বিদায় বাংলাদেশ (১)
May 27, 2020 | 3735
২৫ নভেম্বর ২০১৭
অন্যান্য অবস্থাগুলো অপরিবর্তিত থাকলে আগামী ৫ নভেম্বর রাত ৯:০০ টায় ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের একটা ফ্লাইটে চড়ে আমি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবো। সেখানে জন রেডক্লিফ হাসপাতালের গবেষণাগারে একজন “Research Assistant” হিসেবে আগামী তিনমাস কাজ করতে যাচ্ছি। ভালো কিছু করে দেখাতে পারলে হয়তো সামনে অনেক রোমাঞ্চকর অফার আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
যারা আমাকে কাছ থেকে চেনে তারা সবাই জানে অক্সফোর্ডে যাবার ইচ্ছাটা আমার মাঝে কতটুকু প্রবল। গত ফেব্রুয়ারিতে ওদের কাছ থেকে পিএইচডি করার অফার পেয়েছিলাম। কিন্তু, ভালো কোন স্কলারশীপ না মেলায় পিএইচডিটা এবছর শুরু করা সম্ভব হলো না। আমি এতটাই গোড়া ছিলাম এ ব্যাপারে যে, অক্সফোর্ড ছাড়া অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন পর্যন্ত করিনি। (যদিও এই সিদ্ধান্তটা একটু প্রশ্নবিদ্ধ!)
When one door closes, thousand other doors open. যে ল্যাবে পিএইচডির জন্য চান্স পেয়েছিলাম তার প্রধান আমার ব্যাপারে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিগত তিনমাস তিনি এবং আমার ডিপার্টমেন্টের মুশতাক স্যারের সহযোগিতায় আমরা সবাই মিলে বেশ সুন্দর একটা রিসার্চ প্রজেক্ট দাঁড়া করিয়ে ফেলি। আমাদের সাথে University of Cambridge এর একদল গবেষকও কাজ করবেন। আমাদের গবেষণা ঠিকঠাক হলে কোলন ক্যান্সার সম্পর্কে আমরা সুন্দর কিছু তথ্য দিতে পারবো যা হয়তো এর চিকিৎসায় কাজে আসবে।
২০১২ সালে আমি যখন প্রথম বর্ষে পড়ি তখন মুশতাক স্যার অক্সফোর্ডে পিএইচডি করতে যান। প্রতিদিন তার ছবিগুলো দেখতাম আর বলতাম, “একদিন অক্সফোর্ডে অবশ্যই যেতে হবে”। এতো সুন্দর প্রাসাদতুল্য বাড়িগুলোর মাঝে সাইকেল চালিয়ে মৃদুমন্দ আবহাওয়ায় ঘুরে বেড়াতে নিশ্চয় অসাধারণ লাগবে। TimesHigherEducation এর র্যাংকিং মতে বিগত দু-বছর ধরেই অক্সফোর্ড বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানটি দখল করে আছে। এমন একটা জায়গায় পা রাখতে যাচ্ছি এটা ভাবতেই একটা শিহরণ জাগে।
মানুষ নাকি তার স্বপ্নের মতো বড়! আমিও তাই অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। তার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বিশ্বভ্রমণ। লেখালেখির অভ্যাসটাও আমাকে এখন অনেক বেশি মাত্রায় টানে। আগামী দিনগুলোর রোমাঞ্চকর/ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিনিয়ত আমার ওয়েবসাইটে ব্লগ প্রকাশ করতে থাকবো। আশা করি সে গল্পগুলো হয়তো আরো কিছু মানুষকে আমার মতো অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ-হার্ভাড-এমআইটির স্বপ্নে বিভোর করবে।
সবশেষে বিদায় বেলার কথাগুলো একটু বলে নেই। ১০ মিনিট স্কুলের সাথে আমার আত্মার বাধঁন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর যখন COO পজিশন থেকে রিসাইন করতে মুনজেরিনের হাতে চিঠিটা দিলাম সে সাথে সাথে অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে নিলো। আয়মান যতখানি হাসিমুখে সম্ভব আমার বিদায়টা সহজতর করেছে। ছেলেটার কাছ থেকে গত তিনটা বছরে অনেক কিছু শিখেছি। এই ছেলেটার কথা একদিন সারা বিশ্বের মানুষ অধীর আগ্রহভরে শুনবে— এটা আমি বাজি ধরে বলে গেলাম। শামসের সাথে রাতভর আর শ্যুটিং করা হবে না; এটা চিন্তা করতেই কেমন যেন লাগে। শুক্রবার রাত আর জিয়াউস শামস— আমার জন্য বেশ সমার্থক শব্দ হয়ে গিয়েছিলো। সামনের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে এই মানুষগুলোকে অনুভব করবো। আশা করি, আমাকে ছাড়া ওরা আগের থেকেও ভালো কিছু করবে। ইনশাল্লাহ।
শুভ ও স্বর্ণার প্রতি বিদায় বলাটা সম্ভব না। আমার মতো third wheel ছাড়া তোরা ডেটে গিয়ে মজা পাবি না। আমার মাকে বলে গিয়েছি কোন দরকার হলে তোদেরকে ফোন দিতে। মহিলাটাকে একটু সাহায্য করিস।
অনেক মানুষের সাথে যাবার আগে একবার দেখা করার ইচ্ছা ছিলো। গত একমাস ধরেই প্রতিদিন কারো না কারো সাথে তথাকথিত “শেষ দেখা” করছি। তারপরও সেই লিস্টটা শেষ করতে পারলাম না। হৃদয়ের কিছু জায়গা একটুখানি শূণ্যতায় মেখে রাখতে খারাপ লাগে না।
ভবিষ্যৎটা বেশ অনিশ্চিত। উচ্চ সিজিপিএ নিয়ে দেশে একটা ভালো চাকরি জুটানো খুব বেশি কঠিন কাজ ছিলো না। বিয়ে করে জীবনে তথাকথিত ‘সেটেল’ হলে পরিবারের মানুষজন হয়তো অনেক খুশি হতো। But, if you don’t take risk at 25, when would you? আমিও বার বার নিজেকে একথাই বলেছি। ভালো কিছু করতে হলে রিস্ক নিতে হয়। সেখানে ব্যর্থতার পাল্লাটা অনেক ভারী। কিন্তু, এমন চ্যালেঞ্জে সফলতার স্বাদও কিন্তু সবচেয়ে বেশি।
সবাই আমার জন্য মন থেকে শুভ কামনা করবেন। সুস্থ থেকে গবেষণার হালচালটা যাতে সহজে বুঝে উঠতে পারি।
ফ্রান্সে খুব সুন্দর ছোট ছোট পাপড়ির একটা ফুল হয়। প্রচলিত আছে, যে একবার সেই ফুলটাকে দেখেছে সারা জীবনে তার সৌন্দর্যের কথা ভুলতে পারেনি। ফরাসি ভাষায় ফুলটার নাম— “N’oublie pas moi” (নুবলিয়ে পা মোয়া)। ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “Forget Me Not”.
N’oublie pas moi. Please. <3