দুশো বছরের তারুণ‍্য
Science

দুশো বছরের তারুণ‍্য

Apr 26, 2025   |    114


ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়ে নানা প্রজাতির পশুপাখি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম। বাঘভালুক,গন্ডারতিমিবাদুড় কি নেই সেখানেকিন্তুআমার এই বিস্ময় একটা নতুন মাত্রা নিলো ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। থাইল‍্যান্ডের পিপি আইল‍্যান্ডে গুটিকয়েক বন্ধুসমেত ডুব দিলাম আন্দামান সাগরের পরিষ্কার পানিতে। মুখে স্নর্কেলিং পাইপ আর চোখে সাঁতার উপযোগী চশমা সেঁটে অনাবিল আনন্দে আমরা ঘুরে দেখলাম একটা কোরাল রীফ। বুঝতে বাকি রইলো নাএই পানির নিচে রয়েছে পৃথিবীর আরেকটি রাজত্ব। 

 

প্রাণীজগতের প্রায় ৭৮% প্রজাতির বাস পানির নীচে। বিবর্তনের অসাধারণ কিছু গল্প জানতে হলে আমাদেরকে ডুব দিতেই হবে সাগরের বুকেবের করতে হবে সেখানকার প্রাণীদের দীর্ঘ জীবনের রহস‍্য। কিন্তুকাজটা মোটেও সহজ নয়। পানির কেবল উপরের স্তরে বাতাসের অক্সিজেন এবং আলো প্রবেশ করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যতই গভীরে যাওয়া যায় চারপাশ ততই অন্ধকার হয়বাড়তে থাকে পানির চাপ । এমনই অতল গহবরে বাস করে সবচেয়ে দীর্ঘায়ু বিশিষ্ট  মেরুদন্ডী প্রাণীটি- গ্রীনল‍্যান্ড হাঙর। এমন অদ্ভুত পরিবেশে বাস করা প্রাণীর জীবনে উপকারি হিসেবে বিবেচিত মিউটেশন কিন্তু মাটির ওপরে বসবাসকারী মানুষের জীবনে খুব একটা কাজে আসার কথা না। তবেআশা হারাবার কোন কারণ নেই! পানির ওপরের স্তরেযেখানে আলো আর অক্সিজেন আমাদের পরিবেশের একটু কাছাকাছিসেখানে কিন্তু বেশ কয়েকটি স্তন‍্যপায়ী প্রজাতি বাস করে। তারা কিছুক্ষণ পর পর পানির ওপরে উঠেনাকটা বের করে একটু শ্বাস নেয়এরপর আবার টুপ করে ডুব দিয়ে পানির ভেতরে চলে যায়। হয়তো আপনি ইতোমধ‍্যেই ডলফিন আর তিমির কথা চিন্তা করছেন। মজার ব্যাপার হলোবিবর্তনের বিচারে এই প্রাণীগুলোও মানুষের আত্মীয়। 

 

