অমরত্বের ইতিবৃত্ত: পূর্বকথা
Apr 25, 2025 | 42
পূর্বকথা
২০২০ সালের বইমেলাতে ‘উড়ছে হাইজেনবার্গ’ বইটি প্রকাশ হবার পর আমার লেখা-লেখির রেওয়াজটা বেশ স্তিমিত হয়ে আসে। কোভিড মহামারীর প্রথম দিকে বিছানায় শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়েই ছয় মাস পার করে দিয়েছিলাম। আমি পিএইচডি করেছি নেকেড মোল র্যাট নামক এক ইঁদুরের ওপর যারা ত্রিশ বছরের বেশী সময় ধরে বাঁচে এবং তাদের ক্যান্সার হয় না। সাধারণত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমি নেকেড মোল র্যাটের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতাম। কিন্তু, মহামারীর দ্বিতীয় বর্ষে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের কারণে সেদেশে ঢোকাটা বেশ দুষ্কর হয়ে গেলো। সুতরাং আরো ছয় মাস বাসায় বসে অ্যালকোহল জেল দিয়ে হাতের ভাইরাস দূর করে সেই পরিষ্কার হাত দিয়ে মশা মেরে দিন কাটালাম।
অবশেষে ২০২১ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার অনুমতি পেলাম। তবে শর্ত বেশ কঠিন। প্রথম শর্ত হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা অবস্থায় এক মাস কারো সাথে কোন রকম মুখোমুখি যোগাযোগ করা যাবে না। হেঁটে বাসা থেকে নেকেড মোল র্যাটের ল্যাবে যেতে হবে। সব দোকানপাতি/সদাই করতে হবে অনলাইনে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডে ফেরত আসার পর দশদিন এয়ারপোর্টের একটা হোটেলে কোয়ারান্টাইন করতে হবে। বিজ্ঞান চর্চার নিমিত্তে এই সকল শর্ত মাথা পেতে নিয়ে অবশেষে প্রেটোরিয়ায় চলে গেলাম। একটা মাস দিন-রাত জেগে থেকে নেকেড মোল র্যাটের স্টেম সেলের ওপর বেশ কিছু কঠিন পরীক্ষা চালালাম। প্রায় পঞ্চাশটি মোল র্যাট থেকে অঙ্গপ্রতঙ্গ সংগ্রহ করে সেগুলোকে অক্সফোর্ডে পাঠিয়ে দিলাম। অবশেষে আগস্ট মাসে ফেরত আসলাম বিলাতে। কোয়ারেন্টাইন শেষ করেই ঢুকে পড়লাম ল্যাবের ভেতর। পরবর্তী প্রায় দেড় বছর আমি পার করেছি মাইক্রোস্কোপের অন্ধকার রুমে। নেকেড মোল র্যাটের স্টেম সেলগুলোকে ফ্লোরুসেন্ট রঙে রঞ্জিত করে কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে সেগুলোর হাজার হাজার ছবি তুলেছি। সেই ছবিগুলো পর্যালোচনা করে আমি তাদের স্টেম সেলের বিভাজনের হার নির্ধারণ করেছি। এই কাজটা শেষ করতে করতে ২০২৩ সালের মার্চ মাস এসে গেলো।
এতোদিনে আমার পিএইচডি’র সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাই অবশেষে আমার সব আবিষ্কারের গল্প একসাথে করে থিসিস লেখা শুরু করলাম। পুরো থিসিসের শেষ দিকে এসে আমি বুঝতে পারলাম দীর্ঘ জীবনের একটি বড় রহস্য— যেসকল প্রাণী যত বেশী দিন বাঁচে তাদের স্টেমসেল তত ধীর গতিতে বিভাজিত হয়।
Slow and steady lives the longest.
