Sixth Sense
Aug 20, 2017 | 16800
ক্লাস টেনের কথা। মালিবাগে সোহেল স্যারের কোচিং-এ তখন ইংরেজি পড়তে যেতাম। ভালো ছাত্র হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই ফার্স্ট বেঞ্চে বসে স্যারের সুনজরে থাকতে চাইতাম। ঠিক পাশের সারির ফার্স্ট বেঞ্চে খুবই সুন্দরী একটা মেয়ে প্রায় প্রতিদিনই এসে বসতো। ক্লাসের ফাকেঁ নিজের কিশোরসুলভ আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ পর সেও দেখতাম আমার দিকে ঘুরে তাকাতো! ব্যাপারটা বেশ অবাক লাগতো।
একদিন স্যারের বাসায় সলভ ক্লাস করছি। হঠাৎ আমার মনে হতে লাগলো যে, কেউ আমাকে দেখছে। বা-দিকে ঘুরে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম, অসাধারণ একটা হাসি নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝতে পেরেছি এটা অনুধাবন করে সে কিছুটা ইতস্তত হয়ে ক্লাসে মনোযোগ দিলো। সেদিন বাসায় ফিরে মনে মনে অনেক খুশি লাগছিল। কিন্তু, তার থেকে বেশি আনন্দদায়ক একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে, “একজন আরেকজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেটা অন্য মানুষটা কীভাবে বুঝতে পারে?”
আমি আমার অনেক বান্ধবীদেরই এই প্রশ্নটা গত ছয় বছর ধরে জিজ্ঞাসা করেছি। সবাই একই উত্তর দিয়েছে। হ্যাঁ! কেউ যখন তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে তারা সেটা কোন ভাবে অনুধাবন করতে পারে। ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভাবাতে শুরু করে।
ভাবনা/চিন্তা/Thought— এই জিনিসগুলো আমাদের কাছে বেশ অবায়বীয় অস্তিত্ব। আমি নিজেই মনে করতাম, আমার চিন্তা/ভাবনার চারপাশের পরিবেশের উপর কোন ধরণেরই প্রভাব নেই। আমি যখন ক্যালকুলেটর দিয়ে অংক করি সেটা আমার চিন্তা দ্বারা কোনভাবেই প্রভাবিত হয় না। আমার মন খারাপ থাক্ কিংবা ভালো; ক্যালকুলেটর তো একই উত্তর দিবে।
ছোটবেলায় শাহরুখ খানের “পেহেলি” মুভিটা দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। নায়ক উটের দৌড় প্রতিযোগিতার সময় কিছুক্ষণ ধরে একটা উটের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাত দিয়ে ইশারা করতেই উট-টা অন্যদিকে দৌড় দিলো। হায় হায়! কী ধরণের আবোল-তাবোল দেখাচ্ছে? এইটা কি বিজ্ঞান সম্মত কিছু হলো?
ম্যাট্রিক্স মুভির একটা দৃশ্য আমার কয়েক রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। ছোট একটা বাচ্চা একটি চামচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চামচটা গলে গেলো। প্রথমে ভাবতাম, ছেলেটার চোখ দিয়ে হয়তো লেজার বের হয়েছিলো। পরে বুঝতে পারলাম, সে নিজের চিন্তাকে ওই চামচটার উপর একটি মাত্র বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করেছে। কিন্তু, তাতে কেন চামচ গলে যাবে? তাহলে কি আমাদের চিন্তা চারপাশের বস্তুজগতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে?
একটা ব্যাখ্যা অবশেষে বুঝতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে এসে। তখন মেডিকেল ফিজিওলজির কোর্সটা পড়াতেন জালাল স্যার। লোকটা বেশ মাটির মানুষ। একদিন ক্লাসে “Action Potential” নামক একটা ব্যাপার বোঝানো হলো। আমাদের প্রতিটা কোষেই সোডিয়াম/পটাসিয়াম আয়নের ঘনমাত্রার উপর নির্ভর করে কোষের ভিতরে নানা রকম বৈদ্যুতিক বিভব সৃষ্টি হয়। মাই গড! কোষের ভিতরে বৈদ্যুতিক বিভব! আমি বেশ আগ্রহ খুজেঁ পেলাম।
আরো পড়াশোনার পর জানলাম, আমাদের মস্তিস্কের প্রতিটি চিন্তাই হলো কতগুলো আয়নের আদান-প্রদানের ফল। নিউরনের সংযোগস্থলে প্রতিমুহুর্তে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বৈদ্যুতিক আয়ন বয়ে যায়। তখনই মনে পড়লো ইন্টারমিডিয়েটের পদার্থ বিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্র বইয়ের কথা। সেখানে লেখা ছিলো, যেকোন আয়নের প্রবাহই হলো বিদ্যুৎ প্রবাহ। এবং যখনই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তখনই তার সাথে একটা চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। আমার মাথায় তখন নতুন ভুত চেপে বসলো, “আমাদের মস্তিষ্কের চুম্বকক্ষেত্র আছে! সেটা কীভাবে কাজ করে?”
