চকলেট, স্ট্রিট আর্ট, ব্রাসেল্স
May 27, 2020 | 4654
খুব অল্প সময়ে আসল ইউরোপীয়ান শহরের স্বাদ নিতে চান? অন্য কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে যান বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেল্সে। ব্রাসেল্স শুধু বেলজিয়াম নয়; বরং সমগ্র ইউরোপেরই রাজধানী। নিরপেক্ষ নগরী হিসেবে সুপরিচিত এই শহরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর অবস্থিত।
১ জানুয়ারি ২০১৯, নিউ ইয়ার্স ডে। দেরী করে ঘুম থেকে উঠে আমস্টারডামের দুইভেন্দ্রেক স্টেশন থেকে ইউরোলাইনের ৮ টাকার (৮০০ টাকা) টিকেটে চড়ে আড়াই ঘন্টা পর বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছলাম ব্রাসেল্স শহরের কেন্দ্রে। বাস থেকে নেমে একটা মেট্রোতে চড়ে চলে গেলাম ইটারবেক নামক এলাকায়। সেখানে থাকার জন্য এয়ারবিএনবি মারফত একটা আস্ত অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা হয়েছে। দুই বেড রুম, বিশাল ড্রয়িং রুম সহ এই বাসার দুই দিনের ভাড়া প্রায় ১১ হাজার টাকা। ইউরোপের রেট বিবেচনা করলে এটা অনেক সস্তা। বাড়ীওয়ালা ভদ্রলোক আগেই নিউইয়ারের ছুটিতে ঘুরতে চলে গেছেন। তার সুন্দরী মেয়ে আমাদেরকে ফ্ল্যাটের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে গেল। রান্নাঘরে অনেক শুকনো খাবার আর থালা-বাসন মজুদ আছে। বাসায় রান্না করে খেতে পারলে ইউরো ট্রিপের খরচ অনেকাংশেই কমে আসে।
বাসায় ঢুকেই প্রথমে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঘড়িতে তখন সাড়ে ছয়টা বাজে। বন্ধুরা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। যথারীতি ভবঘুরে আমি নেমে আসলাম ব্রাসেল্সের রাস্তায়। মেট্রোতে উঠে সোজা চলে গেলাম বেলজিয়াম স্টক এক্সচেঞ্চের নিটকবর্তী এলাকায়। প্রথম দর্শনেই সেই বিল্ডিংটা আমাকে হতবাক করে দিলো। স্টক এক্সচেঞ্চ নামটা শুনলেই ঢাকার মতিঝিলের হলুদ রঙের ময়লা একটা বাড়ির কথা মনে হয়। কিন্তু ব্রাসেল্স স্টক এক্সচেঞ্চ একটা বিশাল মিউজিয়ামের তুলনায় কোন অংশে কম সুন্দর নয়। বিল্ডিংটার চারপাশ সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত; সদর দরজার সামনে বড় বড় দুটো সিংহ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আর সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো সেই বিল্ডিংটার চারপাশে বসেছে সুন্দর একটা ক্রিসমাস মার্কেট। আমার পেটে তখন প্রচন্ড খিদে। তাই এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছুটে ভালো খাবার খুঁজতে থাকলাম। ট্রিপের আজ দশম দিন; সুতরাং পকেট বেশ গড়ের মাঠ। The Gourmet Burger নামক একটা স্টলে গিয়ে বসলাম। হাঁক-ঢাক দেখে মনে হলো মাংস দিয়ে ভাসিয়ে দিবে। কিন্তু বাস্তবে বিশাল বড় একটা বনরুটির মধ্যে ১০০ গ্রামের একটা শুকনো প্যাটি ঠেসে কোনমতে বার্গার নামের স্বার্থকতা অর্জনের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন এই বেলজিয়ান ব্যবসায়ী। ৬ ইউরো খরচ করে এই অখাদ্য কোন রকমে শেষ করে আবার রাস্তায় নেমে আসলাম। এই মার্কেটের আশেপাশের জায়গাটা বেশ সুন্দর। অনেকগুলো ছোট ছোট গলি শহরটার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
