পিএইচডি, ডিপ্রেশন, সায়েন্স
May 27, 2020 | 13688
এই পোস্টটা লেখার উদ্দেশ্য হলো আমার জীবনের ব্যর্থতাগুলো স্বীকার করা। ফেসবুকে আমার টাইমলাইন ঘাটলে যে সাফল্যমন্ডিত জীবনের দেখা মেলে তা নিছক এক মরীচিকা। বছরে হয়তো এক দিন আমি ভালো কিছু এক্সপেরিমেন্টে সাফল্য পাই; হয়তো তিনমাসে একবার নতুন কোন দেশে যেতে পারি। কিন্তু, আমার দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে সাধারণ চিত্র হলো এই ছবিটা।
ওয়েদারেল ইনস্টিটিউট অফ মলিকুলার বায়োলজি। ২০ নভেম্বর; রাত্র ২ টা ১৭ মিনিট।
কনফোকাল মাইক্রোস্কোপে প্রায় এক ঘন্টা ব্যয় করে একটি মাত্র ছবি তুলেছি। ছবিতে পাঁচটা ভিন্ন অণু একই সাথে দেখা যাবে। বাস্তবে এই কাজটা করা যে কত কঠিন তা কেবল একজন মলিকুলার বায়োলজির ছাত্রই বুঝতে পারবে। এই ছবি তোলার আগে চারদিন ধরে স্যাম্পলগুলো প্রসেস করেছি। তারপর এক ঘন্টা লাগিয়ে ছবি তুললাম। রাত ২ টা ১৫ মিনিটে বুঝতে পারলাম, এক্সপেরিমেন্ট কাজ করেনি।
কিন্তু, কেন?
কারণ, আমি খুবই সাধারণ একটা ভুল করেছি। ব্যাপারটা ২+২=৪ যোগ করার মতো সহজ একটা ধাপে ভুল করা। এই এক্সপেরিমেন্টের পেছনে প্রায় ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে; সাথে আমার এক সপ্তাহের রাতের ঘুম আর শরীরের ঘাম। ফলাফল হলো শূণ্য। এই রেজাল্ট নিয়ে বসের সামনে দাঁড়ালে কেয়ামত নাজিল হবে।
মাইক্রোস্কোপের অন্ধকার রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। করিডোরটা জনমানবহীন। বিশাল এই বিল্ডিং-এ আমি একা। হেলেদুলে এক কাপ পানি খেয়ে ক্যাফেতে প্রবেশ করলাম। নিজের ব্যর্থতার ভারে নুয়ে পড়লাম একটা সোফার ওপর। আমার মাথার ওপরে কাচেঁর আলিশান ছাদ। রাতের বেলা সেই কাঁচের ওপর আমার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে।
আমি যেন আজ দিকভ্রান্ত…
ভাবনারা কেন খুব ক্লান্ত?
জানিনা…
মনে মনে নিজের জীবনের পর্যালোচনা করতে থাকলাম। সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ বিকেল বেলা বাংলাদেশ থেকে অক্সফোর্ডে ফেরত এসেছি। মাত্র ২৪ ঘন্টার ডিসিশনে দেশে ছুটে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদের জন্য ইন্টারভিউ দিবো। জীবনের অনেক সার্টিফিকেট আর সিজিপিএ নিয়ে হাজির হয়েছিলাম সেই বোর্ডের সামনে। আমি বুঝতে পারলাম, চাকুরিটা তারা আমাকে দিবে না। কার্জন হলের প্রাঙ্গনে শিক্ষকতা করার অনেক দিনের স্বপ্নটা বেশ দুমড়ে মুচড়ে গেলো।
তারপর নিজের ব্যাংক একাউন্টটা খুলে দেখলাম। ২৪ ঘন্টার নোটিশে টিকেট কাটার কারণে খরচ পড়েছে ৯৫ হাজার টাকা। এখন বেঁচে আছে মাত্র এক সপ্তাহের খাবার খরচ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ৮ সেপ্টেম্বর ল্যাবে ঢুকি। ডিসেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত কোন সাপ্তাহিক ছুটি নেই নি। প্রতিদিন সকাল ৯-টায় ল্যাবে ঢুকেছি। ফেরত এসেছি রাত দুইটা তিনটায়।
