ব্লু ম্যাজিক পিল
May 27, 2020 | 9191
পশ্চিমা বিশ্বের জনসংখ্যার এক বড় অংশ তাদের জীবনদশায় উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে ভুগে থাকে। ১৯৮৯ সালে ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তাই হৃদরোগের উপশম ঘটাতে একটি নতুন ওষুধ বাজারে আনার পরিকল্পনা করছিলো। হৃদরোগীদের একটি বড় সমস্যা হলো তাদের হৃদপিন্ডের ধমনী-শিরাগুলোতে চর্বি জমতে জমতে সেগুলো চিকন হয়ে যায়। তাই সেই নালিকা গুলোর মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে না। ফলাফলটা হয় বেশ মারাত্মক; শুরু হয় প্রচন্ড বুকব্যথা। এই সমস্যার সমাধান ঘটাতে হলে এমন একটি ওষুধ দরকার যা হৃদপিন্ডের সাথে যুক্ত রক্ত নালিকাগুলোকে বড় বানিয়ে তার মধ্য দিয়ে রক্তের সুষম প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারবে। ফাইজারের ব্রিটিশ গবেষক দল তখন সিলডেনাফিল সাইট্রেট নামক একটি রাসায়নিক যৌগ সনাক্ত করলেন যা রক্ত নালিকার সাময়িক প্রসারণকে দীর্ঘায়িত করে তার মধ্য দিয়ে রক্তপ্রবাহকে সহজ করে দিতে পারে।
একটি ওষুধ আবিষ্কারের পর তাকে ড্রাগ ট্রায়াল নামক একটি বড়সড় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে ল্যাবরেটরীতে ইঁদুরের উপর সেই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষের উপর এই ওষুধটি প্রয়োগ করার নিরাপত্তা যাচাই করা। পরবর্তী ধাপটিকে বলা হয় “Phase-01 trail” যাতে কিছু সংখ্যক সুস্হ মানুষের উপর ওষুধটি প্রয়োগ করে তার কোন সাইড ইফেক্ট বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা নির্ধারণ করা হয়। অনেক ওষুধ মারাত্মক প্রতিক্রিয়াজনিত কারণে এই ধাপেই বাদ পড়ে যায়। এরপর Phase-2 এবং Phase-3 ট্রায়ালে একই সাথে সুস্থ এবং অসুস্থ মানুষের উপর ডাবল ব্লাইন্ড পদ্ধতিতে* ওষুধটি প্রয়োগ করে তার রোগ উপশমের দক্ষতা বের করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সরকারের অনুমোদন নিয়ে একটি ফার্মা কোম্পানি সেই ওষুধটিকে বাজারে বিক্রি করতে পারে।
ফাইজার তার সিলডেনাফিল সাইট্রেট নিয়ে প্রথমে অ্যানিমেল ট্রায়াল শুরু করলো। সফলতাটা বেশ মাঝামাঝি পর্যায়ের। এই প্রজেক্টের প্রধান রসায়নবিদ ডেভিড ব্রাউন তখন বেশ ভয়ার্ত হৃদয়ে phase-01 trail শুরু করলেন যুক্তরাজ্যের ওয়েলস প্রদেশের কয়লা খণির শ্রমিকদের উপর। জুন ১৯৯৩ সালে ফাইজারের কর্তাব্যক্তিরা ব্রাউনকে ডেকে পাঠালেন তাদের সামনে ওষুধটির সম্ভাবনার কথা বর্ণণা করার জন্য। অ্যানিমেল ট্রায়ালের রিপোর্ট দেখে বড় বসদের মনে সঞ্চার হলো হতাশা। তারা ব্রাউনকে বলেই ফেললো, এই ওষুধের পেছনে কোম্পানি ইতোমধ্যেই মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট করেছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি কোন ভালো গবেষণালব্ধ ড্যাটা না দেখাতে পারো তাহলে তোমার প্রজেক্ট (কোড নাম: UK-92480) আমরা বন্ধ করে দিবো।
ডেভিড ব্রাউনের অবস্থা তখন দিশেহারা। তিনি ছুটে গেলেন তার phase-01 ট্রায়ালের সেই কয়লা খণির শ্রমিকদের কাছে। তাদের প্রতি ব্রাউন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ কি এই ওষুধটি সেবনকালীন সময়ে কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছো?” একজন শ্রমিক কৌতুক ভরা কন্ঠে বলে ফেললো, “প্রতি রাতে আমার যৌনাঙ্গের উত্তেজনা বেড়ে যায়।” সাথে সাথেই অন্যান্য শ্রমিকরাও বলে উঠলো, “আমাদেরও!”
