স্ট্রিট ফুড, শপিং, ব্যাংকক
May 27, 2020 | 4778
৬ জুলাই বেলা তিনটার দিকে দলেবলে পুনরায় ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। এবার থাইরাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ব্যাংকক ঘুরে দেখার পালা। ব্যাংকক এক বিশাল মেগাসিটি। শপিং মল আর ফুড কোর্ডের পাশাপাশি এখানে চারপাশ জুড়েই দেখা যায় উঁচু উঁচু বিল্ডিং। অনেক মানুষের বাস এই শহরে; যার ফলশ্রুতিতে রাস্তায় ভীষণ ট্রাফিক জ্যাম। বিমানবন্দর থেকে আমরা ব্যাংককের বিখ্যাত মেট্রোরেল স্কাইট্রেনে উঠে চলে আসলাম সুকুমভিত নামক এলাকায়। সেখানে লাজ হোস্টেলে আমাদের ব্যাংককের রাত কাটাবার ব্যবস্থা হয়েছে বুকিং.কমের মাধ্যমে।
হোস্টেলে ঢুকেই আমরা সবাই বেশ অবাক হলাম। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর হোস্টেল ছিলো এটা। নীচ তলায় রিসিপশনের সামনে একটা গোলটেবিল বৈঠক করার জায়গা। সেখান থেকে দো’তলায় উঠলে একটা পরিপাটি রান্না ঘর আর ডাইনিং স্পেস। পাশেই মেঝের বড় একটা অংশ পুরোপুরি ফাঁকা; সেখানে একটা জাল ঝুলিয়ে কয়েকটা বালিশ রাখা। যে কেউ চাইলে এখানে শুয়ে থাকতে পারবে। কি সুন্দর চিন্তা করে বানানো হয়েছে এই জায়গাটা! ঘুমানোর বেডগুলো কিন্তু খুব বড় নয়; তবে পরিপাটি। একটা চিকন রুমে দশটা বেড। প্রতিটা বেডের সাথে একটা ছোট লাইট আর চার্জিং পোর্ট। মননশীল স্থাপত্যশৈলীর বদৌলতে এরা অল্প জায়গায় দশজনের জন্য অসম্ভব আরামদায়ক এক পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। এতো সুন্দর লোকেশন পেয়ে আয়মান আর রাকিন সাথে সাথে ভিডিও বানাতে লেগে গেলো। বাকীরা বেশ ক্লান্ত। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে হাত-মুখ ধুয়ে সোজা নীচে নেমে আসলাম। ব্যাংককে আছি মাত্র এক রাত্রি। হোস্টেলে সময় কাটালে অনেক কিছু মিস হয়ে যাবে।
নীচে নামতেই রিসিপশনে বসে থাকা থাই রমনীর সাথে পরিচয় হলো। তার নাম “বুম”। বুম আমাকে কোথায় যেতে হবে; কী খেতে হবে তার একটা ছোটখাটো লিস্ট বাতলে দিলো। হোস্টেলের দরজায় বেশ কিউট একটা কুকুর বসে আছে। সেটাকে হাল্কা আদর করে বেলা ছয়টা নাগাদ আমি নেমে আসলাম ব্যাংকক মেগাসিটির রাস্তায়। সদ্য পি পি আইল্যান্ডের নীল দরিয়া থেকে উঠে আসা এই নরাধমের প্রথম প্রথম রাস্তা বুঝতে একটু কষ্টই হচ্ছিলো। যতদূর চোখ যায় রাস্তা ভর্তি গাড়ি; রাস্তার দুপাশ জুড়ে ট্রাফিক লাইট জ্বলছে। বুঝতে পারলাম, মস্তিষ্কের কিছুটা জ্বালানী দরকার। সামনেই একটা কফিশপে ঢুকে এক কাপ কফি কিনে তাতে চুমুক দিতে দিতে আবার হাঁটা শুরু করলাম। শপিং মল ব্যাংককের এক বিশাল আকর্ষণ। সারা বিশ্বের মানুষ এখানে কেনা-কাটা করতে আসে। আমি প্রথমে ঢুকলাম MBK নামক এক বিল্ডিং-এ।
