নর্দমার ফিনিক্স
Science

নর্দমার ফিনিক্স

Apr 26, 2025   |    103


প্রাচীন গ্রীক পুরাণে বর্ণিত হয়েছে পুর্বসূরীর ভস্ম থেকে লেলিহান অগ্নিশিখা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা জাদুময় এক ফিনিক্স’ পাখির গল্প। হিংস্রতার প্রগাড়তায় ক্ষিপ্ত-উদ্দীপ্ত এই ফিনিক্স পাখি পুরাকথায় থেকে গেলেও আমাদের বাস্তব পৃথিবীতে ফিনিক্সের মতো মৃত‍্যুঞ্জয়ী আগ্রাসী প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। এই প্রাণিটি আর অন‍্য কেউ নয়আমাদের অতিপরিচিত বুকে ভর দিয়ে ছোট পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলা কুমির। এদের কয়েকটি প্রজাতি সমুদ্রে থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বসবাস পচাঁ পুকুর কিংবা নালার পানিতেকখনো বা নদীর ধারে কাদামাটিতেযাতে রয়েছে অধিকমাত্রার ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ ও সংক্রামক রোগজীবাণু। অথচ এমন প্রতিকূল পরিবেশে সকল প্রকার পীড়াব্যাধি ফাঁকি দিয়ে কুমির বেঁচে থাকে গড়ে প্রায় ৭০ বছর। এ প্রজাতির অনেক সদস‍্য শতবছরও পার করে। আমাদের দেশের বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মাজারের ঐতিহ্যবাহী ধলা পাহাড় এবং কালা পাহাড় নামের কুমির দুটি ৫০০ বছর ধরে বেঁচে ছিলো বলে শোনা যায়। অবশ্য গত বছর মাজারের শেষ কুমিরটির মৃত‍্যু ঘটেছে। এহেন অস্পৃশ্য পরিবেশে রোগাক্রান্ত পশুপাখি খেয়ে সুস্থ থাকা এই কালজয়ী কুমিরের সুস্বাস্থ্যের পেছনে বিবর্তন কোন ভূমিকা পালন করেছে কিএই অধ‍্যায়ে আমরা খুঁজে দেখব কাদামাটির জীর্ণতায় অক্ষীণ বেঁচে থাকা এই অকল্পিত ফিনিক্সের সুস্থ জীবনের রহস‍্য।


আপনারা হয়ত বুঝতে পারছেনকুমিরের দীর্ঘজীবনে সবচেয়ে গুরুতর সমস‍্যা হল তার বাসস্থানে বিরাজমান সীমাহীন জীবাণুর প্রকোপ। আজকের দিনে বিভিন্ন দেশে খামার করে কুমির চাষ করা হয়। সেসব খামারের সুনিয়ন্ত্রিত পরিচ্ছন্নতায়ও কুমিরের দেহে লক্ষ‍্য করা যায় সালমোনেলা নামক ভয়াবহ এক ব‍্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিযা মানুষেটাইফয়েড রোগের জন্য দায়ী। সুতরাংকুমিরের বিবর্তনের অন‍্যতম উদ্দেশ‍্য হওয়া উচিত নানাপ্রকার রোগজীবাণু দমন করার ক্ষমতা অর্জন করা। আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছিজীবাণুর বিরুদ্ধে দেহের এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে শ্বেতরক্তকণিকা নামক রক্তের একটি বিশেষ ধরণের কোষ। 