তিমির বিবর্তনের গল্প

আপনি হয়ত ছোটবেলায় বইতে পড়েছেনপ্রায় ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে জীবনের প্রথম সূচনাটি ঘটেছিল সমুদ্রে। সমুদ্রের এই প্রাণীগুলো বটবৃক্ষের ন্যায় অনড় থাকেনিঘুরে বেড়িয়েছে অতল সাগরের পাতালপুরীতে। সামুদ্রিক কিছু দুঃসাহসিক প্রাণী প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে বড় শিকারি মাছের হাত থেকে বাঁচতে এবং নতুন খাবারের উৎস খুঁজতে চলে আসে ঢেউয়ের তোড়ে মাটির ওপরে।  কালের পরিক্রমায় বিবর্তনের পাকে এই নব‍্য স্থলচরদের হাত-পায়ে আঙ্গুল গজাতে শুরু করে। (আপনি বিবর্তন বুঝে থাকলে ইতোমধ‍্যেই ধরতে পেরেছেন যেকোন একটা প্রাণীর নতুন করে আঙ্গুল গজায় না। একটা অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী মিলিয়ন বছরে ধীরে ধীরে উপকারি মিউটেশন অর্জন করতে করতে নতুন বৈশিষ্ট‍্য অর্জন করে।)  কিন্তু তাদের এই পানি থেকে মাটিতে দেশান্তরের গল্প এখানেই শেষ হয়নি। প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাটিতে ঘুরে ফিরে এই নব‍্য স্থলচরদের একাংশ আবারো খাবাদের সন্ধানে সমুদ্রে নেমে পড়েআজ থেকে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে। মাঝের এই ৫০ মিলিয়ন বছর প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্থলে বংশবৃদ্ধি করার কারণে দেখা গেলতারা এখন বাতাস থেকে ফুসফুসের মাধ‍্যমে অক্সিজেন নেয়া শিখেছেআরো শিখেছে হাত-পায়ের আঙ্গুলের ব‍্যবহার। 

 

মজার ব‍্যাপার হলোপুনরায় পানিতে ফিরে গিয়ে এই সাময়িক স্থলচর স্তন‍্যপায়ীরা পানিতে থেকেই ফুসফুসের ব‍্যবহার চালিয়ে গেল। পানিতে থেকে একটু পর পর বাতাসে নাক বের করে অক্সিজেন নিতে লাগল। এভাবে পেরিয়ে গেলও আর শত প্রজন্মমিলিয়ন বছর। সেসব স্থলচারী-জলচারী স্তন‍্যপায়ীদের বর্তমান প্রজন্মই হলো আজকের তিমি কিংবা ডলফিন। এই জল থেকে স্থলে এবং পুনরায় জলে গমনের চিহ্ন এখনো তাদের শরীরে খুঁজে পাওয়া যায়। আজকের দিনে তিমির দেহে বিদ‍্যমান মাছের ফিনের মত হাত আর পায়ের পাতা এক্স-রে করলে দেখা যায়সেটা একেবারেই মাছের ফিনের মত না। বরং এর ভেতর রয়েছে ঠিক মানুষের হাত-পায়ের আঙ্গুলের মত হাড়ের গড়নযদিও সমুদ্রে ফিরে যাওয়ায় সাঁতারের প্রয়োজনে কালের বিবর্তনে এখন আর আঙ্গুলগুলো আগের মত আলাদা নেইতারা জোড়া লেগে গেছে। তিমি কিংবা ডলফিনের শরীরে হাত আর ফিনের মাঝামাঝি এই অঙ্গকে বলা হয় ফ্লিপার। এটা বির্বতনেরই রেখে যাওয়া চিহ্নযা দেখে বিজ্ঞানীরা তাদের পূর্বপুরুষদের গল্প জানতে পেরেছেন। 


উপরের আলোচনার সারমর্ম হলোসামুদ্রিক প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও তিমি কিংবা ডলফিন আমাদের বৈবর্তনিক আত্মীয়। তাই তাদের দেহে বার্ধক‍্য প্রতিরোধের কোন রহস‍্য উদঘাটন করা গেলে তা মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ন হতে পারে। আমরা ছোটবেলা থেকে জেনেছি নীলতিমি পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণী। সেই তালিকার দ্বিতীয় প্রাণীটির কথা আমরা আজকে এই অধ‍্যায়ে আলোচনা করবো। তীর চালানোর ধনুক (bow)-এর মতো বাঁকানো মাথাওয়ালা এই প্রাণীটির নাম বোহেড’ তিমি (Bowhead Whale)। স্তন‍্যপায়ীদের মধ‍্যে তারা সবচেয়ে বেশী দিন বাঁচেগড় আয়ুষ্কাল প্রায় ২০০ বছর। সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছেন যেএই দীর্ঘজীবনে বোহেড তিমির কখনো ক‍্যান্সার হয় না! ৮০,০০০ কেজি ওজনের বিশাল শরীর নিয়ে কীভাবে বোহেড তিমিরা দুশ বছর ক‍্যান্সারকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেতা বিজ্ঞানীদেরকে বহুদিন ভাবিয়েছে।