নীচ তলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত ঠাসা ঠাসা দোকান-পাট। জায়গাটা আমার কাছে অনেকটা ঢাকার বসুন্ধরা সিটির মতো লাগলো। তবে একটা বড় তফাত হলো ভালো ভালো ব্র্যান্ডের জিনিস বেশ কমদামে কেনা যায়। আমি সেখান থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ করে একটা ব্যাগপ্যাক কিনে ফেললাম। এর নাম দিয়েছি “মাউন্টেইন”। মাউন্টেইনকে নিয়ে আজও আমি যেকোন নতুন দেশ ঘুরতে চলে যাই; কোন লাগেজের প্রয়োজন হয় না।
শপিং সেন্টারে যাবার বড় সমস্যা হলো এর কোন শেষ নেই। আপনি চাইলে সারা দিন একটা মলেই কাটিয়ে দিতে পারবেন। কারণ, কেনার মতো বস্তুর কোন অভাব নেই। MBK থেকে আমার কেনা সবচেয়ে পছন্দের জিনিস হলো একটা পাসপোর্ট কভার যার উপর খোদাই করে আমার নাম লেখা আছে। মাত্র ১০০ বাথে এতো সুন্দর একটা স্যুভেনির পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো। এরপর পরিবারের সবার জন্য এটা-সেটা কিনতে কিনতে রাত ৯-টা বাজিয়ে ফেললাম। এপর্যায়ে কিছুটা অস্বস্তি লাগছিলো। আমি শপিং মলের মানুষ না; আমি রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ানোর লোক। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ব্যাংককের চায়না টাউনে খেতে যাবো। কিন্তু MBK থেকে সেই ইয়াওরাত চায়না টাউন বেশ দূরে। অগত্যা থাইল্যান্ডের বাইক শেয়ার অ্যাপ “গ্র্যাব” ব্যবহার করে একটা মোটর সাইকেল ডেকে আনলাম। মিনিট দশেকের মাথায় আমি পৌঁছে গেলাম চায়না টাউনে।
ইউটিউবে মার্ক ওয়েন্স নামক এক ভদ্রলোকের ভিডিও প্রায়ই দেখা হয়। মার্ক এই রাস্তায় এসে বিভিন্ন ধরণের খাবার খেয়ে তার রিভিউ করেছিলো। সেই লিস্ট ধরে আমিও চেখে দেখা শুরু করলাম। চায়না টাউনের রাস্তার দুপাশে অনেক জমকালো রেস্তোরা আছে। তবে আসল থাইল্যান্ডের স্বাদটা মিলবে রাস্তার পাশের ছোট ছোট টং দোকানগুলোতে। প্রথমেই আমি যেয়ে দাঁড়ালাম “শার্ক ফিন স্যুপ”-বিক্রেতার ঠেলাগাড়ির সামনে।
শার্ক ফিন স্যুপ খুবই ভয়ানক এক বস্তু। সেটা কেনো খেয়েছিলাম তা চিন্তা করে আজ পর্যন্ত বেশ পাপবোধ করি। জীবন্ত হাঙ্গর মাছ ধরে তার উপরের ফিনটা কেটে আহত জীবটাকে পানিতে আবার ছেড়ে দেয়া হয়। সেই ফিন দিয়ে এই স্যুপের ঝোলটা তৈরি। সমুদ্রে হাঙরের সংখ্যা হ্রাসের পেছনে এই স্যুপের বাজার কাটতি অনেকাংশেই দায়ী। তাই আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, শার্ক ফিন স্যুপ কখনোই খাবেন না। হাঙর মাছগুলোকে বাঁচতে দিন; এরা সামুদ্রিক পরিবেশের একটা বড় নিয়ামক।
