স্টেম সেল (পর্ব-২): কীভাবে খুঁজে পাবো
Jan 8, 2023 | 5059
এই সিরিজের আগের পর্বে আমরা শিখেছি:
× স্টেম সেল কি?
× স্টেম সেলের তিনটি বৈশিষ্ট্য
× স্টেম সেলের প্রকারভেদ
এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো স্টেম সেল সনাক্তকরণের উপায়। পদ্ধতিটা বেশ দীর্ঘ এবং কোন অঙ্গের স্টেম সেল খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক পর্যন্ত পার করে দেয়। আমি আমার সংকীর্ণ জ্ঞানের উপর ভর করে সেই সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনাদের একটু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো।
প্রথম ধাপ: মার্কার নির্বাচন করা
সাধারণত ধারণা করা হয়, স্টেম সেলগুলো তাদের কোষ আবরণীর উপর কয়েকটি বিশেষ প্রোটিন পতাকার মতো লাগিয়ে রাখবে যা দেখে বোঝা যাবে তারা আসলে স্টেম সেল। (এই ধারণাটির বেশ কিছু ব্যতয় পাওয়া গেছে। তবে আজকের আলোচনা সহজ ও বোধগম্য করার প্রয়াসে আসুন মেনে নেই, স্টেম সেলের কোষ ঝিল্লীর উপর একটি বিশেষ প্রোটিন থাকবে যা তার আইডি কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়।) স্টেম সেলের আবরণীতে অবস্থিত এই প্রোটিনকে আমরা বলতে পারি “স্টেম সেল মার্কার” বা “সনাক্তকারী প্রোটিন”।
কিন্তু, একেক অঙ্গের স্টেম সেলগুলোর আইডি কার্ড বা সনাক্তকারী প্রোটিন একেক রকম হবে। যেমন, নাড়িভুড়ির স্টেম সেল Lgr5 নামক একটি প্রোটিন প্রকাশ করে। অন্যদিকে, রক্তের স্টেম সেল CD34 নামক প্রোটিন প্রকাশ করে। এখন প্রশ্ন হলো, আমি কীভাবে জানবো কোন প্রোটিনটি একটি অঙ্গের স্টেম সেলের জন্য সনাক্তকারী প্রোটিন বা মার্কার?
আজকের যুগে সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো single cell RNA sequencing বা প্রতিটি কোষের সকল প্রকাশিত জিনের একটি প্রোফাইল তৈরি করা। এখন, আপনাদের নিজের তলানীবিহীন জ্ঞানের ঝুলি থেকে এই পদ্ধতি সম্পর্কে একটু ধারণা প্রদান করি।
Single Cell RNA Sequencing
ধরুন আপনি পরিপাকতন্ত্রের স্টেম সেলের মার্কার জানেন না। এখন প্রথমে আপনি পরিপাকতন্ত্রের কিছু নমুনা সংগ্রহ করবেন। তারপর ল্যাবের মাঝে সেই নমুনাটিকে কয়েকটি ধাপে ধাপে আলাদা করে পূর্ণাঙ্গ টিশ্যু থেকে একটি দ্রবণ তৈরি করবেন যাতে প্রতিটি কোষ আলাদা আলাদা হয়ে ভেসে থাকে। এই একক কোষের দ্রবণটিকে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে পাঠালে তারা টাকার বিনিময়ে এই সিকুয়েন্সিং করে দেয়। কীভাবে সেই রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয় তা ভবিষ্যতে কোন এক ব্লগে আলোচনা করবো।
কোম্পানিটি আপনাকে হার্ডডিস্কে ভর্তি করে কয়েক টেরাবাইট ডাটা দিবে। এখন শুরু হবে আপনার প্রোগ্রামিং দক্ষতার পরীক্ষা। কিছু কোডিং ভাষা (যেমন- R, Python ইত্যাদি) ব্যবহার করে এই বিশাল ডাটা (যাকে গলভরা ভাষায় Big Data বলা হয়) পর্যালোচনা করবেন। এই ডাটা হচ্ছে মূলত জিনের বহি:প্রকাশ ঘটেছে কিনা তার তথ্য। প্রতিটি কোষের DNA তে রয়েছে হাজার হাজার জিন। পরিপাকতন্ত্রের সকল কোষের এই DNA হুবহু একই (হাল্কা একটু মিথ্যা কথা। আপাতত মেনে নেন। কিচ্ছু করার নাই)। এই DNA-র মাঝে অবস্থিত জিনগুলো RNA তৈরী করে যা থেকে পররর্তীতে প্রোটিন তৈরী হয়। তাই, কোন কোষে একটি জিনের RNA পাওয়া গেলে তার মানে সেই কোষে সেই জিনটির বহি:প্রকাশ ঘটেছে। এই কথাটাকেই বিজ্ঞানীরা বলে থাকে Gene Expression.