অবশেষে সেই প্রশ্নের প্রথম উত্তরটি দেয়ার চেষ্টা করলেন বিজ্ঞানী ভেরা গর্বুনোভা। ইনি সেই বিজ্ঞানী যিনি নেকেড মোল-র‍্যাটের গবেষণাতেও সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন। ল‍্যাবের মাঝে ৩৫ গ্রাম ওজনের একেকটি নেকেড মোল-র‍্যাট পালা সম্ভব হলেও ৮০,০০০ কেজি ওজনের আস্ত বোহেড তিমি তো পালা সম্ভব নয়! তাহলে কীভাবে পাওয়া যাবে বোহেড তিমির কোষযার ওপর বার্ধক‍্যের গবেষণা চালানো যাবে?


তিমি শিকারী ইনুপিয়াত

আমেরিকার আলাস্কা রাজ‍্যে ইনুপিয়াত নামক এক জনগোষ্ঠী বাস করে যারা ঐতিহাসিকভাবে তিমি শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা এতো ঠান্ডার মাঝে বসবাস করে যে তাদের পক্ষে গরু ছাগল পালন করে খাদ‍্য উপার্জন করা সম্ভব নয়। তাই ইনুপিয়াতরা যুগের পর যুগ ধরে জাহাজে করে বোহেড তিমি শিকার করে চলেছে। জাল কিংবা খাঁচা নয়জাহাজের মাস্তলে উঠে শিকারি ক‍্যাপ্টেন হার্পুন দিয়ে তিমিকে ধরার পর সেটাকে টেনে তীরে নিয়ে আসে। তারপর ৬০-৭০ জন ইনুপিয়াত মানুষ সেই তিমির সর্বাংশ তাদের পরিবারের জন‍্য সংগ্রহ করে। একেকটি তিমি ধরা পড়লে জাহাজের ক‍্যাপ্টেন সমগ্র গ্রামের মানুষকে  দাওয়াত দিয়ে তিমির মাংস খাওয়ান। ভোজ শেষে সেই ইনুপিয়াত গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে তাদের জীবিকা প্রদানকারী তিমিটির জন‍্য প্রার্থণা করে। হাজার বছর ধরে এভাবেই ইনুপিয়াতরা তিমির মাংস খেয়ে আলাস্কা অঞ্চলে বাস করছে। 

 

চিন্তার বিষয় হলোকানাডা আর আমেরিকার কিছু বড় বড় কোম্পানি কেবল অধিক লাভের নেশায় তিমি শিকার করে তাদের সম্প্রদায়কে প্রায় বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। তাই আধুনিককালে বিশ্বের অনেক দেশেই তিমি শিকার করাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু আলাস্কা-এস্কিমোদের তিমি শিকারী আদিম জনগোষ্ঠীর একটি ফাউন্ডেশনকে বছরে কিছু তিমি ধরার অনুমতি দেয়া হয়। কারণ বরফে ঢাকা এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি এই তিমির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ২০১৪ সালে বিজ্ঞানী গর্বুনোভা সেই ফাউন্ডেশনের সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন‍্য একটি চুক্তি করলেন। চুক্তি অনুসারে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আলাস্কায় এই ইনুপিয়াত ক‍্যাপ্টেনরা তিমি শিকার করে তীরে নিয়ে আসার পর গর্বুনোভার ল‍্যাবের বিজ্ঞানীরা তিমির চামড়া থেকে কোষের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেয় আমেরিকার রচেস্টার বিশ্ববিদ‍্যালয়ে। তিমির সেই চামড়ার কোষগুলোকে তারপর মাসের পর মাস ল‍্যাবের প্লাস্টিকের প্লেটে চাষ করার মাধ‍্যমে গর্বুনোভার ল‍্যাব মলিকুলার বায়োলজির গবেষণায় প্রথমবারের মতো বোহেড তিমি অধ‍্যায়ের সূচনা ঘটান।


