ভূটান ভ্রমণ
Sep 3, 2018 | 13795
ড্রাগন রাজ্যের ইতিকথা
পরিবেশ দূষণের এই যুগে পৃথিবীতে কার্বন নেগেটিভ দেশ আছে মাত্র একটি। দেশটার নাম ভূটান। অনেকেই ভূটানকে বলে থাকে অক্সিজেনের রাজ্য। ভূটানীজ মানুষজন নিজেদেরকে “ড্রাগনের দেশের বাসিন্দা” বলতেও পছন্দ করে। তাদের বিমান কোম্পানী Druk Air এর ট্যাগ লাইন হলো- Fly in the wings of Dragon. তাই, প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির আভিজাত্য উপভোগ করতে চাইলে ভূটানের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশের নাগরিকরা ভূটানে বিনা-ভিসায় ভ্রমণ করতে পারে। সুতরাং, আমি আর আমার অক্সফোর্ডীয় বন্ধু ম্যাক ২৮ জুলাই ২০১৮ তারিখে ধানমন্ডির নর্থ এন্ড কফি শপে বসে দুই ঘন্টার মধ্যে ভূটান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
আমি ভ্রমণের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী; অন্যদিকে ম্যাক অনেক ব্যস্ত মানুষ। আমার ধারণা ছিলো, যে কোন সময়ে সে পল্টি মারতে পারে। তাই, কফি শেষ করে পাশের এটিএম থেকে টাকা তুলে সীমান্ত স্কয়ারের Travelzoo এর অফিস থেকে বিমানের টিকেট কাটার মাধ্যমে ম্যাকের ভূটান ভ্রমণটা নিশ্চিত করে ফেললাম। বিরক্তিকর ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ আর ভূটানের মাঝে একটি মাত্র বিমান যাতায়াত করে- Druk Air. দূরত্ব কম হলেও তাই চাহিদার কারণে টিকেটে দাম অনেক বেশী। প্রায় ২৪ হাজার টাকা গুণতে হলো ঢাকা-পারো-ঢাকা বিমান টিকেট কিনতে। ম্যাক আর আমি ঠিক করলাম, কোন রকম ট্রাভেল এজেন্টের সাহায্য ছাড়াই আমরা দুজনে ইন্টারনেটে খুজেঁ আমাদের সমগ্র ভূটান ভ্রমণটা পরিকল্পনা করে ফেলবো।
যেই কথা সেই কাজ। কোথাও ঘুরতে গেলে কি কি জিনিস লাগে?— থাকার হোটেল, যাতায়াতের বাহন আর খাবারের দোকান। গুগলে সার্চ করলাম “Top things to do in Bhutan”. Trip Advisor-এর উত্তর গুলো ঘেটেঁ আমি আর ম্যাক ঠিক করলাম ভূটানের কোন কোন জায়গা দেখা উচিত। আমরা দুজনেই মন্দির, প্যাগোডা অপেক্ষা পাহাড়-পর্বতে সময় কাটাতে বেশী আগ্রহী। প্রকৃতিপ্রেমী আমাদের দু’জনের ভ্রমণ গল্পে তাই আপনি খুব বেশী মিউজিয়াম-মন্দিরের মতো মানবসৃষ্ট স্থানগুলোর কথা শুনতে পাবেন না। তাই, এই গল্পের শুরুতেই পাঠকদের সতর্ক করে দিচ্ছি।
ভূটানের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক স্থানগুলোর লিস্ট বানিয়ে তারপর শহর মোতাবেক সেগুলো সাজিয়ে ফেললাম। আমাদের রুট হবে পারো > থিম্পু > পুনাখা > থিম্পু > পারো। www.booking.com থেকে সবচেয়ে কমদামে পাওয়া হোটেল রুমগুলো বুক করে ফেললাম। আর Trip Advisor আমাদেরকে জানিয়ে দিলো ভূটান ভ্রমণ করতে একটা মাত্র ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করলেই যথেষ্ট। ব্যাস, কী দেখতে চাই? কোথায় থাকতে চাই? কীভাবে যেতে চাই?— এই প্রশ্নের উত্তর বের করা হয়ে গেলো। এটা ম্যাকের সাথে আমার জীবনের প্রথম tour; দুজনেই তাই ভীষণভাবে রোমাঞ্চিত।
২৭ আগস্ট সকাল ৬:০০-টায় উবার ডেকে বাসা থেকে বের হলাম। পথিমধ্যে ম্যাক-কে তার বাসায় থেকে তুলে নিলাম। আমরা দু’জনেই ব্যাকপ্যাকিং করতে আগ্রহী। তাই, দুজনেই মাত্র একটা কাধেঁ ঝোলানোর ব্যাগে নিজেদের ছ’দিনের রসদ গুছিয়ে নিয়েছি; হাতে নেই কোন লাগেজ। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌছেঁ সাড়ে সাতটার মধ্যে ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম। পরবর্তী দু’ঘন্টা আমরা কাটালাম City Bank American Express Lounge-এ। এই ব্যাংকের গোল্ড ক্রেডিট কার্ড থাকায় আমরা দু’জন সকালবেলায় নাস্তাটা buffet-এ করতে পারলাম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। বেলা ৯:৪০ মিনিটে আমাদের বিমান উড়াল দিলো ভূটানের পারো শহরের উদ্দেশ্যে। এক ঘন্টা পর বিমানটা গিয়ে নামলো দুই পাহাড়ের মাঝের এক উপত্যকায়। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম পাইলট কীভাবে এই পাহাড়ী এলাকায় ল্যান্ডিং করলেন। পারো এয়ারপোর্টের কোন আভিজাত্য নেই; আছে ঐতিহ্য। ভূটানের বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করতেই বুঝতে পারলাম যে, এইটা কার্বন নেগেটিক দেশ।
পারো নগরী/ Paro
পারো এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই সামনে দেখা মিললো ট্যাক্সি ক্যাবের। এই যাতায়াত ব্যবসাটা ভূটানে খুবই সিন্ডিকেটেড। মাত্র পনেরো মিনিট দূরত্বে অবস্থিত পারো শহরের কেন্দ্রে যেতে ৫০০ রূপী গুনতে হলো। আর এয়ারপোর্ট থেকে থিম্পু যেতে লাগে ৮০০ রূপী। মজার ব্যাপার হলো, ভূটানের মুদ্রার নাম গুলট্রাম। কিন্তু, ভূটানের অধিকাংশ জায়গাতেই তারা ভারতীয় রূপীতে লেনদেন করে। আমিও বাংলাদেশ থেকে সাথে করে রূপী নিয়ে গিয়েছিলাম।
বেলা এগারোটা নাগাদ একটা ক্যাবে বসে আমরা ছুটলাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। পারো শহরের মধ্য দিয়ে একটা মারুতি সুজুকি ছুটে চলছে। রাস্তার একধারে পাহাড়; অন্যদিকে খরস্রোতা “পারো” নদী। গাড়ীর মধ্যে আমরা দু’জন অবাক হয়ে উপভোগ করতে লাগলাম সেই পাহাড়ের বিশালতা; কানে বাজলো নদী প্রবাহের খল-খল শব্দ।
পথিমধ্যে ৩০০ রূপী খরচ করে আমরা একটা মোবাইল-সিম কিনে ফেললাম। তার সাথে আসলো ১০০ রূপীর টকটাইম আর ২ জিবি ৪জি ইন্টারনেট। ব্যস! এখন গুগল ম্যাপই হবে আমাদের গাইড। বেলা সাড়ে এগারোটায় আমরা পৌঁছলাম Hotel KK-এর লবিতে। রুম ভাড়া প্রতি রাতে ২,০০০ রূপী। তারা আমাদের বুকিং দেখে আগে থেকেই রুম ঠিক করে রেখেছিলো। আমরা রুমে ব্যাগ রেখে সাথে সাথে বের হয়ে গেলাম।