ব্রাউন অবশেষে তার অধ:পাতে যাওয়া প্রজেক্টে যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। সিলডেনাফিলের কাজ ছিলো হৃদপিন্ডে রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধি করা। সেই কাজে ওষুধটি ব্যর্থ হলেও শরীরের অন্য একটি অঙ্গে এই যৌগটি রক্তের প্রবাহকে ঠিকই বৃদ্ধি করতে পেরেছিলো। কিন্তু, কীভাবে?
সিলডেনাফিল হলো ফসফো-ডাই-এস্টারেজ ৫ (PDE5) নামক একটি এনজাইমের ইনহিবিটর বা বাধা প্রদানকারী। এই এনজাইমটির কাজ হলো রক্ত নালিকা প্রসারিত হবার পর তাকে আবার সংকুচিত করা। সিলডেনাফিল এই PDE5 কে বন্ধ করে দিয়ে প্রসারিত রক্ত নালিকাকে সে অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখে। ছেলেদের যৌনাঙ্গ সাধারণত সংকুচিত অবস্থায় থাকে। যৌন সংবেদন লাভ করলে সেই অঙ্গের রক্ত নালিকায় প্রবাহ বেড়ে যায়; নালিকাগুলো আস্তে আস্তে প্রসারিত হয়ে রক্তের প্রবাহকে আমন্ত্রণ জানায়। ফলশ্রুতিতে ছেলেদের যৌনাঙ্গটি রক্তের চাপে প্রসারিত হয়ে পুরোপুরি উত্থিত হয়। এই ঘটনাকে বলা হয় Erection. বয়স্ক পুরুষদের এই প্রক্রিয়াটি ঘটার প্রবণতা কমে যায় যাকে ডাক্তাররা Erectile Dysfunction (ED) বলে থাকেন। সারা বিশ্বজুড়ে ৫০% পুরুষেরা অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও ED-তে ভুগে থাকেন। এই রোগীদের একটা বড় অংশই লজ্জায় ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না এবং ১৯৯৩ সাল পর্যন্তও বাজারে ED প্রশমনের কোন ওষুধ ছিলো না।
ডেভিড ব্রাউন অবশেষে ছুটে গেলেন ফাইজারের গবেষক দলের প্রধান ডেভিড ম্যাক’গিবনীর কাছে। ব্রাউন বেশ উৎসাহভরা কন্ঠ নিয়ে ডেভিডের কাছে প্রায় দেড় কোটি টাকা চেয়ে বসলেন। উদ্দেশ্য যৌনাঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা পরিত্রাণের জন্য সিলডেনাফিলের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা। মাত্র কয়েকদিন আগেই ম্যাক’গিবনী ব্রাউনের প্রজেক্ট বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়েছিলেন। সেই ম্যাক’গিবনীই জুয়োর দানে তার চাল দিলেন। ডেভিড ব্রাউনের হৃদরোগের সিলডেনাফিল তার উদ্দেশ্য বদলে এখন চলে গেলো যৌনরোগের ওষুধের ট্রায়ালে। ১৯৯৮ সালে সরকারী অনুমোদন নিয়ে বাজারে আসে প্রথম ED রোগের ওষুধ- “Viagra”। প্রথম কয়েক সপ্তাহেই ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর লাইন লেগে গেলো। নীল বর্ণের এই ওষুধ যেন রাতারাতিই পশ্চিমা বিশ্বের মানুষদের বিবাহজীবনে নতুন রঙ লাগিয়ে দিলো। Viagra আমেরিকান বাজারে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে টাইমস ম্যাগাজিন ১৯৯৮ সালের মে মাসের সংখ্যার প্রচ্ছদে জায়গা দিলো একটা ওষুধকে- “The Potency Pill”.
সারা বিশ্বের ফার্মাসিউটিক্যালের ইতিহাসে ভায়াগ্রা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। প্রথম বারের মতো মানুষ সরাসরি টিভি পর্দায় যৌনমিলন নিয়ে সরাসরি কথোপকথন শুরু করলো। ফাইজারের সেই নীল বড়ি যৌনাঙ্গের সাথে সাথে একটি সামাজিক বিপ্লবেরও উত্থান ঘটিয়ে দেয়। আর এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছিলো ডেভিড ব্রাউন সাহেবের অধ্যবসায়ের কারণে। ব্রাউন যদি হতাশ হয়ে সিলডেনাফিলের উপর আশা ছেড়ে দিতেন তাহলে হয়তো বিশ্বজুড়ে ৫০% পুরুষ এখনো যৌনহতাশায় ভুগতো। বিজ্ঞানে তাই ব্যর্থতা বলে কিছুই নেই। হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যর্থ হওয়া ওষুধ যৌনসমস্যার সমাধান করে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করতে সক্ষম হয়েছে। তাই, যৌনমিলন এবং বিজ্ঞান দুই ক্ষেত্রেই মনে রাখতে হবে— “হাল ছাড়তে নেই। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে শেষ বিন্দু পর্যন্ত।”
Hope is a good thing. Maybe the best of things. And no good thing ever dies. (Shaw Shank Redemption)