প্রকৃতি, পার্টি, ফুকেট
May 27, 2020 | 3450
১০ মিনিট স্কুলের সহকর্মীদের সাথে কোন এক বিকেলে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলাম। ‘আয়মান বনাম শামীর’ টাইটেলে দল ভাগ করা হলো। প্রচন্ড রেশারেশির সেই ম্যাচে অবশেষে আমার দল অপ্রত্যাশিতভাবে জিতে গেলো। অন্যদলের সবার মন খারাপ। অগত্যা সবাই মিলে জাহাঙ্গীর গেটের ক্যাপ্টেইন্স ওয়ার্ল্ডে খেতে গেলাম। সেখানে বসে জুবায়ের আইডিয়া দিলো, “এখন থাইল্যান্ডের টিকেট সস্তা। চলেন ভাই, থাইল্যান্ড যাই।”
এই জাতীয় কথাবার্তা শোনার পর সাধারণত বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে নেই। টেবিলে বসেই আমি, আয়মান, জুবায়ের (কুলগ্যাং-০১) টিকেট কেটে ফেললাম। সপ্তাহান্তেই শুভ, অভিপ্সু, শামস, রাকিন, চৌধুরি আর ইমু ইমু (কুলগ্যাং-০২) যোগ দিলো আমাদের কাফেলায়। ২ জুলাই ২০১৯ রাত ১১-টায় থাই এয়ারওয়েজের প্লেনে চড়ে কুলগ্যাং-০১ এর সদস্যরা উড়াল দিলো থাইভূমির উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে খানিকটা দেরীতে টিকেট কাটায় কুলগ্যাং-০২ এর সদস্যরা সিংগাপুরে ট্রানজিট নিয়ে প্লেন বদল করে থাইল্যান্ডে আমাদের সাথে মিলিত হবার আশ্বাস দিয়ে গেলো।
৩ জুলাই ভোর ৫ টায় থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে আমাদের প্লেনটা এসে নামলো। রানওয়ের ঠিক ওপাড়েই আকাশটা লাল করে দিয়ে সূর্য উঠছে। ইমিগ্রেশন পাড় করে আয়মানের উদ্যোগে সবাই মোবাইল সিম কিনে ফেললাম। সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ কুলগ্যাং-০২ এর সদস্যদের দেখা মিললো। সুবর্ণভূমি থেকে ভিয়েতজেটের প্লেনে চড়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ফুকেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। ঠিক তখনই বাঁধলো এক ঝামেলা।
কথা নেই, বার্তা নেই— “ফ্লাইট ডিলেইড”। কুলগ্যাং-০১ এর সকাল ১১টার ফ্লাইট গিয়ে পড়লো বেলা দুটায়। আর অন্যদলেরটা উড়বে বেলা চারটায়। সান্ত্বনা স্বরূপ ভিয়েতজেটের পক্ষ থেকে আমাদেরকে ১৫০ বাথের এয়ারপোর্ট কুপন দেয়া হলো। সেটা হাতে নিয়ে সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের এই মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। বেশ সুন্দর করে সাজানো একটা বিমানবন্দর। চারপাশ কাঁচ দিয়ে ঘেরা; তাই খুব সুন্দরভাবে সূর্যের আলোয় আলোকিত। ঠিক মধ্যখানে বেশ বড়সড় একটা মাঠ রয়েছে। সেখানে গেলে জায়গাটাকে একটা স্টেডিয়াম বলে মনে হয়।
আমি, আয়মান আর জুবায়ের মিলে চায়না টাউন নামক একট রেঁস্তোরায় ঢুকে পেকিং ডাক খেয়ে নিলাম। খাবারের এতো ভালো পসরা আমি বিশ্বের খুব কম বিমানবন্দরেই দেখেছি। ইতোমধ্যে কুলগ্যাং-০২ এর অতি উৎসাহী কিছু সদস্য এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাংকক শহরে চলে গেলো। খবরটা শুনেই মনে হচ্ছিলো এরা সেকেন্ড ফ্লাইটটা ধরতে পারবে না। কিন্তু, কি আর করার? আমরা সবাই জীবনে নানা রকম ভুল সিদ্ধান্ত নেই। ভুল করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর।