ডিসেম্বরে আমার পিএইচডির প্রথম বড় ইন্টারভিউ। আমি গত একবছর এতো পরিমাণ কাজ করেছি যে এই ইন্টারভিউ আমার জন্য পানি ভাত। নভেম্বরের শেষ দিকে ঠিক করলাম এক সপ্তাহের ছুটি নিবো। আমার খুব পছন্দের একজন বান্ধবী আমস্টারডাম যাচ্ছে; তার সাথে গিয়ে অসাধারণ সেই শহরটা ঘুরে দেখবো। সবচেয়ে বড় কথা, তার সাথে দেখা করার জন্য অনেক ইচ্ছেও করছে। কারণটা খুব একটা যৌক্তিকও না।
তাই নভেম্বরের বসের কাছে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে আমস্টারডামের টিকেট কাটলাম। ১৫ হাজার টাকা চলে গেলো। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার বস ইমেইল করে জানালো, আমার ডিসেম্বরের ইন্টারভিউ এর ডেট এক সপ্তাহ এগিয়ে আনা হয়েছে। আমি বসের রুমে ঢুকে বললাম, “কি আর করার? আমি ছুটি নিচ্ছি না।” আমার সেই ১৫ হাজার টাকা গঙ্গার জলে ভেসে গেলো।
বসের রুম থেকে বের হয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। ইমেইলটার স্ক্রীণশট নিয়ে বান্ধবীকে পাঠালাম। বেচারী খুবই হতাশ হলো; তাকে এর জন্য দোষও দিতে পারি না। আমি আমার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফেরত গেলাম ল্যাবের ভিতর। সকাল নয়টা থেকে রাত ১টা। চলতে থাকলো আমার দিনগুলি।
২০ নভেম্বর আমার সেই বান্ধবীর সাথে আমস্টারডাম থেকে বার্লিন যাবার কথা। সকাল বেলা মেয়েটা আমাকে আমার সেই খালি প্লেনের সীটের ছবিটা পাঠালো। সাথে বললো, “তুমি থাকলো ভালো হতো!” আমি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ল্যাবে ঢুকলাম। ভাবলাম অন্তত সায়েন্স আমাকে হয়তো ভালোবাসবে।
সে রাতের ২ টা ১৭ মিনিট। আমি ব্যর্থতার ভাড়ে নুয়ে পড়েছি সেই সোফার উপর। নাহ! সায়েন্সে ব্যর্থতার জায়গা নেই। ছোট ভুলে অনেক বড় এক্সপেরিমেন্ট বাতিল হয়ে যায়।
But why do we fall, Bruce?
-So that we can learn to lift ourselves up.
কি আর করার? ফেরতে গেলাম বাসায়। পরদিন শুরু করলাম নতুন এক্সপেরিমেন্ট। নভেম্বরের ২৯ তারিখ আমি পাগলের মতো এই ক্যাফের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে বেড়িয়েছি। কারণ, সেই এক্সপেরিমেন্ট মিলেছে। একই সাথে প্রোটিন এবং RNA ডিকেক্ট করার নতুন একটা পথ আমি বাতলে ফেলেছি। আমার বস পরদিন সেই ছবি দেখে বললো, “শামীর, এটা অসাধারণ কাজ। তোমার এই আবিষ্কারের কথা আপাতত কাউকে বলো না। আমাদেরকে এখন রাতের আড়ালে কাজ করে অনেক ডাটা নিয়ে এই জিনিস পাবলিশ করতে হবে।”
৬ ডিসেম্বর। আমার ইন্টারভিউ। অক্সফোর্ডের দুজন বড় বিজ্ঞানী আমার কাজের রিভিউ করলেন। সাধারণত এই ভাইভাতে তারা পিএইচডি স্টুডেন্টদের অনেক হেনস্তা করেন। কিন্তু, আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিলো বেশ মজার। তারা আমার অদ্ভুদ প্রজেক্ট দেখে বেশ হতবাক। যেই মুহুর্তে বললাম, এই সব এক্সপেরিমেন্ট আমি করেছি আফ্রিকার এক ইউনিভার্সিটিতে বসে, সেই মুহুর্তে একজন বলে বসলো, “তোমরা মনে হয় রাতে ঘুমাও না।” তারা দুজনে মিলে আমার ভাগ্য লিখে দিলো: Passed without reservation.