দো ব্রুকেরি স্কয়ার হলো ব্রাসেল্সের সিটি সেন্টার। জায়গাটা আপনাকে যেকোন মুভির ক্ল্যাসিক ইউরোপীয়ান শহরের কথা মনে করিয়ে দিবে। কোন পিচ ঢালা রাস্তা নেই; সবগুলো পথই ধূসর-কালো ইটে মোড়া। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সেই ইটের রাস্তাকে হাল্কা চকচকে একটা ভাব দিয়ে থাকে। নিউইয়ার উপলক্ষে ঝোলানো ঝাড়বাতি সেই বৃষ্টি ভেজা ইটের রাস্তায় প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে একটা অসাধারণ মোহ তৈরি করে। এরকম রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা একা একা হেঁটে বেড়ানো সম্ভব; আপনি এতটুকুও বিরক্ত হবেন না। আমি গুগল ম্যাপটা পকেটে ঢুকিয়ে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই হেঁটে চলছি। খুব বেশী মানুষ রাস্তায় বের হয়নি সেদিন। হাল্কা বৃষ্টির মৃদু মন্দ আবহে ইউরোপীয়ান রাস্তার আভিজাত্যে মুগ্ধ হতে হতে একটা পর্যায়ে বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলাম।
ছোট একটা গলি পাড় হয়ে একটা বড় স্কয়ারে প্রবেশ করতেই মোটামুটি চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। দ্য গ্রান্ড প্লেস; ব্রাসেল্সের সবচেয়ে আইকনিক নিদর্শন। শহরের এই টাউন হলটা মোটামুটি এখানকার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান। মধ্যযুগের ইউরোপীয়ান স্থাপত্যশৈলী উপভোগ করতে চাইলে গ্র্যান্ড প্লেসের কোন বিকল্প নেই। ৩৬০ ডিগ্রী মাথা ঘুরিয়ে যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই দেখতে পাবেন বিভিন্ন রাজা-রানীর মূর্তি-খচিত স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদ। মূলত বেলজিয়ামের রাজনৈতিক ইতিহাসের সব গল্পই এখানে শুরু হয়। রাতে জায়গটায় বেশ রুচিপূর্ণভাবে আলোসজ্জা করা হয়। চারপাশটা অন্ধকার; শুধুমাত্র বিল্ডিংগুলো জ্বলজ্বল করছে। স্কয়ারটার ঠিক মাঝখানে একটা ক্রিসমাস ট্রী সাজানো হয়েছে। শত শত ট্যুরিস্ট এখানে সুন্দর একটা ছবি তোলার চেষ্টা করে। সমস্যা হলো, গ্র্যান্ড প্লেস এতোটাই বড় যে পুরো জায়গাটা ক্যামারার ফ্রেমে ধারণ করা প্রায় অসম্ভব।
প্রায় ঘন্টাখানেক রাতের গ্র্যান্ড প্লেস উপভোগের পর আমার উপলব্ধি হলো, জায়গাটা দিনের বেলাতেও দেখতে বেশ সুন্দর হবে। তাই মনে মনে আগামীকালও আসবো বলে পাশের একটা গলিতে হাঁটা দিলাম। দশ সেকেন্ডের মাথায় আবার থমকে দাঁড়াতে হলো। চোখের সামনে এবার Everard t’Serclaes নামক সৌভাগ্য মূর্তি। চৌদ্দশ শতাব্দীর এই ভদ্রলোক ব্রাসেল্স শহর থেকে শত্রুদের বিতাড়িত করেছিলেন। তার পা ঘষঁলে নাকি সৌভাগ্য রচিত হয়। অনেক পথচারীকেই দেখলাম সেই সৌভাগ্যের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশ্চাত্য কুসংস্কারের প্রতি হাল্কা নাঁক সিটকে হাঁটতে থাকলাম রাতের ব্রাসেল্সে।
