ইতালি থেকে বলছি
May 27, 2020 | 3166
প্রিয় বিশ্ব,
যেহেতু আমি ইতালিতে বসে এই চিঠিখানা লিখছি, সেহেতু এই কথাগুলোকে তোমরা অনেকটা ভবিষ্যৎ বাণী হিসেবে গ্রহণ করতে পারো। আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে তোমাদের আগমণ এখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই মহামারীর নির্মম লেখচিত্রে আমরা সবাই এখন একই পথের সারথী।
ঠিক যেভাবে এই দৌড়ে হুয়ান প্রদেশ আমাদের থেকে কয়েক সপ্তাহ এগিয়ে ছিলো, সেভাবে আমরাও তোমাদের থেকে এগিয়ে আছি। তোমরা এখন যা করছো আমরাও ঠিক সেই কাজগুলো করে এসেছি। তোমাদের মাঝে একদল এই দূর্যোগকে “হাল্কা-সর্দি-কাশী” বলে উড়িয়ে দিতে চাবে; অন্যদল বুঝতে পারবে মহামারীর আসল গভীরতা। এই দুই দলের মধ্যবর্তী হাস্যকর ঝগড়া-বিবাদও আমরা দেখে এসেছি।
যেহেতু আমি তোমাদের ভবিষ্যতে বসে আছি, সেহেতু আমি হলফ করে বলতে পারবো তোমাদের সাথে কী হতে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় হয়তো ইতোমধ্যেই লক-ডাউন শুরু হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটাকে সামাজিক বৈষম্য বলে গালি-গালাজ করে তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো জর্জ ওরয়েল, এমনকি থমাস হবসের মতো লেখকদের উক্তি আওড়ানো শুরু করবে। কিন্তু, খুব শীঘ্রই তোমরা বুঝতে পারবে এই লক-ডাউনের কোন বিকল্প নেই।
প্রথমত, যে কয়েকটা কাজ লক-ডাউনের মাঝে তুমি ঠিক আগের মতো করার স্বাধীনতা পাবে তার মাঝে অন্যতম হলো খাওয়া। তাই, তুমি কারণে-অকারণে খাবার নিয়ে বসবে।
তোমার বন্ধুরা তোমাকে হাজারটা ফেসবুক গ্রুপে অ্যাড করে প্রোডাক্টিভিটির জ্ঞান ঝাড়া শুরু করবে। তুমি প্রথম দু-একদিন সেগুলোতে চোখ বুলাবে। তারপর সেই পোস্টগুলোকে দেখামাত্রই দ্রুত স্ক্রল করে চলে যাবে।
বিজ্ঞজনের মতো বইয়ের তাক থেকে গুরুগম্ভীর হাজারটা গল্প-উপন্যাস বের করে আলিশান ভাবে পড়তে বসবে। দু-এক পাতা পড়া মাত্রই তোমার সকল আগ্রহ-উত্তেজনা হারিয়ে যাবে। তুমি বুঝতে পারবে, কিছুই যেন আর ভালো লাগে না।
অগত্যা তুমি আবার খাবার নিয়ে বসবে। তোমার হয়তো ঠিকমতো ঘুম হবে না। নির্ঘুম চোখে তুমি হয়তো গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে কয়েক ঘন্টা চিন্তা করবে।
মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপ, জুম মিলিয়ে তুমি একটা অবিরাম সামাজিক বন্ধনে জড়িয়ে যাবে। চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারবে না।
তুমি তোমার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের অভাব অনুভব করতে শুরু করবে। ‘হয়তো আরেকবার তোমার তাদের সাথে দেখা নাও হতে পারে’—এই চিন্তা তোমাকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রাখবে।
পুরাতন ঝগড়া-বিবাদ সবই অর্থহীন হয়ে যাবে। জীবনেও যার চেহারা দেখবেনা বলে পণ করেছিলে ঠিক তাকেই অবশেষে মেসেজ পাঠিয়ে বসবে।
অনেক নারী গৃহ নির্যাতনের শিকার হবেন।
যাদের কোন ঘর-বাড়ি নেই তাদের কথা চিন্তা করে তোমার বেশ মন খারাপ হবে। রাতের বেলা (বিশেষ করে মেয়েদের) বাহিরে যেতে ভয় করবে। প্রায়শই চিন্তা করবে— “এভাবেই কি সমাজের পতন ঘটে? ব্যাপারটা কি এতটাই সহজ?”। যখন এই বেদনার সাথে আর যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারবে না ঠিক তখন তুমি আবার খেতে বসবে।
তোমার ওজন বাড়বে। তুমি ইউটিউবে ব্যায়াম, ইয়োগার ভিডিও দেখা শুরু করবে।
তুমি হাসবে; অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে। তোমার যত রস আছে তাকে চিরতার মতো চিপে চিপে বের করতে চাইবে। এমনকি জগতের সবচেয়ে বাস্তববাদী মানুষটাও জীবন-জগতের অসাড়তার কথা আওড়াবে।
তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে একপলক দেখতে তার সাথে পরিকল্পনা করে মুদি দোকানে বাজার করতে যাবে। দুই মিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে তোমার চোখজোড়া তার মুখশ্রীটাকে মনের ভেতর আরেকবার এঁকে নিবে।
বাসায় যে জিনিসগুলোর দরকার নেই তুমি তার লিস্ট করতে বসবে।
বাসার অন্য মানুষগুলো আসল স্বভাব-চরিত্র তুমি অবশেষে বুঝতে পারবে। এই লক-ডাউনের পর আর কাউকে চিনতে বাকি থাকবে না।
যে সুশীল সমাজ একসময় টেলিভিশনের টক-শো কাঁপিয়ে বেড়াতো তারা সবাই আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে। তাদের কেউ কেউ এসে তোমার সামনে মায়া-মমতাহীন এক ভবিষ্যতের চিত্র আঁকবার চেষ্টা করবে। একসময় তুমি বিরক্ত হয়ে তাদের কথা শোনা বন্ধ করে দিবে। অন্যদিকে যাকে সারা জীবন পাত্তা দাও নি, তাকেই তোমার বিশ্বস্ত, সহনশীল এবং ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা বন্ধু বলে মনে হবে।
কিছু পরিবেশবাদী এই সুযোগে ‘পৃথিবী কীভাবে এখন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে?’— তার ব্যাখ্যা দিয়ে এই দূর্যোগের এক বৃহত্তর স্বার্থের কথা শোনাবে: পৃথিবীর কার্বন নি:সরণ এখন অর্ধেক হয়ে গেছে, প্রকৃতি এখন ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভালো কথা! কিন্তু, আমার আগামী মাসের বাড়ি-ভাড়াটা আসবে কোথা থেকে?”
