A Year in Space
May 27, 2020 | 5225
ধরুন, আপনাকে প্রায় একবছরের জন্য মহাকাশে ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানানো হলো। রকেটে চেপে পৃথিবীর বাহিরে যেয়ে থাকাটা চাট্টিখানি কথা নয়। রকেট উড্ডয়নের সময়ই অনেক দূর্ঘটনা ঘটে। আজ পর্যন্ত রকেট দূর্ঘটনায় মারা যাওয়া নভোচারীর সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়। ধরুন, আপনি ভাগ্যবান। সশরীরে মহাশূণ্যে পৌঁছেও গেলেন। আপনার নভোযানটা মহাকাশের আন্তর্জাতিক স্পেশ স্টেশনে (International Space Station, ISS) যেয়ে যুক্ত হলো। পৃথিবীর বাহিরে সেই একাকীত্বের কালো সমুদ্রে আপনি কি পারবেন দীর্ঘ একটা বছর কাটিয়ে আসতে?
উত্তর দেয়াটা বেশ কঠিন। মহাকাশে দিন কাটানোর বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে। আমরা পৃথিবীর অভিকর্ষের জালে বড় হওয়া মানুষ। হঠাৎ করেই মহাশূণ্যের বাধাহীন শূণ্যতায় আমাদের শরীর মানিয়ে নিতে পারে না। চিন্তা করে দেখুন, আপনার রক্ত প্রবাহ, মলত্যাগ, মূত্র বিসর্জনের প্রক্রিয়াগুলোতেও কিন্তু অভিকর্ষের প্রভাব আছে। যখন সেই ওজনহীন পরিবেশে একজন মহাকাশচারী বাস করা শুরু করে তখন তারা শরীর নতুন করে এই প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করে। অভিকর্ষহীনতার কারণে আমাদের মেরুদন্ডের কশেরুকাগুলো একটি অপরটি থেকে দূরে সরে যায়। মহাকাশে থাকলে একারণে নভোচারীদের উচ্চতা কিছুটা বেড়ে যায়। এছাড়াও নভোচারীদের প্রায়ই হৃদরোগ এবং ওজনহীনতার সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়।
মানসিক সমস্যাটা আরো প্রকট। আপনি ২৪ ঘন্টায় হয়তো কয়েকবার সূর্য উঠতে দেখছেন। আপনি পৃথিবীর আকাশের দিকে তাকিয়ে যেভাবে চাঁদ দেখে অভ্যস্ত হয়তো সেই একই ভাবে আপনি ISS থেকে পৃথিবীকে দেখছেন। মহাকাশযানের ভেতরকার পানি মূলত আপনার নিজের পরিশোধিত বর্জ্য থেকেই আসছে। আর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো শূণ্যতা। আপনার হাত থেকে কিছু পড়ে গেলে সেটা নিচে না যেয়ে ভাসতে থাকবে। আপনি কাঁদলে চোখের পানিও নীচে পড়বে না। কেমন লাগবে সেখানে যেয়ে একটা বছর থেকে আসতে?
বিজ্ঞানের স্বার্থে এই কাজটাই করেছেন মার্কিন নভোচারী স্কট কেলী। ২০১৫ সালে শুরু হয় তার “A year in space” প্রজেক্ট। প্রায় ১১টি দলের গবেষক এই প্রোগ্রামে অংশ নেয়। মানবদেহের উপর মহাশূণ্যের প্রভাব বের করাটাই ছিলো এই মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এটি ছিলো একটি “Twin Study”. স্কট কেলীর জমজ ভাই মার্ক কেলী সেই সময় জুড়ে পৃথিবীতে অবস্থান করে। কিছুদিন পর পরই একই সময়ে এই দুই ভাইয়ের শরীর থেকে রক্ত, মূত্র ইত্যাদি নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হলো। ২০১৬ সালে স্কট পৃথিবীতে ফেরত আসার পর তাদের DNA, জিনের বহি:প্রকাশ বিশ্লেষণ করে দেখা হলো। মজার ব্যাপার হলো, DNA সিকুয়েন্সের কোন পরিবর্তন না হলেও স্কটের দেহের ৭% জিন মহাকাশে থাকতে ভিন্নমাত্রায় প্রকাশিত হতো। এই প্রোগ্রাম থেকে আরো ভালো করে বোঝা গেল, মহাশূণ্যতা আমাদের দেহকে প্রভাবিত করে— সেটা মানসিক দিক থেকে শূরু করে প্রোটিন লেভেল পর্যন্ত।
এটা ছিলো বিজ্ঞানীদের প্রাপ্তি। গবেষণার ফলাফল ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকায়। কিন্তু, সবচেয়ে সুন্দর গল্পটা আমি ব্যক্তিগতভাবে উপভোগ করেছি স্কট কেলীর টুইটারে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ১১ মাস জুড়ে স্কট কেলী আমার অন্যতম পছন্দের মানুষে পরিণত হয়। আমি নিজে কখনো টুইটার ব্যবহার করি না। কিন্তু, শুধু সেই সময়টায় আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে একবার স্কট কেলীর টুইটগুলো দেখতাম। ISS থেকে তোলা ছবিগুলো তিনি কয়েক ঘন্টা পরপরই আপলোড করতেন। চাইলে # ayearinspace হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সেগুলো টুইটারে খুজেঁ দেখতে পারেন।
আমাদের মানব জাতির ইতিহাসটা সাহসিকতায় ভরপুর। বন-জঙ্গলে শিকার করে বেড়ানো মানুষগুলো কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে যান্ত্রিক সভ্যতা গড়ে তুলেছে। হয়তো আরো কয়েক হাজার বছরের মধ্যে আমরা মহাকাশের অন্য গ্রহে বসবাসও করতে শুরু করবো। প্রথম যে মানুষটা মঙ্গলে বসবাস করতে চলে যাবে সে নিশ্চয়ই চোখ বন্ধ করে চিন্তা করবে স্কট কেলীর কথা; তার সেই একবছর মহাকাশে থেকে গবেষণায় অংশগ্রহণ করার কথা। তার আগের একশ বছর ধরে শত শত মহাকাশ বিজ্ঞানীদের নির্ঘুম রাত কাটানোর কথা। মানবজাতিটা বেশ ভয়ানক রকমের সৃজনশীল; নি:সন্দেহে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী।
গল্পের শেষটা করবো স্কট কেলীর টুইটারের ঘটনা দিয়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বেশ মজার মানুষ। একদিন তিনি স্কট কেলীর ছবিগুলো দেখে তাকে টুইট করে বললেন, “Hey Kelly, loving the photos. Do you ever look out the window and just freak out?” উত্তরে স্কট পাল্টা টুইট করে বললেন, “I don’t freak out about anything, Mr. President. Except getting a Twitter question from you.”
জয়, মানুষের জয়!