একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের যাকাত দেয়ার গল্প
Jun 8, 2017 | 18095
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের কথা। তখন বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। নিজের খরচ চালাতে উদ্ভাসে কেমিস্ট্রি পড়াতাম। ইতোমধ্যেই প্রায় তিন-চার’শ ক্লাস নিয়ে ফেলেছি। আয়-ইনকামও মাশাল্লাশ অনেক। যথারীতি কম বয়সের মানুষের হাতে বেশী টাকা থাকলে অপ্রয়োজনীয় গ্যাজেট কিনে সেটা নষ্ট করবো — এটাই স্বাভাবিক!
তো, মা’মনির উপদেশে তিন লাখ টাকার সঞ্চয় পত্র কিনেছিলাম। ভাবলাম কোন এক দুর্দিনে হয়তো টাকাটা কাজে আসবে। তাছাড়া সঞ্চয় করতে শিখা উচিত। ইত্যাদি ইত্যাদি…
ঠিক তার পরের বছরের রমজান মাসে আম্মু আমার সাথে কথা বলতে বসলো! সংলাপ কিছুটা বাড়তেই আম্মাজান বলিলেন আমার উপর নাকি যাকাত ফরজ হইয়াছে! ফিফা ২০১৪ খেলারত অবস্থায় এই কথা শুনে প্রথমেই গেইম পজ করলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নেহায়াত বাচ্চা ছেলে আমি। আমার উপর নাকি যাকাত ফরজ?
আমি বেশ নড়েচড়ে বসলাম। আম্মা আর আমার সংলাপ চলতে থাকলো:
— তোমার সঞ্চয় পত্র যেন কত টাকার?
— এইতো, তিন লাখ টাকার।
— এক বছর হয়েছে?
— হুম!
— এই টাকা তোমার কোন ভরণ-পোষণে কাজে আসে?
— না। এইটা সেইফটি মানি। ধরো, তোমার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলো। তখন এইটা কাজে দিবে।
— রুপার ভরি কত জানো?
— না! তবে কেমিস্ট্রির ভাষার রুপার নাম আর্জেন্টাম। মলিকুলার ম্যাস 107.9। এটা এক ধরণের অবস্থান্তর মৌল বা ট্রানজিশন মেটাল।
— থাপ্পড় দিয়া দুই চাপার দাতঁ ফেলায় দিবো। ইতরামির সীমা থাকা দরকার। রুপার নাম রুপা। প্রতি ভরি ৯৯১ টাকা। তো, তোর কাছে সাড়ে ৫২ ভড়ি রুপার বেশি টাকার সম্পদ ব্যাংকে বেকার পড়ে আছে। তোর উপর যাকাত ফরজ!
বাইশ বছর বয়সে নিজের উপর যাকাত ফরজ করে ফেললাম! এর আগে লাইফে বেস্ট অ্যাচিভমেন্ট ছিলো ফিফা গেইমে ৯৫% পজিশন রেখে ২-০ তে ম্যাচ জিতা।
সে রাতে তো আমার ঘুম হারাম! শীট! যাকাত কীভাবে দিতে হয়? কেন দিবো? আমার এতো কষ্টের টাকা সব দিয়ে দিতে হবে? এইটা কোন কথা?
প্রথমে গুগলে সার্চ দিলাম। ইসলামিক ইতিহাস ঘেটে বেশ অবাক হলাম। মুসলিম রাষ্ট্র গুলো অনেক ঘটা করে যাকাত দিয়ে থাকে। কিছু কিছু রাষ্ট্রে সেটা এতো সুন্দরভাবে বন্টন করা হয় যে, সেখানে যাকাত দেবার মতো মানুষ খুজেঁ পাওয়া যায় না। তারা প্রায়ই বাংলাদেশের মতো দেশে সেই বেচেঁ যাওয়া অর্থ পাঠিয়ে দেয়!
আমি কিছুটা কনভিন্সড হলাম। কিন্তু, কত টাকা যাকাত দিবো?
গুগল বললো, আমার সম্পদের মাত্র ২.৫%!
আমি তো বেশ অবাক! মাত্র ২.৫%! আমি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে তো ভ্যাট দেই ১৫%. সেই তুলনায় ২.৫% তো বেশ কম।
মা’মনিকে গিয়ে বললাম, আচ্ছা, যাকাত দেয়া যায়। আইডিয়াটা খারাপ না। কিন্তু, আমার বেশ দামী আইফোন, আইপ্যাড আছে। এইগুলার উপরেও কি যাকাত দিতে হবে?