ভাইভা শেষে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় একজন বললেন, “শামীর, আমি তোমার সাথে কাজ করতে চাই। তুমি এই এক্সপেরিমেন্টটায় আমার ল্যাবকে একটু সাহায্য করবে?” আমি হেসে বললাম, “I would love to”.
রাতে সেলিব্রেশন হলো। আমার যাবতীয় সকল বন্ধুবান্ধব “হাইজেনবার্গ, হাইজেনবার্গ” চিৎকার করতে করতে ব্যালিয়ল কলেজ থেকে অক্সফোর্ডের অলিগলি কাঁপিয়ে ফেললো। কী সুন্দর সময়!
৮ ডিসেম্বর; রবিবার। বন্ধের দিন। সকাল থেকে মনে হচ্ছিলো ল্যাবে গিয়ে সেই এক্সপেরিমেন্টটা আবার শুরু করা দরকার। আমি যদি ঘুমিয়ে দিন কাটাই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে কেউ একজন আমার আগে এই কাজ করে ফেলবে। নাহ! আমি ঘুমানোর মানুষ নই।
ফেরত গেলাম ল্যাবে। আমি তো পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য কাজ করি না। আমি কাজ করি অজানা সত্য বের করার জন্য। ইন্টারভিউ পাশ করেছি বলে তো আমার ল্যাবের কাজ বন্ধ থাকতে পারে না।
আবার ছুটলো আমার ট্রেন। এইবার মাইক্রোস্কোপে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছি। আমার বান্ধবী হেলেনার ব্যাচেলরেট পার্টি থেকে রাত ১০ টায় ফেরত গিয়েছি কনফোকাল মাইক্রেস্কোপে। পরদিন সকালে এক ব্রাইডস মেইডের বদলে একটা মাইক্রোস্কোপের সামনে ঘুম থেকে উঠেছি।
১৯ ডিসেম্বর। বসের সাথে বছরের শেষ মিটিং। সব কাজের রেজাল্ট বুঝিয়ে দিলাম। বস যা করতে বলেছে তার থেকে বেশী কাজ করে এনেছি। কেন? কারণ, আমার ভালো লাগে। বেশী বেশী অজানা তথ্য প্রথমবারের মতো বের করাটা আমার নেশা। কোকেইন-ইয়াবার থেকে এই জিনিসের নেশা বেশ কঠিন।
২০ ডিসেম্বর। বিকেল ৫-টা। বস আমার রুমে ঢুকে একটা হাগ দিয়ে বললো, “শামীর, দয়া করে আগামী কয়েকদিন ল্যাবে আসবে না। তোমার বিশ্রাম দরকার। কোথাও গিয়ে ঘুরে আসো। হ্যাভ আ নাইস ক্রিসমাস।”
আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলাম। একদিকে এই বছরের সফল এক্সপেরিমেন্ট আর ডাটার ভান্ডার পরে আছে। অন্য দিকে আছে সাতটা মিসড ফ্লাইট, অজস্র রাতের ঘুম আর কিছু দীর্ঘশ্বাস। ব্যাংক একাউন্টে আছে মাত্র ৪৭ পাউন্ড। এই ছুটিতে বাংলাদেশে যেতে হলে দরকার ১৫০০ পাউন্ড। সুতরাং সেই আশায় গুড়ে বালি। অগত্যা বাসায় এসে লিখতে বসলাম আমার পরবর্তী বই।
বাহির থেকে দেখলে আমার জীবনের মাইলস্টোনগুলো বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। আপনি ভাববেন, আহ কী সুন্দর জীবন। কিন্তু, আমি বলবো, “এটা একটা নেশাখোরের জীবন।” এই জীবনে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাটাই বেশী ভারী।
This addiction will render me poor, single and cold in my life. And I am not even sorry for it.