে কোষ বিভাজনের সময় ঘটে যাওয়া ক্ষতিকর মিউটেশনের ভূমিকা প্রবল। যদি হাতির কোন লাভজনক মিউটেশনের কারণে তার শরীরে ক্ষতিকর আলজেইমার সৃষ্টির সম্ভাবনা কমে যায়তাহলে কিন্তু সেই হাতিটির সুস্থ জীবনকাল বৃদ্ধি পাবে। এই মিউটেন্ট হাতিটি তখন বেশি বেশি বাচ্চা দেয়ার সুযোগ পাবে এবং দীর্ঘ সময় ধরে সে বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা করতে পারবে। আলজেইমার দমনকারী এই মিউটেশনটি তখন ডিএনএ-র মাধ্যমে তার বাচ্চাদের দেহে সঞ্চারিত হবে। এরপর বংশ পরম্পরায় প্রায় সব হাতির মাঝেই এই লাভজনক মিউটেশন ছড়িয়ে পড়বে।

 

আপনি হয়তো এখন ভাবছেন--


 মানুষের মাঝে কি এরকম বিবর্তনের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়?

হিমালয় সংলগ্ন তিব্বতে প্রায় ৩,০০০ মিটার উঁচু পাহাড়ে বিগত ৪০,০০০ বছর ধরে মানুষ বসবাস করে আসছে। আপনারা যারা পাহাড়ে চড়েছেন তারা হয়তো লক্ষ করেছেনউপরে ওঠার সাথে সাথে সেখানে শ্বাস নেয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হলোআপনি যতই উপরে যাবেন ততই বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমতে থাকে। একারণেই পর্বতারোহীরা নিজেদের সাথে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বহন করেন। অথচ তিব্বতের এই স্থানীয় মানুষেরা কোন প্রকার অক্সিজেনের সিলিন্ডার ছাড়া পাহাড়ের চূড়ায় অল্প অক্সিজেনে বসবাস করছে। এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?

 

২০১০ সালে সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত এক চমৎকপ্রদ গবেষণায় দেখা গেছেপর্বতচূড়ায় বসবাসকারী তিব্বতের মানুষের ডিএনএ-তে একটি লাভজনক মিউটেশনযুক্ত জিন (EPAS1) রয়েছে যা তাদেরকে স্বল্প অক্সিজেনের মাঝেও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। পাহাড়ের মাটি খুঁড়ে পাওয়া আদিম মানুষের ফসিল বা জীবাশ্ম থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ পরীক্ষা করে এই গবেষকদল জানিয়েছেন৪০,০০০ বছর আগে মানুষ প্রথম যখন তিব্বতে বসবাস শুরু করেছিল,  তখন খুব বেশী মানুষের কোষে এই মিউটেশনটি উপস্থিত ছিলো না। ফলশ্রুতিতে তখন অক্সিজেনের অভাবে তারা কষ্ট পেয়েছে এবং অনেকে মারাও গিয়েছে। কিন্তুকিছু মানুষের মাঝে সেই লাভজনক মিউটেশনযুক্ত EPAS1 জিনটি ছিলো এবং তারা স্বল্প অক্সিজেনের মাঝেও বাঁচতে পেরেছে। এর ফলশ্রুতিতে দীর্ঘায়ু অর্জনে সাহায্যকারী মিউটেশনযুক্ত EPAS1 জিনধারী ব্যক্তিরা অধিক সন্তান জন্মদান করতে পেরেছে। অপরদিকে উপকারী মিউটেশনবিহীন স্বল্পায়ুধারী তিব্বতবাসী কম সন্তান উৎপাদন করতে পেরেছে। 

 

বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেছেনতিব্বতের পাহারে বসবাসের এই চল্লিশ হাজার বছরের ইতিহাসে  মাত্র ৩,০০০ বছরেই পাহারবাসী গোত্রের প্রায় ৪০% মানুষ EPAS1 জিনে লাভজনক মিউটেশনটি বংশ পরম্পরায় অর্জন করেছে। এর অর্থপ্রাচীন তিব্বতে তারাই ভালোভাবে টিকে ছিল এবং অধিক বংশবৃদ্ধি করতে পেরেছে যাদের শরীরে এই লাভজনক মিউটেশনটি জন্মসূত্রে সঞ্চারিত হয়েছে। প্রজন্মের আবর্তনে বর্তমানে তিব্বতের প্রায় ৮৭% মানুষ EPAS1 জিনের লাভজনক মিউটেশনটি ধারণ করছে। সুতরাংআপনি যখন নেপালের কিংবা তিব্বতের শেরপাদের দেখবেন তারা আপনাকে পেছনে ফেলে তরতরিয়ে পাহাড়ের উপর উঠে যাচ্ছেতখন বুঝবেন এর পেছনে রয়েছে বিবর্তনের হাত।

 

সুতরাংএকটি প্রাণীর শরীরে তার জন্য লাভজনক মিউটেশনটি খুঁজে বের করতে পারলে সেই প্রাণীর বিবর্তনের ইতিহাস উদঘাটন করা সম্ভব। কারণ প্রতিটি প্রজাতিই বেঁচে থাকার জন্য বেশ কিছু লাভজনক মিউটেশন তার ডিএনএ-তে জমা করেছে। এখনআমাদের গন্তব্য হলো বার্ধক্যজনিত রোগকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম এমন সব লাভজনক মিউটেশন জীবজগৎ থেকে খুঁজে বের করা। আমরা যদি জীবজগতের সেই মিউটেশনগুলো খুঁজে বের করতে পারিতাহলে আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায় সেগুলোকে মানবদেহে সঞ্চারিত করে মানুষের আয়ুষ্কাল আরেকটু বৃদ্ধি করা সম্ভব হতে পারে। কীভাবে তা করা যেতে পারে সে ব্যাখ্যা আগামী অধ্যায়গুলোতে থাকবে। কিন্তুএজন্য এমন সকল প্রাণীর উপর গবেষণা করতে হবে যারা মিলিয়ন বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের দেহে লাভজনক মিউটেশন  অর্জন করে বার্ধক্যজনিত রোগকে পরাহত করতে পেরেছে। 

 

বুড়ো বয়সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য

আমরা যদি মানুষের বার্ধক্যের সমাধান প্রাণীজগতের মাঝে খুঁজে পেতে চাই তাহলে এমন প্রাণীর উপর গবেষণা করতে হবে যার অন্তত তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

 

        প্রাণীটিকে অবশ্যই দীর্ঘজীবী হতে হবে

        প্রাণীটির বার্ধক্যজনিত রোগ-বালাই কম হতে হবে

        বিবর্তনের বিচারে মানুষের সাথে তার মিল থাকতে হবে

 

এবার আমরা এই তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করে প্রাণীদের একটি তালিকা তৈরি করবো যারা মানুষের বার্ধক্যজনিত রোগের গবেষণায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় হতে পারে।

 

আয়ুষ্কাল

এই অধ্যায়ের শুরুতে আমি ইঁদুর নিয়ে গবেষণার সীমাবদ্ধতা আলোচনায় আয়ুষ্কালের কথা বার বার এনেছি। একটি প্রাণীর আয়ুষ্কাল তার বিবর্তন দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। সুতরাংধারণা করা যায়দীর্ঘজীবী প্রাণীদের বিবর্তন তাদেরকে বার্ধক্যজনিত জটিলতার (ক্যান্সারআলজেইমারপারকিনসন্সআথরাইটিসডায়াবেটিসহৃদরোগ) বিরুদ্ধে প্রস্তুত করেছে। অন্যদিকে স্বল্পজীবী প্রাণীদের বিবর্তনের মূল লক্ষ্যে থেকেছে দ্রুত বংশ বিস্তার। তাইযেহেতু মানুষের আয়ুষ্কাল প্রায় ৭০-৮০ বছরতাই মানুষের বার্ধক্যজনিত জটিলতার সমাধানে আমাদেরকে এমন সকল প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে হবে যাদের আয়ুষ্কাল আমাদের কাছাকাছি অথবা আমাদের থেকে অনেক বেশী। 

 

