পৃথিবীর প্রথম ভ্যাকসিন
May 27, 2020 | 8902
আঠারো’শ শতাব্দীর ইংল্যান্ড। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জয়ে জয়কার। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাটাও তখন অক্সফোর্ড-ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কুক্ষিগত। এধরণের একটি প্রতাপশালী অবস্থায় ব্রিটিশদের মনে যে বস্তুটি ভীষণ ভয়ের সঞ্চার ঘটাতো তা হলো “গুটি বসন্ত” (small pox). এই রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু প্রায় অবধারিত। গুটি বসন্ত রোগীর সমগ্র শরীর জুড়ে ছোট ছোট গুটি গুটি দানা সৃষ্টি হয়। সেই দানার ভেতরে তৈরি হয় গন্ধযুক্ত পুঁজ। সেই পুঁজের সামান্য আঁচড় লাগতেই একজন সুস্থ ব্যক্তিও আক্রান্ত হয়ে পড়ে গুটিবসন্তে। তাই, স্বভাবতভাবেই আক্রান্ত রোগীদেরকে সামাজিকভাবে আলাদা করে দেয়া হতো। সেসময় ইংল্যান্ডের বড় শহরগুলোতে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% মানুষই গুটিবসন্তের কারণে মৃত্যুবরণ করতো। তাই, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াঁয় গুটিবসন্তের প্রতিকার আবিষ্কার।
তৎকালীন মেডিক্যাল ব্যবস্থায় ভ্যারিওলেশন নামক একধরণের থেরাপির প্রচলন ছিলো। গুটিবসন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে শুকিয়ে যাওয়া মৃত চামড়া একজন সুস্থ ব্যক্তির গায়ে সামান্য পরিমাণে ঘঁষে দেয়া হতো। এতে সুস্থ ব্যক্তি অল্প মাত্রায় গুটিবসন্তে আক্রান্ত হতো যা তার শরীর সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু, সমস্যা হলো, ভ্যারিওলেশনের সময় জ্বলজ্যান্ত গুটি বসন্তের জীবাণুটাই শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ ভ্যারিওলেশন গ্রহীতাই বেশ বড়সড় গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে সেসময়ে কেউ গুটিবসন্তের জন্য এই ভ্যারিওলেশন পদ্ধতির সরনাপন্ন হতে চাইতো না।
সেসময় ইংল্যান্ডের গ্লস্টারশায়ারে বাস করতেন এডওয়ার্ড জেনার নামক এক ব্রিটিশ চিকিৎসক। তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন, cow pox বলে এক ধরণের বসন্ত রয়েছে যা গবাদী পশুর দেহে গুটিবসন্তের মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে। সেই কাউ পক্স গরুর শরীর থেকে মানুষের শরীরে চলে আসলে খুবই সামান্য একধরণের বসন্ত তৈরি করে যা একেবারেই জীবনঘাতী নয়। এমনকি সেসময়ে দুধওয়ালাদের অধিকাংশই ছিলো কাউ পক্সে আক্রান্ত। ড. জেনার একটু পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, যে সকল দুধওয়ালার ইতোমধ্যে কাউপক্স হয়েছে তাদের গুটিবসন্তের মতো মরণঘাতী রোগগুলো আর হয় না। কিন্তু, এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?