যেসব জীবাণু দিয়ে মানবদেহে টাইফয়েডসহ নানাবিধ রোগ হচ্ছেসেগুলো দেহে নিয়ে কুমির কীভাবে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে তা বের করতে গবেষণা করছেন থাইল‍্যান্ডের বিজ্ঞানী শমপং থামাসিরিরাং-এর দল। তারা এশিয়ান সায়ামিস কুমিরের রক্ত থেকে কিছু শ্বেতরক্তকণিকা সংগ্রহ করে তা একেবারে গুড়া করে একটি তরল দ্রবণ তৈরি করলেন। গুড়া করার উদ্দেশ্য ছিল কোষগুলোকে ভেঙ্গে ফেলাযাতে সেসব কোষের ভেতরকার প্রোটিনগুলো এই দ্রবণটির মাঝে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকে। এবার তারা ল‍্যাবের প্লেটে ব‍্যাকটেরিয়া চাষ করে তাতে কুমিরের রক্ত থেকে প্রস্তুত করা সেই দ্রবণ ঢেলে দিলেন। একদিন পর অবাক বিস্ময়ে দেখা গেলোপ্লেটের ব‍্যাকটেরিয়াগুলো মারা যাচ্ছে। বিজ্ঞানী শমপং বুঝতে পারলেনকুমিরের রক্তে এমন কিছু প্রোটিন রয়েছে যা অ‍্যান্টিবায়োটিকের মতো ব‍্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে। মানুষকে যেমন টাইফয়েড হলে অ‍্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়তেমন কোন প্রয়োজন কুমিরের নেই। এবার অ‍্যান্টিবায়োটিকের মত কাজ করা সেই প্রোটিনটিকে সনাক্ত করার জন‍্য তারা ম‍্যাস স্পেকট্রোমিটার যন্ত্র ব‍্যবহার করে একটি ক্ষুদ্র প্রোটিন (পেপটাইড) বের করলেনযার নাম লিউক্রোসিন। বোঝা গেলএই লিউক্রোসিনের কারণেই কুমির জীবাণুতে পরিপূর্ণ পরিবেশে রোগহীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে। পরবর্তীকালে নিরন্তর গবেষণায় কুমিরের দেহে ক্রোকোসিনডিফেন্সিন সহ বেশ কয়েকটি পেপটাইড সনাক্ত করা হয়েছে যা তাদের সংক্রামক রোগের বিপরীতে সুরক্ষা প্রদান করে।


কিন্তুকুমিরের দীর্ঘ জীবনে ক‍্যান্সার কেন হয় না?


রহস্যময় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন শারজাহ বিশ্ববিদ‍্যালয়ের বিজ্ঞানী রোকেয়া সিদ্দিকী এবং নাভিদ আহমেদ। কুমিরের শরীর থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তা তুলনা করলেন গবেষণাগারে বহুল ব‍্যবহৃত ইদুর ও মানুষের রক্তের সাথে। ম‍্যাস স্পেকট্রোমিটার ব‍্যবহার করে তারা এই প্রাণীগুলোর রক্তে বিদ‍্যমান প্রোটিন সনাক্ত করা শুরু করলেন। হাজার হাজার প্রোটিনের মাঝে তাদের উদ্দেশ‍্য এমন কিছু প্রোটিন বের করা যা কুমিরের রক্তে বিদ‍্যমান কিন্তু অন‍্যান‍্য প্রাণীদের রক্তে নেই। মানুষের সাধারণ চোখ দিয়ে এই কাজটা করা অতিদুষ্কর বলে তারা এই সনাক্তকরণের প্রক্রিয়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিলেন। একটি মেশিন লার্নিং’ প্রোগ্রামকে প্রথমে ক‍্যান্সার প্রতিরোধে সক্ষম পূর্বপরিচিত কিছু প্রোটিনের গঠন শিখিয়ে দেয়া হলো। প্রোগ্রামটি সেই অগণিত প্রোটিনকে পর্যবেক্ষণ করে ক্যান্সারবিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলো শিখে নিল। তারপর প্রোগ্রামটিকে কুমিরের রক্তে প্রাপ্ত কয়েকশ প্রোটিনের গঠন দেখতে দেয়া হলো। এর ফলে মানুষের সাধারণ চোখ দিয়ে যা বের করা অত্যন্ত দুরূহসে কাজটিই করে ফেলল কম্পিউটার প্রোগ্রামটি। যাচাই বাছাই করে সেটি কুমিরের রক্তে চারটি ক্ষুদ্র প্রোটিন বা পেপটাইড অণু সনাক্ত করল যারা ক‍্যান্সার দমনে সক্ষম হতে পারে। জীববিজ্ঞানের গবেষণায় এরূপ কম্পিউটার প্রোগ্রামের ব‍্যবহারকে বলা হয় বায়োইনফর্ম‍্যাটিক্স। আধুনিকযুগে গবেষণার একটা বিশাল অংশই ঘটে কম্পিউটারের ভেতরকার এই শুকনো ল‍্যাবরেটরিতে।

 