তিমির বার্ধক‍্যবিহীন জীবনের রহস‍্য

বিজ্ঞানী গর্বুনোভার দল তিমিমানুষ আর ইঁদুরের কোষগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা শুরু করলেন। প্রথমেই তারা পরীক্ষামূলক ক‍্যান্সার সৃষ্টির পরীক্ষাটি করলেন। আমরা চতুর্থ অধ‍্যায়ে জেনেছিকোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রণকারী অ‍্যাকসেলারেটর এবং ব্রেক প্রোটিনের রেসিপি (জিন)-তে ইচ্ছাকৃতভাবে মিউটেশন সৃষ্টি করে ল‍্যাবের প্লেটে ক‍্যান্সার তৈরি করা সম্ভব। এইভাবে পরীক্ষামূলক ক‍্যান্সার সৃষ্টির জন‍্য একটি প্রাণীতে যত বেশী মিউটেশন সৃষ্টির প্রয়োজন হবে সেই প্রাণীটিকে তত বেশী সুরক্ষিত বলে বিবেচনা করা যাবে। 

 

গর্বুনোভার দল প্রমাণ করে দেখালেনক‍্যান্সারের সূচনার জন‍্য ইঁদুরের মাত্র দুটি নিয়ন্ত্রক প্রোটিনে মিউটেশন ঘটানোই যথেষ্ট। অন‍্যদিকে বোহেড তিমির দরকার হয় চারটি নিয়ন্ত্রক প্রোটিনের রেসিপিতে ঝামেলা বাঁধারমানুষে লাগে পাঁচটি! অর্থাৎদেখা যাচ্ছেমানুষে এই উপায়ে ক‍্যান্সার সৃষ্টি করা বোহেড তিমির তুলনায় কঠিনযদিও তিমির তুলনায় মানুষের ক‍্যান্সার অনেক বেশী হয়ে থাকে। সুতরাংএই পরীক্ষাটি আমাদেরকে তিমির ক‍্যান্সারহীন জীবনের রহস‍্য ব‍্যাখ‍্যা করতে পারছে না।

 

গর্বুনোভা এরপর হাতি-গবেষকদের পথে হাঁটলেন। আমরা তো আগের অধ‍্যায়েই পি৫৩ প্রোটিনের কথা জেনেছি যা ডিএনএ-তে ঝামেলা বাঁধার পর কোষের বিভাজন বন্ধ করে ডিএনএ মেরামত প্রকল্প’ চালু করে। সেই প্রকল্প সফল না হলে তারা কোষটিকে অ‍্যাপোপটোসিস’ প্রক্রিয়ায় মেরে ফেলে। যদি হাতির ডিএনএ-তে ২০ কপি পি৫৩ প্রোটিন তৈরির জিন থাকে তাহলে বোহেড তিমির কতটি কপি থাকতে পারে?

 