যদি এক কথায় উত্তরে জিজ্ঞাসা করা হয় “ব্রাসেল্স কিসের জন্য বিখ্যাত?”; তবে উত্তরটা খুবই সুমধুর।
চকলেট।
ব্রাসেলস হলো চকলেটের নগরী। গ্র্যান্ড প্লেসের আশেপাশের গলিতে শত শত চকলেটের দোকান। রাত নয়টার দিকে সেখানে দাঁড়িয়ে আমার মোটামুটি তখন পাগল হবার দশা। যেকোন দোকানে ঢুকলেই প্রথমে একটু চকলেট চেখে দেখতে দিবে। সেই চকলেটের নাম আর বাহার— দুটোই বেশ জমকালো। বাদাম, কমলা, শুকনো ফলের সাথে নানা বিন্যাসে মিল্ক চকলেট মিশিয়ে প্রায় হাজার খানেক প্রজাতি তৈরি করেছে বেলজিয়ামবাসীরা। টক, মিষ্টি এমনকি ঝাল ফ্লেভারের চকলেটও পাওয়া সম্ভব এখানে। তবে আমার চোখে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশী আটকে গিয়েছিলো তা হলো চকলেট ফাউন্টেন; গলে যাওয়া চকলেটের ঝর্ণা। শুকনো বিস্কুট সেই চকলেটের লহরে ডুবিয়ে বিনামূল্যে চেখে দেখার জন্য অনেক চকলেটের দোকানেই ব্যবস্থা থাকে। আমি তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ২০ ইউরো খরচ করে ছয়টা ভিন্ন স্বাদের চকলেট বার কিনে ফেললাম। চকলেটের রাজ্যে এসে খালি হাতে ফেরৎ গেলে নিজেকে হয়তো মাফ করতে পারবো না।
চকলেট-বন্দনার পাট চুকিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই আমি পৌঁছে গেলাম জমকালো এক শপিংমলে— “সেন্ট হিউবার্ট গ্যালারী”। জায়গাটা বাহির থেকে দেখে কোনভাবেই শপিংমল মনে হবে না। সোজা একটা ইনডোর কমপ্লেক্স; ভেতরটা ভীষণ মাত্রায় আলোক সজ্জিত। হঠাৎ অন্ধকার রাস্তা থেকে সেন্ট হিউবার্টে প্রবেশ করলে প্রথম পাঁচ মিনিট চোখে দেখতে সমস্যা হয়। সোনালী আলোর এই রাজত্ব চোখে সয়ে গেলে আপনি উপভোগ করা শুরু করবেন ব্রাসেল্সের অন্যতম সুন্দর একটি পারফর্মেন্স। লম্বা করিডোরের দুইপাশে বিশ্বের সব বড় ফ্যাশন চেইনের দোকান; ওপরের তলাটা কাঁচে মোড়া। হঠাৎ করেই সুমধুর পিয়ানোর সুরে করিডোরটা আলোড়িত হয়ে উঠলো। আমি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ব্যাপারটা। পিয়ানোর সুরের তালে তালে করিডোরের আলোক সজ্জা পরিবর্তিত হচ্ছে। সোনালী করিডোরটা মুহুর্তের লাল, বেগুনী হয়ে গেল। মন্ত্র-মুগ্ধের মতো প্রায় দশ মিনিট ধরে সেন্ট হিউবার্ট গ্যালারীর এই তামাশা উপভোগ করলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, বাসায় শুয়ে থেকে বন্ধুরা ব্রাসেল্সের রাতের পুরোটাই মিস করলো।
অভিজাত ব্রাসেল্সের লাল-নীল বাতি দেখতে দেখতে চোখ প্রায় ক্লান্ত হয়ে আসছিলো। তখন ঠিক করলাম, ব্রাসেল্সের আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখতে হবে। নতুবা এই শহর সম্পর্কে একটা পক্ষপাতদুষ্ট অভিমত তৈরি হবে। যেই কথা, সেই কাজ। বাসে চড়ে শহরের কিছুটা দূরের একটা স্টেশনে গিয়ে নামলাম। এবার জায়গাটাকে অনেকটা ঢাকা শহরের মতো মনে হলো। মাইলের পর মাইল ধরে বিল্ডিং। একটা জায়গায় দেখলাম শহরের নীচের অংশে নামার জন্য সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলাম ‘আসল’ ব্রাসেল্স ।