বেলা ১-টার দিকে আমি আর আয়মান একটা দোকানে বসে চিকেন চাবাচ্ছি। হঠাৎ বন্ধুবর আমার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাদের গেটে যাওয়া উচিত।” মুরগীর বুকের মাংসে একটা ছোট্ট কামড় দিয়ে আস্তে আস্তে হেলে দুলে সিকিউরিটি চেকিং পার করে বুঝতে পারলাম আমরা কতো বড় ভুল করে ফেলেছি। সিকিউরিটি গেইট থেকে প্লেনে উঠার গেটে হেঁটে যেতে প্রায় ২৫ মিনিট লাগে। সুতরাং, দিলাম দৌড়। আমি, আয়মান আর জুবায়ের পূর্ণশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। গেট ১৭-তে পৌঁছে বুঝতে পারলাম, দেরি হয়ে গেছে। গেট বন্ধ। কুলগ্যাং-০১ ছাড়াও আরো ৫ জন যাত্রী সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই মিলে ভিয়েতজেটের কর্মচারীদের ভালোমতো অনুরোধ করলাম। তাদের মনে দয়া হলো। একটা বাসে করে গেট থেকে আমাদেরকে প্লেনে নিয়ে যাওয়া হলো। প্লেনের সিটে বসে বেল্ট বাধঁতেই প্লেন চলা শুরু করলো। নেটওয়ার্ক হারানোর আগে শামসকে ফোন করে সতর্ক করে দিলাম, “গেট অনেক দূরে।”
বেলা সোয়া তিনটায় প্লেন নামলো ফুকেট বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ফুকেট শহরে যেতে ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগে। বাহন হিসেবে আছে বেশ কিছু বাস আর প্রাইভেট মাইক্রো। সমস্যা হলো দামাদামি। কুলগ্যাং-০১ এর সদস্যরা জনপ্রতি ১৫০ বাথে মাইক্রো ঠিক করে ফেললো। একই গন্তব্যের জন্য আমাদের মাইক্রোতে বসা কিছু সাদা ভদ্রলোকেরা দিয়েছে ২৫০ বাথ। বুঝতে পারলাম, এরা যার থেকে যেভাবে পারে সেভাবে ভাড়া আদায় করে।
ব্যাপারটা কুলগ্যাং-০২ এর সদস্যদের জানানো দরকার। কিন্তু, ততক্ষণে ওদের তো আকাশে থাকার কথা। আয়মান মেসেজ পাঠাতে গিয়ে দেখলো আমাদের ইনবক্স ইতোমধ্যে ভেসে গেছে। যা ধারণা করেছিলাম, তাই হয়েছে। কুলগ্যাং-০২ এর সেই তিন সদস্য ব্যাংকক শহর থেকে সময়মতো ফেরত আসতে পারেনি। সুতরাং, ফ্লাইট মিস। পরবর্তী প্লেনের টিকেট কেটে তারা রাত দশটা নাগাদ ফুকেটে আসছে। আগামী ছয় ঘন্টা আমার একমাত্র সঙ্গী— “আয়মান আর জুবায়ের”।
ফুকেট বিমানবন্দর থেকে মাইক্রোতে করে শহরের দিকে যাচ্ছি আমরা। আমি আর আয়মান একটা হেডফোন দিয়ে দুজনে মিলে গান শুনছি— “খাবো কি পারিন্দে”। গ্রীষ্মের রাঙ্গা সূর্যটা আমাদের কপালের উপর কড়া এক হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। জীবনটা বেশ সুন্দর মনে হতে লাগলো। বেলা চারটা নাগাদ আমরা Bamboo Beach Hotel এর সদর দরজায় নামলাম। সেখানে একটা বোর্ডে সুন্দর করে লেখা— “Welcome, Mr Ayman