ঘুরতে গিয়ে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করাটা শয়তানের কাজ।
ভূটানে বাংলাদেশীদের প্রবেশ করার সময় যে ভিসা দেয়া হয় তা দিয়ে শুধুমাত্র পারো এবং থিম্পু শহরে প্রবেশ করা যায়। যেহেতু আমাদের পরিকল্পনাতে পুনাখা শহর আছে তাই আমাদের একটা বিশেষ রুট পারমিট দরকার। সেই পারমিট পাওয়া যায় ভূটানের রাজধানী থিম্পুতে। আমাদের থিম্পুর হোটেলের রিসিপশনিস্ট বেশ অতিথিপরায়ন মানুষ। তাকে Whatsapp করে আমাদের ভিসা আর পাসপোর্টের ছবি পাঠিয়ে দিলাম। তিন ঘন্টার মধ্যে লেকী নামক সেই ভদ্রলোক বিনামূল্যে আমাদের রুট পারমিট issue করিয়ে দিলেন। ভূটানের মানুষজন যে কতটা ভালো তা আমরা মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম। ঢাকায় এই কাজটা করতে গেলে নির্ঘাত কাউকে দুই হাজার টাকা বকশিস দিতে হতো।
বেলা বারোটায় আমরা নেমে আসলাম পারো শহরের রাস্তায়। ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য এই শহরটা একটা স্বর্গ মনে হবে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই, মানুষের সংখ্যা কম। ছিমছাম ছবির মতো সাজানো এক শহর হলো পারো। গুগল ম্যাপকে জিজ্ঞাসা করলাম আশেপাশের ভালো খাবারের দোকান কোনটা? উত্তরে উনি জানালেন, Mountain Cafe. পাচঁ মিনিট পায়ে হেটেঁ আমরা গিয়ে বসলাম সেই ক্যাফের ভেতরে। সেখানে আমাদের দেখা মিললো কিছু সাদা-পর্যটকের। ভূটানে সাধারণত সাদাদের আনাগোনা অনেক কম। কারণ, সাদা চামড়ার মানুষদের ভূটানী ভিসা পেতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। তাই, সেই ফরাসী আর চীনাদল দেখে আমি বেশ অবাকই হলাম।
ভূটানে মাংসের আধিক্য অনেক কম। অধিকাংশ মানুষই ভেজিটেরিয়ান। আমরা একটা বার্গার আর পিজা অর্ডার করলাম। পিজার ভেতরে ছিলো ভূটানের বিখ্যাত আইটেম- এমা ডাতসি। “ডাতসি” মূলত পনীর দিয়ে রান্না করা এক ধরণের খাবার। আর “এমা” হলো ভূটানের মরিচ। ভূটানীরা তাদের অল্প ঝালের সেই মরিচকে সব্জির মতো খেয়ে থাকে। আমার আর ম্যাকের নতুন ধরণের এই মরিচ খাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো। মাংসাশী প্রাণী শামীর মোন্তাজিদের অবশ্য সেই খাবার খুব একটা পছন্দ হলো না। অন্যদিকে ম্যাক কোন কিছুকেই খারাপ বলতে চায় না; মানুষের মনে কষ্ট দিতে সে এক্কেবারেই নারাজ। দু’জনে খাবার শেষ করে তাই প্রায় ১,০০০ রূপী গুনে বের হয়ে আসলাম।
ম্যাক আর আমি এরপর ট্যাক্সি খোঁজার জন্য উঠে পরে লাগলাম। এবার আমাদের গন্তব্য হলো চেলেলা পাস এবং হা-ভ্যালী। অবশেষে দিচেন নামের এক ড্রাইভার ১৮০০ রূপীর বিনিময়ে আমাদেরকে পারো>চেলেলা পাস>হা ভ্যালী>পারো নিয়ে যেতে রাজী হলেন। এই ভদ্রলোক এককালে সরকারী চাকুরী করতেন; এখন পর্যটকদের সাথে গল্প করতে ট্যাক্সী চালান। উনার ব্যবহারে আমি আর ম্যাক বেশ খুশী। দিচেনের বাহনে আমরা দু’জন ছুটলাম চেলেলা পাসের পথে। সবুজ পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে চলা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আমরা। প্রতিটা বাকেঁ তার রোমাঞ্চ। প্রায় দেড় ঘন্টার মনোমুগ্ধকর ড্রাইভ শেষে আমরা সেই পাহাড়ের চূড়াতে গিয়ে পৌছঁলাম। পথিমধ্যে ম্যাক একটা পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে নিলো।
চেলেলা পাস/ Chele La Pass
ভূটানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-সমৃদ্ধ জায়গাগুলোর মধ্যে চেলেলা পাস অন্যতম। এটি পাহাড়ের সবচেয়ে উচ্চতর বিন্দু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩,০০০ ফিট উচুঁতে এর অবস্থান। দিচেনের বাহন থেকে নেমে আমি আর ম্যাক পাহাড়ের চূড়া বাইতে শুরু করলাম। সমগ্র পাহাড়ের দেহটা সবুজ ঘাসে মুড়ি দেয়া। সেই ঘাসের ফাকেঁ ফাকেঁ উকিঁ দেয় ছোট্ট ছোট্ট ফুল। মন-ভোলানো সবুজ বলে একটা কথা রয়েছে। চেলেলা পাসের দৃশ্যটা হলো সেই মন-ভোলানো সবুজের কারসাজি।
এতো উচুঁতে অক্সিজেনের ঘনত্বটা বেশ কম। ম্যাকের প্রায়শই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। তাই, ধীরে-সুস্থে আমরা বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকলাম। চেলেলার একদম চূড়াতে অনেকগুলো পাতাকার মতো কাপড় বাধাঁ। সেই কাপড়ে লেখা ভূটানীজ মন্ত্র। মৃত মানুষদের সৌভাগ্য কামনা করে লেখা এইসব মন্ত্র ভূটানের নদী আর পাহাড়ে প্রায়ই দেখা যায়। শেষবার যখন ভারতের লাদাখে ভ্রমণ করেছিলাম তখন এরকম মন্ত্র লেখা রঙিন কাপড় দেখেছিলাম।
প্রায় ত্রিশ মিনিট পর আমি আর ম্যাক গিয়ে পৌঁছলাম চেলেলা পাসের সর্বোচ্চ বিন্দুতে। একটা ভাঙ্গা গাছের গুড়ির উপর বসে অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখতে লাগলাম পাহাড়ের বৈচিত্র্য। একের পর এক সবুজ পাহাড়; একটা শেষ হওয়ার আগেই যেন অন্যটা শুরু হয়েছে। সেই পাহাড়ের গায়ের সরু রাস্তাগুলোকে উপর থেকে দেখতে অনেকটা দৃষ্টিভ্রমের মতো লাগে। একটু দূরের পাহাড়গুলোর রংটা কিছুটা নীলাভ মনে হয়। আর এই সব পাহাড়ের উপর ছায়া হয়ে আটকে আছে বিশাল বিশাল মেঘ। আমরা যেখানটায় বসে ছিলাম সে জায়গাটাও ছিলো মেঘের ভেতরে। ম্যাক আমার দিকে তাকিয়ে বার বার বলছিলো:
This particular moment is called life.
