ভুল যখন ভালো
May 27, 2020 | 7077
১৯২৭ সালের দিকে লন্ডনের সেন্ট ম্যারি হাসপাতালে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং নামের একজন অণুজীববিদ (microbiologist) স্টাফাইলোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করতেন। এই ব্যাকটেরিয়ারগুলো মানুষের অনেক রোগের প্রধান জীবাণু হিসেবে কাজ করে। তখনকার দিনে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ মানেই ছিলো ভয়ানক কঠিন মৃত্যু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সামান্য কাটা-ছেঁড়ায় ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন হয়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যেতো। তাই, বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই ব্যাকটেরিয়া মারার জন্য ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সেই বিজ্ঞানীদের দলেরই অংশ ছিলেন আমাদের ফ্লেমিং সাহেব।
১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে ছুটি নিয়ে পরিবার সমেত ঘুরতে গেলেন ফ্লেমিং। তার ল্যাবের অবস্থাটা ছিলো একটু অগোছালো। অণুজীববিদরা নানা জাতের ব্যাকটেরিয়াকে “পেট্রি ডিস” নামের একধরণের প্লেটে চাষ করে থাকে। বিজ্ঞানের গালভরা ভাষায় একে বলা হয় ব্যাকটেরিয়ার কালচার। যাবার আগে ফ্লেমিং নিজের স্টাফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার কালচারগুলো একসাথে করে ল্যাবের টেবিলের উপর রেখে যান। আর তার সহকর্মীকে ভালো করে বলেন, কেউ যাতে ল্যাবের জানালাটা না খোলে।
ফ্লেমিং চলে গেলেন ফ্যামিলি ভ্যাকেশনে। আর তার সহকর্মী অসাবধানে করে ফেললেন শতাব্দীর সবচেয়ে মধুরতম ভুলটা। তিনি ল্যাবের জানালাটা খুলে রেখেই চলে গেলেন বাসায়। সেপ্টেম্বর মাসের তিন তারিখ ল্যাবে ফেরত আসলেন ফ্লেমিং। ল্যাবে ঢোকা মাত্রই তো তার চোখ রাগে লাল হয়ে গেলো। দেখতে পেলেন ল্যাবের জানালাটা খোলা। তার এতোদিনের ব্যাকটেরিয়ার কালচার নিশ্চয়ই নষ্ট হয়ে গেছে!
ল্যাবে এধরণের ভুল হলে নিয়ম হলো সবকিছু ফেলে দিয়ে নতুন করে এক্সপেরিমেন্টগুলো শুরু করতে হয়। ফ্লেমিংও ভদ্র বিজ্ঞানীর মতো তার পেট্রি ডিসগুলো ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলছিলেন। সেই মুহুর্তেই ঘটলো সবচেয়ে মজার ঘটনাটা। একটা প্লেটের ব্যাকটেরিয়ার কালচারের ঠিক মাঝখানটাতে বিশাল বড় একটা ফাঁকা জায়গা দেখা গেলো। মানে হঠাৎ করেই সেই প্লেটের বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়া মারা গিয়েছে। ফ্লেমিং ছিলেন জাত-বিজ্ঞানী। এই নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লেটের দৃশ্য তার রাতের ঘুম কেড়ে নিলো। প্লেটের সেই শূন্য স্থান থেকে নমুনা নিয়ে নতুন একটা পেট্রি ডিসে কালচার করলেন। কিছুদিন পরেই বুঝতে পারলেন সেই শূণ্য স্থানে জন্মানো শুরু করেছে পেনিসিলিয়াম নামের একধরণের ছত্রাক (fungus).
একটা পাউরুটির টুকরা নিয়ে সেটাকে এক সপ্তাহ খোলা বাতাসে ফেলে রাখুন। দেখতে পাবেন তার গায়ে নীলাভ-সবুজ একধরণের ছত্রাকের জন্ম হয়েছে। এই ছত্রাকটিই হলো পেনিসিলিয়াম। এই ছত্রাকের বীজ (স্পোর) আকাশে বাতাসে ভাসতে থাকে। ফ্লেমিং-এর সহকর্মী যখন ল্যাবের জানালা খুলে চলে গিয়েছিলেন তখন বাহিরের পরিবেশ থেকে পেনিসিলনের স্পোর পেট্রি ডিসের স্টাফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সাথে জন্মানো শুরু করেছিলো।
ফ্লেমিং বুঝতে পারলেন, এই ছত্রাক নিশ্চয়ই এমন কিছু নি:সরণ করে যা ব্যাকটেরিয়া মারতে সক্ষম। বছর খানেক গবেষণা করে কালচার প্লেটের সেই ব্যাকটেরিয়া-নাশক অণুটি তিনি আলাদা করে ফেললেন। পেনিসিলিয়াম ছাত্রক থেকে বের হওয়ায় সেই অণুর তিনি নাম দিলেন “পেনিসিলিন”। আর এভাবেই ভুলের বশে আবিষ্কৃত হলো বিশ্বের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। পেনিসিলিনের বদান্যতায় সেই যুদ্ধে প্রাণ বাচেঁ লক্ষ লক্ষ সৈন্যের। এই আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে তাকে ভূষিত করা হয় নোবেল পুরস্কারে। লন্ডন প্যাডিংটনের সেন্ট ম্যারি হাসপাতালের সেই গবেষণাগারটির নাম এখন Alexander Fleming Laboratory Museum.
বিজ্ঞানের জগতে ভুলগুলোও চমৎকার। একজন ভালো বিজ্ঞানী তার এক্সপেরিমেন্টের ভুল থেকেই অনেক ভালো জিনিস শিখতে পারেন। নিজের আবিষ্কার সম্পর্কে ফ্লেমিং পরবর্তীতে বলেন:
“One sometimes finds, what one is not looking for. When I woke up just after dawn on that September day in 1928, I certainly didn't plan to revolutionize all medicine by discovering the world's first antibiotic, or bacteria killer. But I suppose that was exactly what I did.”
(অনুবাদ: মানুষ মাঝে মাঝে যা চায় না, তাই পেয়ে বসে। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরের সেই সকালে ঘুম থেকে উঠার সময় আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে, ভুলক্রমে বিশ্বের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করে আমি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে পুরোপুরি বদল দেবো। কিন্তু, আমি আসলে ভুলের বসে সেটাই করে ফেলেছি!”)