Sadiq.” রিসিপশনে যেতেই সুন্দরী এক থাই রমনী কমলার ঠান্ডা রস এবং একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে গেলো। থাইদের প্রাথমিক আতিথেয়তায় আমরা বিপুল পরিমাণ মুগ্ধ। প্রাথমিক ফর্ম পূরণ শেষ করে নিজেদের রুমে যেতেই বেশ অবাক হয়ে গেলাম। জনপ্রতি ৬৫০ টাকায় আমরা বেশ বড়সড় ডাবল বেডের, বারান্দাসহ রুম পেয়েছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘোরার সময় হোটেল বাবদ আমার সম্ভবত সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়েছে। থাইল্যান্ডে এই একটা ব্যাপার খুবই ভালো। সবকিছুর দামই বেশ সাধ্যের মধ্যে।
আয়মান আমার ভালো বন্ধু। কিন্তু সে বেশ আরামপ্রিয় প্রজাতির। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর তাকে রুম থেকে বের করা গেলো। নিচে নেমে আমরা তিনজন বেশ কিছুক্ষণ পুলের পানিতে সাঁতার কাটলাম। কিন্তু কোনভাবেই তাদেরকে হোটেল থেকে বের করতে পারলাম না। আমার জন্য ঘুরতে আসার প্রথম নিয়ম— “হোটেলে বসে থাকা যাবে না।” তাই, বন্ধুদের পরিত্যাগ করে পড়ন্ত বিকেলে ফুকেটের রাস্তায় হাঁটা দিলাম। মিনিট ত্রিশের মাথায় একজন থাই বান্ধবী জুটিয়ে ফেললাম। আসুন গল্পের খাতিরে তার নাম দেই- “সিমোনা”।
সিমোনা ফুকেটের স্থানীয় বাসিন্দা; অত্র এলাকার অলিগলি তার মুখস্ত। বান্ধবী আমাকে তার মতে ফুকেটের সবচেয়ে ভালো থাই খাবারের দোকান Doo Dee Thai-এ গেলো। রেঁস্তোরাটা বাহির থেকে দেখতে আহামরি কিছু নয়; তাই প্রাথমিকভাবে আমি কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। সিমোনা আমাকে কয়েকটা ভালো ডিশের সাজেশন দিলো। আমরা টম ইয়াম স্যুপ, প্যাড থাই, অয়েস্টার আর চিকেন সাতে (শিক কাবাব) খাওয়ার জন্য ফরমায়েশ দিলাম। প্রথম আসলো টম ইয়াম স্যুপ। এই বস্তুটা এমনিতেই আমার অনেক পছন্দের একট খাবার। Doo Dee Thai-এর সেই স্যুপটা আমার খাওয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মজাদার স্যুপ। প্রায় পুরো বাটিটা ভর্তি করে চিংড়ি, কাঁকড়া, স্কুইড, কালামারির টুকরা দেয়া। যারা সামুদ্রিক জীব খেতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এই স্যুপটার উপরে আর কিছু নেই। প্যাড থাইটাও বেশ ভালো ছিলো। তবে অয়েস্টারটা খুব একটা মনমতো হয় নাই। খাবারের শেষ দিকটায় মিন্ট দেয়া একটা থাই চা খেয়ে সিমোনা আর আমি দোকান থেকে বের হয়ে আসলাম। ততক্ষণে রাত্রি নয়টা বেজে গেছে। সিমোনাকে বিদায় জানিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম। রিসিপশনে ঢোকা মাত্রই দেখলাম কুলগ্যাং-০২ এর সদস্যরা এসে পৌঁছে গেছে।
