ভোতে কোসির বাঞ্জি জাম্প
Jun 8, 2018 | 7689
নেপাল-চীনা
সীমান্তের গা
ঘেঁষে বয়ে
গিয়েছে খরস্রোতা
নদী- “ভোতে
কোসি”। হিমালয়ের
বরফ গলা
পানি পাথরের
বুক চিড়ে
চলতে চলতে
প্রবেশ করেছে
তিব্বতের রাজ্যে। সেই ভোতে
কোসি থেকে
১৬০ মিটার
উঁচুতে দুই
পাহাড়ের মাঝে
ঝুলছে একটা
ব্রীজ। সেই
ব্রীজের মাঝখানটায়
বের হয়ে
আছে ছোট্ট
একটা পাটাতন।
একটা লম্বা নি:শ্বাস নিন।
এবার, চিন্তা
করুন, আপনি
দাড়িঁয়ে আছেন
সেই কাঠের
তক্তার উপর।
পায়ের ১৬০
মিটার নিচে
ছুটে চলেছে
ভোতে কোসির
সেই উন্মত্ত
স্রোত। পেছন
থেকে কেউ
একজন বললো:
Three,
Two, One, Bunjee…
আর আপনি
লাফিয়ে পড়লেন
বাতাসের রাজ্যে অভিকর্ষের টানকে
ভালোবেসে। গ্যালেলিওর পড়ন্ত
বস্তুর সূত্রানুসারে
প্রতি সেকেন্ডে
আপনার গতি
বাড়বে প্রায়
৯.৮মিটার/সেকেন্ড করে।
এভাবে পাচঁ
সেকেন্ড পর
আপনি আবিষ্কার
করবেন, ভয়
বলে আপনার
আর কিছু
নেই।
ভাবতেই রোমহর্ষক লাগছে?
১০ মিনিট
স্কুলের বন্ধুদের
সাথে নিয়ে
২০১৭ সালের
২৩ জুন
আমার জীবনের
প্রথম বাঞ্জি
জাম্প করে
আসলাম। এই
দিনটার জন্য দীর্ঘসময় যাবৎ
অধীর আগ্রহে
অপেক্ষা করছিলাম।
যেকোন উচুঁ
বিল্ডিং-এর
উপরে উঠলেই
আমার হাত
ঘামতে থাকে,
কেমন যেন
ভয় হয়।
নিজের এই
“Fear of Height” কাটানোর জন্য অবশেষে বাঞ্জি
জাম্পটা দিয়ে
ফেলার সিদ্ধান্ত
নিলাম।
দিনটা ছিলো
শুক্রবার। আমাদের
নেপাল ভ্রমণের
পঞ্চম দিন।
সকাল পাচঁটায়
সূর্য মামা
উঠার আগেই
আমাদের বন্ধু
সাকিব মঞ্জুর
জিহান সবাইকে
ডেকে তুললো।
ভোর ছয়টা
নাগাদ আমরা
“The Last Resort” এর কাঠমন্ডুর
অফিসে হাজির।
দেখলাম আমরা
ছাড়াও আরো
২৫-৩০
জন এই
পাগলামিতে আমাদের
সঙ্গী হবে।
বেলা সাড়ে
ছয়টা নাগাদ
বাস ছাড়লো।
প্রায় তিন
ঘন্টা পর
যাত্রা বিরতিতে
আমরা সকালের
নাস্তা করে
নিলাম। বাসে
ঘটলো বেশ
মজার এক
ঘটনা। এক
ফরাসি সুন্দরী
নারীকে পটানোর
জন্য
আমাদের জনৈক
নেপালী ভাই
উঠে পড়ে
লাগলেন। তার
এই কান্ডকীর্তি
জিহান সামনের
সীটে বসে
আমাদের সবার
জন্য
অতি শুদ্ধ
বাংলায় বর্ণণা
করতে লাগলো।
আমাদের ধারণা,
বাসে কেউ
বাংলা জানে
না। সুতরাং,
বাংলায় বিচিং
করলে কেউ
বুঝবে না।
প্রায় ঘন্টা
খানেক এই
কান্ড ঘটানোর
পর বাসের
পেছনের সীট
থেকে দুই
ভাই স্পীকারে
বাংলা গান
ছেড়ে বুঝিয়ে
দিলেন তারাও
আমাদের সাথে
আছেন। আমরা
তখন হাসতে
হাসতে মাটিতে
গড়াগড়ি খাচ্ছি।
বেলা এগারোটা।
বাস থামলো
ভোতে কোসি
নদীর পাশ্ববর্তী
দুই পাহাড়ের
ধারে। The Last Resort একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যারা
বিশ্বের বিভিন্ন
স্থানে ভ্রমণমূলক
আকর্ষণ সৃষ্টি