ব্রাসেল্সের স্ট্রীট আর্ট দুনিয়া বিখ্যাত। এই শহরের অলি গলির দেয়ালগুলো হলো শিল্পীর ক্যানভাস। আবাসিক ব্রাসেল্সে সেই গ্র্যান্ড প্লেসের আভিজাত্য নেই; আছে ময়লা-আবর্জনা। দেয়ালের কার্টুনে হিটলার থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্যাঙ্গ করে আঁকা গ্র্যাফিটির দেখা মিলবে। বাউদুয়িন বুলেভার্ডের গ্র্যাফিটিটা শুধু একবার চোখে দেখতে প্রায় মিনিট পাঁচেক হেঁটে যেতে হয়। বলতে বাঁধা নেই, পৃথিবীর আর কোন শহরে এতো সুন্দর দেয়ালকর্মের নিদর্শন এই অধমের চোখে পড়েনি।
ঘড়িতে তখন বাজে রাত্র ১১-টা। হাঁটু ব্যাথা হতে শুরু করেছে। হেঁটে চলেছি ব্রাসেল্সের নাম না জানা কোন এক রাস্তায়। ততক্ষণে গুগোল ম্যাপ ঘেঁটে দেখার শক্তিটুকু শেষ হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে দূর থেকে বেশ সুন্দর একটা চার্চ দেখতে পাচ্ছি। সবকিছু বাদ দিয়ে সেই চার্চ অভিমুখে যাত্রা করলাম। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এটা বিখ্যাত সেন্ট ক্যাথেরিন চার্চ। তার চারপাশ জুড়ে বসেছে বিশাল এক ক্রিসমাস মার্কেট। একই শহরে দ্বিতীয় ক্রিসমাস মার্কেটের সন্ধান পেয়ে আমি তো তখন খুশিতে আত্মহারা। তবে এতো রাতো কোন দোকানই খোলা নেই। অগত্যা ম্যাপে জায়গাটা লিখে রেখে আজকের মতো ব্রাসেলস ভ্রমণ ক্ষান্ত দিয়ে ফেরৎ গেলাম ইটারবেকের বাসায়। বন্ধুরা আমার জন্য একটা গ্রীল চিকেন আর কিছু রুটি রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রচন্ড খিদের চোটে সেই ঠান্ডা মুরগী চিবিয়েই গভীর ঘুমে লুটিয়ে পড়লাম।
২ জানুয়ারি, ২০১৯। সকাল সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠে অমিতার বানানো স্যান্ডউইচ খেতে খেতে সবাই মিলে রওনা দিলাম গ্র্যান্ড প্লেসের দিকে। আমস্টারডামের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আমরা সবাই বেলজিয়ামেও স্যান্ডিম্যান সাহেবের ফ্রি ওয়াকিং ট্রিপে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সকাল দশ ঘটিকায় আমাদের পরিচয় হলো শার্লোট নামক এক বেলজিয়ান তরুণীর সাথে। ব্রাসেল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি সে আমাদের মতো ভ্রমণপিপাসুদের তার শহরটা ঘুরিয়ে দেখায়। প্রাথমিক পরিচয়ের পর্ব সেরে শার্লোট আমাদেরকে বেলজিয়ামের ইতিহাসের বর্ণণা শুরু করলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ যখন দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে ধ্বংস করতে শুরু করলো তখন বেলজিয়াম ছিলো নিরপেক্ষ। যদিও পরবর্তীতে হিটলার সাহেব বলপূর্বক ব্রাসেল শহর দিয়ে নিজের সৈন্যবাহিনী মার্চ করে নিয়ে যান। পরাধীন ব্রেলজিয়ামে নানা ধরণের বিধি নিষেধ আরোপ করা হলো। যেমন- কোন নাগরিক বেলজিয়ামের পতাকার তিনটি রং (লাল, হলুদ, কালো) একই পোশাকে পরিধান করতে পারবে না। কিন্তু, বেলজিয়ানরা তো ছাড়বার পাত্র নয়।
তারা কি করলো?