বোহেড তিমি পি৫৩ প্রোটিনের কারসাজি

ডিএনএ পর্যালোচনায় দেখা গেলোতিমির শরীরে মানুষের মতই একটি মাত্র পি৫৩ তৈরির জিন থাকে। এরপর গর্বুনোভার দল মানুষইঁদুর আর তিমির কোষের পি৫৩ প্রোটিনের সক্রিয়তা পরিমাপ করতে নেমে পড়লেন। তিনটি প্রাণীর কোষকে ল‍্যাবের মাঝে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির নিচে ঘন্টার পর ঘন্টা রেখে দিলেন। আমরা আগেই জেনেছি যেআল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি আমাদের ডিএনএ-তে ক্ষতের সৃষ্টি করে। সুতরাং আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির কারণে কোষগুলোতে পি৫৩ প্রোটিন সক্রিয় হয়ে ওঠার কথাযার ফলশ্রুতিতে ঘটবে অ‍্যাপোপটোসিস বা কোষ-মৃত‍্যু। তাই পি৫৩ প্রোটিনের সক্রিয়তা পরিমাপ করতে গর্বুনোভার দল এই তিনটি প্রাণীর কোষে অ‍্যাপোপটোসিস’ প্রক্রিয়ার মৃত কোষের সংখ‍্যা হিসেব করে হতবাক হয়ে গেলেন। দেখা গেলোতিমিমানুষ আর ইঁদুরের মাঝে সমপরিমাণ মৃত কোষ! সুতরাংবোহেড তিমির পি৫৩ প্রোটিনে কোন অভিনব কার্যকারিতার প্রমাণ নেই। এই পি৫৩ প্রোটিনও পারলো না বোহেড তিমির বার্ধক‍্যবিহীন জীবনের রহস‍্যকে ব‍্যাখ‍্যা করতে।

 

এপর্যায়ে তো গর্বুনোভার দল একটু বিরক্ত। সেই আলাস্কার ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তাদের বিজ্ঞানীরা তিমির চামড়া সংগ্রহ করে এনেছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ল‍্যাবের ভেতর পরীক্ষার পর কীভাবে তিমির দেহে মানুষের থেকেও কম ক‍্যান্সার হয় তার উত্তর মিলছে না। তাদের শেষ ভরসা পি৫৩ প্রোটিনটিও তিমির কোষে বেশী অ‍্যাপোপটোসিস ঘটাতে পারলো না! কিন্তুহঠাৎ তাদের মনে পড়লোঅ‍্যাপোপটোসিস ঘটানো তো পি৫৩ প্রোটিনের দ্বিতীয় কাজ। পি৫৩ প্রোটিনের প্রথম কাজ তো হলো ডিএনএ মেরামত প্রকল্প’ বাস্তবায়নের মাধ‍্যমে ডিএনএ-তে সৃষ্ট যেকোন ধরণের মিউটেশন বন্ধ করা। তাহলে কি বোহেড তিমির ডিএনএ মেরামত প্রকল্প’ বাকি প্রাণীদের তুলনায় বেশী ভালোভাবে কাজ করেফলে তাদের পি৫৩ প্রোটিনকে আর অ‍্যাপোপটোসিস ঘটিয়ে কোষকে মেরে ফেলার মাধ‍্যমে ক‍্যান্সারের প্রতিকার করতে হয় নাএপর্যায়ে গর্বুনোভার দল তাদের নতুন এই হাইপোথেসিস নিয়ে আবার ল‍্যাবে ফেরত গেলেন।


ডিএনএ মেরামত প্রকল্প

বাংলাদেশে বর্ষাকালে সিটি কর্পোরেশনগুলো রাস্তা খুড়ে নানা রকম পাইপ মেরামত প্রকল্প চালু করে। এর কারণ হলোবর্ষাকালে পানির পাইপ ভেঙ্গে তার মাঝে বর্জ‍্য পদার্থ ঢুকে যায়। কখনো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এই শ্রমিকদের কাজ পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবেনতারা প্রথমে একটি যন্ত্রের সাহায‍্যে রাস্তার যে অংশের পাইপে ছিদ্রের কারণে পানিতে ময়লা ঢুকে যাচ্ছে তা সনাক্ত করে। তারপর মাটি খুড়ে সেই নষ্ট পাইপটিকে উন্মোচিত করে। এরপর একজন ইঞ্জিনিয়ার এসে পরীক্ষা করে দেখেন যেএই পাইপটিকে কীভাবে ঠিক করা উচিত। ছোটখাটো ছিদ্র হয়ে থাকলে তারা হয়তো পাইপের বাহির থেকে একটা প্রলেপ মেরে ছিদ্রটা বন্ধ করে দিবে। কিন্তু পাইপটি যদি অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন পাইপটা পুরোপুরি বদলে ফেলতে হয়। সেজন‍্য প্রথমে ক্ষতিগ্রস্থ পাইপটিকে কেটে সরিয়ে ফেলা হয়। তারপর নতুন একটা পাইপ এনে তাকে দুইপাশের পাইপের সাথে জোড়া লাগিয়ে দিতে হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এলাকার পানির লাইন তারপর ঠিকমতো কাজ শুরু করে।

