শার্ক, শার্লক, লন্ডন
Dec 29, 2017 | 11002
২৬ ডিসেম্বর আমার অক্সফোর্ড জীবনের ১ মাস পূর্তি হলো। বড়দিন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দশ দিনের জন্য বন্ধ। এখানকার ছুটির ধান্ধাটা বাংলাদেশের পুরোপুরি উল্টো। আমাদের দেশে সবাই ঈদের বন্ধে বাইরে ঘুরতে যায়; খাবারের দোকানে হানা দেয়। আর ইংল্যান্ডে বড়দিন উপলক্ষে মুদি দোকান থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট— প্রায় সবই বন্ধ। রাস্তা যেন এক মরুভূমি। ছুটিতে সবাই বাসায় 'ক্রিসমাস মিল' রান্না করে খেয়ে দেয়ে ঘুমায়। কেউ বাইরে বের হয় না তেমন।
যেহেতু আমি এই পরবাসে মোটামুটি পরিবারহীন অবস্থায় বন্দী, সেহেতু এই ছুটি কীভাবে কাজে লাগানো যায় তার নীলনকশা তৈরি করলাম। ২৫ ডিসেম্বরটা বাসায় মুভি দেখে কাটালাম। ২৬ ডিসেম্বরকে বলা হয় “বক্সিং ডে”! ক্রিসমাসের বাজারের বেচেঁ যাওয়া জিনিসপত্র ৫০-৮০% ছাড়ে কেনার জন্য মানুষ শপিং মলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমার কেনাকাটার শখ নেই বললেই চলে। ২০১১ সাল থেকে একই সোয়েটার পরতেসি। তাই ঠিক করলাম, ২৬ ডিসেম্বর হবে আমার লন্ডন ভ্রমণের দিন।
লন্ডন অসম্ভব খরুচে জায়গা। একরাত হোটেলে থাকতে গেলেই অনেক পাউন্ড গুনতে হবে। দূর্ভাগ্যবশত আমার কোন লন্ডনী আত্মীয়-স্বজনও নেই যার বাসায় রাতে থাকতে পারবো। তাই এমন একটা প্ল্যান করলাম যাতে সকালে গিয়ে রাতে ফেরত আসা যায়। প্রায় তিন দিন ধরে ইন্টারনেট ঘাঁটার মাধ্যমে তৈরি হলো আমার সুপার হিট পরিকল্পনা । সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা— লন্ডনের মূল আকর্ষণগুলো ছুয়ে দেখার জন্য একটা চেষ্টা মাত্র।
প্ল্যানটা ছিলো মিনিট বাই মিনিট ভাগ করা। ৬:৫৩ তে বাসে উঠবো, ৮:৩০ এ সকালের নাস্তা— ঠিক এইভাবে। আমার বস সাজিয়া লন্ডনে থাকে। আমার প্ল্যানটা কতটুকু বাস্তবসম্মত তা জানার জন্য ওকে লিস্টটা পাঠালাম। সাজিয়া তখন তার ভাইয়ের সাথে বড়দিনের ছুটি কাটাচ্ছিলো। আমাকে ফিরতি বার্তায় বললো, “শামীর, আমার ভাই তোমার প্ল্যান দেখে এতো অবাক হয়েছে যে সে ব্যস্ত না থাকলে এখনই তোমার সাথে এই লন্ডন tour-এ যোগ দিতো! তোমার প্ল্যানিং করার ক্ষমতা অনেক ভালো।”
২৬ ডিসেম্বর সকাল ৬:২০ মিনিটে নিজের সাইকেলে চড়ে মার্স্টন রোডের বাসা থেকে অক্সফোর্ড ব্রুকস ইউনিভার্সিটিরসামনে গেলাম। চারপাশে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাইকেলটা লক করে বাস স্টপে এসে দাড়াঁলাম। ৬:৫৫ মিনিটে লন্ডনগামী X90 বাসটা আসলো। যাবার ভাড়া ১৫ পাউন্ড। তবে যাওয়া-আসার টিকেট একসাথে কাটলে মাত্র ১৮ পাউন্ড। আমার দরিদ্র সত্ত্বটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে রিটার্ন-টিকেটটাও কেটে নিলো। চড়ে বসলাম বাসটাতে। সকাল ৮ টা নাগাদ লন্ডনের বেকার স্ট্রীট স্টেশনে এসে নামলাম। চারদিকে তখন মাত্র আলো ফুটতে শুরু করেছে।
বেকার স্ট্রীটকে আমার চিনিয়ে দেবার কোনো দরকার নেই। ২২১বি বেকার স্ট্রীট বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ঠিকানা। কেন সেটা দেখা গেলো স্টেশনের ঠিক সামনেই। ফুটপাতের ধারে বিশাল আকৃতির “শার্লক হোমস” সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। মাত্র মিনিট পাচেঁক হাটঁতেই আমি পৌছেঁ গেলাম সেই বিখ্যাত বাড়ির সমানে যেখানে শার্লক আর ওয়াটসন ১৮৮১ সালে থাকা শুরু করেছিলো।
আশেপাশের সব গুলো বাড়িই আধুনিক ধাচেঁর। কিন্তু, এই বাড়িটা এখনো দেখতে ভিক্টোরিয়ান সময়ের বাড়ির মতো। ব্রিটিশরা নিজেদের ইতিহাস নিয়ে অসম্ভব সচেতন। দুনিয়া উল্টে গেলেও এরা ২২১বি বেকার স্ট্রিটের একটা ইটও নড়তে দিবে না। সারা দুনিয়ার সব ঐতিহ্য সংগ্রহ (চুরি) করে এরা নিজেদের মিউজিয়াম গুলোকে সাজিয়ে তুলেছে।