জিয়াউস শামসও আমার মতো হোটেলে সময়-না-কাটানোর মন্ত্রে বিশ্বাসী। আমি, শামস, অভীপ্সু, রাকিন আর ইমু ইমু একটা টুকটুক (বাংলাদেশে একে ব্যাটারী বলে)-এ চড়ে রওয়ানা দিলাম ফুকেটের বিখ্যাত “বাংলা ওয়াকিং স্ট্রিট” এর দিকে। এর রাস্তার নাম কেন বাংলা রোড সেই রহস্য এখনো আমার কাছে রহস্যই রয়ে গেলো। তবে, বাংলা রোড ফুকেটের সবচেয়ে সরগরম এলাকা। রাস্তার দুপাশে আছে পাব, ক্লাব, সেক্স শো, স্ট্রীপ ক্লাব। তবে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর স্ট্রীট ফুড। প্রায় প্রতিটা গলিতেই দেখা যাবে কেউ মুরগীর কোন একটা বিশেষ অঙ্গ ভেজে বিক্রি করছে। দাম মাত্র ১০ বাথ (৩০ টাকা)। আমরা পুরোটা রাস্তা ধরে হেঁটে একের পর এক সব ধরণের খাবার ট্রাই করতে থাকলাম। বার-বি-কিউ রিবস জিনিসটা অসম্ভব ভালো লাগলো। বুকের হাড্ডির উপর লেগে থাকা আগুনো ঝলসাঁনো মাংসে কামড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে থাই সংস্কৃতির একটা বড় জিনিসের সাথে হাতে-নাতে পরিচিত হলাম- “পতিতাবৃত্তি”।
রাতের রাণীদের রাজ্য থাইল্যান্ড। এই পেশাকে থাইল্যান্ডে খুবই স্বাভাবিকভাবে নেয়া হয়। খুবই মজাদার একটা ব্যাপার হলো “লেডি বয়” নামক এক ধরণের মানুষ যারা ছেলে হয়ে জন্ম নিলেও মেয়ে সেজে পতিতাবৃত্তি করে থাকে। এই লেডি বয়রা বেশ জমকালো জামা পড়ে বাংলা রোডের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় নতুন খদ্দেরের জন্য। পাশেই আছে ম্যাসাজ পার্লার। সেখানে চলছে বিখ্যাত “থাই ম্যাসাজ”। প্রথমবারের মতো সেই ম্যাসাজ নিতে গেলে দয়া করে বলবেন আস্তে দেয়ার জন্য। নইলে বেশ ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খাবারের পাশাপাশি বাংলা রোডের ক্লাবগুলো আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। বেশ ভালো কিছু ডিজে পুরো স্টেজটা মাতিয়ে রেখেছে। রাস্তার ওপাশে রয়েছে ভিডিও গেইমের দোকান। নাচ, গান, গেইম, পার্টি, সেক্স— সবকিছুর মেলা হলো ফুকেটের বাংলা রোড।
পার্টির এক পর্যায়ে বেশ ক্লান্তি এসে ভর করলো। দলছুট হয়ে আমি রাস্তার ওপাড়ে “পাতং বীচে” হাঁটা ধরলাম। মিনিট ত্রিশেক হাঁটার পর হাটুঁ ব্যথা করতে লাগলো। সামনে একটা রিসোর্টের বাগানে সুন্দর একখানা দোলনা দেখতে পেলাম। আস্তে করে কোনমতে এগিয়ে গিয়ে সে দোলনায় গা এলিয়ে দিলাম। বাংলা রোডের পার্টির রাজ্যের ঠিক উল্টা পাশেই যে এরকম এক শান্তির বেহেস্ত রয়েছে তা কল্পনার অতীত।
ঘড়িতে বাজে তখন রাত আড়াইটা। ফুকেটের পাতং বীচের উপর কোন এক দোলনায় দোল খাচ্ছি। হঠাৎ করেই বিধাতার মনে হলো একটু বৃষ্টি হলে মন্দ হবে না। যেই চিন্তা, সেই কাজ। উনি বৃষ্টি নামিয়ে দিলেন। আমি এতটাই ক্লান্ত যে সেই সামান্য বৃষ্টি এড়াতে দোলনা ছেড়ে উঠতে কোনভাবেই রাজি ছিলাম না। সমুদ্রের দিকে কাতঁ হয়ে শুয়ে আছি। বড় বড় ঢেউ বিশাল ফণা তুলে পাড়ে আছড়ে পড়ছে। সেই লবণাক্ত পানির কয়েক ফোটাঁ এসে আমার মুখে লাগছে। পরক্ষণেই বৃষ্টির পানিতে তা ধুয়ে যাচ্ছে। কী এক মধুর বিড়ম্বনা!