শার্ক ফিন স্যুপ অসম্ভব দামী খাবারও বটে। রাস্তার এই টং-এ এর দাম প্রায় ১ হাজার টাকার মতো। বাদামী রং এর ঝোলের মধ্যে একটা শার্ক ফিনের টুকরো। সাথে নানা প্রজাতির থাই মশলা আর পাতা দেয়া হয়েছে স্বাদ বাড়ানো জন্য। ঝোলটা একদমই ঝাল নয়; বড়ং স্বাদটা কিছুটা পানসে। আর ফিনটা খেতে গেলে কচ কচ করে; অনেকখন ধরে চাবাতে হয়। জীবনে একবার চেখে দেখার জন্য খেয়ে দেখলাম। কিন্তু, ভবিষ্যতে আর কখনো এই বস্তু খাবো না বলে পণ করে বের হয়ে আসলাম। কারণটা এর স্বাদ নয়; বরং কারণ হলো হাঙর বাচাঁনো।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে চায়না টাউনে হেঁটে যাচ্ছি। যতদূর চোখ যায় শুধু খাবার আর খাবার। মাত্র ৫০ বাথের বিনিময়ে একটা দোকানে সুন্দর এক বাটি নুডুলস স্যুপ পেয়ে গেলাম। এই বস্তুটা থাইল্যান্ডে বেশ ভালো পাওয়া যায়। নুডুলসের সাথে বেশ সুন্দর একটা ঝোল থাকবে; উপরে ছড়িয়ে দেয়া হবে কয়েক টুকরো মাংস। খাবারের শেষে থাকবে একটা থাই আইস টি। সবকিছু হয়ে যাবে মাত্র ১০০ বাথের মধ্যে। থাইল্যান্ডের রাস্তার খাবারের মতো সুস্বাদু আর সস্তা খাবার আমি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখিনি।
নুডুলসের দোকান থেকে উঠে এরপর উপস্থিত হলাম একটা সী-ফুডের দোকানে। সেখানে কাঠির উপর কাবাবের মতো এক ধরণের বস্তু বিক্রি করা হচ্ছে। চিংড়ি আর অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণিকে কীমা বানিয়ে তা একটা সামুদ্রিক শৈবাল দ্বারা মুড়ো দেয়া হয়েছে। সেটাকে সয়া সসে ডুবিয়ে খেতে বেশ ভালো লাগে। ভিতরকার মাংসের স্বাদটা চিংড়ি/স্কুইড গোছের, শৈবালটা খেতে সুশি রোলের আবরণের মতো। আর সব থাই খাবারের সাথেই সয়া সসটা বেশ ভালো যায়। ৭০ বাথের সেই সী-ফুড খেয়ে পেটটা প্রায় ভরে গেছে। মুখ মিষ্টি করতে মাত্র ১০ বাথ খরচ করে রাস্তা থেকে একটা থাই প্যানকেক খেয়ে নিলাম। সেই প্যানকেক বানানোর কায়দাটা দেখার মতো। গরম প্যানের উপর চালের গুড়ার খামির দেয়া হয়। সেটা শক্ত হয়ে আসলে এর উপর খানিকটা সেমাই, কিশমিশ ছড়িয়ে এক বিশেষ কায়দায় কেকটাকে রোল করে দেয়া হয়। আপনি তাতে কামড় দিতেই প্রথমে কুড়মুড় করে খোলসটা ভেঙ্গে ফেলবেন; এরপর ভেতর থেকে মিষ্টি পুরটা মুখের ভেতর ছড়িয়ে পড়বে। আহা!