আম্মা বললো, এইগুলা তোর দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। আইফোনে তুই আমার সাথে কথা বলস। আইপ্যাডে দুনিয়ার সব পিডিএফ পড়তেসোস। এক আইপ্যাডের কারণে তোর হাজার হাজার টাকার বই কেনা লাগে নাই। এইগুলার উপর যাকাত নাই।
বাহ! সুন্দর তো। ইসলাম তো বেশ লজিকাল দেখি। বুঝতে পারলাম এইটাকে কেন ধর্ম না বলে প্রায়ই জীবন ব্যবস্থা বলে।
ক্যালকুলেটরে হিসাব করতে বসলাম। তিন লক্ষ টাকার ২.৫% হলো ৭,৫০০ টাকা। মোটামুটি আমার একটা টিউশনির একমাসের বেতন।
তখন মাথায় আসলো অন্য চিন্তা। আমি প্রতিদিন বাইরে মোটামুটি ৩০০-৪০০ টাকার খাবার খাই। সারাদিন টিউশনি করতে গেলে এছাড়া উপায় থাকে না। একমাসে আমার ফাস্টফুডের খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। সে তুলনায় সাড়ে ৭ হাজার টাকা খুব বেশি কিছু না।
যাই হোক ঠিক করলাম, যাকাত দিবো। কিন্তু, কাকে?
আবারো গুগলকে জিজ্ঞাসা করলাম। উনি উত্তর দিলেন, আগে নিজের পরিবারের এমন আত্মীয়কে যাকাত দিতে হবে যে নিজের অভাবের কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না।
বাহ! নাইস। আম্মাকে বললাম এমন কে আছে?
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আম্মুকে সারাদিন অফিসে থাকতে হতো। শানুখালা নামে আমাদের বাসায় গ্রামের একটা মেয়ে থাকতেন। উনি মূলত আমার সব দেখাশোনা করতেন। শানুখালা এখন গ্রামে থাকেন। আম্মু তার বিয়ে দিয়েছে। তাদের পরিবারকে গরু কিন দিয়েছে। তারপরও ৬ জনের সংসার টানতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। উনার মেয়েটা নাকি ক্লাস এইটে বৃত্তিও পেয়েছে।
কোন চিন্তা না করেই ৫ হাজার টাকা তাকে পাঠিয়ে দিলাম। বললাম, উনার মেয়েটার সামনে SSC পরীক্ষা। ৫ হাজার টাকা অনেক কম। কিন্তু, প্লীজ তাকে বইলো মেয়েটাকে যেন অন্তত ফিস দিয়ে স্কুলে পাঠায়। গরু পেলে অভাব দূর হবে না। এই মেয়ে পড়ালেখা শিখলে অভাব দূর হবে। পেটের অভাব না মিটলেও অন্তত মনের অভাব মিটবে।
হাতে আরো ২৫০০ টাকা আছে। সেগুলোকে ভাঙ্গিয়ে সব একশত টাকার নোট বানালাম। এইটা কতটুকু ইসলাম সম্মত জানি না। কিন্তু, একটা সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট করা শুরু করলাম।
প্রতিদিন রোজায় রিকশা দিয়ে যাই। গরমের দিনে রিকশাওয়ালারা প্রায় মারা যায়। ধরুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেইলী রোডে স্টুডেন্ট পড়াতে গেলাম। ভাড়া ৫০ টাকা। রিকশা থেকে নেমে প্রথমে ৫০ টাকা দিতাম। তারপর, হাসি দিয়ে বলতাম: “চাচা, এই রোদে রোজা রেখে কষ্ট করে নিয়ে আসলেন। এই ধরেন আরো ১০০ টাকা। ভালো করে ইফতার কইরেন।”
কয়েক জন বেশ নরমাল ভাবেই নিতো। কিন্তু, কয়েকজন তো প্রায় কেদেঁই দেয়। মাইগড! ১০০ টাকা পেয়ে তারা এতো খুশি! দুই লিটার কোকের দাম ১০০ টাকা। এই সামান্য টাকা তাদের চোখে পানি এনে দেয়?
