Procrastination
May 27, 2020 | 8257
হোমওয়ার্ক, কোর্স এসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট রিপোর্ট থেকে শুরু করে পরীক্ষার প্রস্তুতির মত সকল বাঁধা-ধরা কাজেই আমাদের এক ধরনের আলসেমি কাজ করে। ইংরেজিতে এই স্বভাবটার একটা সুন্দর নাম আছে— “Procrastination”. অর্থ-শেষ সময়ের জন্য কাজ ফেলে রাখা। Procrastination আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য।
ধরুন, আপনাকে একটা জরুরী রিপোর্ট/এসাইনমেন্ট লিখে দিতে হবে। ডেডলাইন আজ থেকে ত্রিশদিন পর। প্রথম পনেরো দিন আপনি গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেরাবেন; ভাবটা এমন হবে যে আপনি হানিমুনে আছেন। ষোল নম্বর দিনে রিপোর্ট/এসাইনমেন্টটা একটু খুলে দেখবেন। গুগলে হাল্কা সার্চ দিবেন। ইউটিউবে সেই সংক্রান্ত একটা-দুইটা ভিডিও দেখবেন। সেই ভিডিওর সাজেশনে হঠাৎ করে “দেখুন ভিডিওসহ” প্যাকেজের কিছু একটা আসবে। আপনি সেটাতে ক্লিক করবেন। ব্যাস! রাত্রি শেষ। ট্রাভেল ভিডিও, মিউজিক ভিডিও, ফুড রিভিউ, টেক রিভিউ, সেলিব্রিটি স্ক্যান্ডাল— এতো কিছু দেখার পর এসাইনমেন্টের সময় কোথায়? ক্লান্ত শরীরে আপনি যাবেন ঘুমাতে।
এরপর সপ্তাহ খানেক আপনি আবার হানিমুন-মুডে থাকবেন। কারণ, আপনিতো কাজটা অন্তত শুরু করেছেন। হাল্কা একটা আইডিয়া তো হয়েছে। আর কি লাগে? খুশি মনে আরো সপ্তাহ খানেক মুভি-টিভি সিরিজ দেখবেন। অবশেষে ডেডলাইনের ঠিক তিনদিন আগে আপনার টনক নড়বে!
হায় হায়! দেখতে দেখতে প্রায় ত্রিশদিন নষ্ট করে ফেলেছেন? এখন কেমনে কি করবেন? মনে হবে আপনার দুনিয়াটা উল্টে যাচ্ছে। বন্ধু-কলিগদের ফোনের পর ফোন দিয়ে টিচার কিংবা বসের নামে ঘন্টা দুয়েক গালি-গালাজ করবেন। অবশেষে দুই দিন আগে হুশ হবে। আপনি বুঝতে পারবেন যেই কাজ করার জন্য আপনাকে ত্রিশদিন সময় দেয়া হয়েছিল সেইটা করার জন্য এখন ত্রিশ ঘন্টা বাকী!