দোলনার শান্তির রাজ্যে দোল খেতে খেতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি রাত চারটা বাজে। বীচের বালি পাড়িয়ে একটা সুপার শপে ঢুকলাম। সেভেন-ইলেভেন নামক এই দোকানটা থাইল্যান্ডের জীবনটাকে সহজ করে দেয়। কয়েক মিনিট পর পর একটা করে সেভেন-ইলেভেন পাওয়া যায়। আর প্রতিটা দোকানেই থাকবে আপনার চাহিদার সবকিছু। আমি সেভেন-ইলেভেন থেকে একটা আইস-টীর বোতল নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুদের খুজঁতে থাকলাম। পথিমথ্যে দেখলাম এক মহিলা ডিমভাজি/অমলেট বিক্রি করছে। তার স্পেশাল ব্যাপার হলো সেই অমলেটের মধ্যে আছে ঝিনুকের মাংস। দেখে আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না। সামুদ্রিক প্রাণী আমার পছন্দের তালিকায় বেশ উপরের দিকে থাকে। আর ফুকেটের রাত চারটার সময় খাওয়া সেই ডিমভাজি আমি হাজার খুজেঁও আর অন্য কোথাও পাইনি। এখনো ঠোটেঁর কোণায় যেন তার স্বাদ লেগে আছে।
অবশেষে বাংলা রোডের এক মাথায় বন্ধুদের খুজেঁ পেলাম। তাদের সাথে একটা টুকটুকে উঠে ফেরত আসলাম হোটেল রুমে। বিছানায় যেয়ে চোখ বন্ধ করতে করতে ভোর পাচঁটা বেজে গেছে। ঘুমটা একটু গভীর হবার আগেই মোবাইল ফোনের এলার্ম বেজে উঠলো। সকাল সাতটা বেজে গেছে! আমাদের থাই ট্যুরের অন্যতম আকর্ষণ- “ফাং না বে”-র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে।
দশ জনের দল নিয়ে চলার বড় সমস্যা হলো সবাই এক সাথে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। অন্যদিকে ট্রাভেল এজেন্ট সকাল সাড়ে সাতটায় আমাদেরকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে হোটেলে এসে হাজির। আমরা হালকা হেলে দুলে আগের রাতের কাচাঁ ঘুমটাকে কোলে তুলে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। ফেরেশতা শামস আর রাকিন পার্শবর্তী সেভেন-ইলেভেন থেকে কিছু খাবার কিনে আনলো। সেটা খেতে খেতে আমরা ছুটলাম অও পও পিয়ারের (ঘাঁট) দিকে। সেখানে কয়েকটা ছোটখাটো জাহাজ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সারাদিনের এই ট্যুরের জন্য খাবার সহ জনপ্রতি খরচ পড়েছে মাত্র ৮০০ থাই বাথ।
ঠিক সাড়ে নয়টায় জাহাজ ছাড়লো। শুরুতেই ট্যুরের আয়োজক দুই ভাই তাদের হাস্যকর থাই ভঙ্গিতে আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানালো। বড় ভাইয়ের নাম “নানা”। ছোট ভাইটা মজা করে তাকে “বা-নানা” ডাকে। মজার ব্যাপার হলো, পুরো জাহাজের সব কর্মী মুসলমান। তাই, খাবারের আয়োজন পুরোটাই হালাল। সেই খবর পেয়ে আয়মান আর জুবায়ের বেশ খুশি। জাহাজের রেলিং এর পাশে আমরা সবাই লাইন ধরে বসে আছি। স্পীকারে গান বাজছে। চারপাশে ভীষণ নীল একটা সমুদ্র। সেই নীল বর্ণটা ছবি তুলে বোঝানো যাবে না; গল্প লিখেও বোঝানো যাবে না। সেই নীল বর্ণটা কেবলমাত্র চোখে দেখেই বোঝা সম্ভব। প্রকৃতির বিশালতার সামনে লেখকের কলম আর আলোকচিত্রীর ক্যামেরাকে আরেকবার হার মানতে হলো।