তিন জন বেলজিয়ান একসাথে হয়ে একজন লাল, দ্বিতীয় জন হলুদ আর তৃতীয়জন কালো কাপড় পড়ে পাশাপাশি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতো। এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বেলজিয়ানদের শান্ত-শিষ্ট স্বভাব এবং কৌতুকপ্রবণ বুদ্ধিদীপ্তির প্রমাণ মেলে। বেলজিয়ামের রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে আছে শত শত কার্টুনের গ্রাফিটি। জাপান আর আমেরিকার পর বেলজিয়ামেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশী কমিকস বই ছাপা হয়। আমার ছোটবেলার প্রিয় চরিত্র টিন টিনের জন্মও হয়েছে ব্রাসেলস শহরে। শার্লোট আমাদেরকে হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়িরটার সামনেও নিয়ে গেল। বিল্ডিংটার নীচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত টিনটিন, স্নোই, ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর থমসন-থমসনের ছবি আঁকা। প্রথম পলকেই আমার শৈশবের স্মৃতি হাতের লোমকূপকে নাড়া দিয়ে গেলো।
ওয়াকিং ট্যুরের মধ্য বিরতিতে আমি আর অমিতা বেলজিয়ামের বিখ্যাত সেই হট চকলেট খাওয়ার মিশনে নামলাম। আমরা বাংলাদেশে যেই হট চকলেট খেয়ে অভ্যস্ত তার তুলনায় “আসল” হট চকলেট কিছুটা ভিন্ন। এক গ্লাস গরম দুধের মধ্যে আপনার পছন্দের চকলেটের (ক্যাডবেরী, মার্স, ফেরো রসার্স) এক টুকরা ভেঙ্গে দেয়া হবে। একটা চামচ দিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে সেটা দুধের মধ্যে গলিয়ে আপনি হালকা ধূসর একটা দ্রবণ তৈরি করবেন। প্রথম চুমুকেই আমি নেহায়েত হতাশ হলাম। আমার কাছে কফি শপের “নকল” হট চকলেটই বেশী আকর্ষণীয় মনে হয়। তবুও অভিজ্ঞতার স্বার্থে বেলজিয়ান হট চকলেটের গ্লাসটা গিলে ফেলে শার্লোটের সাথে উপস্থিত হলাম ম্যানিকিন পিসের সামনে।
প্রতিটা দেশের একটা করে আইকন থাকে। যেমন- বাংলাদেশের প্রতীক শাপলা; আমেরিকার ঈগল পাখি। মজার ব্যাপার হলো, বেলজিয়ামের আইকন হলে ম্যানিকিন পিস নামক এই অদ্ভূদ ছোট মূর্তি। প্রথম দেখায় আমি একটু হতাশ হলাম। মাত্র দেড়ফুট লম্বা একটা ছোট বাচ্চার মূর্তি; কুচ কুচে কালো তার বর্ণ। বাচ্চাটা দিগম্বর উজার করে তার পুরুষাঙ্গ দিয়ে মূত্র বিসর্জন করছে। সেই মূত্রের ধারা ফোয়ারার মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এই বস্তুটাই বেলজিয়ামের জাতীয় প্রতীক।
কিন্তু, কেন?
