যেভাবে কাটছে অক্সফোর্ডের দিনগুলি
Oxford Life

যেভাবে কাটছে অক্সফোর্ডের দিনগুলি

May 27, 2020   |    5171


সোম থেকে শুক্রবার আমি ল‍্যাবের বাসিন্দা। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানাই। ডিমের অমলেট, ব্রিয়োশ ব্রেড, জ‍্যাম আর একটা কলা। পেটপূজোর পর কাপড়-চোপড় পড়ে নিজের সাইকেলটাতে চেপে পাড়ি জমাই ল‍্যাবের উদ্দেশ‍্য। গন্তব‍্যস্থল হলো জন রেডক্লিফ হাসপাতাল। কিন্তু, আমার বাসা সিটি সেন্টারে। বাসা থেকে একটানা ১৭ মিনিট সাইকেল চালিয়ে মাঠ-ঘাট আর ছোট একটা পাহাড় পাড়ি দিয়ে অবশেষে শিশু হাসপাতালের পাশে এসে সাইকেলটা পার্ক করি। কার্ডিয়াক ডিপার্টমেন্টের পেছনের দরজাটা দিয়ে ঢুকে প্রায় ৫ মিনিট হাঁটলে অবশেষে আমার ল‍্যাবের দেখা মেলে। 


NDCLS. নাফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অফ ক্লিনিক‍্যাল ল‍্যাবরেটরী সায়েন্সেস। প্রথমেই চলে যাই আমাদের রিসার্চার রুম 4A17-এ। ব‍্যাগ থেকে ম‍্যাকবুকটা টেবিলে রেখেই দৌড় দেই সেল কালচার রুমে। মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখি আমার কালচারের সেলগুলো কেমন আছে। রুমে এসে তারপর বেশ কিছুক্ষণ সারা দিনের পরিকল্পনা করে সেটা ল‍্যাববুকে লিখে ফেলি। এরপর শুরু করি দিনব‍্যাপী এক্সপেরিমেন্ট। কোন দিন তা চলে ৫-৬ ঘন্টা; কোন দিন ৮-১০ ঘন্টা। 


বেলা একটার দিকে আমি সাধারণত নিজের রুমে এসে ফ্রিজ থেকে রান্না করা খাবারের বাটিটা বের করি। লাঞ্চের বিরতিটা সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট হয়। তারপর আবার ল‍্যাবে দৌড়। বেলা তিনটা নাগাদ আমার মাথা-ব‍্যথা শুরু হয়। তখনই নিজের আভিজ‍াত‍্যের আলিশান নিদর্শক কফি মেশিনটাকে আদেশ দেই। খর খর শব্দ করে বড় এক কাপ ল‍্যাটে তৈরি হয়ে যায়। কফিতে চুমুক দিতে দিতে মাঝে মাঝে ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রামটা চেক করি। আর ল‍্যাব বুকটা লিখে ফেলি। কফি শেষে আবার দৌড়।


রাত আটটা কি নয়টা নাগাদ অধিকাংশ দিনের কাজ শেষ হয়। আমার বসের মেজাজ ভালো থাকলে তার সাথে এরপর কিছুক্ষণ খোশ-আড্ডায় মাতি। ও চলে গেলে কিছুক্ষণ বৈজ্ঞানিক পত্রিকা পড়ি। সাড়ে নয়টা-দশটা নাগাদ আবার সাইকেলে চেপে ফিরে আসি বাসায়। ফ্রিজটা খুলে বক্সের খাবার গরম করি। নেটফ্লিক্সের নতুন কোন সিরিজ দেখতে দেখতে খাবার খাই। রুমমেট অভিষেকের সাথে মাঝে মাঝে গল্প করি। খাবার শেষে গোসল করে পিঠটা বিছানায় লাগাতেই অন্ধাকারের রাজ‍্যে হারিয়ে যাই।


পরদিন সকালে ঘুম ভাঙে সাড়ে সাতটায়। চলে সেই রুটিনের জীবন। এক্সপেরিমেন্ট শুধু বদলায়, জীবনটা বদলায় না। খারাপ কিন্তু লাগে না। বেশ মজা নিয়ে কাজগুলো করি। স্বপ্ন দেখি সারা জীবন এভাবে বিজ্ঞানকে ঘেটেঁ দেখার।