ইন্টারনেটে রাতের পর রাত ঘেটেঁ দেখলাম। আমি একা নই; এই প্রশ্নটা হাজার হাজার মানুষ প্রায় ১৫০ বছর ধরে গবেষণা করে বের করার চেষ্টা করছে। চুম্বকক্ষেত্রের একটা বিখ্যাত আইডিয়া হলো ম্যাগনেটিক ডাইপোল। অসংখ্য ছোট ছোট ডাইপোল যদি বিশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করে তাহলে তারা একজন অন্যজনের প্রভাবকে নষ্ট করে দেয়। তাই, এই রকম বিশৃঙ্খল ডাইপোলের সমারোহে মোট চুম্বকত্ব প্রায় শূণ্যের কাছাকাছি চলে আসে। তাই, আয়নের প্রবাহ হলেই যে চুম্বকত্বটা বেশ প্রভাবশালী হবে এমনটা নয়। আমাদের ব্রেইনে প্রতি মুহুর্তে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন আয়ন ঠিকই প্রবাহিত হয়। কিন্তু, তাদের বিশৃঙ্খল ডাইপোলগুলো হয়তো একজন অন্যজনের দ্বারা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু, যদি নষ্ট না হয়? তখন কিন্তু মস্তিষ্ক ঠিকই একটা চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করবে যার মান বেশ বড় হবে।
ফেরত গেলাম ম্যাট্রিক্স মুভির সেই দৃশ্যে। বাচ্চাটা যখন তার সমগ্র চিন্তা চামচের উপর একবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করা শুরু করে তখন তার মস্তিষ্কের ভেতর একটা বিশেষ নিউরাল পথে বারবার আয়নের প্রবাহ শুরু হয়। চিন্তা যতই প্রখর হবে, আয়নের প্রবাহ হবে ততই শক্তিশালী। মেডিটেশনের উচ্চস্তরে তার মস্তিষ্কের অসংখ্য ডাইপোলগুলোর মধ্যে কিছু ডাইপোল আস্তে আস্তে শৃঙ্খলিত হতে শুরু করে। তাদের চৌম্বকক্ষেত্রগুলো একই বিন্দুতে পূঞ্জিভূত হয়। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ক্ষুদ্র আয়নের প্রভাব যখন এক বিন্দুতে জেকেঁ বসে তখন সেখানে সৃষ্ট চৌম্বকশক্তি চামচ গলানো থেকে শুরু করে পানি ফুটিয়ে বাষ্পে পর্যন্ত পরিণত করতে পারে।
আমার বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনার জগতে তখন ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হলো। হায় হায়! আমাদের চিন্তাকে আমরা যতটা ক্ষুদ্র মনে করি ব্যাপারটা ততটা ক্ষুদ্র নয়। “শুধু চিন্তা করেই জগত বদলে দেয়া যায় না!”— কথাটা কিছুটা হলেও ভুল। চিন্তা করে জগতের উপর অতিক্ষুদ্র প্রভাব ঠিকই ফেলা সম্ভব।
নয়েটিক সায়েন্স নিয়ে আমার আগ্রহ তুঙ্গে উঠে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল দেখে। বিজ্ঞানী রজার ১৯৮০ সাল থেকে এই গবেষণটা শুরু করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ৩৬টি কম্পিউটারে Random Number Function টির আচরণ তারা লক্ষ্য করেন। সবার জ্ঞাতার্থে একটু বলি, Random Number Function টির কাজ হলো একটি Random Number সৃষ্টি করা। সোজা কথায়, ১০০০ বার এই ফাংশনটি ব্যবহার করার পর যদি দেখা যায় x সংখ্যাটিকে সে মোট ১৫ বার সৃষ্টি করেছে তাহলে y সংখ্যাটিকেও তার ১৫ বারের মতো সৃষ্টি করার কথা। অর্থাৎ, এই ফাংশন থেকে সকল আউটপুট পাওয়ার সম্ভাবনা সমান।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার সন্ত্রাসী হামলা হামলা ঘটে। সারা বিশ্ব তখন শোকে মর্মাহত। সবার দৃষ্টি সেদিন ছিলো BBC/CNN এর নিউজ ব্রডকাস্টে। রজার এবং তার গবেষক দল ওই দিন প্রতি সেকেন্ডে Random Number ফাংশনটির আচরণ পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। হঠাৎ তাদের চোখ কপালে উঠার মতো রেজাল্ট আসা শুরু করলো। Random Number ফাংশনটির আউটপুটে তারা কিছু নম্বরের আধিক্য লক্ষ করা শুরু করেন। তার মানে কম্পিউটারের এই ফাংশনটি ওই দিন একটু ভিন্ন আচরণ করতে শুরু করে!