 

আমাদের কোষের ডিএনএ-তে প্রতিদিন নূন‍্যতম ১০,০০০ বার ক্ষত সৃষ্টি হয়। তখন সিটি কর্পোরেশনের মতো আমাদের কোষের ভেতরও একটি ডিএনএ মেরামত প্রকল্প চালু হয়। এই ক্ষতের প্রধান কারণ হলো কোষের ভেতরকার জীবনধারণের প্রক্রিয়া সচল রাখতে সেখানে ঘটে চলা হাজার হাজার রাসায়নিক বিক্রিয়া। এসকল রাসায়নিক বিক্রিয়ার উপজাত হিসেবে ঋণাত্মক চার্জ বিশিষ্ট এক ধরণের অণু সৃষ্টি হয় যারা ডিএনএ-তে নানা রকম ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। এই ক্ষতিকর অনুগুলোকে বলা হয় reactive oxygen species (ROS/রস)। অনেক মানুষকেই হয়তো বলতে শুনেছেন যেস্ট্রবেরী খেলে ত্বক সুন্দর হয়। এর কারণ হলোস্ট্রবেরীতে অ‍্যান্টি অক্সিডেন্ট নামক এক ধরণের অণু থাকে যারা কোষের ভেতরে সৃষ্ট রস’-কে ধ্বংস করার মাধ‍্যমে ডিএনএ-কে সুরক্ষা দেয়। যেহেতু ডিএনএ-র মিউটেশন বার্ধক‍্যের অন‍্যতম কারণসেহেতু রস’ ধ্বংস করতে পারলে বার্ধক‍্য বিলম্বিত হয়। একই সাথে যদি ডিএনএ মেরামত প্রকল্প ভালো কাজ করেতাহলে যাবতীয় সকল বার্ধক‍্যজনিত রোগই কমে যাবে।

 

এখন বোহেড তিমির গবেষণায় আবার ফেরত যাওয়া যাক। গর্বুনোভার দল প্রথমে মানুষ আর তিমির কোষে ডিএনএ-র ছোটখাটো ক্ষতকে মেরামত করার সক্ষমতাকে পরীক্ষা করলেন। বর্ষাকালের পাইপে সৃষ্ট হওয়া ছিদ্র মেরামতের প্রক্রিয়ার মতো ডিএনএ-র এই ক্ষতকে PARP (পার্প) নামক একটি প্রোটিন প্রথমে খুঁজে বের করে। তারপর আরো কয়েকটি প্রোটিনের সহায়তায় পার্প প্রোটিন সেই ক্ষতটি মেরামতের সূচনা ঘটায়। গর্বুনোভার দল প্রথমে মানুষ আর তিমির কোষকে পাশাপাশি রেখে তাতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ঢেলে দিলেন। এর ফলে কোষে সৃষ্টি হলো প্রচুর পরিমাণ ক্ষতিকর রস’ অণুযা ডিএনএ মেরামত প্রকল্পের সূচনা ঘটায়। অত:পর তারা দেখতে পেলেন,  তিমির কোষে মানুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশী পার্প প্রোটিন কাজ করছে। আরেকটু নিশ্চিত হতে কোষগুলোতে একটি ক্ষতিকর মিউটাজেন (এমন রাসায়নিক পদার্থ যা মিউটেশন সৃষ্টি করে) ঢেলে দেখতে পেলেনমানুষের কোষে মিউটেশন সৃষ্টি হলেও তিমির কোষে কোন মিউটেশন সৃষ্টি হচ্ছে না। তারা বুঝতে পারলেনবোহেড তিমির ডিএনএ মেরামত প্রকল্প মানুষের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী সক্রিয়যা কোষে সৃষ্ট ছোটখাটো মিউটেশন নিমিষেই ঠিক করে ফেলে। কিন্তুডিএনএ-র বড়সড় ক্ষতের বেলায় কি ঘটবে?