রাত বাজে সাড়ে দশটা। চায়না টাউনের খাদ্য-ভ্রমণ শেষই হচ্ছে না। কিন্তু, ততক্ষণে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সামনেই দেখলাম একটা দোকানে আস্ত হাঁস গ্রীল করছে। আমি সেই দোকানের ভেতরে ঢুকে এসিতে বসে একটা আইস টী খেয়ে নিলাম। তারপর হাঁসটাও একটু চেখে দেখার ফরমায়েশ দিলাম। অল্প একটু ভাতের উপর হাঁসের গ্রীলের টুকরো ছড়িয়ে আছে। সাথে এসেছে একটু ঝোল, কয়েকটা আদা আর সয়া সস। সবকিছু একবারে মুখে দিতেই ভাতের উপর মাংসের গন্ধটা আদা আর সয়া সসের সম্মিলনে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি করলো। খাবার শেষে বিল দেখে তো আমি বেশ অবাক! মাত্র ৮০ বাথ! থাইল্যান্ডের সেই সুলভ মূল্যের সুস্বাদু খাবারের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে।
রাত্র এগারোটা নাগাদ পেটের শেষ কিনারাটাও ভরে ফেললাম। অত:পর বন্ধুদের কথা মনে পড়লো। মেসেজে জানতে পারলাম তারা সবাই একটা সুপারশপে শপিং করছে। আমি একটা বাইক “গ্র্যাব” করে তাদের সাথে সেই সুপারশপে গিয়ে মিলিত হলাম। আয়মান ১০ মিনিট স্কুলের শ্যুটিং এর জন্য বেশ কিছু জিনিসপত্র কিনেছে। শুভ সবকিছু একবার দেখে/শুকে আবার সেটাকে শেল্ফে রেখে দিচ্ছে। এই ভদ্রলোক কিছু কিনবে বলে মনে হলো না। অবশেষে রাত্রি দেড়টা নাগাদ আমরা সবাই ব্যাংককের বেশ বিখ্যাত “খাওসান” রোডে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
খাওসান রোড ফুকেটের বাংলা রোডের মতোই জমজমাট; তবে পতিতাবৃত্তিটা এখানে তেমন চোখে পড়লো না। স্ট্রীট ফুডের সমারোহটা বেশ সমৃদ্ধ। যথারীতি মুরগীর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ ১০ থেকে ৪০ বাথের মধ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। আয়মান একটা মুরগীর রান ধরে সোজা কামড় দিলো। বেচারার চোখে মুখে ঈদের আনন্দ দেখতে পেলাম। আমিও এক দোকান থেকে অন্য দোকানে গিয়ে যা পারছি চেখে দেখছি। জীবনে প্রথম বারের মতো হরিণ আর কুমিরের মাংস খেয়ে দেখলাম। কুমির খেতে অনেকটা মুরগীর মতো। তবে হরিণের মাংসের কাবাবটা আমাকে একটু নিরাশ করেছে। হয়তো এদের হরিণ রান্না ততটা ভালো না।
খাওসান রোডের মাংস ভ্রমণের এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনাল রাউন্ডের খেলা চলছে। একটা পাবে ঢুকে লম্বা এক গ্লাস বিয়ার হাতে নিয়ে সবাই মিলে খেলায় মন দিলাম। শুভ-আয়মান ব্রাজিলের বড় ফ্যান। অন্যদিকে বাকীরা সবাই বেলজিয়াম সাপোর্টার। অবশেষে ২-১ গোলে বেলজিয়াম জিতে গেলো। শুভ-আয়মানের মন ভালো করতে আমরা সবাই মিলে আবার রাস্তায় হাঁটা দিলাম। শামস-অভীপ্সু-রাকিন-জুবায়ের-ইমু ইমু-চৌধুরীও এপর্যায়ে চলে এসেছে। একটা পুল জোনে ঢুকে সাদিক সাহেব সবাইকে পুল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। সবাই একে একে তার কাছে এক রাউন্ড করে হারলো। আয়মান সাদিকের “স্পোর্টিং ইগো”টা হাল্কা ফেরত আসলো। আমরা পুনরায় ফেরত গেলাম খাওসান রোডের রাস্তায়।
রাতের ব্যাংকক বেশ জমজমাট। যথারীতি থাই রমণীরা রাস্তায় খদ্দেরের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার পাশে “সেক্স শপ” নামক এক অদ্ভূদ দোকানের দেখা মিললো। যৌনমিলনের সময় ব্যবহার্য নানা রকম খেলনা সামগ্রীর একটা বড় বাজার থাইল্যান্ড। সেই সেক্স শপগুলো যুবক ছেলেদের আকৃষ্ট করে ভেতরে আনার জন্য সুন্দরী কয়েকজন মেয়েকে দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে। যৌনতার থেকে বড় হাতিয়ার হয়তো আর একটিও নেই!