আধুনিক কালের রোগতত্ত্ববিদ্যার প্রসারে আমরা জানি, আমাদের শরীরে শ্বেত রক্ত কণিকায় B-cell নামক এক ধরণের কোষ থাকে যারা একবার কোন রোগে আক্রান্ত হবার পর সেই জীবাণুর চেহারাটা চিনে রাখে। এই ধরণের B-cell কে বলা হয় Memory B-cell; কারণ তারা জীবাণুর মেমোরি তৈরি করে রাখে। তাই, একবার রোগ আক্রান্ত হওয়ার পর ভবিষ্যতে সেই একই চেহারার জীবাণু দেহে প্রবেশ করা মাত্রই আমাদের শরীরের B-cell গুলো পুলিশ হিসেবে NK-cell এবং খাদক কোষগুলোকে ডেকে নিয়ে এসে ক্ষতিকর জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে। এখানে মজার ব্যাপার হলে, Memory B-cell এর স্মৃতিটা এক্কেবারে ১০০% সঠিক নয়। অর্থাৎ, কাছাকাছি চেহারার জীবাণু দেহে প্রবেশ করলেও সেই শ্বেতকোষ গুলো তাদের মেরে ফেলার জন্য কাজ করতে পারে। এবং এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই আমাদের গল্পের নায়ক এডওয়ার্ড জেনার সাহেব তার জগৎ বদলে দেয়া বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সফল হন।
জেনার ধারণা করেন, কাউপক্স এবং গুটিবসন্তের জীবাণুগুলো হয়তো কাছাকাছি গোত্রের। গুটিবসন্ত মানুষের জন্য মরণঘাতী; অন্যদিকে কাউপক্স অতি সামন্য জ্বরসৃষ্টিকারী। কাউকে যাদি কাউপক্সে আক্রান্ত করে গুটিবসন্তের ছোবল থেকে বাচাঁনো যায় তাহলেই তো বাজিমাত! কিন্তু, জেনারকে এখন তাই সেই ধারণা প্রমাণ করে দেখাতে হবে। কারণ, বিজ্ঞান কেবল প্রমাণে বিশ্বাসী।
সারা নামের এক দুধওয়ালী জেনারের বাসায় দুধ সরবরাহ করতো। কিছুদিন আগেই সারা কাউপক্সে আক্রান্ত হয়। জেনার সারার শরীর থেকে খানিকটা কাউপক্সের পুঁজ নিয়ে তার মালীর সুস্থ ছেলে জেমসের ত্বকে ঘঁষে দিলেন। কয়েকদিন পরই জেমসের হাল্কা জ্বর শুরু হলো যা থেকে সে সহজেই সুস্থ হয়ে গেলো। তারপর জেনার তার সবচেয়ে ভয়ংকর পরীক্ষা শুরু করলেন। ভ্যারিওলেশন ট্রিটমেন্টে ব্যবহৃত জ্বলজ্যান্ত গুটিবসন্তের জীবাণু জেনার এবার ঢুকিয়ে দিলেন জেমসের শরীরে। কি হবে এখন? জেনার কি তার মালীর আট বছরের নিষ্পাপ শিশুকে জেনে শুনে মরণঘাতী গুটিবসন্তে আক্রান্ত করে ফেলেছেন? খুবই কঠিন ছিলো সেসময়ের উত্তেজনা।
কিছুই হলো না জেমসের। সারা বিশ্বের লাখ লাখ গুটিবসন্ত রোগীর জন্য এটা ছিলো সবচেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাচঁবার খবর। জেনার সরাসরি একজন মানুষকে কাউপক্স দিয়ে আক্রান্ত করে তাকে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিষেধী করতে সক্ষম হলেন। তাও সেই আঠারো’শ শতকে। কাউপক্স এবং গুটিবসন্তের জীবাণু দেখতে কাছাকাছি হওয়ায় প্রথমে কাউপক্সের জীবাণু জেমসের শরীরে প্রবেশ করে সেখানে memory B-cell উৎপাদন করে। সেই কোষ গুলো দ্বিতীয়বার যখন ক্ষতিকর গুটিবসন্তের জীবাণুর প্রবেশ বুঝতে পারে তখন তারা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তুলে গুটিবসন্ত প্রতিরোধ করে। এটাই আধুনিকযুগের ভ্যাকসিনেশনের মূল আইডিয়া। একটু কম ভয়ংকর কিছু জীবাণু জেনে শুনে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে অতি ভয়ানক একটি রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়। এই আবিষ্কারের জন্য এডওয়ার্ড জেনার বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরদিন অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
অনেক বিজ্ঞানীর মতে, জেনারের এই এক আবিষ্কার পৃথিবীর অন্য সকল আবিষ্কারের তুলনায় বেশী মানুষের জীবন বাচিঁয়েছে। ব্রিটেন আর ফ্রান্সের তখন যুদ্ধ চলছিলো। ফ্রেঞ্চ অধিপতি নেপোলিয়ন এই আবিষ্কারের পর তার সকল সৈন্যবাহিনীকে গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন প্রদান করেন। সেই ভ্যাকসিনের আবিষ্কারক জেনারের পাঠানো চিঠির প্রতি সম্মান দেখিয়ে নেপোলিয়ন তার কারাগার থেকে দু’জন ব্রিটিশ কয়েদীকে নি:শর্ত মুক্তি প্রদান করে বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী আবিষ্কারকের কথা ফেলে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
হুম! এমনই শক্তি আমাদের এই বিজ্ঞানের। নেপোলিয়নের মতো যুদ্ধজয়ীদেরকেও বিজ্ঞান মাথানত করতে শেখায়।
The greatest power in this world is called science.