 

গর্বুনোভার দল এরপর কোষের ডিএনএ-তে বড়সড় ক্ষত তৈরির জন‍্য মানুষ আর তিমির কোষকে পাশাপাশি রেখে উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন প্রয়োগ করলেন। এই রেডিয়েশনের ফলে ডিএনএ-র একটা অংশ ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যায়। ব‍্যাপারটা বর্ষাকালে রাস্তায় একটা পাইপ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবার মতো। তখন পাইপের মতো সেই নষ্ট ডিএনএ-টিকে কেটে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন করে ডিএনএ তৈরি করতে হয়। যদি সবকিছু ঠিকঠাক মতো কাজ করেতাহলে ডিএনএ মারাত্মক রকম বিপদ এড়িয়ে যাবে। কিন্তুএকটু গড়মিল বাঁধলেই ডিএনএ-র প্রোটিন তৈরির রেসিপির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে। যার পরিণামে হতে পারে ক‍্যান্সার। সুতরাংএই রেডিয়েশনের প্রভাব বোঝার জন‍্য গর্বুনোভার দল মানুষ আর তিমির কোষ থেকে ডিএনএ নিয়ে তা পর্যালোচনা করে দেখলেন। দেখা গেলোমানুষের প্রায় ১০% ডিএনএ রেডিয়েশনের ফলে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ মানব কোষের ডিএনএ মেরামত প্রকল্প বড় ধরণের ক্ষতকে ঠিক করতে পারছে না। বিস্ময়ের ব‍্যাপার হলোতিমির ডিএনএ-তে রেডিয়েশনের ফলে কোন অংশই পুরোপুরি হারিয়ে যায় নি। বোঝা গেলোছোট কিংবা বড় ডিএনএ-র সকল ধরণের ক্ষতকেই বোহেড তিমির কোষ মানুষের তুলনায় অনেক ভালোমতো মেরামত করতে পারে। একবার চিন্তা করে দেখুনএই মেরামত ঠিকমতো কাজ করলে পি৫৩ প্রোটিনকে কোন দিনই আর আত্মহত‍্যার জন‍্য অ‍্যাপোপটোসিস চালু করতে  হবে না। তাইবলা যায়বিবর্তন বোহেড তিমিকে বার্ধক‍্যের নিয়ামক মিউটেশন প্রতিরোধের জন‍্য সবচেয়ে উপকারী অস্ত্রটি দিয়েছে। সেটা হলো ডিএনএ মেরামত প্রকল্প। কিন্তুএখন আসল প্রশ্ন হলো: বোহেড তিমির কোন প্রোটিনটি এই মেরামত প্রকল্পের সফলতার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে?

 

তিমির ডিএনএ মেরামত প্রকল্পের জাদুকর

গর্বুনোভার দল রেডিয়েশনের পরীক্ষাটি করার সময় কোষগুলো থেকে প্রোটিন আলাদা করে তার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখলেন। তারা লক্ষ‍্য করলেনরেডিয়েশন দেওয়ার পর মানুষ কিংবা ইঁদুরের তুলনায় তিমির কোষে CIRBP (আমরা আলোচনার সুবিধার্থে একে ডাকবো কিরবিপ) নামক প্রোটিনটি অনেক বেশী পরিমাণে তৈরি হচ্ছে। কিরবিপ প্রোটিনের কাজ হলো ডিএনএ মেরামতে সাহায‍্য করা। খুব সহজেই তখন বোঝা গেলোএই কিরবিপই হয়তো তিমির ক‍্যান্সারবিহীন জীবনের মূল চাবিকাঠি। কিন্তুসেটা কীভাবে প্রমাণ করা যাবে?