এখন আপনার মাঝের ঘুমন্ত জিনিয়াসটা জেগে উঠবে। এই মানুষটাকে আপনি একেবারেই চিনতে পারবেন না। এই মানুষটা মাত্র একবার পড়েই সবকিছু বুঝতে পারবে; একবার চিন্তা করেই সবকিছু লিখে ফেলতে পারবে। এই মানুষটার ঘুম আসে না; ডিসট্র্যাকশন হয় না। এই মানুষটা ফেইসবুক মেসেঞ্জারে অন্য মানুষের মাই-ডে দেখে সময় নষ্ট করে না। এই মানুষটা তো সুপার হিউম্যান। সেই সুপার-হিউম্যান আপনাকে কোনমতে সেই ডেডলাইনের এক ঘন্টা আগে একটা জবু-থবু রিপোর্ট/এসাইনমেন্ট লিখে দিবে। সেইটা জমা দিয়ে আপনি অবশেষে হাফঁ ছেড়ে বাচঁবেন। সিদ্ধান্ত নিবেন যে, এবারই শেষ। আগামীবার থেকে সময়মতো কাজ করবেন।
তারপর যখন পরবর্তী কাজ হাতে আসবে তখন আবারো আপনি procrastination এর এই পুরোনো চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন।
এই গল্পটা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প। কিন্তু, আমরা কেন এরকম করি? procrastination এর এই সাইকোলজিটা খুব সাধারণ কিছু রূপক উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে সেই অনেকটা এরকম দাড়াঁবে:
আমাদের প্রত্যেকের মাথার ভিতরে একটা কন্ট্রোলার থাকে যা দিয়ে আপনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো নিয়ে থাকেন। এই কন্ট্রোল রুমে বাস করে দুইজন— একজন যুক্তিবিদ আর একটা বানর। যুক্তিবিদ সাধারণত সবসময় যৌক্তিক, ভালো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আর বানরটার কাজ হলো সব সময় “সহজ এবং মজা”র কাজ করা।
আমরা যখন ডেডলাইন চোখে দেখতে পারি না তখন আমাদের মাথার কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব নেয় সেই বানরটা। আপনি যখন ঘন্টার পর ঘন্টা ফেইসবুকে অজানা মানুষের ছবিতে লাইক দিয়ে সময় কাটিয়ে দেন কিংবা ইউটিউবে একের পর এক ভিডিও দেখে “জ্ঞান” অর্জন করেন তখন সেই বানরটার রাজত্ব চলে। ডেডলাইনের তিনদিন আগ পর্যন্ত সেই বানরটা আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে; আপনি পড়তে বসলে আপনার কানে “ঘুম পাড়ানি গান” গেয়ে শোনাবে। যা কিছু সহজ এবং মজার আপনি শুধু সেগুলোই করবেন।
কিন্তু, ডেডলাইনের তিন দিন আগে আপনার কন্ট্রোলরুম নতুন এক বাসিন্দা প্রবেশ করবে। উনার নাম— “প্যানিক মন্সটার”। প্যানিক প্রবেশ করার সাথে সাথেই বানরটা দৌড়ে গাছে উঠবে। আপনার মাথার যুক্তিবিদটা কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব নিবে; আর আপনি পরিণত হবেন একটা সুপার হিউম্যানে।
এই যু্ক্তিবিদ, বানর আর প্যানিক মন্সটারের দাসত্বে আপনি পার করে দিবেন আপনার প্রতিটি ডেডলাইন। এটা মোটামুটি আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের জীবনের সহজ সত্য। আমরা সবাই একজন procrastinator. সবাই এর ভুক্তভোগী। কিন্তু, এর থেকে বের হবার উপায় কি?
উপায় নেই। আমার মনে হয় আমাদের ডিজাইনেই এই Procrastination লুকিয়ে আছে। যারা এই বৃত্ত ভেঙ্গে বের হয়ে আসে তাদের অনেককেই আমরা নরমাল মনে করি না; রোবট ভাবি। কিন্তু, আমার সবচেয়ে বড় কথা হলো, Procrastination কি খুব খারাপ কিছু?
