স্নর্কেলিং, বিচ পার্টি, পি পি
May 27, 2020 | 4600
৫ জুলাই ২০১৮। আমাদের থাই ট্রিপের তৃতীয় দিন। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে সবাই ফেরী ঘাটের দিকে দৌড় দিলাম। কারণ সকাল নয়টায় ফুকেটের ঘাট থেকে পি পি আইল্যান্ড (Koh Phi Phi) অভিমুখে একটি ফেরী ছেড়ে যাবে। সেটা ধরতে না পারলে সব পরিকল্পনাই মাটি হয়ে যাবে।
অবশেষে কোনমতে সকাল ৮:৫০ মিনিটে আমরা ঘাটে পৌঁছলাম। ফেরীটা দোতলা— নীচ তলায় অনেকগুলো চেয়ার ঠাসাঠাসি করে বসার জায়গা করা হয়েছে। আর দো’তলাটা খোলামেলা। সেখানে হেঁটে বেড়ানো যায়; আন্দামান সাগরের সৌন্দর্যের সহচার্য পাওয়া যায়। নীচতলায় গাট্টি-বস্তা রেখে আমরা তাই দলে-বলে দোতলার ডেকে চলে গেলাম। প্রায় তিন ঘন্টার এই ফেরী যাত্রায় আমরা ফুকেট থেকে ক্রাবী অঞ্চলের পি পি দ্বীপের দিকে যাচ্ছি। থাইল্যান্ড বিশাল একটা দেশ। পুরোটা ভালোমতো ঘুরে দেখতে হয়তো মাস দুয়েক লেগে যেতে পারে।
ফেরী ছুটছে সাগরের বুক চিরে। আশেপাশে শুধু নীল পরিষ্কার পানি; সেই পানিতে উঠছে বড় বড় ঢেউ। অনেক দূরে সাগরের ঠিক মাঝখানে পাহাড়ের মতো উঁচু কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। কী অদ্ভূদ সেই দৃশ্য! ইচ্ছে করছিলো তখনই উড়ে সেই পাহাড়টার কাছে চলে যাই। কিন্তু, সেই শক্তি কোথায়? গত ৪৮ ঘন্টা ধরে সবাই শুধু দৌড়ের উপর আছি। দুই দিনে সর্বমোট ৫ ঘন্টা ঘুমিয়েছি। সবার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসছে। অগত্যা ফেরীর ডেকের ঠিক মাথার উপর বসে আমরা সবাই লাইন ধরে ঘুমিয়ে গেলাম।
থাই ট্রিপে অনেক ছবি তোলা হয়েছে। এর মধ্যে একটা ছবি আমার খুব বেশী প্রিয়। সেটা এই ঘুমের ছবি। কোন এক অভাগা (সম্ভবত রাকিন) না ঘুমিয়ে আমাদের ছবিটা তুলেছে। সেই ছবির বাম দিকটায় জিয়াউস শামস বেশ বিরক্ত চেহারা নিয়ে মাত্র ঘুম থেকে উঠে বসেছে। তার পাশে আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে শুয়ে আছি। এর পাশে আছে আয়মান, অভীপ্সু, শুভ এবং ইমু ইমু। শেষের দুইজনের মাঝে মাথায় কাপড় দিয়ে কে ঘুমাচ্ছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এই ছবিটা এখনো প্রায় দেখি। মনে হয় জীবনটা অনেক সুন্দর।
ছবির মতো সুন্দর সেই ঘুমটার অবসান ঘটলো বিশাল এক সাইরেনের শব্দে। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সাধারণত বেশ বিরক্ত লাগে। কিন্তু, আমরা বিরক্ত না হয়ে বরং মুখ হা করে চারপাশে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ আগে যে পাহাড়টার কথা বলেছিলাম আমরা এখন ঠিক সেই পাহাড়ের সামনে। কাছ থেকে সেটাকে গেরুয়া বর্ণের মাটির বিশাল একটা ঢিবির মতো মনে হলো। তার গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সবুজ গাছ। সেই গেরুয়া-সবুজ রং সমুদ্রের নীলের সাথে মিশে ভীষণ সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করেছে।
