আব্বু-আম্মুর প্রতি খোলা চিঠি
Psychology

আব্বু-আম্মুর প্রতি খোলা চিঠি

Jan 28, 2018   |    17070


শ্রদ্ধেয় আব্বু-আম্মু,

 

পত্রের শুরুতে আমার শুভেচ্ছা রইলো। আজ এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তোমাদের কাছে লিখতে বসেছি। সারাটা জীবন ভরে তোমরা আমাকে অসংখ্য ভালো উপদেশ দিয়েছো। তোমাদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা ্যতীত আমার কোন অস্তিত্বই থাকতো না। তারপরও তোমাদের প্রতি আমার কিছু কিছু ছোট অভিমান যুগের পর যুগ ধরে জমাট বেধেঁ আছে। কোন কিছুই তো চেপে রাখা ভালো না। তাই, আজ আমার সবগুলো অভিমানের কথা মুখ ফুটে বলবো। আজকের পর সন্তান আর বাবা-মার মাঝের দূরত্ব কিছুটা হলেও মিটবে বলে আশা করি। পত্রের বাকি অংশটুকু পড়ার আগে আমার সকল বেয়াদবী এবং স্পর্ধা মাফ করে দিয়ো।

 

তোমরা ছোটবেলা থেকে আমাকে শিখিয়েছো— “সততাই সর্বৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু, তোমাদের মুখের কথা আর কাজের মাঝে বিশাল এক তফাৎ আমি দেখতে পাই। গত বছর সবাই মিলে গ্রামে যাবার সময় যখন আমরা ট্রেনের টিকেট পাচ্ছিলাম না তখন আব্বু রেল স্টেশনের লোকটার হাতে একটা পাচঁশ টাকার নোট গুজেঁ দিয়ে আমাদের টিকেট করে ফেললো। এটা তো সততা না! কিন্তু, তোমরা আমাকে ্যবহারিক ক্লাসে হাতে কলমে দেখিয়ে দিলে ঘুষ দিলে কাজ হয়। এমনকি গত বছর আব্বুর প্রোমোশনের জন্যও তো তোমরা উনার বসকে দামী উপহার দিলে। আব্বুর প্রোমোশনটাও হলো। তাহলে কেন আমাকে ছোটবেলায় মিথ্যে শিক্ষা দিলে? সৎ হওয়া যদি আসলেই তোমাদের শিক্ষা হয়ে থাকে তাহলে কেন এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাসেঁর পর সেটা চড়া দামে কিনে আমার সোনার পাচঁটা সহজে ্যানেজ করে দিলে? আমাকে তো তোমরা হাতে কলমে কীভাবে অসৎ হতে হয় তাই শিখিয়েছো প্রতিটি পদে পদে। অন্তত সত্য কথাটা বললে তো পারতে!

 

ছোটবেলায় তোমরা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তারপর অন্য আত্মীয়দের সাথে গল্প করতে বসতে। তোমরা হয়তো কখনোই জানবে না যে, প্রায়ই আমার ঘুম ভেঙ্গে যেতো এবং আমি তোমাদের সেইবড়দের কথাগুলো সব শুনে ফেলতাম। তিন বছর বয়সেই আমি নিজের অজান্তে জেনেছি আমার কোন আন্টির স্বভাব খারাপ, আমার কোন চাচার একটা পরকীয়া আছে কিংবা আমার কোন মামার তার বউয়ের সাথে ঘর ভাঙ্গতে যাচ্ছে। এই আলাপগুলো তো তোমরা অন্য রুমে গিয়ে করলেও পারতে। আমার অবুঝ মনে সেই সংবেদনশীল তথ্য গুলে বেশ বড় দাগ কেটে যায়। আমি যত ছোটই হই না কেন ঠিকই বুঝতে পারছিলাম যে এইকথা গুলো আমার জানা উচিত নয়।

 

আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রায়ই আমাদের বাসায় আব্বুর একজন বন্ধু আসতেন। উনার নাম কবির আংকেল, দাড়িওয়ালা লোকটা। বাসায় এসেই উনি আগে নামাজ পড়তেন। তারপর আমাদের সাথে গল্প করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। আজকে একটা সত্যিকথা বলতে চাই, কবির লোকটা ভালো না। তোমরা আশেপাশে না থাকলে উনি আমাকে জোর করে ধরে তার কোলে বসাতে চাইতেন। প্রায়ই আমার ্যান্টের ভিতর হাত ঢুকানোর চেষ্টা করতেন। একদিন আমি রেগে উনাকে থাপ্পড় দিয়ে দিলাম। তোমরা এসে আমার বেয়াদবীর জন্য আমাকে এক সপ্তাহ বাহিরে খেলতে যেতে দিলে না। কিন্তু, ওই অমানুষটাকে তো ঠিকই বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে। কেন আমাকে সেই অত্যাচার সহ্য করতে হলো? আমি জানি তোমাদের কাছে জবাব নেই। আমার জবাব দরকারও নেই। শুধু তোমাদেরকে সেই না বলা কথাগুলো বলতে চাই। এই ঘটনা আমার স্কুলের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবীদের সাথেও হয়। ওরাও ভয়ে আমার মতো কিছু বলে না। কিন্তু, এভাবে আর কত দিন?

 

আমি তখন ক্লাস এইটে উঠেছি। হঠাৎ একরাতে বুঝতে পারলাম যে, আমার এক অস্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু, লজ্জায় তোমাদেরকে এসে কিছু বলতে পারছিলাম না। তোমরা আমার এই অবস্থা বুঝতে পেরেও আমাকে চুপ করে এড়িয়ে গেলে। তখন থেকেই আসলে আমার বন্ধুরা আমার দুনিয়ায় পরিণত হলো। কোচিং ক্লাসের পর আমি, সেজান, হিমু, কবীর একসাথে বসে এই বিষয়গুলো আলোচনা করতাম। একদিন কবীরপর্ণনামের এক নতুন আইডিয়ার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আস্তে আস্তে বুঝলাম আমাদের বয়সী ছেলে মেয়েদের প্রায় শতভাগই পর্ণ মুভির ভক্ত। কারণ, এই ভিডিও গুলোই তো ছিলো আমাদের সেক্স এডুকেশন। যে বিষয়গুলো নিয়ে তোমাদের আমার সাথে খোলামেলা কথা বলা উচিত ছিলো সেই বিষয়গুলো আমরা শিখেছি জনি সিন্স নামের একটা টাকলা লোকের কাছ থেকে। এখন বুঝি, সেই শিক্ষাটা কতটা ভয়াবহ! আমার বন্ধুদের অনেকেই এখন বিবাহিত জীবনে ভায়াগ্রা খেয়ে নিজেকে তার কল্পনার জনি সিন্সের সাথে মিলাতে চাচ্ছে। কিন্তু, তোমাদের সাথে আলোচনা হলে হয়তো সাড়ে তিন মিনিটের শান্তিটা আমরা বুঝতে পারতাম।

 

সেই ছোটবেলা থেকেই তোমরা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছো— “ছেলে মেয়ের মেলামেশাটা নিষিদ্ধ কিন্তু, এই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই যে আমার অনেক বেশী আগ্রহ। ক্লাস নাইনে উঠার পর থেকেই কীভাবে কোচিং ক্লাসে পাশের বেঞ্চের মেয়েটার ফোন নম্বর পাবো সেই চিন্তায় মশগুল থাকতাম। সত্যিকথা, প্রথম এক-দুই বছর খালি ্যর্থ প্রেমের গ্লানিই বইতে হলো। কলেজে উঠার পর যখন প্রথম প্রেয়সী জুটলো আমার ভাগ্যে তখন তো তোমরা আমাদের জীবনটা নাজেহাল করে দিলে। একরাতে ফোনে কথা বলার সময় তোমরা হাতে-নাতে ধরে ফেললে। হাত থেকে ফোনটা সিজ করে নিলে; সামিয়ার আব্বু-আম্মুকে বাসায় ডেকে আনলে। তোমাদেরকে বুঝ দেয়ার জন্য আমি আর সামিয়া ব্রেক আপ করলাম। কিন্তু, সত্যি কথা কি জানো? সেই সামিয়া আর আমি আজো হাত ধরে হেটেঁ যাই, বৃষ্টিতে রিক্সার হুড ফেলে ভিজি, কখনো বা জড়িয়ে ধরে আলতো চুমো খাই। পুরো ্যাপারটাই হয়ে গেছে ফুয়াদের গানের মতো— “সবই হবে অগোচরে জানবে না তো কেহ!” কিন্তু, প্রেম করাটা কি এতোটাই খারাপ কিছু? ধর্মের দোহাই দিয়ে ্যাপারটাকে ্যাবু বানিয়ে তোমরা শুধু দেখেও না দেখার ভান করছো। এর থেকে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে একটু আদর করে কাছে টানলে আমিও হয়তো তোমাদেরকে সত্যি কথাটা বলতে পারতাম। কতবার যে তোমাদের বলতে চেয়েছি, সামিয়া অনেক হট! নাহ, মানে সামিয়া অনেক সুন্দর। ওই আর কি! ধুর, সামিয়ার কথা বলতে গেলে মাথাটা একটু কম কাজ করে।