বায়োইনফর্ম‍্যাটিক্সের একটা বড় সীমাবদ্ধতা হলো এই প্রোগ্রামগুলো হাজার হাজার প্রোটিন থেকে কয়েকটা পেপটাইডের একটা ক্ষুদ্র তালিকা তৈরি করে দিতে পারে। কিন্তুএই পেপটাইডগুলোর আদৌ রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা রয়েছে কিনা তা প্রমাণ করার জন্য ল্যাবে কোষের ওপর পরীক্ষা করতে পারবে না। তাই বায়োইনফর্ম‍্যাটিক্সের কাজ মূলত গাণিতিক হিসেবের উপর ভিত্তি করে একটি অনুমান করা যা পরবর্তীতে ল‍্যাবরেটরিতে প্রমাণ করা হয়।

 

এবার চারটি পেপটাইডের তালিকা নিয়ে বিজ্ঞানী নাভিদ-রোকেয়ার দল চলে গেলেন ল‍্যাবের ভেতর। তারা প্রথমে মানুষের জরায়ুপ্রস্টেট ও ব্রেস্ট ক‍্যান্সার থেকে কোষ আলাদা করে ল‍্যাবের প্লেটে চাষ করলেন। একইসাথে সুস্থ মানুষের কোষও চাষ করলেন যাদেরকে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয় নেগেটিভ কন্ট্রোল’। র কাজ হলো তুলনার মাধ্যমে একটি এক্সপেরিমেন্টের সত‍্যতা যাচাই করা। এরপর বিজ্ঞানীদল একইসাথে ক‍্যান্সার এবং সুস্থ কোষগুলোর ওপর কুমিরের রক্ত থেকে সনাক্ত করা পেপটাইড চারটিকে প্রয়োগ করলেন। এবার সপ্তাহখানেক ধরে সেই কোষগুলোকে ল‍্যাবের কৃত্রিম পরিবেশে বিভাজিত হতে দেয়া হলো। দেখা গেলোপেপটাইডগুলো সুস্থ কোষের ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলছে না (কোন প্রভাবের অভাবের কারণেই তাদেরকে নেগেটিভ কন্ট্রোল বলা হয়ে থাকে)। অন‍্যদিকে ক‍্যান্সার কোষগুলোর বিভাজন এই পেপটাইডের কারণে অনেকাংশেই থমকে গেছে। সুতরাংআমরা বুঝতে পারলাম কুমিরের রক্তে বিদ‍্যমান এই চারটি পেপটাইড তাদের শরীরে ক‍্যান্সার দমনে সাহায‍্য করে। একই সাথে আমরা এটাও বুঝতে পারলামকুমিরের এই পেপটাইডগুলো মানব ক‍্যান্সারের চিকিৎসাতেও ব‍্যবহার করা সম্ভব।

 

একটি থট এক্সপেরিমেন্ট: ধরুন উপরের গবেষণায় দেখা গেলো সুস্থ এবং ক‍্যান্সার উভয় ধরণের কোষের বিভাজনই কুমিরের পেপটাইড প্রয়োগের কারণ থেমে গেছে। তাহলে কি আমরা ক‍্যান্সারের চিকিৎসায় এই পেপটাইডগুলো ব‍্যবহার করতে পারতামউত্তরটা এই বইতে দেয়া হবে না। চিন্তা করে আপনার বুদ্ধিমান কোন বন্ধুর সাথে আলোচনা করুন।

 

সহজ বাংলায় বলতে গেলে, জীবাণুযুক্ত পরিবেশে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর বাস করার মাধ‍্যমে কুমির রোগজীবাণু এবং ক‍্যান্সার দমনকারী ক্ষুদ্র প্রোটিন অণু তৈরির রেসিপি তাদের ডিএনএ-তে অর্জন করেছে। এই সকল পেপটাইড কুমিরের রক্ত থেকে আলাদা করে মানবদেহে প্রয়োগ করার মাধ‍্যমে মানুষের সংক্রামক ব‍্যাধি এবং ক‍্যান্সারের প্রতিকারের চিকিৎসা হয়তো আগামী দশকেই শুরু হবে। এভাবে দীর্ঘজীবী সুস্থ প্রাণীদের ওপর গবেষণা আমাদেরকে বহুল প্রতীক্ষিত দীর্ঘায়ুর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারবে হয়তো এই শতাব্দীতেই।

———————————————————————————

সূচিপত্র:

———————————————————————————

ই-বইটি পড়ে ভালো লেগে থাকলে লেখক ও প্রকাশকের কথা চিন্তা করে অনুগ্রহপূর্বক বইটির কপি সংগ্রহ করুন এই লিংক থেকে: রকমারি.কম 



Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2025 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.