প্রায় বেলা ১২-টায় আমরা নোঙর ফেললাম পি পি দ্বীপে। দ্বীপটার প্রথম দর্শনেই প্রণয় হয়ে যায়। ঘাটের জায়গাটা তিন দিক থেকে পাহাড়-ঘেরা; অন্য দিকে বিশাল সমুদ্র। মাটিতে পা দিয়েই আমরা সবাই পাড় ধরে হোটেল অভিমুখে হাঁটা ধরলাম। আমাদের গন্তব্য পি পি মাইদা হোটেল। বুকিং.কম থেকে বেশ স্বল্প দামে ভালো মানের এই হোটেল জুটানো হয়েছে। দ্বীপটার ভেতরের দিকটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মতো। চিকন চিকন মাটির রাস্তা; সেটা এদিক সেদিক দিয়ে শাখা বের করে দ্বীপের বুকে ছড়িয়ে গেছে। প্রায় মিনিট দশেক হাটাঁর পর আমরা হোটেলে যেয়ে পৌঁছলাম। চেক-ইন করে রুমে ঢুকেই সবাই সাথে সাথে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমাদের রুমের জানালা থেকে হোটেলের বিশাল নীল পুলটা দেখা যাচ্ছে। আয়মান অতি উৎসাহে সবাইকে নিয়ে পুলে নামতে পায়তারা শুরু করে দিলো। বেচারাকে শান্ত করে কোনমতে আমরা সবাই ঘন্টা খানেকের মধ্যে গৃহত্যাগ করলাম।
বেলা বাজে দুইটা। খিদের জ্বালায় পেটে আগুন ধরেছে। আশে পাশে অনেকগুলো রেঁস্তোরা। সবাই ১৮০ বাথে বুফে লাঞ্চ দিচ্ছে। ফ্রাইড রাইস, চাওমিন, চিলি চিকেন, শ্রেডেড বীফ, স্যুপ— চাইনিজ আইটেমের সবই আছে। সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি সবাই মিলে পেটপূজো সেরে নিলাম। রেঁস্তোরা থেকে বের হতেই আমাদের পরিচয় হলো ‘চুন’ নামক এক ব্যক্তির সাথে। চুনের বাড়ি আমেরিকার লং আইল্যান্ডে। সে পি পি আইল্যান্ডে থাকে জীবিকার তাগিদে। তার একটা ছোট স্টীম বোট আছে। সেটা চালিয়ে সে রোমাঞ্চচারী ভ্রমণপিপাসুদের স্নর্কেলিং করতে নিয়ে যায়। জনপ্রতি মাত্র ৩০০ বাথের বিনিময়ে চুন আমাদেরকে ছয়টি লোকেশনে ডুব দিতে নিয়ে যেতে রাজি হলো। প্রয়োজনীয় লাইফ জ্যাকেট এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদিও চুনের বোটেই মিললো।
প্রায় তিনটা নাগাদ আমাদের বোট ছুটলো সাগরের বুকে। বিশাল বিশাল ঢেউের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোট্ট একটা নৌকা চলেছে। প্রায়ই নৌকাটা লাফিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে; কখনো বা ডানে বামে কাঁত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের মাথা ঘুরিয়ে বমি বমি ভাব হতে লাগলো (একেই সী-সিকনেস বলে)। আমি আর রাকিন পালাক্রমে অনেকক্ষণ নৌকার মাথায় বসে রইলাম। ফুরফুরে একটা বাতাস এলোমেলো চুলের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে। মাথার উপরের সূর্যটা ফিক করে একটা হাসি দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঠিক এমনই একটা পরিবেশে আমাদের বোট থামানো হলো।
টাইম টু ডাইভ।
চুন নৌকার পাশে একটা সিঁড়ি লাগিয়ে দিলো। আমরা লাইফ জ্যাকেট পড়ে চোখে-মুখে স্নর্কেলিং মাস্ক লাগিয়ে ঝুপ করে পানিতে নেমে গেলাম। প্রথম পাচঁ-দশ মিনিট চলে যাবে পাইপের মধ্য দিয়ে শ্বাস নেয়া শিখতে শিখতে। মাস্কের ভেতরকার পাইপের একটা মুখ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রাখতে হয়। L-আকৃতির পাইপটির অন্য প্রান্ত পানির উপরে থাকবে। নাকের বদলে শ্বাস নিতে হবে মুখ দিয়ে। একবার পাইপ যদি পানিতে ডুবে যায় তাহলে মুখের ভেতর লবণ পানি ঢুকে যাবে। বেশ কাড়িগড়ি ব্যাপার-স্যাপার। আমরা চার-পাচঁজন খুব সহজেই স্নর্কেলিং-এর মন্ত্রটা বশ করে ফেললাম। লাইফ জ্যাকেট আমাদের ভাসিয়ে রাখবে, পাইপ দিয়ে শ্বাস নিবো আর চোখে আছে সাঁতারুদের চশমা। এরপর আমাদের আর কে পায়?