রজারের দল তখন উঠে পড়ে লাগলেন তাদের ফলাফলকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য। ২০০৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামা জয়ী হলেন। ইতিহাসে প্রথম বারের মতো একজন মুসলমান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশীল আসনে বসলেন। ওবামার বিখ্যাত YES, WE CAN! বক্তৃতার সাথে সাথে সারা বিশ্বের মানুষের মনে নতুন এক চিন্তার সঞ্চারণ ঘটে। এই সময়ে রজারের কম্পিউটারের Random Number এ আসতে শুরু করে স্পাইক। কিছু সংখ্যার আধিক্য শুরু হয়; Random Number Function তার আচরণের পরিবর্তন আনে।
আমার সারা জীবনের বিশ্বাস কিছুটা পরিবর্তিত হয়। আমার চিন্তা আসলেই আমার ক্যালকুলেটরকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু, আমার একজনের চিন্তা কিংবা একজনের মস্তিষ্কের ম্যাগনেটিক ফিল্ড খুবই ক্ষুদ্র। কিন্তু, কথায় আছে, United we stand. ২০১২ সালে আমি TED Talk-এর বিশাল ফ্যানে পরিণত হই। TED এর কর্তাব্যক্তি Chrish Anderson একবার বলেছিলেন, “একটা বিশাল অডিটরিয়াম ভর্তি মানুষ যখন কোন একটা বিশেষ আইডিয়া নিয়ে একসাথে চিন্তা করা শুরু করে তখন সবাই মিলে একটা Invisible Neural Pattern সৃষ্টি করে।” এতগুলো মানুষের মস্তিষ্কের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মান তো বেশ বড়! বস্তু জগতের উপর এর প্রভাব নিশ্চয়ই থাকবে।
ধর্ম আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই চিন্তা করতে শিখায়। অনেকের চিন্তা-চেতনা ধর্মীয় বাণীর আদলে সৃষ্ট। আমি মাঝে মাঝেই ভাবি কেন জামাতে যেয়ে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয়? কেন হিন্দুরা বিশাল রথ যাত্রা করে? কেন লাখো মুসল্লি হজ্জ করতে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়? নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান মানুষেরা বুঝতে পারেন এর আসল প্রভাব। লাখ খানেক মানুষের মস্তিষ্ক যখন একই স্রষ্টার চিন্তায় মশগুল হয় তখন আরাফাতের ময়দানের চারপাশের চৌম্বক ডাইপোলগুলো নিশ্চয়ই একটা প্যাটার্নে আস্তে আস্তে শৃঙ্খলিত হতে শুরু করে।
অনেক আবোল তাবোল বকে ফেললাম। এইগুলো আমার মনের অযাচিত চিন্তার খানিকটা বহি:প্রকাশ মাত্র। গত দুই মাস ধরে মেডিটেশনের ভূত আমার উপর সওয়ার হয়েছে। শার্লক হোমসের মতো একটা মাইন্ড প্যালেস কীভাবে বানানো যায় সেইটা নিয়ে কয়েকজনের সাথে প্রায়ই আলোচনা করি। Sciene & Spirituality এর মাঝে আমি মোটামুটি বন্দী হয়ে গেছি। ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলংকায় কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সন্ধান পেয়েছি। তারা মেডিটেশন করে নিজের হার্টবিট ১০ এর নিচে নামিয়ে আনতে পারেন। হয়তো ভবিষ্যতে Medical Science এর পাশাপাশি Noetic Science চর্চাটাও শুরু করবো!
Think, think & think. Then think some more! It does have
some effects.