 

আমার সবচেয়ে খারাপ সময়টা কাটে এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর। জোর করে ধরে আমাকে একই সাথে বুয়েট এবং মেডিকেল ভর্তি কোচিং- পাঠিয়ে দিলে। কারণ, বাবা চায় আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো; আর আম্মু চায় ডাক্তার। একবার কি জানতে চেয়েছো যে, আমি কি চাই? আমিও তো একটা মানুষ! আমার ্যারিয়ার চয়েসের ডিসিশনটা কি আমার নেয়া উচিত না? তোমাদের বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন থাকলে নিজেরা পরীক্ষা দিয়ে চান্স কেন পাওনি? কেন নিজের ্যর্থতার বোঝাটা আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো? আর আমার উপর চাপিয়ে দেয়া বিষয়টা তো আমি কোন দিনই আগ্রহ নিয়ে পড়বো না! “বাবা-মা সন্তানের ভালো চানএই লাইনটা পরিবর্তন করে বলা উচিত— “বাবা-মা বিয়েবাড়িতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের সামনে সন্তানের প্রশংসা কুড়তে চান।

 

তোমরা আমাকে সবসময় বলেছো, যত বড় বিপদই হোক না কেন বাবা-মা আমাদেরকে সাহায্য করবে। কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রেই আমি হতাশ হয়েছি। আমার এক বান্ধবী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিজের বিশ্বাসভাজন কারো দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। কাউকে না পেয়ে সে আমার কাছে এসে সাহায্য চায়। আমি তাকে বললাম, “আমার বাবা-মা সবসময় বলতেন, যে কোন বিপদে বাবা-মার কাছে সবকিছু খুলে বলা উচিত।সে প্রথমে রাজি হলো না। পরে আমি জোর করে তাকে তার বাবা-মার কাছে নিয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, প্রভাবশালী পিতা হয়তো সেই পশুটার বিচার করবে। কিন্তু, প্রভাবশালী পিতা নিজের সামাজিক দূর্নামের ভয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমি পুরোপুরি হতাশ হয়ে বাবা-মার উপর থেকে

শ্বাস হারিয়ে ফেললাম। একজন মানুষ কীভাবে সমাজের ভয়ে নিজের মেয়ের উপর করা নির্যাতন সহ্য করে মেনে নেয় ?

 

সর্বদা ভালো ছেলেদের সাথে মিশবে, দুষ্টদের থেকে দূরে থাকবে।”— এই লাইনটার সাথে আমি একেবারেই একমত হতে পারি না। ক্লাস নাইনে আমি একটা ভাব-সম্প্রসারণ পড়েছিলাম— “উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।তোমরা আমাদেরকে ধরে বেধেঁ এই মধ্যম জাত বা এভারেজ বানিয়েছো। যেখানে স্কুলে আমাদেরকে দেখানো হয়েছে আকাশ ছোয়াঁর স্বপ্ন; বাসায় আমাদেরকে দিয়েছো কেরানী হবার ট্রেনিং। সত্যি কথা কি জানো? আমি ছোটবেলা থেকেই সবার সাথেই মিশতাম। আতেঁলদের কাছ থেকে নোট যেমন নিতাম তেমনি গুন্ডা-পান্ডাদের সাথে ফুটবল খেলতে দিয়ে রড় দিয়ে মাড়ামাড়িও করে আসতাম। তোমদেরকেই শুধু বলতাম না। মানুষ চেনার এই ট্রেনিংটা সবার ভাগ্যে জুটে না। কিন্তু, রিয়েল লাইফে আমরা সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়ি মানুষ চিনতে গিয়ে। তাই, দয়া করে দুষ্টদের থেকে দূরে থাকার শিক্ষাটা আর দিও না। বরং, ছোটবেলা থেকেই দুষ্ট-ভদ্র সবার সাথেই কীভাবে আচরণ করতে হয় সেটা শেখাও। বাস্তব জীবনে কাজে দিবে।