করে থাকে।
নেপালের দুটো
পাহাড় তারা
ভাড়া নিয়ে
তৈরি করেছে
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের
এক অসাধারণ
রাজ্য।
নদীর উপরে
ঝুলিয়ে দিয়েছে
এক বিশাল
ব্রীজ। সেখানে
থেকে হয়
তাদের বাঞ্জি
জাম্প। আর
ব্রীজের ওপারে
পাহাড়ের কোলে
রয়েছে ছোট
ছোট তাবু।
সেই তাবুতে
রাত কাটানোর
সৌভাগ্য
হয় কিছু
মানুষের।
ঝুলন্ত সেই
ব্রীজ দিয়ে
হেঁটে যাবার
সময়ই আমাদের
বেশ ভয়
ভয় লাগছিলো।
নীচে তাকাতেই
পা থমকে
যাচ্ছিলো। রিসোর্টে
পৌছেঁ আমরা
সবাই প্রথমে
ফ্রেশ হয়ে
ব্রিফিং সেশনে
যোগ দিলাম।
একজন ট্রেইনার
আমাদের সবাইকে
বাঞ্জি জাম্পের
অ-আ-ক-খ বুঝিয়ে
বললেন। শুধু
বাঞ্জি জাম্প
করতে খরচ
৮০ ডলার।
আর বাঞ্জি
এবং ক্যানিয়ন সুইং
একত্রে করতে
১২০ ডলার
লাগে। এই
দামের মধ্যে যাতায়াত খরচ
এবং দুপুরের
খাবারও অন্তর্ভূক্ত।
আমাদের সবাই
বাঞ্জি+সুইং
প্যাকেজে
নাম লিখিয়ে
নিলাম।
শুরুতেই সবার
ওজন মেপে
সেই অনুপাতে
দল ভাগ
করা হলো।
হালকা মানুষ
প্রথমে লাফ
দিবে, আমার
মতো মোটারা
পরে। তাই
প্রথম ঘন্টা
দুয়েক আমি-শামস-যুবায়ের দূরে
দাঁড়িয়ে শুভ-সিকি-জিহানের লাফ
দেয়া দেখতে
থাকলাম। অবশেষে
ডাক পড়লো
আমাদের।
ব্রীজের উপরে
প্রথমে আমার
শরীরে সুরক্ষা
বেল্ট পড়িয়ে
দেয়া হলো।
বাঞ্জিতে পা
বাধাঁ থাকে।
সুতরাং শরীরের
উপরের অংশকে
সামনে ঠেলে
লাফ দিতে
হয়। আপনি
শত অনুরোধ
করলেও ট্রেইনার
আপনাকে ধাক্কা
দিবেন না।
কারণ, নিজের
ভয়কে জয়
করতে হলে
ইচ্ছা শক্তির
পরিচয় দিতে
হয়। বাঞ্জি
জাম্পটা তাই
করতে হবে
আপনার নিজের
ইচ্ছায়।
একজন ভিডিও
গ্রাফার এসে
আমার একটা
ছোট খাটো
ইন্টারভিউ নিয়ে
গেলেন। আমি
লাইনে দাঁড়িয়ে;
আমার পেছনে
আছে শামস।
আমরা দুইজন
তখন নিজেদের
নার্ভাসনেসের চূড়ান্ত
দশা বর্ণনায়
ব্যস্ত।
শামস: শামীর
ভাই, আমি
জোড়ে একটা
ঢেকুড় দিলেই
গলা দিয়ে
বীচি বের
হয়ে আসবে।
আমি: নিচে
যেই ছোট
ছোট পাথর
দেখা যায়
ওই খানে
নেমে পরে
খুজেঁ দেখতে
হবে।
যতটা সম্ভব
হাসি তামাশায়
নিজেদের শান্ত
রাখার ব্যর্ত প্রচেষ্টা করছিলাম।
আমার আগে
একজন ভাই
পাটাতনের উপর
ছয় সাতটা
চেষ্টা করেও
লাফটা দিতে
পারলেন না।
আমি তাই
সিদ্ধান্ত নিলাম,
পাটাতনের উপর
দাড়িঁয়ে দ্বিতীয়
কোন চিন্তা
না করেই
লাফ দিবো।
যেই কথা,
সেই কাজ..
ব্রীজের দুপাশে
লাগানো দড়ির
নীচ দিয়ে
পাটাতনের উপর
দাড়াঁলাম। আমার
দুই পা
রশিতে বাধাঁ।
বন্দী পা
জোড়াকে আস্তে
আস্তে করে
পাটাতনের কিনার
পর্যন্ত নিয়ে
গেলাম। আমার
ট্রেইনার পেছন
থেকে আমার
বেল্ট ধরে
রেখেছেন। হঠাৎ
করেই তিনি
বললেন, Three, Two, One, Bunjee…
ব্যস!