২০২৩ সালের শেষ দিকে আমি পিএইচডি’র ফাইনাল পরীক্ষা দিতে বসলাম। অক্সফোর্ড আর বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিজ্ঞানী আমার সাথে চার ঘন্টা ধরে আলোচনার পর আমাকে ‘ডক্টর অফ ফিলোসফি ইন মেডিকেল সায়েন্স’ উপাধি দিতে সম্মত হলেন। একই সময়ে নেকেড মোল র্যাটের স্টেমসেলের এই বিস্ময়কর তথ্যটি বিজ্ঞান জগতে প্রকাশ করার জন্য আমি নেচার কমিউনিকেশন্স নামক পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে আমার গবেষণাটি পাঠালাম। প্রায় ছয় মাস ধরে তিনজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আমাদের গবেষণাটি পর্যালোচনা করে অবশেষে সেটাকে প্রকাশ করতে রাজি হলেন। ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশ্ব দরবারে আমাদের গবেষণাটি প্রকাশিত হলো। দীর্ঘজীবী প্রাণীদের সুস্থ জীবনের রহস্য উদঘাটনে বিজ্ঞান আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো।
ঠিক যে মুহুর্তে নেচার কমিউনিকেশন্স থেকে আমার ইমেইলে গবেষণা প্রকাশের সুখবরটি আসলো ঠিক তখনই আমি ভিডিও কলে গল্প করছিলাম আমার দীর্ঘকালের শিক্ষাগুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুশতাক ইবনে আয়ূবের সাথে। মুশতাক স্যারও পিএইচডি করেছেন অক্সফোর্ড থেকে। আমার অক্সফোর্ডে যাওয়ার পেছনে তার উপদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি সেই ভিডিও কলে আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন আবার একটি বই লেখার। সহজ ভাষায় আমার গবেষণার বিষয় বস্তুকে আমজনতার সামনে তুলে ধরা হবে এই বইতে।
বার্ধক্য, স্টেম সেল ও ক্যান্সারের মতো কাঠখোট্ট ব্যাপারগুলো নিয়ে সহজ বাংলায় লেখাটা একটু দুষ্কর ব্যাপার। অনেকদিন লেখা লেখি থেকে দূরে থাকার কারণে বিজ্ঞানের কঠিন শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ মাথায় আসছিলো না। অবশেষে ত্রাতা হয়ে এলো আমার ডাক্তার বন্ধু বুশরা নাজ। বুশরা অক্সফোর্ডে মাস্টার্স শেষ করেছে। ফেসবুকে সে অনেক সুন্দর করে বাংলায় লেখালেখি করে। পড়াশোনার পর চাকরি শুরু করবার আগে তার হাতে একমাস অবসর সময় আছে। আমার নিপীড়নে বাধ্য হয়ে সে অবশেষে এই বইটির সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে রাজি হলো।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে আমি আবার রেওয়াজ করে লিখতে শুরু করলাম। রাতের বেলা সারাদিন ধরে লেখা পান্ডুলিপি পাঠালাম বুশরার কাছে। পরদিন সকাল নাগাদ সেই পান্ডুলিপি কেটে-ছিড়ে সে একেবারে ঝাঁঝড়া বানিয়েপাঠিয়ে দিলো। একদিন তো বুশরা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললো, আমি নাকি গবেষণা করতে করতে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। বুশরার সম্পাদনার কারণে এই বইয়ের অধ্যায়গুলো সাধারণ মানুষের জন্য একটু বেশী বোধগম্য হয়েছে। নতুবা এই বইটি হয়তো সবার জন্য পড়া একটু কষ্ট হয়ে দাঁড়াতো।
পান্ডুলিপি লেখার শেষদিকে এসে মুশতাক স্যার বইটির নাম দিলেন— ‘অমরত্বের ইতিবৃত্ত’। প্রথম পঠনেই নামটি আমার বেশ ভালো লেগে গেলো। এই প্রকৃতিতে কিছু প্রাণী রয়েছে যারা প্রাকৃতিকভাবেই অনেকদিন বাঁচে। এদের অনেকেরই ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো বার্ধক্যজনিত রোগ-বালাই হয় না। বিজ্ঞানীরা বেশ অনেক দিন ধরেই এই সকল প্রাণীদের রোগহীন দীর্ঘজীবনের রহস্য বের করে তা মানুষের দেহে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমিও সেই দলের একজন সদস্য। আমাদের গবেষণার ছোট একটি সারমর্ম এই বইতে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যদি বইটি পড়ে বিজ্ঞানের প্রতি আপনার ভালো লাগা বৃদ্ধি পায় তাহলে আমার এই বইটি লেখার উদ্দেশ্য সার্থক হবে।
শামীর মোন্তাজিদ
ওল্ড রোড ক্যাম্পাস
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
———————————————————————————
ই-বইটি পড়ে ভালো লেগে থাকলে লেখক ও প্রকাশকের কথা চিন্তা করে অনুগ্রহপূর্বক বইটির কপি সংগ্রহ করুন এই লিংক থেকে: রকমারি.কম