চুন হঠাৎ করে একটা পাউরুটির টুকরা আমাদের মাঝখানে ছুড়ে মারলো। মুহুর্তের মধ্যে হাজার খানেক ছোট ছোট রঙিন মাছ আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। আমরা পানির মাঝে ডুব দিয়ে সেই মাছেদের সাথে সখ্যতা গড়ছি। আমার ধারণা ছিলো, মানুষ দেখে এরা হয়তো পালিয়ে যাবে। কিন্তু, সে ধারণাটা পুরোটাই ভুল। মাছদের দল জানে পানিতে তারাই রাজা। আমাদের মতো পাইপ দিয়ে শ্বাস নেয়া স্তন্যপায়ীদের তারা দুই পয়সার দাম দিলো না। নিজেদের আপন মনে তারা সাঁতার কেটে চললো। আমরা অবাক বিস্ময়ে দুচোখ ভরে সেই দৃশ্য মনের দেয়ালে এঁকে রাখলাম। নীল রঙের মাছগুলোর উপর হলুদ বর্ণের ছোপ। একটা মাছ গতির দিক পরিবর্তন করলে পুরো দলটাই সেদিকে চলে যায়। নেতাকে অনুসরণ করার ক্ষমতা এদের খুব ভালো।
এর মধ্যে আয়মান একটা পাউরুটির টুকরো নিজের হাতে নিয়ে পানিতে ডুবালো। তার উদ্দেশ্য ছিলো মাছগুলোর কাছ থেকে একটা আলাদা অ্যাটেনশন পাওয়া। কিন্তু, বিধি বাম। শতশত মাছ তার হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। পাউরুটির সাথে সাথে আয়মানের আঙ্গুলের সামান্য একটু মাংসও তারা ছিড়ে নিয়ে গেলো। ছেলেটার প্রতি দয়া না দেখিয়ে আমরা দাঁত বের করে হাসতে থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর চুন আমাদেরকে ডেকে বোটে তুলে আনলো। আমরা গেলাম দ্বিতীয় লোকেশনে। সেখানেও একই রুটিন। তবে মাছের দলটা বদলে গেছে। এবারের মাছগুলো প্রায় সবুজাভ নীল। পায়ের নীচে মিটার দুয়েক গভীরে একটা কোরাল রীফ দেখা যাচ্ছে। সেখানে একটা সামুদিক সাপ গোল হয়ে শুয়ে আছে। আমি বেশ উৎসুক হয়ে মাথা ডুবিয়ে সেই কোরাল-বনের খেয়ালিপনা উপভোগ করছি। হঠাৎ মাথা তুলতেই শামসের ডাক শুনতে পেলাম। সে বেশ বিরক্ত! কারণ, আমি এই ডুব দিয়ে থাকতে থাকতে চারপাশের দুনিয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাকীরা এতোক্ষণে বোটে উঠে গেছে। আমাকে অবশেষে চ্যাংদোলা করে টেনে তোলা হলো। লাইফ জ্যাকেটটা খুলে ক্লান্ত শরীরটাকে নৌকার মাথায় এলিয়ে দিলাম। গ্রীষ্মের সূর্যটা চেহারার উপর ঝলক দিয়ে গেলো আরেক বার।
লিওনার্দো দি ক্যাপরিওর “বীচ” মুভির শ্যুটিং হয়েছিলো “মায়া বে” নামক একটা জায়গায়। অসাধারণ সুন্দর সে দ্বীপের পাড়ে এখন আর কাউকে যেতে দেয়া হয় না। কারণটা খুবই দু:খজনক। “বীচ” সিনেমার সফলতার পর সারা দুনিয়ার মানুষ এই দ্বীপে ঘুরতে এসেছে। মানুষ যেখানে যায়; তার পিছু পিছু যায় প্লাস্টিক। ফলাফল ভীষণ মাত্রায় পরিবেশ দূষণ। আপাতত মায়া বে-কে বন্ধ রেখে তার পরিবেশকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিখ্যাত সেই “মায়া বে”র পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গেলাম। পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেন? ঘরের কোণায় বসে থাকলে হয়তো কোনদিনই এসব জায়গার কথা জানতে পারতাম না।