আমি শরীরটাকে
কাঠের তক্তার
কিনারা থেকে
ফেলে দিলাম।
বাতাস আমার
কানের দুপাশ
দিয়ে সুড়
সুড় করে
চলে যাচ্ছে।
আর আমি
মাথা নীচের
দিকে দিয়ে
পড়ছি ভোতে
কোসি নদীর
উপরে। প্রথম
সেকেন্ডে ইচ্ছামতো
নিজেকে গালি
দিলাম। কী
দরকার ছিলো
এইসব কাজ
করার? এতো
ভয় লাগছে
তা বলে
বোঝানো সম্ভব
না। দ্বিতীয়
সেকেন্ডে বুঝলাম
আমি ওজনহীন।
নিজের শরীরটা
খুবই হাল্কা
লাগছে। তৃতীয়
সেকেন্ডে দেখলাম
আমি নদীর
প্রায় দশ
ফিট উপরে
আছি। হঠাৎ
অনুভব করলাম
বাঞ্জির দড়িতে
টান লেগেছে।
রবারের তৈরি
এই দড়ি
আমাকে আবার
উপরে নিয়ে
যাচ্ছে। তার
কিছুক্ষণ পর
আমাকে আবার
নিচে ফেলে
দিলো; তারপর
আবার টেনে
উপরে তুললো।
আমি যেন
এক ছেলে
খেলার বস্তু
মাত্র!
প্রায় পাচঁ-দশ সেকেন্ড ধরে
আমি গলা
ফাটিয়ে চিৎকার
করছি। হাতে
লাগানো গো-প্রো ক্যামেরায়
ধারণকৃত ভিডিও
দেখে পরে
বুঝছি, আমি
আসলে অনেক
ভয় পাচ্ছিলাম।
অবশেষে আমার
ঝোলাঝুলি থামলো।
পায়ে লাগানো
রশিটা এক
টানে খুলে
ফেললাম। তারপর
কোমড়ে লাগানো
বেল্টের সাহায্যে আমাকে টেনে
আবার উপড়ে
উঠানো হলো।
নিজের ভয়কে
সদ্য
জয় করা
এক শিশুর
মতো লাফাতে
লাফাতে আমি
ব্রীজের উপরে
উঠে আসলাম।
দেখলাম, জুবায়ের
এবার প্রস্তুতি
নিচ্ছে লাফ
দেবার। আমাকে
তখন পাশের
ক্যানিয়ন
সুইং করতে
নিয়ে যাওয়া
হলো।
ক্যানিয়ন
সুইং-এ
বাঞ্জির থেকে
বেশী লম্ব
সময় ধরে
নীচে পড়তে
হয়। বাঞ্জিতে
রশি বাঁধা
থাকে পায়ে;
তাই আপনি
নিচে পড়ে
উপরে উঠে
আসবেন। আর
সুইং-এ
রশি বাধাঁ
থাকে কোমড়ে।
নিচে পড়ে
তাই আপনি
দুই পাহাড়ের
মাঝে পেন্ডুলামের
মতো দুলতে
থাকবেন। সেই
থেকে এই
চ্যালেঞ্জটির
নাম “canyon
swing”.
সদ্য
বাঞ্জি জাম্প
করে আসায়
আমার ভয়
তখন অনেকটাই
কেটে গেছে।
সুইং-এর
জন্য
তৈরি হয়ে
আমি এবার
মোটামুটি হাসতে
হাসতেই লাফ
দিলাম। পেন্ডুলামের
আগায় বাধাঁ
ববের মতো
আমি নেপালের
দুটো সবুজ
পাহাড়ের মাঝে
দোল খাচ্ছি;
আর দুই
হাত ছড়িয়ে
দিয়ে চিৎকার
করছি। নিজের
এই শিশুতোষ
আচরণগুলো ভিডিও
করেও রেখেছি।
প্রতি পাচঁ
বছর পর
পর এটা
দেখে নিজের
মানসিক জড়তা
কাটাবো।
দোল খাওয়া
শেষ হওয়ার
সময় আমার
রশিটা পাহাড়ের
পাশ থেকে
একজন ধরে
ফেললো। এবার
আর ব্রীজে
তোলা হবে
না। আমি
রশি টেনে
চলে গেলাম
পাহাড়ের ধারের
ছোট একটা
স্টেশনে। সেখানে
আমার জন্য এক বোতল
পানি হাতে
একজন লোক
অপেক্ষা করছিলো।
পানি হাতে
ধরিয়ে দিয়ে
সে বললো:
Follow
these signs and go up. It’s only 1500 steps!