ম্যাক অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ। তার পড়াশোনার দৌরাত্ম্যও অনেক। আমাকে সে পাহাড়ের আলোর স্বল্পতা নিয়ে নানারকম জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছিলো। পাহাড়ে নাকি সূর্যোদায় হয় অনেক দেরীতে আর সূর্যাস্ত যায় অনেক তাড়াতাড়ি। আমি চেলেলা পাস ছেড়ে আসতে নারাজ ছিলাম। কিন্তু, ম্যাকের নীপিড়নে অবশেষে আমরা আবার চড়ে বসলাম দিচেনের গাড়িতে। এবার আমরা ছুটলাম হা-ভ্যালীর উদ্দেশ্যে। গাড়ি পাহাড় থেকে নিচের দিকে নামতে লাগলো। ত্রিশ মিনিট পর আমরা পাহাড়-ঘেরা এক সমতল ভূমিতে এসে থামলাম।
হা-ভ্যালী/ Haa Valley
হা ভূটানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপত্যকা। জায়গাটা একটু গ্রামাঞ্চলের মতো। আমরা হা-তে পৌঁছলাম প্রায় বেলা ছ’টা নাগাদ। ততক্ষণে আলো কমতে শুরু করেছে। চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা; যথারীতি পাশে একটা খরস্রোতা নদী বইছে। সেই নদীর উপর একটা ঝুলন্ত ব্রীজ। আমরা দুজনে সেই ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। ব্রীজ থেকে নেমে অবশেষে রাস্তায় হাটঁতে থাকলাম। যেকোন নতুন শহরে গেলে আমার আর ম্যাকের সবচেয়ে পছন্দের কাজ হলো রাস্তায় রাস্তায় হাটাঁ। আমরা ব্যাপারটাকে এভাবে বলে থাকি:
আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো আর প্রচ্চুর চিল করবো।
ততক্ষণে হা-ভ্যালীতে সূর্য অস্ত গিয়েছে। ম্যাকের কথামতো রওনা না দিলে সূর্যাস্তকালে হা-ভ্যালীর সৌন্দর্যটা দেখা হয়ে উঠতো না। রাতে হা-ভ্যালী সম্পূর্ণ ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যা সাত-টার পর কোন কিছুই খোলা থাকে না। আমরা বাজারের রাস্তার আশ-পাশ ঘুরে অবশেষে একটা রেস্তোরায় ঢুকে পাহাড়ী অঞ্চলের বিখ্যাত খাবার “মো-মো” অর্ডার করলাম। এটা সিদ্ধ আটার রুটি দিয়ে মোড়ানো মাংসের পুড় বিশিষ্ট একধরণের পিঠার মতো খাবার। ভূটানী মরিচের চাটনীতে ডুবিয়ে আমরা সেই মো-মোর স্বাদ উপভোগ করতে থাকলাম। খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো সেই রোস্তারার স্থানীয় মানুষজনের সাথে। আমি ঘুরতে গেলে অজানা মানুষজনের সাথে আলাপ জমাতে খুবই পটু। দুই হা-বাসীর কাছ থেকে জানলাম, ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে হা-ভ্যালীতে প্রচন্ড তুষার পড়ে। ভূটানের এই অঞ্চলটা একটু আধুনিকতা বঞ্চিত, একটু দূরবর্তী, একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, আর একটু বেশীই শান্তিপূর্ণ।
ম্যাক আর আমি বারবার আফসোস করতে থাকলাম। হা-ভ্যালীতে একটা রাত কাটানো উচিত ছিলো। ভবিষ্যৎ ভূটান-ভ্রমণার্থীদের প্রতি আমাদের উদাত্ত আহবান: হা-ভ্যালীতে রাত কাটান। শুনশান নীরবতাপূর্ণ এই উপত্যকার অলিতে গলিতে আপনি খুজেঁ পাবেন শান্তি। হা-ভ্যালীতে কাটানো সেই এক ঘন্টা আমাদের মুখ হা-করে রেখে দিলো। অবেশেষে আমরা দুজনে দিচেনের গাড়িতে বসে রওনা হলাম পারোর পথে। আড়াই ঘন্টার এক আকাঁ-বাকাঁ পথ পাড়ি দিয়ে এসে আমাদের মাথা ঘুরতে থাকলো। পথিমধ্যে ম্যাক আমার কাধেঁ মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। যতদূর মনে পড়ে যখন হোটেলে পৌছঁলাম তখন রাত পৌনে দশটা। পুরো পারো নগরী তখন অন্ধকারে ঢাকা। রাতের খাবারের জন্যও কোন দোকান খোলা ছিলো না। “নিশ্চয়ই খাবার অপেক্ষা ঘুম উত্তম”— নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে আমরা দুই ক্লান্ত মুসাফির অবশেষে পাড়ি জমালাম ঘুমের রাজ্যে।
আবারো পারো (Paro)
ঘুম ভাঙলো ভোর পাঁচটায়। ভ্রমণে আসলে আমি বেশ সকালবেলার পাখি হয়ে যাই। দাতঁব্রাশ করে গোসল সেরে আমি ম্যাককে জাগিয়ে তুললাম। ম্যাক বিরক্তিসহকারে আমাকে কিছু গালি দিয়ে অবশেষে ফ্রেশ হয়ে নিলো। সকাল সাতটার মধ্যে আমরা দু’জনে নেমে আসলাম পারোর রাস্তায়। পারোর দোকানপাট খুলে বেলা ন’টায়। তাই আমাদের হাতে দু’ঘন্টা সময় রয়েছে। একটা ব্রীজের উপর দিয়ে পারো নদীর অপর পাড়ে গিয়ে পাহাড়ের পাশের রাস্তা ধরে দুজনে হাটঁতে থাকলাম। হাতের বা-দিকে পারো নদী; ডানদিকে পাহাড়। রাস্তার উপর অনেক সুন্দর সুন্দর কুকুর। ভূটানের রাস্তায় এই কুকুরের আধিক্যটা আমাদের মতো কুকুরপ্রেমীদের জন্য বেশ আকর্ষণীয় একটা ব্যাপার। একটা বাদামী রঙের কুকুর অনেকক্ষণ ধরে ম্যাকের পায়ের কাছে ঘুরতে থাকলো। ম্যাক তো তখন খুশীতে আটখানা। প্রায় দুই ঘন্টা রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার পর আমরা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত Champaca Cafe-তে গিয়ে বসলাম।
আমি ব্রেড এবং অমলেট অর্ডার করলাম; ম্যাক চাইলো ফ্রেঞ্চ টোস্ট। মনের মতো পেটপূজো শেষ করে বেলা সাড়ে ন’টায় আমরা আবার দিচেনের গাড়িতে বসে পড়লাম। এই লোকটাকে আমাদের বেশ ভালো লাগায় তাকে নিয়েই ভূটানের পুরোটা ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। পারো থেকে থিম্পু দেড় ঘন্টার রাস্তা। গাড়ি ভাড়া ৮০০ রূপী। ম্যাক আর আমি আবার উপভোগ করতে থাকলাম এক অসাধারণ রোড ট্রীপ। লং ড্রাইভ জিনিসটা আমাদের দু’জনেরই বেশ পছন্দের। এই ড্রাইভে আমাদের দেখা হয়ে গেলো Dochula Pass. জায়গাটা মেঘের চাদরে ঢাকা পড়া একটা মন্দিরের মতো; তবে তার আকাশটা খোলা। সিঁড়ি বেয়ে সেই মন্দিরের ভেতরে ঢুকে আমরা বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। দিচেন নিজের ফোনে স্মৃতিস্বরূপ আমার আর ম্যাকের ছবি তুলে রাখলো। আমরা সবাই কী ভীষণ স্মৃতিকাতর! ভীষণ!