জীবনে প্রথমবার যাকাত দিতে গিয়ে মানুষের আসল অভাবটা বুঝতে পারলাম। আমার কাছে যেটা একটা বার্গারের দাম, সেইটা অনেক লোকের একদিনের সংসার খরচ। আমি বার্গারটা একদিন না খেয়ে সেই টাকাটা দান করলে ওই লোকটার পুরো পরিবার খাবার পায়। জিনিসটা এতোটাই সহজ।
ছোট বেলায় একটা নাটক দেখেছিলাম। নাম ছিলো সম্ভবত “নাল পিরাণ”। ছোট একটা বাচ্চা তার বস্তিবাসী মার কাছে বায়না ধরে ঈদে লাল রং-এর একটা শার্ট কিনে দেবার জন্য। হঠাৎ, এলাকায় মাইকিং হয় যে, চৌধুরি বাড়িতে ২২ রমজানের দিন যাকাতের লুঙ্গি-শাড়ি দেয়া হবে। গরীব মা তার ছেলেকে নিয়ে যায় যাকাতের একটা শার্ট মিলবে সে আশায়।
ফ্রি-তে নতুন কাপড় পাবার আশায় চৌধুরি বাড়ির প্রধান দরজায় শত শত মানুষের ভীড় জমলো। দরজা খুলতেই সবাই দিলো দৌড়। লাল শার্ট বিলাসী সেই বাচ্চা আর তার মা মানুষের পায়ের চাপায় মারা গেলো। এই ঘটনা এই রমজানেও ঘটবে।
অনেক টাকার মালিক মানুষগুলো তাদের আভিজাত্য জাহির করেন বেশ বাজে কাপড়ের যাকাতের শাড়ি ও লুঙ্গি দিয়ে। বঙ্গবাজারে গেলে দেখবেন “এই খানে যাকাতের লুঙ্গি-শাড়ি পাওয়া যায়” শিরোনামে সাইনবোর্ড ঝুলছে। এই একটা শাড়ি কিংবা লুঙ্গি দিয়ে আপনি কারো অভাব দূর করতে পারবেন না; শুধু এলাকায় নিজের নামই ফাটাতে পারবেন। এইটা যাকাত দেয়া না; পরবর্তী ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচনের প্রচার।
সত্যিকার অর্থে অভাব দূর করতে হলে নিজের যাকাতের টাকাটা সীমিত কয়েকজন মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেন। একসাথে পাচঁ হাজার মানুষের ১০ টাকার অভাব না মিটিয়ে দুই জন মানুষের এক মাসের সংসার চালানোর ব্যবস্থা করে দিন। আমার মা কিছু হলেই গরু কিনে দেয়। তার লজিক হলো, গরুটা পেলে সে দুধ বিক্রি করবে। এতো তার সংসারের একটা সবসময়ের আয়ের উৎস সৃষ্টি হবে।
শেষ করবো আমার সেই হাতেম-তাই সেজে ১০০ টাকা বিলানোর ঘটনা দিয়ে। সত্যি কথা হলো, ১০০ টাকা দান করে আমি রিকশাওয়ালাদের বিশেষ কোন উপকার করতে পারি নাই। কাজটা অনেকটা শাড়ি-লুঙ্গি বিলানোর মতো হয়েছে। তবে প্ল্যানটার একটা দারুন দিক অবশ্যই আছে। অনেক গুলো মানুষের অভাবের আচঁটা অত্যন্ত কাছ থেকেই বুঝতে পেরেছি। এরপর অযথা ১০০ টাকা খরচ করতে গেলে বেশ গায়ে লাগে।
২০১৪ সালের ২৮ রমজানের ঘটনা। রিকশা করে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর যাচ্ছি। রিকশাওয়ালা বুড়া চাচার শার্টের পিছনটা ছেড়াঁ। সেই ফাকাঁ জায়গা দিয়ে তার ঘর্মাক্ত কালো দেহটা দেখা যাচ্ছে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দেয়ার আগেই চাচা বললেন, “বাবা, সারাদিন রোজা রেখে কষ্ট করে রিকশা চালাইছি। পড়ার মতো একটা শার্ট নাই। কয়টা টাকা বাড়াইয়া দিও।”
আমি হাতের একশ টাকার নোট-টা নিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সামনেই দেখলাম একটা বেশ দামী কাপড়ের দোকান। আমি চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, “চাচা, আমি কখনো ঈদে কেনাকাটা করি না। আমার বাবাকে কখনো আমি দেখি নাই। উনি জন্মের আগে মারা গেছেন। বেচেঁ থাকলে হয়তো তাকে ঈদে একটা শার্ট কিনে দিতাম। কিছু মনে না করলে আপনাকে কিনে দেই?”
লোকটা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। উনি রিকশা বাইরে রেখে কোথাও যাবেন না। আমি অগত্যা ভাড়া না দিয়ে দৌড় দিয়ে দোকানে ঢুকলাম। একটা সুন্দর নীল শার্ট ও সুন্দরী সেলস গার্লকে সাথে নিয়ে বের হয়ে আসলাম। চাচার পিঠে ধরে একবার মাপ দিয়েই বুঝলাম সাইজ হবে। ব্যাস! পেমেন্ট করে চাচার হতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলাম। লোকটার চোখ থেকে তখন ঝরঝর করে পানি পড়ছে। আমি খিলখিল করে হাসছি। কী নির্মমতা!
বাসায় আসার পর বুঝলাম, চাচার ভাড়া দিতে ভুলে গেছি। চাচা, মাফ করে দিয়েন।