তোমার কাছে এই ‘নতুন সজীব পৃথিবী’র জন্মকে এক নির্মম অভিজ্ঞতা বলে মনে হবে।
তুমি গিটার হাতে গাইতে বসবে। আমরা যখন ইতালির বারান্দায় বসে প্রতিবেশীদের মন ভালো করতে গান গেয়েছি তখন তোমাদের অনেকেই এটাকে ‘ইতালিয়ানা’ বলে হাসি-তামাশা করেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে সেই তোমরাই বারান্দায় বসে, ফেসবুকের লাইভে এসে গিটার হাতে সুরের মূর্ছনা তুলবে। আর আমরা তখন ইতালির ব্যালকনিতে বসে মাথা নেড়ে তোমাদের আচরণকে সায় দিয়ে যাবো; ঠিক যেমনটা গত ফেব্রুয়ারি মাসে হুয়ান করেছে আমাদের দিকে তাকিয়ে।
তোমাদের অনেকই প্রতিরাতে ঘুমাতে যাবার আগে নিজের কাছে মনে মনে পণ করবে— ‘লক-ডাউন শেষ হবার সাথে সাথেই ডিভোর্স ফাইল করবো।’
অনেক নবজাতকের জন্ম হবে।
বাচ্চারা অনলাইনে ক্লাস করতে শুরু করবে। তারা তোমার জীবনটাকে একটু অসহ্য করে তুলবে; আবার এরাই তোমাকে বাঁচতে শেখাবে।
বৃদ্ধরা কিশোরীসুলভ আচরণ করা শুরু করবে। তাদেরকে মোটামুটি যুদ্ধ করে ঘরে বসিয়ে রাখতে হবে।
আইসিইউর বিছানায় শুয়ে একা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার কথা চিন্তা করে তোমার খারাপ লাগবে।
ডাক্তারদের হাঁটার রাস্তাটার ওপর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে আসতে ইচ্ছে করবে।
জীবনে প্রথমবারের মতো সমাজের সবাই নিজ স্বার্থের বাহিরে এসে কোন উদ্দেশ্যে একসাথে কাজ করা শুরু করবে। অনেকেই এর মাঝে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাবে।
সবশেষে, টাকা হয়ে দাঁড়াবে সবচেয়ে বড় ভাগ্যনির্ধারক। বড়লোকের বাড়ির বাগানের আয়েশী লক-ডাউন আর বস্তির ছুপড়ি ঘরের ঠাসা-ঠাসি এক হবে না। বাসায় বসে কাজ করতে অসহ্য লাগবে; আর অসহ্য লাগবে চোখের সামনে নিজের চাকুরিটা চলে যেতে দেখে। যে নৌকায় করে আমরা এই মহামারীর দুর্যোগ পাড়ি দিচ্ছি সেটা সবার জন্য এক হবে না; কখনো সেটা এক ছিলও না।
এক সময় বুঝতে পারবে, তুমি আর এটা নিতে পারছো না। তুমি হয়তো কাছের মানুষের কাছে নিজের ভয়টা স্বীকার করে ফেলবে; অথবা হয়তো তাদেরকে নিদারুন যাতনার হাত থেকে বাঁচাতে নিজের ব্যাথাটা লুকিয়ে রাখবে।
অত:পর তুমি আবার খেতে বসবে।
ইতালিতে বসে আমরা তোমার এই ভবিষ্যতই দেখতে পাচ্ছি। তবে এটা খুবই ছোট পরিসরের ভবিষ্যৎ বাণী। যদি আমরা একটু দূরের ভবিষ্যতের কথা বলতে চাই, সেটা তোমার-আমার দুজনের কাছেই অজানা। শুধু একটা কথাই হলফ করে বলতে পারি— “যখন এই সবকিছু শেষ হবে, এই পৃথিবী আর আগের মতো রইবে না।”
ইতি
ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রি
ইতালীয় ঔপন্যাসিক
মূল লেখাটি ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ৩০ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। ভাষান্তর করেছেন শামীর মোন্তাজিদ।