থিম্পু/ Thimpu
বেলা সাড়ে এগারোটায় আমরা পৌছঁলাম থিম্পুর Khamsum Inn হোটেলে। চার তারকা বিশিষ্ট এই হোটেলের রেটিং ৮.৪; ভাড়া রাত প্রতি ২৫০০ রূপী। রুমে সুন্দর বাথরুম, ফ্রিজ, বিছানা; সেই বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে দূরের পাহাড় দেখা যায়। ম্যাক আর আমি অনেকটা হানিমুন যুগলের মতো অনুভব করতে থাকলাম। গোসল সেরে আমরা ঘন্টা খানেকের মধ্যে আবার নেমে আসলাম থিম্পুর রাস্তায়।
থিম্পু ভূটানের রাজধানী। রাস্তাগুলো বেশ সরু, তাতে মাত্র একটা লেনে গাড়ি চলে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ভূটানের রাস্তায় কোন ট্রাফিক লাইট লাগে না। সবাই নিজ থেকেই নিয়ম মেনে গাড়ি চালায়। ভূটানের মানুষগুলো অসম্ভব শান্ত স্বভাবের। সমগ্র ভূটানে মাত্র একজন ট্রাফিক পুলিশ আছেন। তাকে দেখা যায় থিম্পুর ক্লক টাওয়ারের নিকটবর্তী এক চৌরাস্তায়।
প্রথমে আমরা গেলাম Burger Point নামের এক রেস্তোরায়। Beef Cheese Bacon Bruger আর Lemon Tea অর্ডার করলাম। গরম গরম লেবুর গন্ধ তোলা সেই হলুদ বর্ণের চা খেয়ে আমি বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বার্গারটা অবশ্য আমাদের একটু হতাশ করলো। কারণ, তাতে মাংশ অপেক্ষা বানের অংশটাই বেশী। আমাদের ক্ষুধার্ত পেটের অবশিষ্টাংশ পূরণে আমরা এবার গেলাম Tibet Kitchen এ। সেখানে আমাদের মন ভুলিয়ে দিলো বীফ থুকপা (নুডুলস soup) আর হানি চিকেন। আমরা এই সব খাবারের সন্ধান Mark Weins সাহেবের ভিডিও দেখে জোগাড় করে রেখেছিলাম। কিন্তু এই রেস্তোরায় কিছুক্ষণ পর একটা বাংলাদেশী পরিবার দলবলে প্রবেশ করলো। তাদের চিৎকার চেচাঁমেচিতে অবশেষে আমরা বের হয়ে আসলাম।
পেট পূজোর পর আমাদের দরকার একটু ডেজার্ট আর কফি। গুগল আমাদের নিয়ে গেলো Coffee Culture নামের এক দোকানে। এটা থিম্পুর সবচেয়ে বিখ্যাত কফিশপ। ভূটানে আগত সব tourist-ই এখানে আসেন। নি:সন্দেহে এটা খাওয়ার জন্য ভূটানের সেরা জায়গা।
কফি কালচারের দো’তলায় উঠতেই আমি আর ম্যাক মনের মতো একটা সোফা পেয়ে গেলাম। আমাদের আর তখন পায় কে? একটা চকলেট লাভা কেক, লাটে এবং মোকা অর্ডার করে আমরা জুড়ে দিলাম রাজ্যের গল্প। ম্যাকের গল্পের ঝুড়িটা অসম্ভব সমৃদ্ধ। তার পড়াশোনার দৌরাত্ম্যটাও অনেক। কখনো বাইবেল, কখনো কুরআন, কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো মুজতবা আলী— আমাদের গল্পের নদীটা তখন আকাঁ-বাকাঁ চলতে থাকলো। সেই নদীর পানি যখন শুকিয়ে গেলো তখন সন্ধ্যা সাত-টা বাজে। থিম্পু সাড়ে আট-টায় ঘুমিয়ে যায়। তাই, আমরা ক্ষুধা না থাকা সত্ত্বেও জোর করেই Busy Bean নামক কফি শপে খেতে ঢুকলাম। ভূটানের খাবারে আদার আধিক্যটা আমাকে কিছুটা হতাশ করলো। অবশেষে আমরা কিছু আপেল আর কিউই ফল কিনে হোটেলে ফেরত আসলাম।
আগেই বলেছিলাম ম্যাক অসম্ভব ব্যস্ত মানুষ; তার রিসার্চের অনেক কাজ বাকী। ম্যাক তার ল্যাপটপটা বের করে কাজ করা শুরু করলো। আমি তাকে রুমে রেখে রাত নয়টায় হাটঁতে নামলাম ঘুমন্ত থিম্পুর বুকে। সেদিন ছিলো মঙ্গলবার। কেনো যেন এটাকে বলা হয় অফ ডে। অফিস খোলা থাকলেও এইদিন মানুষ খুব বেশীক্ষণ বাহিরে থাকে না। আমি ব্যাপারটাতে বেশ খুশি। শহরের কেন্দ্রস্থলে ক্লক টাওয়ারের পাশের গ্যালারীতে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। ভূটানের মেঘলা আকাশে তারা দেখা যায় না। অন্ধকারের রাজ্যে ঢাকা পড়া এই রাজধানী শহরের রাস্তায় আমি তখন একমাত্র মানব; আমার সঙ্গী হয়েছে চারটা কুকুর। এই কুকুরগুলো পাশে থাকায় একাকীত্ব কিছুটা দূর হলো। কানের হেডফোনে ক্রিস মার্টিন সাহেব গেয়ে যাচ্ছেন-
Well, they say people come..
They say people go…
This particular diamond was extra special.
And though you might be gone, and the world may not know…
Still I see you, celestial. (Everglow, Cold Play)
রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার এক পর্যায়ে প্রচন্ড খিদে পেলো। কিন্তু, দোকানপাট তো সব বন্ধ। অবশেষে থিম্পুর সিনেমা হলের ক্যান্টিনে আশার আলো জ্বলতে দেখলাম। রাতের শেষ শো-র পর দোকানীরা তখন জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে। কিন্তু, একজন tourist দেখে তারা আবার দোকান খুলে দিলো। ভূটানের আতিথেয়তায় আমি আরেক দফা মুগ্ধ হলাম। লেবুর গন্ধযুক্ত এক কাপ নুডুলস খেয়ে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেলো। ভূটান রাতের বেলায় একটু ঠান্ডা। হাল্কা একটা জ্যাকেট মুড়ি দিয়ে আবার পা চালালাম থিম্পুর রাস্তায়। রাত এগারোটা নাগাদ আমি হোটেলে ফেরত আসলাম। কাকতলীয়ভাবে ঠিক তখনই ম্যাকের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা দু’জনে তখন রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলাম। সেই গল্পের ইতি ঘটলো গভীর ঘুমে।
পরদিন সকাল সাত-টায় ঘুম ভাঙলো। যথারীতি সকালবেলার পাখিযুগল আবার পথে নেমে এলো। নাস্তার উদ্দেশ্যে আমরা ঢুঁ মারলাম Ambient Cafe-তে। আমাদের ভূটান ভ্রমণের অন্যতম সুন্দর ক্যাফে হলো এটি। কাঠের আসবাবপত্রে সজ্জিত এই কফিশপের একপাশের সেলফে বই সাজানো। আমি একটা ম্যাগাজিন নিয়ে ঘাঁটাতে লাগলাম। ম্যাক মেসেঞ্জার কলে তখন তার প্রেমের গুষ্টি উদ্ধারে ব্যস্ত। তাকে মনে মনে গালি দিয়ে আমি সঙ্গ দিলাম ক্যাফের পোষা বিড়ালটাকে। কিছুক্ষণ পর আমাদের ব্রেড অমলেট আর গ্রীলড চীজ স্যান্ডউইচ সার্ভ করা হলো। তারপর আসলো আমার কফি। সেই কফির ধোয়াঁয় জমলো আমাদের আড্ডা। প্রায় দু’ঘন্টা পর আমরা হোটেলে ফেরত আসলাম। বেলা এগারোটায় দেখা দিলো দিচেন। আমরা ছুট মারলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পুনাখার দিকে। ভূটানের রাস্তাগুলো বেশ মন ভরানো সৌন্দর্যের ভান্ডার। পাহাড়ের পাশ ঘেষেঁ গাড়িতে ভ্রমণ করাটা এই tour-এর অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ ছিলো। থিম্পু থেকে পুনাখা প্রায় আড়াই ঘন্টার রাস্তা। খরচ ১২০০ রূপী। বেলা আনুমানিক দু’টায় আমরা পুনাখার খুরুথাঙ্গে গিয়ে নামলাম।
পুনাখা/ Punakha
আমার মতে ভূটানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহর হলো পুনাখা; ম্যাকের যদিও থিম্পু সবচেয়ে পছন্দের। পুনাখায় থিম্পুর মতো অভিজাত কফিশপ নেই; আছে প্রকৃতির আভিজাত্য। যথারীতি পুনাখাও পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটি সমতল ভূমি। তবে এখানকার পাহাড়গুলো একটু ভিন্ন। সেই পাহাড়ের ধাপে ধাপে সিড়ির মতো করে চাষাবাদ হচ্ছে নানা রকম শস্যের। পাহাড়ের গায়ে চাষাবাদের জমিগুলো পুনাখার সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। ভূটানের অন্যান্য শহরগুলো অপেক্ষা পুনাখা অপেক্ষাকৃত গরম; এখানে বৃষ্টিপাতও হয় বেশী।
পুনাখায় আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য রাফটিং এবং ক্যাম্পিং। এই উদ্দেশ্যে আমরা ইন্টারনেট ঘেঁটে Druk Rafting Services এর সাথে বুকিং করে ফেলি। রাফটিং+ক্যাম্পিং এর জনপ্রতি খরচ ৪,০০০ রূপী; তবে নূন্যতম ৪ জনের দল হতে হবে। আমরা মাত্র দুই জন থাকায় জনপ্রতি ৫,০০০ রূপী গুনতে হলো। ভূটানে রাফটিং এর জন্য সবচেয়ে খরস্রোতা নদী হলো ফচু (বাবা-নদী)। আমি গতবছর নেপালের ত্রিশুলি নদীতে রাফটিং করে এসেছি। তাই রাফটিং এর ভয় অনেকাংশেই কমে গেছে। ম্যাক অবশ্য পানিকে একটু ভয় পায়।
বেলা ২ টার দিকে তাশী নামের এক সুদর্শন যুবক একটা মাইক্রোবাস নিয়ে এসে আমাদের রিসিভ করলো। প্রথম সে আমাদের Phuenzhi Diner নামক একটি লোকাল রেস্তোরায় নিয়ে গেলো। আমাদের পেটে তখন খিদে চোঁ চোঁ করছে। ভেজ নুডুলস, চিকেন গ্রেভি এবং সব্জি ভাজির ফরমায়েশ করা হলো। আমি চিকেন গ্রেভিতে কুপোকাত; ম্যাক সব্জির স্বাদে এক্কেবারে বাজিমাত হয়ে গেলো। পুনাখার দুপুরের খাবারটা আমাদের অনেকদিন মনে থাকবে। সেই হোটেলের পোষা টেরিয়ার কুকুরটা দেখে ম্যাককে তখন আর আটকায় কে?