এখানে আয়ুষ্কালের সংজ্ঞাটা পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। অনেকেই ভাবতে পারেনজাপানে এক-দুজন মানুষ ১২০ বছর পর্যন্ত বাঁচার খবর শোনা যায়। তাহলে কি মানুষের আয়ুষ্কাল ১২০ বছরএই বইয়ের আলোচনায় আয়ুষ্কাল বলতে আমি যে সময়ের মধ্যে একটি প্রজাতির ৮০% সদস্য মারা যায় সে সময়টাকে বোঝাচ্ছি। একটি প্রজাতির কিছু সদস্য এর থেকে অনেক বেশী দিন বাঁচতে পারবে। সেই বয়সকে প্রজাতির সর্বোচ্চ আয়ুসীমা বলা যেতে পারেআয়ুষ্কাল নয়। ফ্রান্সের মানুষের আয়ুষ্কাল প্রায় ৮৩ বছর কারণ ফ্রান্সের ৮০% মানুষ ৮৩ বছরের মধ্যে মারা যায়। বাকি ২০% মানুষ অধিকতর সময় বাঁচতে পারে। 

 

এখন জীবজগতের প্রাণীদের মধ্যে আয়ুষ্কালের দিক থেকে উপরের দিকে অবস্থান করে এমন কয়েকটি প্রাণীর নাম জেনে নেয়া যাক। নিচের বিরক্তিকর তালিকাটি সাধারণজ্ঞান পরীক্ষার জন্য মুখস্ত করার কোন দরকার নেই। তালিকাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে প্রাণীজগতের মাঝে বয়োজেষ্ঠ্যদের নামগুলো শুধু একবার জেনে নিলেই চলবে।

 

 

প্রচলিত নাম

বৈজ্ঞানিক নাম

আয়ুষ্কাল

গ্রীনল্যান্ড হাঙ্গর

Somniosus microcephalus

২৫০ বছর

বোহেড তিমি

Balaena mysticetus

২০০ বছর

আল্ডাব্রা কচ্ছপ

Aldabrachelys gigantea

১০০ বছর

মানুষ

Homo sapiens

৭৩ বছর

লোনা-পানির কুমির

Crocodylus porosus

৭০ বছর

আফ্রিকান হাতি

Loxodonta africana

৭০ বছর

ইল মাছ

Anguilla dieffenbachii

৬০ বছর

কাকাতুয়া পাখি

Cacatua galerita

৬০ বছর

ম্যাকাউ পাখি

Ara macao

৫০ বছর

গুইসাপ

Sphenodon punctatus

৬০ বছর

শিম্পাঞ্জি

Pan troglodytes

৬০ বছর

 

 

রোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সুরক্ষা

বিজ্ঞানীরা বিগত চল্লিশ বছরের গবেষণায় বেশ কয়েকটি প্রাণীর কথা বর্ণণা করেছেন যারা প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষিত। এখানে প্রাকৃতিকভাবে বলতে আমি বিবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত সুরক্ষা ব্যবস্থাকে বোঝাচ্ছি। মানুষের বার্ধক্য মোকাবিলায় তাই আমাদের এ সকল প্রাণীর উপর গবেষণা করে তাদের প্রতিরক্ষার রহস্য উদঘাটন করতে হবে। এধরণের কয়েকটি প্রাণীর তালিকা এখানে দেয়া হলো:

 

 

প্রচলিত নাম

Sceintific name

বিশেষ গুণ

নেকেড মোল র‍্যাট

Heterocephalas glaber

ক্যান্সার, আলজেইমার, আথরাইটিস, ব্যাথা, অক্সিজেন স্বল্পতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা

আফ্রিকান হাতি

Loxodonta africana

ক্যান্সার, আলজেইমার, আথরাইটিসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা

লোনা-পানির কুমির

Crocodylus porosus

ছত্রাকের আক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা

জামাইকান বাদুড়

Artibeus jamaicensis

ভাইরাস ও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা

আল্ডাব্রা কচ্ছপ

Aldabrachelys gigantea

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা

মেক্সিকান স্যালামান্ডার

Ambystoma mexicanum

পরিণত বয়সে তাদের হাত-পা কেটে ফেলার পর স্টেমসেলের কারণে তা নতুন করে গজাতে পারে; ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা

বোহেড তিমি

Balaena mysticetus

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা

 

 

মানুষের বৈবর্তনিক আত্মীয়

যে সকল প্রাণী বিবর্তনের বিচারে মানুষের খুব কাছাকাছি তাদেরকে অনেক সময়ই আমাদের ‘বৈবর্তনিক কাজিন’ বলা হয়। এর কারণ হলো তাদের সাথে আমাদের ডিএনএ-র অনেক মিল। এই মিলের পরিমাণ অনেকাংশেই ৯০% ছাড়িয়ে যায়। তাই, মানুষের সাথে ডিএনএ-র মিল রয়েছে এমন প্রাণীর উপর গবেষণা করে যে চিকিৎসা আবিষ্কৃত হবে তা মানুষের উপর প্রয়োগ করে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশী। এখানে ডিএনএ-র মিলের উপর ভিত্তি করে মানুষের কাছাকাছি কয়েকটি প্রাণীর তালিকা দেয়া হলো:

 

 

প্রচলিত নাম 

Sceintific name

মানুষের সাথে ডিএনএ-র মিল

শিম্পাঞ্জি

Pan troglodytes

৯৮.৮% জিনের তথ্যের মিল

কুকুর

Canis lupus familiaris

৯৪% জিনের তথ্যের মিল

নেকেড মোল র‍্যাট

Heterocephalas glaber

৯৩% জিনের অবস্থানের মিল

বিড়াল

Felis catus

৯০% জিনের তথ্যের মিল

ইঁদুর

Mus musculas

৮৫% জিনের তথ্যের মিল

গরু

Bos taurus

৮০% জিনের তথ্যের মিল

 

সত্যিকথা বলতে, ডিএনএ-র বিচারে এই সবগুলো প্রাণীই মানুষের বৈবর্তনিক নিকটাত্মীয়। তাই, যেকোন দীর্ঘজীবী স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহ বিদ্যমান লাভজনক মিউটেশন কিংবা তাদের ওপর কাজ করা চিকিৎসা মানুষের উপরও কাজ করার সম্ভাবনা অনেক বেশী।

 

এখন, এ তিনটি তালিকার উপর ভিত্তি করে এখন আমরা এই বইটির পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে নিম্নলিখিত পাঁচটিপ্রাণীর কথা আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি:

  • নেকেড মোল র‍্যাট: সবচেয়ে বেশী সংখ্যক রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষিত প্রাণী, মানুষের সাথে ডিএনএ-র মিল ৯০% এর বেশী এবং সবচেয়ে বেশী আয়ুষ্কালের ইঁদুর প্রজাতি।
  • আফ্রিকান হাতি: আয়ুষ্কাল মানুষের কাছাকাছি; ক্যান্সার হয় না।
  • বোহেড তিমি: স্তন্যপায়ীদের মাঝে সবচেয়ে বেশীদিন বাঁচে; কোন ক্যান্সার হয় না।
  • আল্ডাব্রা কচ্ছপ: সর্বাধিক আয়ুর স্থলচর প্রাণী, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষিত।
  • কুমির: মানুষের কাছাকাছি আয়ুষ্কালের সরীসৃপ; অসাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী।

 

এই প্রতিটি প্রাণী নিয়ে আলোচনার সময় আমরা তার বিবর্তনের ইতিহাস জানবো এবং কীভাবে প্রাণীটি রোগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং লাভজনক মিউটেশন অর্জন করেছে তা ব্যাখ্যা করবো। একই সাথে কীভাবে এই প্রাণীগুলোর লাভজনক মিউটশনের প্রভাব মানবদেহে সঞ্চারিত করার মাধ্যমে আমাদের সুস্থ আয়ুষ্কালকে দীর্ঘায়িত করা যায় তা নিয়েও আমরা চিন্তা করে দেখবো। 


———————————————————————————

সূচিপত্র:

———————————————————————————

ই-বইটি পড়ে ভালো লেগে থাকলে লেখক ও প্রকাশকের কথা চিন্তা করে অনুগ্রহপূর্বক বইটির কপি সংগ্রহ করুন এই লিংক থেকে: রকমারি.কম


 



Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2025 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.