একসময় লক্ষ্য করলাম ভোর ৫-টা বেজে গেছে। আজকেই বাংলাদেশে ফেরত যাবো। ভেবে একটু মন খারাপ হচ্ছিলো। কারণ, ১০ মিনিট স্কুলের বন্ধুদের সাথে এটাই হয়তো আমার শেষ ট্যুর। এরপর অক্সফোর্ড জীবনে এই বন্ধুদের সাথে আবার কবে ঘুরতে যাবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে। জীবনটা বেশ জটিল; জীবনের সমীকরণ মেলানোটা সহজ কাজ নয়।
প্রভাত লগ্নে দলে-বলে হোস্টেলে ফেরত আসলাম। সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত। আমি গোসল করে এসে বিছানায় গা লাগাতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখে। এরপর যখন চোখ খুললাম তখন সকাল দশ’টা বেজে গেছে। এই প্রথম থাইল্যান্ডে একটু সময় নিয়ে ঘুমাতে পারলাম। কিন্তু, একই সাথে খানিকটা অপরাধবোধও কাজ করছিলো। সকালে উঠতে পারলে হয়তো আরো একটু বেশী ঘুরে দেখা যেতো।
আক্ষেপনামা রচনা বন্ধ করে হোস্টেল থেকে সোজা বের হয়ে আসলাম। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, দলে-বলে ঘুরতে আসলেও আমি ভ্রমণের প্রায় অর্ধেকটা সময় একা থাকতে পছন্দ করি। বন্ধুদের সাথে ঘোরাটা অবশ্যই মজাদার; তবে একা ঘুরতে যাবার একটা অন্য রকম আনন্দ আছে। সঙ্গীবিহীন ভ্রমণে অনেক অপরিচিত সঙ্গী জুটে যায়। তাদের সাথে জীবনের কয়েকটা ঘন্টা কাটানো যায়। তারপর তারা চলে যাবে পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে। সাতশ কোটি মানুষের পৃথিবীতে হয়তো আপনাদের আর কখনো দেখা হবে না। কী রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা সেটা!
থাই ট্রিপের শেষ দিন সকাল ১১-টায় আমি রওনা দিলাম সিলোম সয় ২০ নামক এক রাস্তার উদ্দেশ্যে। মার্ক ওয়েন্সের ভিডিওতে এই রাস্তার সকালের নাস্তার অনেক প্রশংসা শুনেছি। বাইক থেকে নেমে সয় টুয়েন্টিতে কিছুক্ষণ হেঁটে খাবারের অপশনগুলো দেখে নিলাম। অর্গান মিটের একটা স্যুপ বেশ মনে ধরলো। একটা প্রাণীর প্রতিটা অঙ্গ থেকে একটা টুকরো থাকবে সেই স্যুপের মধ্যে। গাঢ় স্বাদের সেই ঝোলের মধ্যে থাকবে একটুখানি নুডুলস। মাত্র ৫০ বাথে বাহারী স্বাদের এই ডিসে একটু কলিজা, একটু কিডনী, একটু চামড়া, একটু জিহবা আর একটু মাংসের স্বাদ পাওয়া গেলো। বাংলাদেশী রান্নায় এতো মশলা থাকে যে গরু-মুরগী-খাসি খেতে প্রায় একই রকম লাগে। তাই প্রতিটা মাংসের আলাদা গন্ধে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত না। তবে আমি এখন হাল্কা রান্না করা মাংসের বোটকা গন্ধটা একটু একটু উপভোগ করার চেষ্টা করি। নিজের জিহবার বর্ণালীটা এতে করে খানিকটা প্রসারিত হবে।