ধরুন, আপনি অনেক পরিকল্পনা করে কাজ করতে পছন্দ করেন। আপনি পুরো মাত্রায় non-procrastinator. কোন কাজের একমাস আগে আপনি প্ল্যান করলেন। তারপর সেই প্ল্যান অনুসারে ধাপে ধাপে সেই কাজের প্রতিটি অংশ সম্পাদন করলেন। ডেডলাইনের দুই দিন আগে আপনার প্রজেক্ট শেষ! বাহ! কত আদর্শ সেই জীবন। মোটামুটি সব বড় বড় কোম্পানিও এই প্রক্রিয়ায় কাজ করে থাকে। তাই, সেই বড় কোম্পানির চাকুরেদের জীবন ধীরে ধীরে খুবই মেকানিকাল হয়ে যায়। কোন কারণে তাদের পরিকল্পনার বাহিরে কিছু হলে তখন তারা আর ঠিকমত কাজ করতে পারে না।
কিন্তু, আপনি যদি একজন procrastinator হয়ে থাকেন তাহলে এই ধরণের অনিশ্চয়তা আপনার নিত্যদিনের সঙ্গী। প্যানিক মন্সটার দেখা দিলে আপনি ভড়কে যাবার বদলে বরং আরো ভালো করে কাজ করতে পারেন। ডেডলাইনের আগে আপনি হয়ে যান সুপার হিউম্যান। আমার মতে, procrastinator-রা হলো বিপদের বড় সহায়। যখন সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে তখন এরাই সবচেয়ে বেশী কাজ শেষ করে দিতে পারে।
বাস্তবতার কথা বলতে গেলে, এই পৃথিবীতে procrastinator-দের কোন স্থান নেই। কারণ, আমরা বাস করি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিশ্বে। এই বিশ্বে সব কাজ ডেডলাইনের মধ্যে শেষ করতে হবে। এই পৃথিবীতে ভালো কর্মী সে যে আদেশ পালন করবে, প্ল্যান করে কাজ করবে। তাই, procrastinator vs non-procrastinator বিতর্কে সবাই non-procrastinator-দেরই বাহবা দিবে। তবে আমি কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করি।
আমার মতে, আমাদের পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষই অনেক দরকার। যেহেতু বিশ্বে বেশীর ভাগ কাজ পরিকল্পনা অনুসারে করা লাগে তাই non-procrastinator দের রাজত্বটা একটু বড়। তবে, যখন পরিকল্পনা কাজ করবে না তখন সেই অবস্থা সামাল দেয়ার জন্য সব প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন master-procrastinator রাখা উচিত। এদের কাজ একটাই, বিপদ সামাল দেয়া।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দুই প্রকার মানুষের মাঝামাঝি একজন। ক্যারিয়ার সংক্রান্ত কাজ— যেমন থিসিস লেখা, এসাইনমেন্ট করাতে আমি খুবই পরিকল্পনা করে কাজ করি। কিন্তু, আমার উপভোগ্য জীবনটা হলো পুরোটাই “খনিকের চিন্তা”। আমার বন্ধুরা আমাকে খুবই “impulsive” হিসেবে আখ্যা দেয়। আমি একবার সব সফল মানুষদের দৈনিক রুটিন সম্পর্কে পড়ছিলাম। টীম কুক, ল্যারি পেইজ, ইলন ম্যাস্ক, বিল গেটসদের সবাই সকাল ৫-৬টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে। সারাটা দিন তারা রুটিন তৈরি করে তা ফলো করে। সেটা দেখে আমিও কাজটা করার চেষ্টা করলাম। ক্যালেন্ডারে প্রতিটা কাজ লিখে লিখে করতে থাকলাম। দেখলাম, কাজ ঠিকই হয়। তবে সেই কাজের চূড়ান্ত ফলাফলটা আমার কখনোই পছন্দ হয় না।
একদিন ঠিক করলাম, শুক্রবার রাত ৮ টার মধ্যে একটা ব্লগ লিখে প্রকাশ করতে হবে। দুই দিন আগে সেটা লিখে ফেললাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে ব্লগ রেডি। সেই ব্লগটা পড়ার পর তা প্রকাশ করা ইচ্ছাটাই শেষ হয়ে গেল। মাত্র ৩০ মিনিটে তখন আবার প্রথম থেকে লেখা শুরু করলাম। ক্যামব্রীজ ঘুরতে যাবার গল্পটা লিখে প্রকাশ করলাম; মনে অনেক শান্তি লাগছিলো। আমি আমার procrastinator সত্ত্বাটাকেই বেশী উপভোগ করি; যদিও আমার non-procrastinator সত্ত্বাটা আমাকে সমাজের চোখে তথাকথিত “ভালো ছাত্র” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আমার প্রায়ই মনে হয়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদেরকে যেই শিক্ষা দেয়া হয় তার পুরোটাই হলো দক্ষ কর্মী তথা জনশক্তি তৈরি করার জন্য। তাই, আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে applied বিষয় যেমন- কম্পিউটার সায়েন্স, EEE, pharmacy, BBA পড়তে বেশী উৎসাহিত করা হয়। কারণ একটাই—আপনি ভালো চাকুরি পাবেন। বসের দেয়া ডেডলাইনে কাজ করবেন। যা করতে বলা হবে তাই করবেন। এর বাহিরে কিছুই করবেন না। আমার ভাই একবার বলছিলো, “চাকুরি করা মানে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে নিজের সমগ্র জীবনটা একটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়া”। কথাটা আমার অনেক মনে ধরেছিলো।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়, procrastinator-রা অনেক বেশী ক্রিয়েটিভ। তারা প্রায়ই “out-of-the-box” চিন্তা করতে চায়, তারা নিয়ম ভাঙ্গতে চায়। আমি নিয়ম ভাঙ্গার অনেক বড় ভক্ত। যেই ইলন মাস্ক আর বিল গেটসদের উদাহরণ দিয়ে কর্পোরেট ট্রেইনারবৃন্দ কর্মীবাহিনীকে উৎসাহিত করেন সেই বিল গেটসরাই স্বীকার করেছেন যে তারা প্রায়ই হুজুগে কাজ করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। আপনার কি মনে হয় বিল গেটস উইন্ডোস বানানোর কাজটা পরিকল্পনা করে করেছিলেন?