সমুদ্রের সাধনা যখন নান্দনিকতার বাধঁ ভাঙতে বসেছিলো ঠিক তখনই প্রকৃতি-কাব্যের পরবর্তী পঙক্তিতে বৃষ্টির আগমন ঘটলো। বৃষ্টি সবসময়ই একটা ভিন্ন মাত্রার আনন্দ নিয়ে আসে। আয়মানকে দেখলাম জাহাজের রেলিং থেকে মাথাটা বের করে দিয়ে চুলটাকে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে নিলো। অন্যদিক থেকে রাকিন তার ক্যামেরায় সেই ছবি পিক্সেল বন্দী করলো। মন্দ যাচ্ছিলো না আমাদের ঘুম বিবর্জিত থাই ভ্রমণ নাট্যের দ্বিতীয় চিত্র।
হঠাৎ দেখলাম, সমু্দ্রের মাঝখানে বিশাল বড় একটা পাহাড়। সেই পাহাড়ের নীচে একটা গুহা দেখা যাচ্ছে। আমাদের জাহাজটা তার মুখে গিয়ে থামলো। নীচতলার ডেকে রাখা বাতাসের ক্যানোও বোটগুলো পানিতে ছাড়া হলো। একজন অভিজ্ঞ নাবিক আর তিনজন করে ট্যুরিস্ট গিয়ে বসলো প্রতিটা বোটে। অভীপ্সু-শামস আর আমি একটা বোটে বসলাম। সেই নৌকাটা গুহার ভেতরে গিয়ে ঢুকলো। ভেতরটা বেশ অন্ধকার; ছাদটায় হাজার খানেক বাদুড়ের বাসস্থান। সেই বাদুড়ের অবদানে পরিবেশটা বেশ গন্ধময়। তবে নাকটা হালকা চেপে ধরে রাখতে পারলে অন্ধকারের সেই রাজ্যের সৌন্দর্যটা চোখে পড়তে শুরু করবে। টর্চের হালকা আলো সমুদ্রের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে গুহার দেয়ালের উপর পড়ছে। লাইমস্টোনের সেই দেয়ালের অদ্ভূত ধূসর-কালচে বর্ণটা বেশ মনে রাখার মতো। তবে বদ্ধ পরিবেশ যাদের ভালো লাগে না তারা মিনিট দশেক পরই বের হতে চাইবে। আমাদের ক্যানোও বোট যখন গুহা থেকে বের হলো তখন যেন আনন্দের সীমা রইলো না। মনে হলো কত বছর পর যেন আবার সূর্যের আলো দেখছি। আলো যে কত ভালো তা অন্ধকারে থাকলেই কেবল বোঝা যায়।
আমরা আবার ফেরত আসলাম জাহাজের ডেকে। নাবিক ছুটলো নতুন গন্ত্যবে; স্পীকারে বাজলো এড শীরনের “ফটোগ্রাফ” গানটা।
Loving can hurts sometimes…
But it’s the only thing that makes us feel alive.
এড সাহেব তার শৈশবের ভালোবাসার কীর্তি গেয়ে শেষ করবার আগেই জাহাজ থামলো দ্বিতীয় ক্যানোও লোকেশনে। আমি মনে মনে একটু বিরক্ত। ভাবলাম, আবারো বাঁদুড়ের হাগুভর্তি গুহায় ঢুকতে হবে। ক্যানোও বোটে বসে নাকটা চেপে ধরে গুহায় প্রবেশ করলাম। অপর পাশে যেতেই নাক ছেড়ে দিয়ে মুখটা হা করে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইয়েস! আমি স্বর্গে পৌছেঁ গেছি। ঈশ্বর এর থেকে সুন্দর কিছু বানাতে পারবেন না।
জায়গাটা ছিলো সমুদ্রের মাঝখানে পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটা ম্যানগ্রোভ বন। ঠিক তখনই বৃষ্টিকে পড়তেই হলো। নতুবা হয়তো গল্পের পুরোটা শোনা যেতো না। পৃথিবীটা যে কতটা সুন্দর তা আমি সে দিন ‘ফাং না বে’র সেই ক্যানোও বোটে বসে ঠাওর করার চেষ্টা করছি। মায়াকাব্যের মতো করে বৃষ্টি পড়ছে। কয়েকটা ফোটাঁ পাহাড়ের ঢালে ধাক্কা খেয়ে আমাদের চোখে-মুখে এসে লাগছে। পাহাড় বেশী সুন্দর নাকি সমুদ্র?— উত্তরটা আছে থাইল্যান্ডে। উত্তরটা হলো— “পাহাড়ের মাঝের সমুদ্র”। প্রকৃতিতে কৃপণতার কোন স্থান নেই।
সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, পৃথিবীর অনেক দেশ ঘোরার পরও হয়তো এই ফাং না বে-র ধারে কাছের কোন জায়গা খুজেঁ পাওয়া যাবে না। ফাং না বে-র সেই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে আমি আমার মনের একটা কোণা ভেঙ্গে রেখে এসেছিলাম। এ ব্যাপারে আমার কোন ক্ষোভ কিংবা রোশ নেই; আছে প্রশান্তি। নিজেকে হারিয়ে এর থেকে বেশী খুশি হয়তো হওয়া সম্ভবও নয়।