রুটিন জীবনটা ভাঙে শুক্রবার রাত আটটায়। ল‍্যাবে থেকে বাসায় না গিয়ে এবার হাজির হই ম‍্যাকের বাসায়। সেখানে অমিতা, মঞ্জি আর ইফতি আসে। গল্প জুড়ে সারা সপ্তাহের, কখনো ইচ্ছা হলো রাস্তায় গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করি। বেশ রাত করে শুক্রবার আমরা বাসায় ফিরি।


শনিবার ঘুম ভাঙে সাড়ে আটটায়। প্রথম কাজ হলো মা’মনিকে ফোন দেয়া। সারা সপ্তাহের গল্প একসাথে বলা হয়। এই একটা কলই মা-ছেলে আঁঠালো সম্পর্কটা বাচিঁয়ে রেখেছে। কল শেষে সাইকেল চেপে যাই উল্ফসন কলেজে। সেখানে ইফতির সাথে হয় আলিশান ব্রাঞ্চ। খাওয়া শেষে আমি সাপ্তাহিক মুদি দোকানের বাজার করে বাসায় রেখে আসি। শনিবার বিকালের কোন প্ল‍্যান থাকে না। শর্ত একটাই: কোন পড়াশোনা করা যাবে না। এক এক শনিবার এক একটা এক্সপেরিয়েন্স নেই।


রবিবার সকালে আমি আর অভিষেক বাসায় নাস্তা বানাই। আমি প‍্যানকেক গুরু, অভিষেক অমলেটের হেডশেফ। আমার নাস্তার শেষটা হয় এসপ্রেসো কফিতে। বান্ধবীর কাছ থেকে গিফট পাওয়া মোকা-পট যন্ত্রটা অভিষেক বেশ ভালো ভাবেই কাজে লাগায়। 


রবিবার দুপুরটা কাটে রান্না করে। ৪-৫ ঘন্টা ধরে রান্না করে আমি বক্সে ভরে ফ্রিজে সাজিয়ে রাখি। পুরো সপ্তাহের খাবার রেডি। বিকালের দিকে লন্ড্রি রুমে কাপড়গুলো মেশিনে ঢুকিয়ে লেখালেখি করতে বসি। সেই কাজের শেষটা হয় গোসল দিয়ে। রবিবার সন্ধ‍্যা ছয়টায় বাসায় এককাপ ল‍্যাটে বানাই। সেই কফিতে চুমুক দিতে দিতে আগামী সপ্তাহের প্ল‍্যান করে গুগল ক‍্যালেন্ডারে লিখে ফেলি। সবই যাতে ধরা-বাধাঁ জীবনে আটকে যায়।


কী? অনেক বেশি যান্ত্রিক মনে হচ্ছে? আসলে. নিয়ম মাফিক না চললে ডক্টরেট জীবন কষ্টকর হয়ে যাবে। তবে মাঝে মাঝে বসকে ইমেইল পাঠিয়ে আমি শুক্রবারটা ছুটি নিয়ে নেই। শুক্র-শনি-রবির ছুটিতে লন্ডন কিংবা গ্লাসগো ঘুরে আসি। জীবনটা সুন্দর হয়ে যায়। সামনের দিনগুলোতে হঠাৎ করে ইউরোপে উড়াল দেয়া ইচ্ছে আছে।


অক্সফোর্ড জীবনটা কঠিন এবং চ‍্যালেঞ্জিং। তবে জীবনটা অনেক মজারও। প্রায়ই কলেজের ফর্মাল ডিনার থাকে। সেই ডিনারের অভিজ্ঞতাগুলো হয় অতুলনীয়। সারা দিনের কঠিন পরিশ্রম শেষে সাইকেল চেপে অন্ধকার রাস্তা ধরে বাসায় ফেরার পথে প্রায়ই ধমকে দাঁড়াই শেল্ডনিয়ান থিয়েটার কিংবা র‍্যাডক্লিফ ক‍্যামেরার সামনে। মুহুর্তেই ক্লান্তির চেহারাটায় হাসির ঝলক আসে। মনে হয়, আমি কতটা ভাগ‍্যবান!


৯ ডিসেম্বর ২০১৮

ম‍্যান্সফিল্ড রোড, অক্সফোর্ড



Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.