লোকমুখে শোনা যায়, ১৪ শতাব্দীতে শত্রুপক্ষ ব্রাসেলস শহরের অলিগলিতে বিষ্ফোরক লাগিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করে। সেই সময় জুলিয়ানস্ক নামক এক বাচ্চা ছেলে সেই স্পাইদের পিছু নিয়ে পুরো ব্যাপারটা উদঘাটন করে ফেলে এবং বিষ্ফোরকের উপর প্রস্রাব করে তাকে অকেজো করে দেয়। তখন থেকেই ম্যানিকিন পিস ব্রেলজিয়ামের আইকনে পরিণত হয়েছে। এই অদ্ভূত মূর্তির জাতীয় জনপ্রিয়তা থেকে বেলজিয়ানদের কৌতুক-প্রবণতার পরিচয় পেলাম আরেকবার। মজার ব্যাপার হলো, ম্যানিকিন পিসের প্রায় এক হাজারের বেশী কাপড় রয়েছে। বছরের বিভিন্ন দিন, বিভিন্ন উৎসবে তাকে সাজিয়ে তোলা হয়। দু:খের ব্যাপার হলো, ছোট এই মূর্তিটা এখন পর্যন্ত গোটা দশবারের মতো চুরি হয়েছে। তাই, অবশেষে ব্রাসেল্স কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে আসল মূর্তিটাকে সিটি মিউজিয়ামে সুরক্ষিত করে রাখে; আর একটা রেপ্লিকা বানিয়ে সেটাকে সবার জন্য সিটি সেন্টারে বসিয়ে দেয়। প্রকৃতির ডাকে সাড়ারত এই বাচ্চার ব্রোঞ্জের মূর্তি দেখতে এখন প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ব্রাসেল্সের কেন্দ্রে জড়ো হয়।
শার্লোটের সাথে আমাদের ভ্রমণের শেষ হয় রাজা আলবার্টের প্রাঙ্গনে। বিশাল বড় এক বাগানের এক পাশে বিজয়ী রাজা আলবার্ট ঘোড়ার পিঠে বসে অপর পাশে অবস্থিত তার স্ত্রী এলিজাবেথের মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের বিখ্যাত প্রেম কাহিনীকে এই দুই মূর্তির মুখোমুখি অবস্থানের মাধ্যমে বেলজিয়ামবাসী বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে।
বেলা একটা নাগাদ শার্লোটকে বিদায় জানিয়ে আমি, অমিতা, বাঁধন আর ম্যাক ব্রাসেল্সের রাস্তায় রাস্তায় কার্টুনচিত্র খুঁজতে বের হলাম। ব্যাপারটা অনেকটা “পোকেমন গো” খেলার মতো। একটা শহরের অলিগলিতে ঘুড়ে বেরিয়ে একটার পর একটা কার্টুনের গ্রাফিটি বের করতে থাকলাম আমরা। বিকেল পাঁচটার দিকে যথারীতি সবাই অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আমি তখন বন্ধুগণকে প্ররোচিত করে টেনে নিয়ে গেলাম সেন্ট ক্যাথেরিনের ক্রিসমাস মার্কেটে।এবার শুধু খাওয়া-দাওয়া হবে; কোন কথা হবে না। চারজন মিলে চারটা দোকান থেকে চারটা ভিন্ন ডিস অর্ডার করে সবাই মিলে মিশে খেতে থাকলাম। আলু-মাংসের হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ, চিকেন কাবাব, জার্মান বিয়ার আর গ্রীক সুভলাকি (অনেকটা শর্মার মতো) আমাদের ক্ষুধার্ত পেটকে শান্ত করে দিলো।
সন্ধ্যা নামতেই আমরা সবাই চলে গেলাম ব্রাসেল্সের বিখ্যাত পাব “ডিলেরিয়াম ট্রিমেন্স”-এ। এই নামের অর্থ হলো “alcoholo withdrawal syndrome”. ২০০৪ সালে এই পাবটি একসাথে ২০০৪ ভিন্ন স্বাদের বিয়ার সার্ভ করার মাধ্যমে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছে। চিন্তা করে দেখুন তাদের মেন্যুর কথা। সেই মেন্যুটা একটা বড় ডাইজেস্টের সমান। আমি দৈবচয়নে একটা পৃষ্ঠা খুলে তার সাত নম্বর বিয়ারটা অর্ডার করলাম। ওয়েটার মিনিট খানেকের মাথায় বিয়ার নিয়ে হাজির। ২০০৪-টা বিয়ারের মাঝে একটা অর্ডার খুঁজে এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে তারা বের করে আনে তা এক গবেষণার বিষয়। Spice in Space নামক সেই বিয়ারের স্বাদের পাশাপাশি বোতলটাও দেখতে বেশ সুন্দর। আমি সেই বোতলটাকে স্যুভেনির হিসেবে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম।