চুন সাহেব এরপর আমাদের নিয়ে গেলেন “মাংকি আইল্যান্ডে”। এই পর্যায়ে আমাদের আরামদায়ক থাই ট্রীপ ভিন্নমাত্রা গ্রহণ করলো। থাই আতিথেয়তার অন্য এক রূপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো সেখানে। যেই মুহুর্তে চুনের নৌকা দ্বীপের পাড়ে ঠেকলো, সেই মুহুর্তেই একদল বিশাল বানর লাফ দিয়ে আমাদের নৌকায় উঠে পড়লো। বানর দলের অধিপতি আমাদের নৌকা থেকে যা পারলেন তাই বগলদাবা করলেন। একটা কিশোর বয়সী বানর রাকিনের কোকের বোতলা নিযে এক ঢোকে তার পুরোটা শেষ করে ফেললো। এই দৃশ্য দেখে হ্যাডম-গোছের অন্য একটা বানর এসে তাকে শাসন করা শুরু করলো। চিৎকার চেচাঁমচিতে এক এলাহী কারবার! ততক্ষণে বানর-অ্যাটাক থেকে বাচঁতে আমরা সবাই পানিতে লাফ দিয়েছি। আন্দামান সাগরে ভাসমান অবস্থায় আমাদের বৈবর্তনিক মামাতো-ভাইদের জানোয়ার-মার্কা আচরণ দেখতে থাকলাম। অভীপ্সু তার ওয়াটার-প্রুফ আইফোন দিয়ে ছবি তুলছিলো। মাঝখানো শামস এসে সেই ফোনে পানি ঢুকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু, হিতে বিপরীত। শামসের নিজের পিক্সেল ফোনে পানি ঢুকে সেটা চার্জ নেয়া বন্ধ করে দিলো। ছেলেটা হাল্কা প্যারা খেয়ে আবার চিলে যোগ দিলো।
আমি আর শুভ তখন বেশ বিরক্ত। শুভ একটু পর পর হাস্যকর ভাষায় বানরগুলোকে গালি দিচ্ছে। তারপর সে কিছুক্ষণ চুন-কে গালি দিলো। শুভর ধারণা চুনের সাথে বানরদের যোগসাজশ আছে। অন্যদিকে বেশ কিছুক্ষণ চুনের দেখা মিললো না। এক জাপানী ভদ্রলোককে দেখলাম একটা বানরকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছবি তুলছেন। বানরটা হঠাৎ করে তার ক্যামেরাটা কেড়ে নিয়ে দিলো দৌড়। দ্বীপের বনে ঢুকে সে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে ক্যামেরাটা নাড়িয়ে ভেংচি কেটে গেলো। বানরদের এই চৌর্যবৃত্তি সম্পর্কে ভবিষ্যত ভ্রমণকারীদের তাই সাবধান হবার অনুরোধ রইলো।
অনেকক্ষণ এই বানর বংশের দাপাদাপি আর যন্ত্রণার পর অবশেষে চুনের আবির্ভাব ঘটলো। সে আমাদেরকে নৌকায় উঠিয়ে পরবর্তী লোকেশনের দিকে যাত্রা শুরু করলো। ততক্ষণে আমরা বুঝতে পারলাম সাগরের অবস্থা বেশ উত্তাল। নৌকাটা বেশ এলোপাথারি দোল খাচ্ছে। চুন জিজ্ঞাসা করলো আমরা আরো স্নর্কেল করতে চাই কিনা। সবাই একটু নীরব। কিন্তু, আমি আর অভীপ্সু হই হই করতে করতে আবারো পানিতে নেমে গেলাম। একটা ডুব দিয়ে মাথা তুলে দেখি নৌকা থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে চলে গেছি। সাগরের ঢেউ বাড়ছে; পানির টানও প্রচন্ড। তাই আমরা আবার নৌকায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু, সমস্যা হলো অনেক চেষ্টা করেও সাঁতার কেটে আমরা নৌকা পর্যন্ত যেতে পারছি না। এই পর্যায়ে একটু ভয় লাগতে শুরু করলো। কিন্তু, অভীপ্সু আর আমি হাল ছাড়লাম না। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চেষ্টা চালানোর পর অবশেষে আমরা আবার নৌকায় উঠে বসলাম। হাফ ছাড়তে ছাড়তে চুনকে বললাম, “চলো ফেরত যাই। আসমানের অবস্থা সুবিধের নয়।”
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমাদের নৌকটা ঘাটে ভিড়লো। পেছনে তাকিয়ে দেখি পুরো সমুদ্র আর আকাশ একসাথে কালো হয়ে এসেছে। পর দিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সেদিন পি পি থেকে দুটো স্নর্কেলিং বোট ঝড়ে নিখোজঁ হয়ে গেছে। আমি মনে মনে চিন্তা করতে থাকলাম, বড় বাচাঁ বেচেঁ গেছি!