বেলা তিনটার দিকে তাশী আমাদের নিয়ে গেলো রাফটিং স্পটে। সেখানে আমাদের পরিচয় হলো কাকার সাথে। কাকা আমাদের রাফটিং গাইড। প্রায় ১২ বছর ধরে সে এই কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমেই আমরা কাপড় বদল করে swim suit পড়ে নিলাম। ড্রুক থেকে আমাদেরকে লাইফ জ্যাকেট, হেলমেট আর রাফটিং কিট দেয়া হলো। অবশেষে আমি আর ম্যাক সেই বাতাসে ফোলানো নৌকার মাথায় গিয়ে বসলাম। নদীটা বেশ খরস্রোতা; চারপাশের দৃশ্যটা তার থেকে বেশী মনোরোম। প্রথমেই কাকা আমাদের রাফটিং-এর কমান্ডগুলো বুঝিয়ে দিলো। এরপর শুরু হলো নৌকা বাওয়ার কাজ। আমি আর ম্যাক কাকার কমান্ডে কখনো ফরোয়ার্ড, কখনো রিভার্স সুইপ করে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে বেশ বড়সড়ো একটা ঢেউ এসে আমাদের কাপিঁয়ে দিয়ে গেলো। নদীর সামনের অংশটা বেশ শান্ত। আমি কাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম পানিতে নামা যাবে কিনা? কাকা উত্তরে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
ঝুপ।
বেশ শব্দ করে আমি পানিতে পড়ে গেলাম; বরফ শীতল সে পানি। মুহুর্তেই আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ ঠান্ডায় জমে গেলো। স্রোতের টানের সাথে সামাল দিতে এক হাতে রাফটিং নৌকাটা ধরে রাখলাম। নাক পর্যন্ত পানিতে ডুবে অবাক নয়নে অবলোকন করতে থাকলাম পুনাখার সম্ভার। প্রায় মিনিট দশেক পর কাকা আমাকে নৌকায় টেনে তুললো। কিন্তু, ম্যাক তখনো পানিতে নামতে নারাজ। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। ম্যাক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। ছোটবেলায় তাদেরকে পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে “Baptiasm” নামের একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা হয়। ব্যাপারটা অনেকটা মুসলমানদের আকিকা দেয়ার মতো। সেই ব্যাপটিসমের ডুব খাওয়ার পর থেকেই ম্যাক পানি ভয় পায়। সে কোন অবস্থাতেই পানিতে নামবে না।
কিন্তু, কাকা এক্কেবারে না-ছোড় বান্দা। সে কোন অবস্থাতেই একজন রাফটারকে শুকনো অবস্থায় ফেরত নিবে না। নৌকার বৈঠা দিয়ে প্রথমে সে পানি মেরে মেরে ম্যাককে ভিজিয়ে দিলো। এরপর আমি যোগ দিলাম সেই ষড়যন্ত্রে। অবশেষে ম্যাককে বলা হলো, তুমি যদি ঝাঁপ না দাও তাহলে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো। কায়াকিং বোটের একজন নাবিক ম্যাককে ধরতে আমাদের নৌকার কাছে চলে এলো। অবশেষে ম্যাক নিজের ইচ্ছায় পানিতে নামতে রাজি হলো। ঝুপ।
প্রথম পাচঁ সেকেন্ড তার চোখে-মুখে ভয়ার্ত আভা; মুহুর্তেই সেটা মিলিয়ে গেলো ভয়কে-জয়-করার হাসিতে। ম্যাকের এই বীরত্বের মুহুর্তে তাকে সঙ্গ দিতে আমি আবার পানিতে নামলাম। কাকা নৌকার উপর থেকে আমাদের ছবি তুলে দিলো। মিনিট দশেক পর আমাদেরকে আবার নৌকায় উঠতে বাধ্য করা হলো। ততক্ষণে হাত-পা ঠান্ডায় জমে গেছে। প্রায় ৪৫ মিনিট রাফটিং করার পর আমাদের নৌকা গিয়ে ভিড়লো ঘাটেঁ। মজার এক দৃশ্য দেখলাম সেখানে। নদীর পাড়ে সাড়ি সাড়ি মারিজুয়ানা গাছ (গাজাঁ)। কাকা জিজ্ঞাসা করলো আমরা রাতে এর স্বাদ নিতে চাই কিনা? উত্তরে আমরা শুধু ডানে-বামে মাথা নাড়ালাম।
আবার দেখা মিললো তাশী ও তার মাইক্রোবাসের। তাতে চেঁপে আমরা এবার একটা হোটেলের লবিতে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ভেজা কাপড়-চোপড় বদলে গোসল করে নিলাম। চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতেই আমাদেরকে চা-বিস্কুট সার্ভ করা হলো। সেই গরম ধোঁয়া তোলা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই আমি আর তাশী গল্প জুড়ে দিলাম। আমাদের ব্যস্ত মানুষ ম্যাক মোবাইলে তার রিসার্চ পেপার এডিট করতে ব্যস্ত। তাশী আমাকে বর্ণণা করলো তার ভূটান জীবনের উপাখ্যান। ভূটানের শিক্ষাব্যবস্থা, পর্যটন, রাজতন্ত্রের ব্যাপারে কিঞ্চিত ধারণা পেলাম। আমি তাকে আমাদের ১০ মিনিট স্কুলের ভিডিও দেখালাম। এভাবে আড্ডা চললো ঘন্টাখানেক। একপর্যায়ে ম্যাকের কাজ শেষ হলো। গাড়িতে চড়ে এবার আমরা ছুটলাম Riverfront Punakha নামক একটা জায়গায়।
পুনাখার রিভারসাইড ভূটানের জাতীয় ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। তবে আপনি চাইলেই সেখানে তাঁবু খাটাতে পারবেন না; অবশ্যই কোন একটা কোম্পানির মাধ্যমে সেটা করতে হয়। নদীর তীরে সারি সারি গাছের রাজ্যে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম তিনটি সবুজ রঙের তাঁবু খাটানো। তাশী ইশারা করে দেখালো, ওইটা তোমাদের তাঁবু। আমি আর ম্যাক তাবুর ভেতর প্রবেশ করতেই দেখলাম দুটো স্লিপিং ব্যাগ আর কম্বল রাখা; বাহিরে আট-দশটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌহার্দ্যটুকু আমাদের অসম্ভব ভালো লাগলো। তাঁবুতে ব্যাগ রেখে আমি আর ম্যাক নদীর তীরে হাঁটা দিলাম। খানিকটা দূরে গিয়ে আমরা পাড়ের উপর বসে পড়লাম। আমাদের বা দিকে একটা সবুজ বনের ভিতর তিনটা তাঁবু, ডানদিকে খোলা মাঠ, সামনে খরস্রোতা নদী, আর নদীর ওপাড়ে দম্ভ নিয়ে দাড়িয়ে আছে ঘনসবুজ এক পর্বত। বেলা তখন সাড়ে ছয়টা। সূর্য মামা কিছু না বলেই হঠাৎ ডুব দিলেন। অন্ধকারের সাম্রাজ্যে আমি আর ম্যাক আবার হাটঁতে থাকলাম।