পরিপাকতন্ত্রের সবগুলো কোষের DNA একই হলেও সকল কোষে বিদ্যমান RNA একই হবে না। কারণ প্রতিটি কোষ তার নিজ নিজ প্রয়োজন অনুসারে বিশেষ বিশেষ জিনের RNA প্রকাশ করবে। তাই এই RNA-র পরিচয় জানতে পারলেই সেই কোষটির পরিচয় জানা যাবে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় Gene Expression Profiling. একটু সহজ বাংলায় বলতে গেলে, কোষের প্রকৃত পরিচয় লুকায়িত তার RNA-র মাঝে, DNA-তে নয়! আমাদের শরীরের সকল কোষের DNA একই, কিন্তু, তাদের RNA profile ভিন্ন।
এখন প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে সিকুয়েন্সিং ডাটা পর্যালোচনা করে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়:
১. পরিপাকতন্ত্রের নমুনাটিতে কয় ধরণের কোষ আছে?
> Gene Expression Profiling (প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে) করার পর দেখা যাবে পরিপাকতন্ত্রের হাজার হাজার কোষ গুলোকে তাদের RNA সম্ভারের উপর ভিত্তি করে মাত্র ১০-১৫টি দলে ভাগ করা যায়। এই প্রতিটি দলের সবগুলো কোষের RNA-র সম্ভার প্রায় একই রকম। অন্যদিকে একটি দলের সাথে অন্য দলের RNA-র সম্ভার বেশ ভিন্ন। প্রতিটি কোষের RNA-র সম্ভারের উপর ভিত্তি করে সবগুলো কোষকে কয়েকটি দলে ভাগ করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় clustering বা দল-বিভাজন। সাধারণ, একটি নমুনায় যতগুলো ক্লাস্টার বা দল পাওয়া যায় সেই নমুনায় ততগুলো ধরণের কোষ রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়।
২. কোন কোষটির স্টেম সেল হবার সম্ভাবণা বেশী?
> এই ধাপটি প্রমাণ করে বিজ্ঞানী হিসেবে আপনার চিন্তাশক্তি কতটা প্রখর। ইতোমধ্যে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকা পড়ে এখন আপনাকে এই ১০-১৫টি দল থেকে মাত্র ১-২টি দল নির্বাচন করতে হবে যারা সম্ভাব্য স্টেম সেল হতে পারে। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে মানুষ বলে গেছে পরিপাকতন্ত্রের কোন কোষে কোন ধরণের জিন প্রকাশিত হচ্ছে বা কোন কোষে কোন RNA পাওয়া যাবে। যেমন- মিউকাস নি:সরণ কারী কোষগুলোতে Muc2, হরমোনাল কোষে ChrA জিনের RNA-র দেখা মেল। সুতরাং, যেই ক্লাস্টারগুলোতো এই RNA গুলোর উপস্থিতি পাওয়া যাবে তাদেরকে আলোচনা থেকে বাদ দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত একটি মাত্র দল বের করতে হবে। একটা মজার ব্যাপার হলো, যেকোন অঙ্গে স্টেম সেলের সংখ্য খুবই অল্প, মাত্র ১-৩%। তাই যে ক্লাস্টার বা দলে সবচেয়ে কম কোষ থাকে তারা আমাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় পছন্দ হতে পারে।
৩. আমাদের পছন্দের ক্লাস্টারে কোন RNA-গুলো স্বকীয়?