পিপির ঘাটে বসে ক্লান্ত শরীরে আমরা সবাই তখন সমুদ্রের ঝড়ের সৌন্দর্য দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টির পানি ঠান্ডা, কিন্তু সমুদ্রের পানি গরম। পাড়ের বালিগুলো খুবই পরিষ্কার। আয়মান সেই বালিতে পা ঘঁষে স্ক্র্যাব-স্পা করার সিদ্ধান্ত নিলো। আমরা বাকিরাও আইডিয়াটা বাস্তবায়ন করতে গলা পর্যন্ত পানিতে বসে পা দুটো পরিষ্কার বালির উপর ঘষঁতে থাকলাম। দৃশ্যটা একবার চিন্তুা করে দেখুন। সাগরের মাঝখান ছোট একটা সবুজ দ্বীপের পাড়ে বসে ঝড়ের সময় পাহাড় ঘেড়া পরিবেশে উষ্ণ সমুদ্র আর ঠান্ডা বৃষ্টির পানিতে ভিজে নিজের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ গুলোর সাথে গল্প করছেন। কি চাই আর এই জীবনে?
ঝড় আমাদেরকে মোহান্বিত করে রেখেছে। কোনভাবেই আমরা সেই মোহ কাটাতে পারছি না। ঠান্ডায় একসময় গা কাঁপতে লাগলো। অবশেষে আয়মান আমাদেরকে জোর করে টেনে তুলে হোটেলে নিয়ে গেলো। সবাই একের পর এক গোসল করে গা শুকিয়ে নিলাম। রাজ্যের ক্লান্তি শরীরে ভর করেছে। এর থেকে বেশী ভর করেছে খিদে। সাঁতার কাটা অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম।
আমি আর শামস চোখের সামনে যে প্রথম দোকানটা দেখলাম সেটাতেই ঢুকে পিজ্জা খেয়ে নিলাম। তবে তার স্বাদে খুব একটা মুগ্ধ হতে পারলাম না। পেটে তখনো অনেক খিদে। সামনে একটা ম্যাকডোনাল্ডস’ দেখে তার ভেতর ঢুকে পড়লাম। সেখানে দ্বিতীয় দফায় পেটপূজো হলো। বাকী বন্ধুরা তখনো হোটেলে। শামস, অভীপ্সু, রাকিন, ইমু ইমু আর আমি একটা পাবে ঢুকে বসলাম। সেখানে লাইভ মিউজিক চলছে। সামনে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। এক থাই সুদর্শীনি নারী এসে আমাদেরকে কিছু পানীয় দিয়ে গেলো। আমরা হাল্কা আড্ডায় সারা দিনের ক্লান্তি কাটিয়ে নিলাম।
অবশেষে শুভ-আয়মানের দেখা মিললো এক থাই ফুডের দোকানে। আমরা সবাই ওদের সাথে ডেজার্টে যোগ দিলাম। থাইল্যান্ডের খুব বিখ্যাত ডেজার্ট হলো “ম্যাংগো স্টিকি রাইস”। সোজা বাংলায় মিষ্টি জাউ ভাতের সাথে একটা আম কেটে দিবে। এই বস্তুটা খেতে অমৃত। ঘন দুধে জ্বাল দিতে দিতে সেই জাউ ভাত রান্না করা হয়। আম-দুধ আর ভাতের মিশ্র সেই স্বাদ মনটাকে একেবারে খুশি করে দিলো।
রাতের খাবারের পর সবাই একসাথে একটা লম্বা হাঁটা দিলাম। পি পি দ্বীপটা খুব বড় নয়। ঘন্টা দুয়েক হাঁটলেই পুরোটা দেখে ফেলা যায়। বাংলাদেশের গ্রামের রাস্তায় হাঁটার সাথে সেই অনুভূতির বেশ মিল পেলাম। অবশেষে রাত্র ১১-টার দিকে সবাই হোটেলে যেয়ে ঘুম দিতে সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু, আমি ঘুমাতে নারাজ। কারণ, পিপির এই স্বর্গ কাল সকাল আটটায় ছেড়ে চলে যাবো। ঘুমিয়ে আমি সেই