বনের মধ্যে আমরা হঠাৎ একটা মন্দির আবিষ্কার করলাম। ম্যাক আগ্রহ নিয়ে বললো, চলো ঢুকে পড়ি। যেই কথা, সেই কাজ। সদর দরজাটা খোলা পেয়ে মাথাটা নীচু করে আমি আর ম্যাক ঢুকলাম সেই সাদা মন্দিরে। তখন বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের দুইজনের কাছে একটা মাত্র ছাতা। সেটা আকাশে মেলে দিয়ে আমরা কোনমতে মন্দিরের মেঠো পথে হাটঁছি। হঠাৎ বেশ শব্দ করে চারটা ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠলো। আমি ভাবলাম এই লাইটগুলো হয়তো মোশন-সেন্সরের মাধ্যমে কাজ করে। কিন্তু ম্যাক দেখালো, মন্দিরের ভেতরের একজন লোক আসলে আমাদের দেখে এই বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই মন্দিরের চূড়োতে একজোড়া চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যাক অসম্ভব ভালো পর্যবেক্ষক। সে বললো, ভূটানের প্রায় প্রতিটা মন্দিরের চূড়োতে সে এই চোখ জোড়া দেখতে পেয়েছে।
কিছুক্ষণ পর আমরা তাঁবুতে ফেরৎ এলাম। ম্যাক তার ফেইসবুকে ডুব দিলো। আমি চোখ জোড়া হালকা বন্ধ করে মাটির গন্ধ শুকতে থাকলাম। রাত আট-টার দিকে তাশীর ডাক এলো। রাতের খাবার দেয়া হয়েছে। আমাদের তাবুর সামনে জ্বলছে বিশাল এক বনফায়ার। সেই আগুনের পাশে একটা টেবিলে সাজানো আছে আমাদের buffet ডিনার। এমা ডাতসি, গ্রিলড সব্জি, কচুর লতি ভাজি, মুরগির তরকারি, ডাল, ভাত, রুটি। আমি আর ম্যাক দুজনেই ভাত বিদ্বেষী। তাই দুজনেই রুটির সাথে ভুড়ি ভুড়ি করে মুরগি আর সবজি নিয়ে পেট পুড়োলাম। ম্যাক soup-এর বাটিতে করে কিছুক্ষণ আয়েসী ভঙ্গিতে ডাল খেলো। হালকা ডিনারের আইডিয়াটা আমাদের দুজনেরই বেশ ভালো লাগে। যথারীতি খাবারের টেবিলে গল্প করাটা আমাদের পছন্দের কাজ। আজকের গল্পটা ছিলো আমাদের জীবনকেন্দ্রিক। আমরা দুজনই সামনে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে রোমাঞ্চ এবং অনিশ্চয়তা। তবে একটা ব্যাপারে আমরা দুজনেই সহমত, জীবন নিয়ে আমাদের কারোরই কোন আফসোস নেই। আমরা দুজনেই জীবনটাকে উপভোগ করছি দু’হাত ভরে আর দু’চোখ ভরে। ভূটান আমার ঘোরা সপ্তম দেশ, আর ম্যাকের পঞ্চম।
রাত প্রায় দশটার দিকে আমরা হাত ধুয়ে এসে আগুনের পাশে বসলাম। ক্যাম্পের বাকী লোকজন ততক্ষণে জিনিসপত্র গুছিয়ে তাদের তাঁবুতে ঢুকে গিয়েছে। বৃষ্টিভেজা পরিবেশে আগুনের হল্কায় আবার ছুটলো আমাদের গল্পের ট্রেন। সেই ট্রেনের পরের স্টেশনটা হলো আমাদের তাঁবুর ভেতরে। আমি প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে ম্যাককে দাজ্জাল সংক্রান্ত কন্সপায়রেসি থিওরী ব্যাখ্যা করলাম; ম্যাক নিজেও ড্যান ব্রাউন ফ্যান। এই ধরণের গল্পে সেও কিছুটা আগ্রহী হলো। একপর্যায়ে গল্পের বাগানে কখন যে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম তা বুঝতে পারলাম না। রাত তিনটার দিকে কুকুরের চিৎকারে হঠাৎ আমাদের ঘুম ভাঙলো।
চারটা কুকুর আমাদের তাবুর কোণায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে নির্বিচারে। ম্যাক কিছুটা ভয় পাচ্ছে। আমি তার ভয়টা বাড়ানোর জন্য বললাম, কুকুর কিন্তু আল্ট্রাসাউন্ড রেঞ্জে শুনতে পারে। ধারণা করা হয়, কুকুর মৃত আত্মার উপস্থিতি বুঝতে পারে। বাহ! মুহুর্তেই ম্যাক চুপসে গেলো। আমি তাকে তাঁবুর বাহিরে নেয়ার জন্য অনেক্ষণ জোড়াজুড়ি করলাম। সে কোনভাবেই যাবে না। এই অন্ধকারে নদীর পাড়ের মন্দিরটার ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু, ম্যাকের কথা চিন্তা করে অবশেষে তাবুর মধ্যেই পড়ে রইলাম। হঠাৎ ম্যাক লক্ষ্য করলো যে, নিভে যাওয়া আগুনটা নাকি আবার জ্বলে উঠেছে। আমি তখন তাকে কাঠ-চাপা-আগুনের ধারণা বুঝিয়ে বলে সান্ত্বনা দিলাম। এভাবে প্রায় ভোর চারটার দিকে আমরা দুজনেই গভীর ঘুমে হেলে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো সকাল ৮-টায়। সূর্যের আলো ততক্ষণে চারদিক রাঙিয়ে তুলেছে।
ঘুম থেকে উঠে আমরা টয়লেট পর্ব সেরে নিলাম। কিছুক্ষণ পর চলে আসলো আমাদের সকালের নাস্তা। দুধ আর কর্নফ্লেক্স এবং ভাত আর মরিচ ভর্তা। যথারীতি আমি আর ম্যাক দুধ-কলা-কর্নফ্লেক্সে মন দিলাম। সকালের নাস্তার সময়টায় আমরা দুজনেই একটু চুপ-চাপ থাকি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমাদের গল্পের ঝুলিটা খুলতে থাকে। খাবার শেষে আবার আমরা নদীর পাড়ে হাটঁতে থাকলাম। হঠাৎ দিচেন ফোন দিলো। তার গাড়ি নষ্ট; আমাদেরকে নিয়ে যেতে সে তার এক বন্ধুকে পাঠিয়েছে। বেলা ৯:০০টায় সেই দিচেন-মিত্র আমাদের ক্যাম্পের সামনে এসে হাজির। আমি আর ম্যাক আমাদের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে তাশীর সাথে বিদায়পর্বটা সেরে নিলাম। দুজনেই সংকল্প করলাম, তাশীর সাথে দেখা করতে আবার পুনাখা আসবো। মনোমুগ্ধকর পরিবেশে একটা রাত কাটানোর পর আমরা আবার রওয়ানা হলাম থিম্পুর দিকে।
দ্য রিটার্ন অফ থিম্পু
বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটায় আমরা পৌঁছলাম থিম্পুর পুরোনো সেই Khamsum Inn হোটেলে। আমাদেরকে আবার দেখতে পেয়ে পূর্ণিমা আর লেকী বেশ খুশি হয়ে গেলো। ম্যাক আর আমি বেশ ক্লান্ত। পুরোনো গেস্ট দেখে তারা আমাদেরকে কোন রকম রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই সোজা রুমে পাঠিয়ে দিলো। ২০৩ নম্বর কক্ষে ঢুকেই আমরা অনুভব করলাম রাজ্যের ক্লান্তি। গোসল সেরে কোনরকমে বিছানায় এলিয়ে পড়লাম। পূর্ণিমা এসে আমাদের দু’কাপ চা দিয়ে গেলো। প্রায় তিনটা পর্যন্ত আমরা গতরাতের কাজা হওয়া ঘুমটা আদায় করে নিলাম। থিম্পু আমরা আগেও ঘুরে দেখেছি। তাই আজকের উদ্দেশ্য হলো শুধু আমাদের পছন্দের জায়গাগুলোতে নতুন কিছু চেখে দেখা।