> আপনি যে ক্লাস্টারটিকে সম্ভাব্য স্টেম সেল হিসেবে নির্বাচন করলেন এখন সেই ক্লাস্টারের মাঝে প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে বের করবেন কোন জিনের RNA-গুলো শুধু এই কোষগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে এবং অন্যকোন ক্লাস্টারে প্রকাশিত হচ্ছে না। এরাই হবে আপনার সম্ভাব্য মার্কার জিন যাদের দ্বারা প্রকাশিত প্রোটিনগুলো স্টেমসেলের প্রাচীরে পতাকার মত প্রকাশিত হক পারে।
দ্বিতীয় ধাপ: মার্কার নিশ্চিতকরণ (Marker validation)
প্রোগ্রামিং-এর জগত থেকে এখন ফেরত যাবেন ল্যাবে। আপনার প্রতিটি মার্কারে জন্য একটি করে ইঁদুর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে সৃষ্টি করতে হবে। মূল ধারণাটি হলো এরকম: আপনি দেখতে চান X প্রোটিনটি কি স্টেম সেলের মার্কার? এখন X-প্রোটিনটির জিনের মাঝে একটু কারসাজি করতে হবে ল্যাবের ভেতর। প্রতিটি জিনের শুরুতে একটি সুইচ থাকে, তারপর প্রোটিনের কোড আর শেষে একটি অফ সিগন্যাল। DNA-এর মাঝে ব্যাপারটি দেখতে এরকম:
[সুইচ]—[X-প্রোটিনের কোড]—[অফ সিগন্যাল]
সুইচ: আসল নাম promoter. এই সুইচ নির্ধারণ করে একটি কোষে এই জিনটি প্রকাশিত হবে কিনা। এই সুইচ না থাকলে সব জিনই সব সময় প্রকাশিত হয়ে একটা কাইজ্জা সৃষ্টি করতো।
প্রোটিনের কোড: A,T,C,G নামক চারটি রাসায়নিক অনুর সমন্বয়ে সৃষ্টি একটি কোড। এই কোড পরে রাইবোসোম প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় translation.
অফ সিগল্যাল: একটি জিনের কোড কোথায় শেষ হয়েছে তা বোঝানোর জন্য এই সিগন্যাল থাকে। এটা না থাকলে পর পর অবস্থিত দুটি জিনের মাঝে ঝামেলা সৃষ্টি হতো।
এখন ল্যাবের ভেতরে কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই সু্ইচের পরে একটি রিপোর্টার ঢুকাতে হবে। সবচেয়ে প্রচলিত রিপোর্টার হলো Green Fluorescent Protein (GFP) যা সবুজ হয়ে জ্বলতে থাকে। সুতরাং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে আমরা নিচের DNA-টি সৃষ্টি করবো:
[সুইচ]—[GFP প্রোটিনের কোড]—[X-প্রোটিনের কোড]—[অফ সিগন্যাল]
এখন এই নতুন DNA-টি ইঁদুরের ডিম্বকের মাঝে ঢুকিয়ে সেটিকে জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হবে। তারপর নতুন যে বাচ্চা ইঁদুর জন্ম নেবে তার X-জিনের কোডের মাঝে এখন GFP ঢুকে বসে থাকবে। যখনই X-জিনের সুইচ অন হবে সাথে সাথেই GFP প্রোটিন প্রকাশিত হবে এবং কোষটি সবুজ হয়ে জ্বলে উঠবে।