সুযোগ নষ্ট করতে চাই না। তাই, দলছুট হয়ে আমি অনেকক্ষণ জাহাজের ঘাটে বসে রইলাম। কিন্তু, যতই হোক ক্লান্তিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। হাল্কা বাতাস বইতেই দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো। অগত্যা ম্যাকডোনাল্ডস’ এর সামনে একটা বেঞ্চে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত্র তখন ১২ টা। মজার ব্যাপার হলো থাইল্যান্ডে আসার পর এখন পর্যন্ত এক রাতও হোটেলে ঘুমানো হয়নি। দোলনা-বেঞ্চ-বীচেই শুয়ে রাত কাটাচ্ছি।
রাত দু’টা নাগাদ প্রচন্ড বীটের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কোথাও গান চলছে, সেই বীটের দাপটে মাটি পর্যন্ত কাঁপছে। আমি তখন বীটের-গোলামে পরিণত হয়ে গেলাম। বীট যেদিক থেকে আসছে সেদিকে হেঁটে যাচ্ছি। বেশ কয়েকটা হোটেল পার হয়ে বীট আমাকে নিয়ে গেলো পি পি দ্বীপের অন্য প্রান্তে। সেখানে দেখতে পেলাম বেশ সুন্দর একটা বীচ। সেই বীচের পাড় জুড়ে অনেকগুলো পাব। সেই পাবের সামনের খোলা ময়দানে চলছে ধুন্ধুমার পার্টি। আমি তো তখন খুশিতে আত্মহারা। এক দৌড়ে সেই পার্টিতে ঢুকতেই দেখা মিললো বন্ধু শামস আর ইমু ইমুর। তারাও আমার মতো বীটের গোলামী করে এই পার্টিতে এসে হাজির। আমরা তিনজন বাকীসব ঘুমন্ত বন্ধুদের জীবনের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে সেই বীচ পার্টিতে চুটিয়ে লাফা লাফি করলাম। পার্টির সবাই তাদের গায়ে-পিঠে লুমিনেসেন্ট কালিতে ট্যাটু এঁকে নিয়েছে। সেই ট্যাটু চাঁদের আলোর নীচে সবুজ আর কমলা হয়ে জ্বলছে। প্রকৃতি আর পার্টির কী অদ্ভূত এক সম্মিলন এই পি পি আইল্যান্ড। দ্বীপটার একটা কোণা শান্তির কুড়ে ঘর; অন্য প্রান্তটা লাস ভেগাস!
সেই রাতে কখন আমরা হোটেলে ফিরেছি তা মনে নেই। তবে পরদিন সকালে উঠে এই পি পি দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে একেবারেই ইচ্ছে করছিলো না। সকালে হেলে দুলে আমরা সবাই কোনমতে ফেরীতে উঠে বসলাম। কিন্তু, মনটা তখন অনেক খারাপ। এই দ্বীপে আর কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারলে মন্দ হতো না। সমস্যা হলো, আমাদের ব্যাংকক ফেরার ফ্লাইট সকাল ১১ টায়। তাই তড়িঘড়ি করে ফেরী পার হয়ে কোনমতে আমরা এয়ারপোর্টে ঢুকে বিমানে গিয়ে বসলাম। ক্লান্তির একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে গেলো বুক দিয়ে। ভিয়েতজেটের বিমানে চড়ে ব্যাংকক শহরে ফেরত যাচ্ছি। কিন্তু, মনটা তখনো পড়ে আছে পি পি আইল্যান্ডের বীচ পার্টিতে কিংবা মায়া বে-র কোণায়।
If I had died during that snorkelling session in Koh Phi Phi, I would not have regretted my life choices. It was worth dying for.