থ্যালিডোমাইড কেলেংকারি
May 27, 2020 | 6668
ভয়ানক এই গল্পের শুরুটা ১৯৫৩ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেশ কাটিয়ে জার্মানী তখন কেবল মাত্র নতুন যাত্রা শুরু করেছে। বিখ্যাত বার্লিন দেয়ালের দুইপাশে ইস্ট এবং ওয়েস্ট জার্মানী তখনো দ্বিধাবিভক্ত দুই রাজ্য। এমন অবস্থায় দেয়ালের পশ্চিম পাশের জার্মানীতে কেমি গ্রুনেনথ্যাল নামের এক কোম্পানীর অভ্যুত্থান ঘটে যার গবেষণা প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় হেনরিক মুয়েকটার নামক এক জার্মান ভদ্রলোককে। যুদ্ধের সময় হেনরিক সাহেব ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য জার্মানীর গোপন গবেষণা দলে কাজ করেছিলেন। কেমি গ্রুনেনথ্যাল তার সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাজারে বিক্রির উপযোগী ওষুধ বানাতে চেয়েছিলো।
একটি গবেষণা প্রজেক্টে কাজ করার সময় সাধারণত কোটি কোটি টাকার রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করা হয়। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রায়ই আমাদের প্রত্যাশিত কেমিক্যালের পাশাপাশি নানা ধরণের অন্যান্য পদার্থও তৈরি হয় যাকে আমরা উপজাত (biprouduct) বলে থাকি। হেনরিকের সহচর উইলহেল্ম কুঞ্জ তাদের গবেষণাগারের জন্য ক্যামিকেল প্রস্তুত করার সময় হঠাৎ উপজাত হিসেবে তৈরি হওয়া একটি অণু সনাক্ত করেন। হার্বার্ট কেলার নামক এক ফার্মাকোলজিস্ট সেই কেমিক্যালটির গঠনের সাথে একটি চেতনানাশক ওষুধের মিল খুজেঁ পান। ফার্মাসিউটিক্যালের জগতে এধরণের আবিষ্কার মানেই বিলিয়ন টাকার ব্যবসা। কেমি গ্রুনেনথাল সাথে সাথে সেই যৌগটিকে ওষুধ হিসেবে বাজারে আনার গবেষণাটা শুরু করে দেয়। ১৯৫৬ সালে পশ্চিম জার্মানীর ফার্মাসীতে “থ্যালিডোমাইড” নামক নতুন এক ম্যাজিক ড্রাগের দেখা মিলে।
অধিকাংশ মেয়েদেরকেই গর্ভাবস্থায় “মর্নিং সিকনেস” নামক একটি সমস্যা সহ্য করতে হয়। সকাল বেলা তারা বমি বমি ভাব অনুভব করেন; অনেকেই ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। থ্যালিডোমাইড এই গর্ভবতীদের জন্য আশীর্বাদের নামে অভিশাপ হয়ে আসে। সাধারণত একটি ড্রাগ আবিষ্কারের পর ল্যাবরেটরীতে তার অ্যানিমেল ট্রায়াল হয়। ইদুর, বানরে ঠিকমতো কাজ করলে তারপর সুস্থ মানুষের উপর সেই ওষুধের প্রভাব দেখা হয়। সব ঠিক ঠাক থাকলে তারপর অসুস্থ মানুষকে সেই ওষুধ দিয়ে তার রোগ প্রশমনের ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়। আধুনিককালে এই পুরো প্রক্রিয়াটা ঘটতে প্রায় ১০-১৫ বছর সময় লেগে যায়। এর মানে হলো, আজকে যদি আমি ল্যাবে কোন ওষুধ আবিষ্কার করতে পারি তাহলে হয়তো আজ থেকে হয়তো ১২ বছর পর সেটা বাজারে কিনতে পাওয়া যাবে। আবিষ্কৃত ওষুধের মাত্র ৩% এই ট্রায়ল প্রক্রিয়া পার করে ফার্মাসীর দোকানে শোভা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
এবার একটু ভেবে দেখুন। ১৯৫৩ সালে আবিষ্কৃত ওষুধ ১৯৫৬ সালেই বাজারে চলে আসলো। এর মানে কি? আসলে তৎকালীন সময়ে ওষুধের ট্রায়াল প্রক্রিয়াটা খুব বেশি কঠোর ছিলো না। কেমি গ্রুনেনথ্যাল ইঁদুরের উপর ট্রায়াল চালিয়েই মূলত খুশিতে আটখানা হয়ে গিয়েছিলো। তারা দেখতে পায়, অনেক বেশি মাত্রায় এই ওষুধ গ্রহণ করলেও কোন ইঁদুর মারা যাচ্ছে না। LD50 বা লিথ্যাল ডোজ বলে এই ব্যাপারটায় থ্যালিডোমাইড বেশ ভালো আশা দেখায়। জার্মান ওষুধ সংস্থা থ্যালিডোমাইডকে “ওভার দ্য কাউন্টার” ড্রাগের অনুমোদন দিয়ে দেয়। এর মানে হলো, প্যারাসিটামলের মতো কোন প্রকার প্রেসক্রিপশন ছাড়াই মুদি দোকান থেকে থ্যালিডোমাইড কেনা যাবে। মর্নিং সিকনেসে আক্রান্ত মহিলারা সবাই ভুড়ি ভুড়ি থ্যালিডোমাইড খেতে থাকে। এতে মর্নিং সিকনেস ভালো হলেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো এক ভয়ানক খবর।