এখন এই বাচ্চা ইঁদুর একটু বড় হলে তার পরিপাকতন্ত্রের নমুনা সংগ্রহ করে তাকে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে দেখতে হবে। যদি X আসলেই স্টেম সেলের মার্কার হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাবে শুরুতে মাত্র কয়েকটি কোষ সবুজ হয়ে জ্বলছে (কারণ স্টেম সেলের সংখ্যা খুবই কম)। তারপর সেই স্টেম সেল গুলো থেকে যখন পরিপাক তন্ত্রের অন্যান্য কোষ তৈরি হবে তখন সেই কোষগুলোও সবুজ হয়ে জ্বলতে থাকবে। কয়েক মাস অপেক্ষা করলে দেখা যাবে, পুরো পরিপাকতন্ত্রটাই সবুজ হয়ে জ্বলছে। তাহলে প্রমাণিত হবে, X-জিনটি পরিপাকতন্ত্রের স্টেম সেলের মার্কার। কারণ, X-জিন প্রকাশকারী কোষগুলো পুরো পরিপাকতন্ত্র সৃষ্টি করতে পারছে। এই পদ্ধতিতে স্টেম সেলের মার্কার সনাক্তকরার উপায়কে বলা হয় “Genetic Lineage Tracing”।
কিন্তু, যদি X জিনটি পুরো অঙ্গ তৈরি না করতে পারে তবে সেটি স্টেম সেলের মার্কার নয়। তখন কি করবেন?
কয়েক মাস ডিপ্রেশনে ভুগবেন কারণ আপনার কয়েক বছরের কষ্ট পানির জ্বলে ভেসে গেছে। তারপর কাউন্সেলিং আর থেরাপির পর ল্যাবে ঢুকে মার্কারের লিস্টের পরবর্তী Y-জিনটিকে একই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে দেখবেন। সেটা কাজ না করলে Z। আর ল্যাবের অনেক টাকা থাকলে দশজন পিএইচডি ছাত্র এনে তাদেরকে কুত্তার মতো খাটিয়ে একই সাথে দশটা জিনই পরীক্ষা করে দেখবেন। নয়জন নেগেটিভ রেজাল্ট পেয়ে ডিপ্রেশনে ভুগে রিসার্চ ছেড়ে দিবে। একজন ভাগ্যের বশবর্তী হয়ে সফল হবে। তার পেপার পাবলিশ হবে; সবাই বাহবা দিবে। যদিও সবাইকেই সমান পরিমাণ বাহবা দেয়া উচিত। কিন্তু, আমাদের পৃথিবীটাকে সাজানো হয়েছে সফলদের স্বপ্নের দুনিয়া হিসেব। ব্যর্থদের তেমন বেল নাই!
এই ব্লগের কভারে যেই ছবিটা দেখা যাচ্ছে তা নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে নেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে ডাচ বিজ্ঞানী হ্যান্স ক্লীভারের দল Genetic Lineage Tracing ব্যবহার করে প্রমাণ করে দেখিয়েছে Lgr5 নামক প্রোটিন প্রকাশকারী কোষগুলো পরিপাকতন্ত্রের স্টেমসেল হিসেবে কাজ করে। এই ভদ্রলোকের আগামী ১০ বছরে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী।
এই পর্বে আমরা আলোচনা করলাম:
× স্টেম সেলের মার্কার কি?
× অজানা স্টেম সেলের মার্কারের লিস্ট কীভাবে তৈরি করতে হয়?
× স্টেম সেলের আসল মার্কার কিভাবে প্রমাণ করতে হয়?
× বিজ্ঞানের জগতে হতাশ হবার সম্ভাবনা কতটা বেশী?
আগামী পর্বে আলোচনা করা হবে স্টেম সেলকে ল্যাবের মাঝে সৃষ্টি করার পদ্ধতি সম্পর্কে। চোখ রাখুন আমার এই ব্লগে।