বাহ! পনেরোশো
ধাপের সিড়িঁ।
তাও আবার
অসাধারণ এই
প্রাকৃতিক পরিবেশে।
আমি তখন
খুশিতে আত্মহারা।
সিড়িঁ বেয়ে
কখনো পাহাড়ের
উপরে উঠছি,
কখনো নিচে
নামছি। হঠাৎ
দেখি বিশাল
এক পাথরের
উপর জিহান
বসে আছে।
একা এই
লম্ব পথ
পাড়ি না
দিয়ে সে
আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো।
দুজনে মিলে
সেই পাথরের
উপর বসে
ভোতে কোসির
জলে পা
ভাসিয়ে দিলাম।
বরফ শীতল
সেই পানি
যেন শরীর
কাপিঁয়ে তোলে।
কিছুটা ঠান্ডায়,
বেশিটা রোমাঞ্চে।
কিছুক্ষণ পর
দেখলাম যুবায়ের
আসছে। কেন
যেন ওকে
নীচে রেখেই
আমরা উপরে
যাবার সিদ্ধান্ত
নিলাম। মাঝে
মধ্যেই
নিচে তাকিয়ে
যুবায়েরের অবস্থা
দেখছি। একটা
ছোট ঝর্ণা
নিচের দিকে
বেয়ে পড়েছে।
সেই ঝর্ণার
পানিতে দেখলাম
যুবায়ের গলা
ভিজিয়ে জীবন
বাঁচালো। আমি
আর জিহান
ধীরে ধীরে
সেই বিশাল
পাহাড়ের সিড়িঁ
বেয়ে উঠতে
থাকলাম। প্রায়
৪০ মিনিট
পর ঘর্মাক্ত
অবস্থায় আমরা
নিজেদের আবিষ্কার
করলাম বেইস
ক্যাম্পে।
সেখানে আমাদের
জন্য
অপেক্ষা করছে
সিকি আর
শুভ।
প্রথমে বসেই
ঢক ঢক
করে এক
বোতল পানি
সাবাড় করলাম।
হাত-মুখ
ধুয়ে লাস্ট
রিসোর্টের বাগানের
টেবিলে বসে
আড্ডা দিচ্ছি।
সামনের টেবিলে
এক বিদেশিনী
আগ্রহ নিয়ে
হাসি দিলো।
তার সাথে
গল্প শুরু
করলাম। ‘সারাহ’ জাতিতে
ফ্রেঞ্চ, পেশায়
আইনজীবী। জীবনের
জড়তা কাটাতে
সে গত
৪৫ দিন
ধরে এই
লাস্ট রিসোর্টের
তাবুঁতে পড়ে
আছে। প্রতিদিন
সকালে ঘুম
থেকে উঠে
সে “ইয়োগা” করে।
তারপর সারাদিন
ধরে বই
পড়ে, অজানা
মানুষজনের সাথে
আড্ডা দেয়।
ওর গল্পটা
শুনে অনেক
উৎসাহিত হলাম।
ঠিক করলাম,
জীবনে কোন
একদিন আবার
লাস্ট রিসোর্টে
গিয়ে একা
এক সপ্তাহ
থেকে আসবো!
বেলা দুটায়
খাবার এলো।
বুফের মেন্যুটা বেশ সমৃদ্ধ
ছিলো; আর
পেটে বিদ্যমান ছিলো ভয়ানক
ক্ষুধা। নিজেদের
মন ভরিয়ে
খাবার খেলাম।
ছোট ছোট
পিস করে
কাটা তরমুজ
খেতে অনেক
শান্তি লাগছিলো।
খাবার শেষে
বন্ধুরা বসে
গল্প বাধঁলাম।
দেখতে দেখতে
শেষ করে
ফেলেছি আমাদের
পাচঁদিনের নেপাল
ভ্রমণ। বেলা
পাচঁটায় বাসে
চড়ে বসলাম।
রাত ন’টায় কাঠমন্ডুর হোটেলে
ফিরলাম। শরীর
জুড়ে নেমে
এসেছে রাজ্যের ক্লান্তি, আর
মনটা ভরে
উঠেছে প্রশান্তিতে।
ভয় একটা
দুর্বোধ্য
ব্যাপার।
লাস্ট রিসোর্ট
থেকে ফেরার
সময় সেই
ব্রীজ দিয়ে
হেটেঁ আসতে
আবার ভয়
লাগছিলো। কিন্তু,
এবার ভয়ের
থেকেই বেশী
লাগছিলো আনন্দ!
Twenty years from now you will be more disappointed by the things you didn’t do than by the ones you did. So throw off the bowlines, sail away from the safe harbor, catch the trade winds in your sails. Explore. Dream. Discover. (Mark Twain)
১. কাঠমন্ডু
২. রিভার রাফটিং