হার্ভাডে পড়ার সময় তিনি একটা কোম্পানিকে ফোন দিয়ে তার সফটওয়্যারটা বিক্রির কথা বলেন। সেই কোম্পানি তাকে একমাস পর যোগাযোগ করতে বলে। বিল গেটস হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কারণ, যেই জিনিসটা বেঁচার জন্য তিনি মাত্র কথা বললেন সেটা এখনো বানানোও শুরু করেননি। যদিও বর্তমান মাইক্রোসফট কোনদিনও এইভাবে কাজ করবে না। বিশাল কর্পোরেট মৌচাকে procrastinator-রা খুবই খারাপ কর্মী মৌমাছির ভূমিকা পালন করবে যাদের প্রায়ই রাণী মৌমাছির রোষানলে পড়তে হয়। কিন্তু, এই procrastinator-রাই দেখা যাবে হঠাৎ করে সেই কোম্পানির জন্য “game-changing” আইডিয়া বের করে ফেলে। কারণ, ডেডলাইন যখন দুই ঘন্টা করে তখন প্যানিক মন্সটারের সাথে যুদ্ধ করার জন্য এই procrastinator-দের দলটাকে একটু আলাদা চিন্তা করতেই হয়। তাই বলবো, পরিমিত মাত্রায় procrastination এই বিশ্বের জন্য খুবই দরকার।
শেষ করবো দুটো ব্যক্তিগত গল্প দিয়ে। বছর খানেক আগে একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বই লেখার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। বইমেলার আগে একটা ডেডলাইনের মধ্যে বইটা লিখে শেষ করতে হবে। খুবই যৌক্তিক কথা। কিন্তু, যতবারই সেই ডেডলাইনের কথা চিন্তা করে বইটা লিখতে বসেছি ততবারই সেটা লেখার ইচ্ছা চলে যেতো। এই মাঝখানের সময়টাতে ১৫-২০টা ব্লগ ঠিকই লিখেছি; কিন্তু বইটার কাছ এতটুকুও হয়নি। কারণ, ব্লগ প্রকাশের কোন ডেডলাইন ছিলো না। সেই কাজটা করেছি অনেক স্বাধীনচেতা মানসিকতায়। শুধুমাত্র নিজের ভালোলাগা থেকে। এই ঘটনার পর বুঝেছিলাম আমি procrastination-টা বেশ পছন্দ করি। যখন মনে হয় তখন ধুমধাম লিখে ফেলি। কলম দিয়ে বসিয়ে লিখতে বললে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
ঘটনা দুই। গতবছর টিম উরবান নামক এক ভদ্রলোকের টেড টক দেখেছিলাম- “inside the mind of a master procrastinator”. সেটা এতোটাই মনে ধরেছিলো যে, ঠিক করলাম এই লোকের কথাগুলো বাংলায় অনুবাদ করে একটা ব্লগ লিখবো। মাত্র একবছর পর আজ সেটা লিখে ফেললাম।