বেলা সাড়ে তিনটায় আমরা গেলাম Coffee Culture-এ। নি:সন্দেহে এদের খাবার আমাদের দুজনের সবচেয়ে প্রিয়। বিফ টেন্ডালয়িন, চিকেন শর্মা, চিকেন সিসেমী রোস্ট, চকলেট লাভা কেক, ক্রীম ব্রুলে আর পানি। এক অর্ডারে বিল আসলো ১,৫০০ রূপী। ঘন্টা দুয়েক ধরে ম্যাক আর আমি গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। প্রায় নাক পর্যন্ত খাবার ভরার পর আমরা অবশেষে নিস্তার পেলাম। এই বিশাল ক্যালোরী বার্ন করতে এখন আমরা দুজনে আবার থিম্পুর “রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে” লাগলাম। ম্যাক আশেপাশের কাপড়ের দোকানগুলোতে ঢুকে দেখলো। সবকিছুরই দাম খানিকটা বেশী।
আমি অনেকক্ষণ ধরেই কফি খেতে উসখুস করছিলাম। প্রথমে আমরা Ambient Cafe-তে গেলাম। হায়! বৃহস্পতিবার ক্যাফেটা বন্ধ থাকে। সেখান থেকে গেলাম Art Cafe-তে। এই কফিশপটার ভেতরটা খুবই নান্দনিক কায়দায় সাজানো। কিন্তু, সমস্যা হলো এরা শুধু ফিল্টার কফি বিক্রি করে; আমার নাকের ডগায় সেটা আটকে যাবে। অগত্যা আমরা গেলাম Karma’s Coffee-তে। কিন্তু, সমস্যা হলো বেলা ৬টার পর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। আমার মেজাজটা তখন বেশ খারাপ হলো। কিন্তু কার্মা সাহেবের কফির দোকানের প্রবেশ পথে একটা সাইনবোর্ড দেখে মন ভালো হয়ে গেলো-
Give me coffee and no one gets hurt. (Karma’s Coffee, Thimpu, Bhutan)
ম্যাক বারিস্তা নামের এক দোকানের সামনের উঠানে পাতা চেয়ারে গিয়ে বসলো। আমরা দুজন সূর্যাস্ত পর্যন্ত গল্প করতে থাকলাম। এক পর্যায়ে সে হোটেলে গিয়ে ঘুমাতে চাইলো। কিন্তু আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরার ধান্ধায় সেই চেয়ারেই বসে রইলাম। আরো ঘন্টা দুয়েক একা ঘুরে অবশেষে ডিনার হিসেবে কাপ নুডুলস আর আইসক্রীম কিনে আমি হোটেলে ফেরত আসলাম।
আজকের রাতে আমাদের খুব ভালো ঘুম দরকার। কারণ আগামীকাল আমরা বেশ লম্বা সময় ধরে পাহাড়ে চড়বো। তাই, রাত আট-টায় আমরা দুজন ল্যাপটপে The imitation game সিনেমাটা ছেড়ে দিয়ে কাপ নুডুলস আর আইসক্রীমে মজে গেলাম। চোখের সামনে জানালা দিয়ে পাহাড়ের চূড়োয় অবস্থিত মন্দিরটার আলো দেখা যাচ্ছে। সে এক অদ্ভূত অনুভূতি। মুভিটাও ছিলো বেশ হৃদয়স্পর্শী। ক্যাম্ব্রীজের এক ম্যাথ প্রফেসর কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সিক্রেট কোড ব্রেক করে ফেলেছিলো সেই গল্পটাই আমরা দেখলাম থিম্পুর রাতে। এরপর মাত্র রাত সাড়ে এগারোটায় আমরা দুজন হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
ঘুম ভাঙলো ভোর সাড়ে ছ’টায়। আমি আর ম্যাক তৈরী হয়ে নিলাম। লেকীকে শেষ বিদায় জানিয়ে পুরোনো বন্ধু দিচেনের বাহনে চেপে বেলা সাতটায় আমরা রওয়ানা হলাম পারোর উদ্দেশ্যে। প্রায় সাড়ে আট-টায় আমরা পৌঁছলাম পারো নগরীর কেন্দ্রস্থলে। ভূটানের সকালে ৯:০০টার আগে কোন রেস্তোরা খুলে না। ব্যতিক্রম শুধু Champaca Cafe. অগত্যা আবারো আমরা পুরোনো সেই চেয়ার টেবিলেই ঘাটিঁ গাড়লাম। আবারো ৬০০ রূপীর বিনিময়ে সেই পুরোনো অর্ডারটাই করলাম। এবার অবশ্য শেষে আসলো ক্যাফে লাতে।
বেলা সাড়ে নয়টায় আমরা চেক ইন করলাম আমাদের নতুন হোটেল View point lodge-এ। ভাড়া রুমপ্রতি ২,১০০ রূপী। আমাদের আগের হোটেলটা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত ছিলো, আর ভিউ পয়েন্ট হোটেলটা এক্কেবারে সবুজ মাঠের মাঝে দাড়াঁনো। রুমের জানালা দিয়েই আমরা দেখতে পারলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য- Tiger’s Nest. সময়ক্ষেপণ না করে আমরা দিচেনের সাথে করে রওনা দিলাম Tiger’s Nest এর উদ্দেশ্যে। বেলা সাড়ে দশটায় আমরা পৌঁছলাম সেই পাহাড়ের গোড়ায়।
টাইগার্স নেস্ট/ Paro Taktsang/ Dzongkha/ Tiger’s Nest
ইন্টারনেট ঘাটঁলে বুঝতে পারবেন ভূটানের এক নম্বর tourist আকর্ষণ হলো টাইগার্স নেস্ট। ভয়ানক এক মুনি এক বাঘের পিঠে চড়ে এসে এই পাহাড়ের গায়ে রাজত্ব স্থাপন করেছিলো। পরে সে আটটি ভিন্ন রূপে জন্ম লাভ করে এই স্থানকে ভূটানের অন্যতম পবিত্র জায়গার মর্যাদা দিয়ে যান। ম্যাক আর আমি যখন সেই পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে দাড়াঁলাম তখন বেশ অসম্ভব একটা হাইক বলে মনে হলো। এতো উচুঁ পাহাড়ে এর আগে আমাদের কেউই কখনো উঠিনি। Tourist হিসেবে জনপ্রতি ৫০০ রূপী দিয়ে আমাদের টিকেট কাটতে হলো। বেলা ১০:৪০ মিনিটে আমি আর ম্যাক কোন রকম গাইড ছাড়াই উঠতে লাগলাম সেই পাহাড়ের গায়ে।
মিনিট বিশেক পরেই আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। একটা ঝর্ণার পাশে বসে ম্যাক আমাকে মনে মনে গালি দিতে থাকলো। তখন স্বর্গদূতের মতো আবির্ভূত হলো এক ভূটানীজ কৃষক পরিবার। দুই বোন, তাদের স্বামী এবং বড় বোনটার একমাত্র ছেলে- এই পাচঁজনের দল নিয়ে তারা তীর্থযাত্রায় এসেছে। আমাদের গাইড নেই তা বুঝতে পেরে তারা আমাদেরকে তাদের সাথে নিয়ে চললো। পথিমধ্যে তারা নিজেদের বাগানো জন্মানো নাশপাতি খেতে দিলো। ভূটানের মানুষ যে কতটা ভালো তা আরো একবার বুঝতে পারলাম। তাদের একটা কৃষক পরিবারের সবাই ইংরেজিতে কথা বলতে পটু!