 

প্রথমে তারা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ‍্যমে কিরবিপ প্রোটিনের জিনটিকে তিমির কোষে বন্ধ করে দিলেন। ফলশ্রুতিতে দেখা গেলো তিমির কোষ রেডিয়েশনের পর ডিএনএ মেরামতের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এরপর তারা একই ভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে আগের কোষগুলোতে নতুন করে কিরবিপ প্রোটিন ঢুকিয়ে দিলেন। দেখা গেলো তাদের ডিএনএ মেরামতের ক্ষমতা আবার ফিরে এসেছে। এই দুই পরীক্ষায় সাফল‍্য পাওয়ার পর তারা করলেন সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি। তারা তিমির ডিএনএ থেকে কিরবিপ প্রোটিনের রেসিপিটি মানুষের কোষে ঢুকিয়ে দিলেন। রেডিয়েশন দেয়ার পর তখন দেখা গেলো মানুষের কোষটিও তিমির মতো ডিএনএ মেরামত করছে। এই সব কিছু বিবেচনা করে ২০২৩ সালে গর্বুনোভার দল সবাইকে জানিয়ে দিলেন তারা বোহেড তিমির বার্ধক‍্যবিহীন জীবনের রহস‍্য খুঁজে পেয়েছেন। তারা বললেনঃ

 

বোহেড তিমির কোষে CIRBP/কিরবিপ নামক একটি প্রোটিন মানুষের তুলনায় বেশী পরিমাণে তৈরি হয়। এই প্রোটিনটি কোষের ভেতরে ঘটা ডিএনএ-র যেকোন ধরণের ক্ষতকে মেরামত করার মাধ‍্যমে মিউটেশন হওয়া ঠেকাতে পারে। ফলে বার্ধক‍্যজনিত সকল সমস‍্যা অন‍্যান‍্য প্রাণীদের তুলনায় তিমির শরীরে কম হয়। যদি তিমির কিরবিপ প্রোটিনের রেসিপি মানুষে ঢুকানো হয় তবে মানুষের কোষও তিমির মতো ডিএনএ মেরামত করতে শিখে যায়। (এই গবেষণাটি বর্তমানে একটি বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পথে রয়েছে। গর্বুনোভার দল সামাজিক যোগাযোগ মাধ‍্যমে ইতোমধ‍্যে তাদের ফলাফলগুলো প্রকাশ করায় আমি আপনাদেরকে এই গল্পগুলো বলতে পারছি। ২০২৪ সালের শুরুর দিকেই আমরা এই গবেষণাটিকে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ আকারে দেখতে পাবো।)

 

আমরা এখন শুধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো আগামী ১০-২০ বছরের মাঝেই হয়তো তিমির কিরবিপ প্রোটিনটি ইঞ্জেকশনের ভরে বাজারে চলে আসবে। আমরা তখন হয়তো আমরাও দেহের ভেতর তিমির ডিএনএ মেরামত প্রকল্পটিকে চালিয়ে দিয়ে চিরতারুণ‍্য ধরে রাখতে পারবো। কি সুন্দর একটি ভবিষ‍্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন‍্য!

 

আগামী অধ‍্যায়ে আমরা পানির জগৎ থেকে আবার ফেরত যাবো ডাঙ্গায়। ভারত মহাসাগরের বুকের একটি ছোট দ্বীপে বাস করছে লাখ খানেক বৃহৎ কচ্ছপ যাদের আয়ু প্রায় ১০০ বছর! আগামী অধ‍্যায়ে থাকছে এই কচ্ছপদের গল্প।

———————————————————————————

সূচিপত্র:

———————————————————————————

ই-বইটি পড়ে ভালো লেগে থাকলে লেখক ও প্রকাশকের কথা চিন্তা করে অনুগ্রহপূর্বক বইটির কপি সংগ্রহ করুন এই লিংক থেকে: রকমারি.কম

 



Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2025 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.