সকালের নাস্তা শেষ করে আমি চলে গেলাম “সিয়াম প্যারাগন” নামক এক সুবিশাল শপিং মলে। রীতিমতো এলাহী কারবার সেখানে। দুনিয়ার সবচেয়ে দামী ব্যান্ডগুলোর আড়ৎ একটা বিল্ডিং জুড়ে। এমনকি দোতলায় ফেরারীর একটা শোরুমও দেখা গেলো। নিজের ফুটো পকেটটা হাত দিয়ে ধরে রেখে শুধু চোখে দেখেই নিজের কেনার চাহিদা মেটাতে হলো। তবে আমার কৃষ্ণগহবর পেটটা তখন আবার চোঁ চোঁ করে ওঠলো। কিছুক্ষণ গুগল রিভিউ ঘেঁটে চলে গেলাম “রামেন কিও” নামক একটা রেস্তোরায়। রামেন এক ধরণের জাপানিজ/কোরিয়ান খাবার। এর আসল মজাটা হলো স্যুপের মধ্যে। বিভিন্ন রকম মাংস জ্বাল দিয়ে গাঢ় একটা ঝোল তৈরি করা হবে। সেটাকে নানা রকম হার্ব দিয়ে সুস্বাদু করে তোলা হবে। স্যুপের বাটির নিচে থাকবে কিছু নুডুলস। উপরে এক/দুটো বড় মাংসের টুকরো সাজিয়ে দেয়া হবে। পাশে থাকবে অসাধারণ একটা বস্তু— “রামেন এগ”।
আধা সিদ্ধ ডিমকে কয়েক পদের সসে তিন রাত চুবিয়ে রেখে রামেন এগ বানানো হয়। রামেনের ঝোলে জিহবা ভেজাতে ভেজাতে সেই ডিমে একটা কামড় দিলাম; মাংসটাও মুখে পুড়ে নিলাম। বাহ! জীবনে আর কি লাগে? এই স্বাদ ভুলবার নয়। বন্ধুদের এই রামেনের কথা জানাতে সাথে সাথে মেসেজ করলাম। শামস-জুবায়ের-অভীপ্সু এসে পড়লো সাথে সাথে। চারজন মিলে সুন্দর একটা আড্ডার সাথে সাথে রামেনের সেই স্বর্গীয় অনুভূতি উপভোগ করতে থাকলাম। (এ পর্যায়ে পাঠকের খিদে লেগে গেলে আমি খানিকটা দু:খিত!)
খাদ্যপর্ব সমাধানের পর পরই কুল গ্যাং-০২ এর সদস্যরা বিদায় নিলো। তাদের ঢাকা ফিরবার ফ্লাইট বিকেল বেলা। আমি আবার দলছুট হয়ে থাই রাস্তায় হাঁটতে থাকলাম। অনেকগুলো খোলা বাজারের দেখা মিললো। সেখানে লাইভ মিউজিক হচ্ছে; হাল্কা খাবারের ব্যবস্থাও আছে। তবে ভীড়টা বড্ড বেশী দেখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করলো না। বেলা প্রায় ছয়টার দিকে লাজ হোস্টেলে ফেরত আসলাম। জুবায়ের-আয়মান প্রস্তুত। আমিও তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। হোস্টেলের নীচের তলায় একটা বোর্ডে সারা পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসুরা তাদের থাই বন্দনার কথা কতগুলো রঙিন কাগজে লিখে রেখে গেছে। আমিও নিজের চিহ্ন রাখতে সেখানে লিখে আসলাম—
“Dear Thailand, I loved your food, streets, people, hospitality and weather. N’oublie pas moi (forget me not).”
রাত ১১-টার ফ্লাইটে চড়ে কুলগ্যাং-০২ এর সদস্যদের সাথে আমি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ট্রিপের শুভ সমাপ্তি ঘটলো। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে বাসায় যাবার সময় বার বার মনে পড়লো পি পি আইল্যান্ডের কথা, চুনের কথা, মাছদের সাথে ভেসে বেড়ানোর কথা, ফাং না বে-র কথা। থাইল্যান্ড আসলেই এই মর্ত্যের স্বর্গ!