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জান্নাত ছেড়ে আমাদেরকে আবার জাহাজে টেনে তোলা হলো। মনটা একটু খারাপ। তবে সেটা মুহুর্তেই দূর হয়ে গেলো বুফে লাঞ্চের সুবাসে। দল বেঁধে আমরা ঝাপিঁয়ে পড়লাম চিকেন ফ্রাই, রাইস আর নুডুলসের বাটিতে। খেতে খেতে বন্ধুদের সাথে হাল্কা খুনসুঁটি চালিয়ে গেলাম। অনেকেই সারা জীবন ধরে ব্যাংকে টাকা জমায়। আর আমি জীবন ভর এরকম ছোটখাটো মুহুর্ত মনের ব্যাংকে জমিয়ে রাখি। দুনিয়ার ব্যাংকে আমি গরীব হলেও মনের ব্যাংকে বেশ বড়লোক।
দুপুরের খাবারের প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমাদেরকে সাতাঁর কাটার সুযোগ দেয়া হলো। আমরা সবাই লাইফ জ্যাকেট পড়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনি ‘ঝুপ’ করে এক শব্দ। আয়মান আর আমাদের মাঝে নেই। বেশ ঝানু এই সাতারু লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই আন্দামান সাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমরাও তার সাথে যোগ দিলাম। সাকিব বিন রশীদ সমুদ্রের মাঝখানে তিন সদস্য বিশিষ্ট কিছু মিনি-কমিটি গঠন করে গুটি-চিলের ব্যবস্থা করলো। তারা একে অপরের হাতে-হাত ধরে সাঁতার কেটে এদিক-ওদিক ভেসে বেড়ালো। কিছু সাদা চামড়ার মানুষ অতি আগ্রহে প্রায় মাইল খানেক দূরের পাড়ে চলে গেলো। জাহাজের মানুষজন অবশেষে বাঁশি বাজিয়ে আমাদের ডেকে তুলতে বাধ্য হলো। পানিতে ভাসাটা একটা নেশার মতো। এই নেশায় মজলে ভাব কাটানো বড় দায়!
ক্যানোও হলো, সাঁতার হলো, বাকী রইলো ‘জেমস বন্ড আইল্যান্ড’। জায়গাটার আসল নাম ‘খাও ফিন কান’। ১৯৭৪ সালে বন্ড সাহেবের The man with the golden gun সিনেমার শ্যুটিং এখানে হওয়ার পর থেকে তার নাম হয়ে গেছে বন্ড সাহেবের দ্বীপ। হলিউডের দাপট কী!
জেমস বন্ড আইল্যান্ড হলো “লোক দেখানো” ঘুরতে যাবার জন্য ভালো জায়গা। সুন্দর সুন্দর ফ্লোরাল টপস পড়ে মানুষ পাতা-পানিতে নেমে বাহারী পোজ দিয়ে ছবি তুলে। সেই ছবি তারা ইন্সটাগ্রামে Eat.Sleep.Travel ক্যাপশন দিয়ে আপলোড করেন। আমার জায়গাটা খুব একটা পছন্দ হলো না। কারণ, এটা তো আর সেই পাহাড় ঘেড়া সমুদ্রের মাঝে ভেসে থাকা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট না। এটা মানুষের জঙ্গল। এখানে মানুষ অনেক টাকা দিয়ে ডাবের পানি খায়; স্যুভেনির কিনে নিয়ে যায়। আসল ট্রাভেল হলো সমুদ্রের মাঝে ভেসে বেড়ানো জায়গা গুলোতে। মাটির উপরটা তখন আমার কাছে বেশ ম্লান হয়ে গেছে।
বেলা প্রায় ছয়টা নাগাদ জাহাজে করে আমরা ফেরত এলাম ফুকেট শহরে। হোটেলে ঢুকে ব্যাগ রাখতেই বুঝতে পারলাম কিছু একটা ফেলে এসেছি। তবে সেটা মোবাইল কিংবা মানিব্যাগ নয়। বরং আমার মনের ছোট্ট একটা টুকরো। সেই টুকরোটা এখনো ফাং না বে-র পানিতে ভেসে বেড়ায়। আমার মনের সবচেয়ে সুখী টুকরো হলো সেটা।
If floating in water were a religion, Phang Na Bay would be the Mecca of it.