ডিলেরিয়াম ট্রিমেন্সে বসে সবাই মিলে আমাদের ক্রিসমাস ট্রিপের স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকলাম। গত এগারো দিন ধরে ইউরোপের তিনটি শহরে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। কখনো একা, কখনো সবাই মিলে অসংখ্য সুন্দর মুহুর্ত কাটিয়েছি; কথা বলেছি অনেক অপরিচিত মানুষের সাথে। চেখে দেখেছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাবার। আর সবচেয়ে বড় কথা, সম্মান করতে শিখেছি প্রতিটি দেশের স্বকীয়তা আর সৌন্দর্যকে।
বিয়ারের বিশ্বরেকর্ড দেখে আমরা চলে গেলাম স্টক এক্সচেঞ্জের নিকটবর্তী এলাকায়। সেখানে ফ্রিতল্যান্ড নামক দোকানে আসল “বেলজিয়ান ফ্রাই” পাওয়া যায়। আমরা যে বস্তুকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বলে থাকি তাকে বেলজিয়ামবাসীরা তাদের নিজেদের আবিষ্কার বলে দাবী করে থাকে। সেই দাবীর সত্যতা যাচাই করতে আমি-অমিতা-ম্যাক-বাঁধন ফ্রিতল্যান্ডের চিজ ফ্রাই অর্ডার করলাম। “ফ্রেঞ্চ” ফ্রাই থেকে এই বস্তু বেশ ভিন্ন। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সাধারণত চিকন এবং ভেতরে মচমচে হয়ে থাকে। কিন্তু, বেলজিয়ান ফ্রাই মোটা মোটা। বাহিরে মচমচে; ভেতরটা নরম। সুতরাং, আমার কাছে “ফ্রেঞ্চ” আর “বেলজিয়ান” ফ্রাই দুটি ভিন্ন খাবার বলেই মনে হলো। সম্ভবত ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের দাপটে “ফ্রেঞ্চ” ফ্রাইটা বিশ্বে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
আগামীকাল সকালে আমাদের লন্ডনে ফেরার ফ্লাইট। খাওয়া শেষে তাই সবাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে নিজেদের কাপড়-চোপড় ঘুছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে ট্রেনে উঠে রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সমস্যা হলো, সিটি মেট্রোর ডে-পাস ব্যবহার করে এয়ারপোর্টে যাওয়া যায় না। তার জন্য আলাদা টিকেট কাটতে হয়। ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারলাম যখন টিকেট চেকার আমাদেরকে চেক করতে আসলো। ভদ্রলোক ট্যুরিস্ট কোটায় আমাদেরকে মাফ করে দিলেন; নতুবা জনপ্রতি ৫০ ইউরো জরিমানা গুণতে হতো!
সকাল নয়টায় ব্রাসেলস এয়ারপোর্টের লাইন দেখে আমাদের মাথায় আক্কেল গুড়ুম! ইমিগ্রেশন পার হতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লেগে গেলো। সারা ইউরোপ যেন বেলজিয়ামে এসে তাদের নিউ ইয়ার উদযাপন শেষ করেছে। বেলা বারোটা নাগাদ ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এ৩২০ বিমানে চড়ে লন্ডন গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে এসে নামলাম। এয়ারলাইন নামক বাসে চেপে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীরে ফিরে যাচ্ছে নিজের শহর অক্সফোর্ডে। পেছনে ফেলে এসেছি কিছু নতুন বন্ধু, কিছু অসাধারণ মুহুর্ত আর স্মৃতিময় একটা বছরকে।
Brussels is as beautiful as Europe can get.