১৯৫৭ সাল পর্যন্তও বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, মায়ের দেহ থেকে বাচ্চার শরীরে কোন ওষুধ প্রবেশ করতে পারে না। মা এবং পেটের বাচ্চা (ফিটাস) প্লাসেন্টা নামক এক টিশ্যু দ্বারা একে অপরের সাথে যুক্ত যাকে কিনা বাংলা সিনেমার ভাষায় “নাড়ীর টান” বলে আখ্যা দেয়া হয়। সেসময়ের জ্ঞান অনুযায়ী, প্লাসেন্টা পার করে ওষুধ ফিটাসের মধ্যে প্রবেশ করাটা ছিলো অচন্ত্যনীয়। তাই, ড্রাগ ট্রায়ালের সময় গর্ভবতী মহিলার বাচ্চার উপর কোন ওষুধের প্রভাব চেখে দেখার প্রয়োজনীয়তাটা কেউ অনুভব করতো না। গল্পের লোমহর্ষক কাহিনীার সূচনাটা সেখানেই।
থ্যালিডোমাইড বাজারে আসার বছর দুয়েকের মাথায় অনেক ডাক্তারই লক্ষ্য করতে থাকেন যে, এই ওষুধ সেবনকারীদের বিকলাঙ্গ বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। এক পশ্চিম জার্মানীতেই থ্যালিডোমাইড সেবনের কারণে ৫,০০০ হাত-পা বাঁকানো সন্তানের জন্ম হয় যাদের প্রায় ২০% শিশুকালেই মৃত্যুবরণ করে। ইউরোপ জুড়ে এই সংখ্যাটা দাঁড়ায় দশ হাজারে। মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকার ড্রাগ ট্রায়াল প্রক্রিয়া কঠোর হওয়ায় থ্যালিডোমাইড সেদেশের বাজারে অনুমোদন পায়নি। যার ফলে মার্কিনীদের থ্যালিডোমাইডজনিত বিকলাঙ্গতার খবর খুবই বিরল।
কিন্তু, থ্যালিডোমাইডে এমন কি আছে যার ফলে সে গর্ভবতী মায়ের পেটের বাচ্চার অঙ্গ প্রতঙ্গকে গড়ে উঠতে দেয় না?
উত্তরটা লুকিয়ে আছে আমার প্রাণপ্রিয় রসায়নের বইতে। এই ওষুধটা প্রোটিনের অ্যামিনো এসিড গ্রুপের সাথে বিক্রিয়া করে তার রাসায়নিক গঠনকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দেয়। আমাদের হাত-পায়ের মাংসপেশীর বেশীর ভাগই এই প্রোটিন দিয়ে গঠিত। তাই, থ্যালিডোমাইড সেবনকারী মায়েদের গর্ভে হাত-পা বিহীন বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হতে থাকে। এই ধরণের কেমিক্যালকে বলা হয় টেরাটোজেনিক পদার্থ। অর্থাৎ এরা ভ্রুণের সঠিক বিকাশকে বিনষ্ট করতে পারে। বছর দু’য়েকের মধ্যেই কেমি গ্রুনেনথাল বাজার থেকে ওষুধটি সরিয়ে নেয়। কিন্তু, ততক্ষণে যা হবার তা ঘটে গেছে। ইউরোপজুড়ে জন্ম হয়েছে হাজার হাজার থ্যালিডোমাইড বেবীর।
মিডিয়া জুড়ে তখন সমালোচনার ঝড় বইলো। এই কেলেংকারির পর বিশ্বজুড়ে ড্রাগ অনুমোদন প্রক্রিয়াটা আরো জোরদার করা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভের সন্তানের উপর কোন ওষুধের প্রভাব পর্যালোচনা করাটা এখন “ড্রাগ ট্রায়াল” প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটেনের বিভিন্ন কোর্টের রায়ের পর ফার্মা কোম্পানিগুলো বেশ কিছু পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়। কিন্তু, সবাই আশা করছিলো কেমি গ্রুনেনথালের কাছ থেকে একটি ক্ষমার আর্জি।
দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি নিজের এই অতীতের কথা এড়িয়ে এসেছে। অবশেষে ২০১২ সালে কেমি গ্রুনেনথালের প্রধান কর্তা ব্যক্তি হ্যারোল্ড স্টক সাহেব মিডিয়ার সামনে করজোড় করে কোম্পানির পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। জন্ম হওয়া সেই সব থ্যালিডোমাইড বেবীর স্মরণে কোম্পানির অফিসের সামনে একটি বিকলাঙ্গ বাচ্চার মূর্তি উন্মোচন করা হয় যা প্রতিনিয়ত তাদেরকে নিজেদের সেই কালো অধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দিতে থাকবে।
The book of science is a wonderful read. But, it contains dark chapters too.