টাইগার্স নেস্টে যাওয়াটা যতটা না শারীরিক পরিশ্রম, তার থেকে বেশী মানসিক। ম্যাক প্রথম এক ঘন্টায় বেশ কাহিল হয়ে গেল। এতো উচুঁতে তার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। ভীষণ! আমি একটু পর পর ম্যাককে নানা রকম উৎসাহ ব্যাঞ্জক বাণী দিতে থাকলাম। পথের প্রথম অংশটা পুরোটাই মাটির রাস্তা। সেই পথের দু’ধারেই আছে প্রকৃতির ঐশ্বর্য। পথের অর্ধেকাংশে একটা ক্যান্টিন আছে। সেখানে মালিবাগবাসী এক বাংলাদেশীর সাথে পরিচয় হলো। জার্মানীর এক নাগরিক ৪০ জনের দল নিয়ে ভূটানে এসেছে তীর্থযাত্রা করতে। এদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আমি একটু পর পর বিশ্রাম নিতে থামতাম আর এই সকল বিদেশীদের সাথে গল্প জুড়তাম; ম্যাক শুধু চুপচাপ পানি গিলতো। মজার ব্যাপার হলো, এই পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় খাবার পানির পাইপ লাগানো; সেখান থেকে বরফ শীতল পানি বের হয়। তাই, গরম লাগলেই আমরা ঠান্ডা পানিতে গলা আর মুখ ভিজিয়ে নিতে পারতাম।
অবশেষে সবুজ পাহাড় শেষ হয়ে আসলো। শুরু হলো পাথরের রাজত্ব। প্রায় ৭০০ ধাপের একটা সিড়ি বেয়ে সেই পাথরের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত টাইগার্স নেস্টে যেয়ে পৌছঁলাম। সেখানে বেশ বড়সড় একট ঝর্ণা আছে যার শব্দে আশপাশের এলাকাটা বেশ আলোড়িত হয়। বেলা তখন প্রায় দুটা বাজে। নিজেদের মুঠোফোন আর ব্যাগ বাহিরে লকারে রেখে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। মন্দিরটার তলায় তলায় প্রার্থণা কক্ষ। আমরা কয়েকটা কক্ষে ঢুকে কিছুক্ষণ মেডিটেশন করার চেষ্টা করলাম। ম্যাক খুব তাড়াতাড়িই ধ্যান হারিয়ে ফেলে। কি আর করার?
অবশেষে আমরা টাইগার্স নেস্টের সবচেয়ে কোণায় গিয়ে দাড়াঁলাম। এই জায়গাটার আমি নাম দিয়েছি “রূপসাগর”। আমি আজ পর্যন্ত যতগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গায় গিয়েছি তার মধ্যে রূপসাগর সব থেকে সেরা। বাম থেকে ডানদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। একটা পাহাড় শেষ হয় তো আরেকটা শুরু। গুনে গুনে সাতটা পাহাড় সেখানে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে মনের ক্যামেরায় সেই ছবিটা গেথেঁ নিলাম। বামদিকের প্রথম তিনটা পাহাড় কলাপাতার মতো সবুজ; পরের পাহাড়গুলো একটু গারো সবুজ। সূর্যের আলো একপাশ থেকে মাত্র তিনটা পাহাড়ের উপর পড়েছে। তাই বাকী গুলোকে দেখতে একটু অন্ধকার মনে হয়। দূরের পাহাড়গুলো একটু নীলাভ আর অস্বচ্ছ।
প্রতিটা পাহাড়ের সর্বাঙ্গটুকু বড়বড় সবুজ গাছে আচ্ছ্বাদিত। মাঝে মাঝে এক দুইটা পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট একটা কুড়ে ঘর দেখা যায়। আমি ম্যাককে বললাম ছোটবেলায় আমি এরকমই একটা কুড়ে ঘরে বড় হয়েছি। ম্যাক আমার দিকে তাকিয়ে বললো:
I am proud of you, Shamir. You have dreamt high.
রূপসাগরে সবচেয়ে বড় দম্ভটা প্রদর্শন করেছে মেঘ। আমাদের ধারণা ছিলো, মেঘ হয়ে থাকো গোল গোল। কিন্তু, আকাশ থেকে নেমে আসা আলোর মতো উলম্বরেখায় কিছু মেঘ পাহাড়ের চূড়োটা ঢেকে রেখেছে। এই উচ্চতায় দুপাখা মেলে উড়ছে ছোট ছোট পাখি। জীবনটা ওদেরই সবচেয়ে স্বাধীন। আমি বৃষ্টির অপেক্ষা করছিলাম। ম্যাক বললো, এই উচ্চতায় বৃষ্টি হবে না। মেঘ সব আমাদের পায়ের নীচে। ম্যাককে ভুল প্রমাণ করতেই বিধাতা তখন বৃষ্টি শুরু করলেন। আমি আর ম্যাক রূপসাগরের সাম্রাজ্যে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলাম।
Yes, life is beautiful.
আমরা দুজনে কোনমতেই ফিরতে চাচ্ছিলাম না। একবার ম্যাক বলে আরো পাচঁ মিনিট, অন্যবার আমি বলি আরো দশ মিনিট। অবশেষে প্রায় তিনটার দিকে দুজনে নীচে নামা শুরু করলাম। পথিমধ্যে পরিচয় হলো অঙ্কিত নামের এক ভারতীয় ব্যাংকারের সাথে। ১২০ জন Bank of India স্টাফ একসাথে ভূটান ভ্রমণে এসেছে। অঙ্কিত আমাদের রিসার্চের কথা শুনে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলো। ভ্রমণের অনেক বড় একটা মজা হলো এই সকল অপরিচিত লোকজনের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা। আমি অঙ্কিতকে বললাম:
This world is round. We will meet again, my friend.
পাহাড় থেকে নামার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অভিকর্ষের টান। বেশী জোড়ে নামতে গেলেই পা মচকাবার সুযোগ থাকে। আমি আর ম্যাক একজন আরেকজনের হাত ধরে নামতে লাগলাম। প্রায় ৭-৮ বার আমরা দুজন দুজনকে পড়ে যাবার সময় ধরতে পেরেছিলাম।
A good friend is better than your walking stick.
বেলা প্রায় সাড়ে ছ’টায় আমরা পাহাড়ের গোড়ায় নেমে আসলাম। আমি আর ম্যাক মনে মনে বললাম, “we have made it!” পার্কিং লটে দিচেন যথারীতি হাজির। সে আমাদের নিয়ে গেলো View Point Lodge-এ। সেখানে পৌছেঁ আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। রুটি, চিকেন গ্রেভি, সব্জি ভাজি— ৪৬০ রূপী খরচ। পাশের একটা মুদি দোকান থেকে আমরা রাতের জন্য দুটো কাপ নুডুলস আর চিপস কিনে নিলাম। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বোম্বে সুইটসের চিপস ভূটানেও পাওয়া যায়।
আজকের রাতটা ভূটানে আমার আর ম্যাকের শেষরাত; হয়তো এটা আমাদের জীবনে একসাথে কাটানো শেষরাতও হতে পারে। ভূটান থেকে ফেরার পর আমরা দুজন নিজেদের গবেষণা নিয়ে বিশ্বের দুইপ্রান্তে চলে যাবো। তাই রাতটা ভরে দুজনে গল্প করে নিলাম। আমাদের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো, কোন প্রকার টপিক ছাড়াই আমরা দুজনে আট-দশ ঘন্টা কথা বলতে পারি। Art of Conversation-টা আমাদের বেশ ভালো। আমরা দুজনেই বেশ Dinning Ettiquettes মেনে চলি। একজন অপরজনকে অসম্ভব সম্মান করি। আমার জীবনে খুজেঁ পাওয়া সবচেয়ে সাদামনের মানুষদের তালিকায় ম্যাক বেশ উপরের দিকে থাকবে। তার সাথে কথা বলতে বলতে আমি মনের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো সকাল ৭টায়। ব্যাগ গুছিয়ে হোটেলের ফ্রি ব্রেকফাস্টে যোগ দিলাম। অমলেট, ব্রেড, জ্যাম, চা— ওরা কীভাবে যেন বুঝে গেছে আমার আর ম্যাকের পছন্দের তালিকাটা। সকাল ৮:০০টায় দিচেন আবার হাজির। শেষবারের মতো লোকটা আমাদেরকে পারো বিমানবন্দের নামিয়ে দিয়ে গেলো। তাকে বিদায় জানাতে সবচেয়ে খারাপ লাগছিলো। ইমিগ্রেশন পার হয়ে আমি আর ম্যাক নিজেদের খুচরা টাকা একসাথে করে Himalayan Java Coffee নিয়ে নিলাম। বেলা ১১:০০টায় বিমান উড়লো। ১২:১৫ মিনিটে সেই বিমান নামলো ঢাকা এয়ারপোর্টে। আমি উবার ডাকলাম। ম্যাককে এয়ারপোর্টের লবিতে রেখে চলে যাচ্ছি। মাঝে দুবার পেছনে ফিরে তাকালাম। সেও দেখি তাকিয়ে আছে। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে অবশেষে আমি বাসার দিকে যাত্রা করলাম। কানের ভিতরে হেডফোনে এবার বাজছে Wiz Khalifa featuring Charlie Puth:
It's been a long day without you, my friend.
And I'll tell you all about it when I see you again…
We've come a long way from where we began…
Oh, I'll tell you all about it when I see you again…
When I see you again…