 

তোমরা ছোটবেলা থেকেই আমাকে শিখিয়েছো কীভাবে ফার্স্ট হতে হয়। একবারো কি বলেছো কীভাবে ফেইল করতে হয়? সত্যি কথা বলতে, জীবনে আমরা পাশের চেয়ে ফেইল অনেক বেশী করি। সেই ্যর্থতার গ্লানি কীভাবে কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাড়াঁতে হয় তা হতে পারতো তোমাদের কাছ থেকে শেখা আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষা। কিন্তু, আফসোস! তোমরা তো শুধু চেয়েছো গোল্ডেন ফাইভ। অনার্সে ফার্স্ট হওয়ার পর যখন মাস্টার্সে সেকেন্ড হলাম তখন মুখটা পেচাঁর মতো করে বসে রইলে। যদি খারাপ দিনের সাথী না হতে পারো তাইলে সুখের দিনের সারথীই বা কেন হতে চাও? আমার কোনদিন সন্তান হলে হয়তো তাকে একটাই কথা শেখাবো 

 

শোন, তুই ফেইল করবি। পরীক্ষায় না করলেও জীবনে ফেইল করবি। ফেইল করাটা নিশ্চিত। খালি একটা কথা জেনে রাখ, হোঁচট খাওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয়; জয়ের অনীহা থেকেই পরাজয়ের শুরু হয়।

 

 

সেই ছোটবেলা থেকে তোমরা আমার আগ্রহ, ভালোবাসার মানুষ, ্যর্থতা, যৌনতার মতো ্যাপারগুলোকে রীতিমতো অবজ্ঞা করে গিয়েছো। আর মাঝ বয়সে এসে এখন অভিযোগ করে বলে, “ছেলেটা আমার খালি বন্ধুদের সাথে থাকে; মেয়েটা আমার সারাদিন দরজা লাগিয়ে ঘরে বসে থাকে।দয়া করে তোমাদের সন্তান লালন-পালনের সিলেবাসটার একটা আপগ্রেড আসা দরকার। একটু সাহস করে বয়:সন্ধিকালে আমাদের সাথে এসে কথা বলো, পাশের সাথে সাথে ফেইল করাটাকেও স্বাভাবিক চোখে দেখো, ভর্তি পরীক্ষার আগে আমার নিজের আগ্রহের বিষয়টার কথা জানতে চাও আর ভালোবাসার মানুষটাকে বাসায় একদিন দাওয়াত দিয়ে খাওয়াও। কিন্তু তোমার হাতের বিরিয়ানী বেশ পছন্দ করে। গত ঈদে তোমার রান্না করা বিরিয়ানী টিফিন বাটিতে করে নিয়ে ওকে দিয়েছিলাম। ওর অনেক পছন্দ! 

 

্যরি, বেফাঁশ মুখে অনেক কথা বলে ফেলেছি। সকল বেয়াদবী ক্ষমা করে দিও। আর একটা কথা তোমাদের কখনোই বলার সাহস পাই না! আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি, সামিয়ার থেকেও তোমাদের প্রতি টানটা অনেক বেশী। ওকে প্রতিরাতে রুটিন করে একবার বলতে হয়। তোমাদেরকে একবারও বলার সাহস পাই না। আজ আবার বলতে চাই, I love you, Mom & Dad. You guys are gems.  

 

ইতি

 

১৪-২৫ বছর বয়সী সব বাংলাদেশী সন্তান

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

. এই চিঠিটি কাল্পনিক মনের চর্বিত চিন্তার বহি:প্রকাশ মাত্র। চিঠিতে ্যবহৃত প্রতিটি নাম কাল্পনিক। কোন চরিত্র অথবা নাম বাস্তবে কারো সাথে মিলে গেলে অবশ্যই লেখক দায়ী থাকবে।

. লেখাটি সকল বাবা-মার প্রতি উদ্দেশ্য করে লেখা। হয়তো এটি পড়ে তারা আমাদের মনের না বলা কথাগুলো সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবেন। সন্তানের সাথে বাবা-মার আরো খোলামেলা কথা হোক সেই কামনায় এই চিঠিটি লেখা হয়েছে।

 



Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.