যাই হোক, শার্লকের বাড়ির দুয়ার খুলবে সকাল সাড়ে নয়টায়। আমার হাতে তখনো অনেক সময় বাকী। প্রথমেই আমি লন্ডনের আন্ডার গ্রাউন্ডের ব্যাপারটা বুঝতে গেলাম। স্টেশনের ভেতর কয়েকটা মেশিন থাকে। সেখানে কয়েন দিয়ে অথবা কার্ডের মাধ্যমে পে করা যায়। আমি একসাথে সারাদিনের জন্য টিকেট কেটে রাখলাম। দিনটা বেশ ঠান্ডা পড়েছিলো। হাত-কান প্রায় জমে যাচ্ছিলো। অগত্যা “প্রেট অ মনজে” নামের একটা কফিশপে ঢুকে গরম গরম মোকায় চুমুক দিলাম। ৯:৩০টায় আবার শার্লকের মিউজিয়ামের দরজায় যেতেই আমি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। হায় হায়! কম করে হলেও প্রায় ১০০ জন লাইন দিয়ে আছে।
১৫ পাউন্ডে টিকেট কেটে আধা ঘন্টা পর ২২১ বি বেকার স্ট্রীটের কাঠের সিড়িঁ বেয়ে শার্লক আর ওয়াটসনের ড্রয়িং রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। রুমটা এতোটাই ছোটো যে ওয়াটসন এক গল্পে বলেছিলো, “বড় একটা লোক রুমে ঢুকলে প্রায় পুরো রুমটাই দখল করে নেয়।” পাশেই শার্লকের নিজের রুম-বিছানা। সেখানে তার ডিটেকটিভ কিট আর কেমিক্যালের বাহার সাজানো। উপরের তালায় ড. ওয়াটসন আর মিসেস হাডসনের রুম। (শার্লকের টিভি সিরিজে যে বাসাটা দেখানো হয় তা বাস্তবতা থেকে বেশ ভিন্ন)। তৃতীয় তলায় রয়েছে একটা মোমের মিউজিয়াম। সেখানে শার্লকের বিভিন্ন গল্পের প্রধান খলনায়কদের মোমের মূর্তি সাজানো আছে। সত্যিকারের জিম মরিয়ার্টি দেখতে বেশ ভিন্ন! টিভি সিরিজটায় শুধু শার্লক আর ওয়াটসনের চেহারাটাই কাছাকাছি রাখতে পেরেছে। মিউজিয়ামটার বেশ ভালো ব্যাপার হলো ভিক্টোরিয়ান সময়ের পোশাক পড়া কিছু মেয়ে আপনাকে পুরোটা সময় ধরে গাইড করবে। তারা প্রতিটা রুমের ইতিহাস আর খুটিনাটি সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে।
সাড়ে দশটা নাগাদ আমি আবার নেমে আসলাম বেকার স্ট্রীটের রাস্তায়। এবার গন্তব্য ওয়েস্টমিন্সটার। লন্ডনের সেরা ব্যাপার হলো তার আন্ডারগ্রাউন্ড। ঢাকায় যে রাস্তা যেতে আপনার ১ ঘন্টা লাগবে সেটা আন্ডার গ্রাউন্ডে মাত্র দুই মিনিট। তবে লন্ডন ঘুরতে আসলে সাথে করে একটা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আসবেন। এদের অধিকাংশ জায়গায় (এমনকি উবারেও) কোন নগদ পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই।
আমি জীবনে প্রথম বারের মতো লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডে নামলাম। খুবই সুন্দর করে প্রতিটি রুট ভাগ করা। বিশাল স্ক্রীণে আমার প্ল্যাটফর্ম নম্বরটা দেখলাম। প্রতি ৩ মিনিট অন্তর একটা করে ট্রেন আসে। হায়রে! এদের দেশে চলাফেরা কতটা সহজ। ঢাকায় আমার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যেতে প্রতিদিন মিনিমাম ১ ঘন্টা লাগতো। যাইহোক, চোখের পলকেই আমি পৌছেঁ গেলাম ওয়েস্টমিন্সটার স্টেশনে। রাস্তায় বের হতেই মুখ হা হয়ে গেল।
এক জায়গায় এতো কিছু! আমার সামনেই লন্ডনের বিখ্যাত টেমস নদী। সে নদীর অপর পাশেই বিশাল আকৃতির “লন্ডন আই” (Merry-go-round)। ডানপাশে তাকাতেই দেখি “বিগ বেন”। তবে কিছুটা হতাশ হতে হলো এ পর্যায়ে এসে। সংস্কারের জন্য বিগ বেনের চারপাশ ঢেকে রাখা হয়েছে। বিশাল এক আকর্ষণ মিস হয়ে গেলো। কিন্তু, দিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আমার জন্য তখনো অপেক্ষা করছে। আমার আজকের প্রধান গন্তব্য “সি লাইফ লন্ডন একুরিয়াম”।
আমি ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি ন্যাট জিও, ডিসকভারির ডকুমেন্ট্রি দেখে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগতে সাগর তলের দৃশ্যগুলো। সেই থেকেই লন্ডন একুরিয়ামের প্রতি আমার বিশেষ টান। এইখানের প্রবেশ মূল্য ২২ পাউন্ড। কিন্তু, আমি প্রায় ১৩০ পাউন্ড (প্রায় ১৪ হাজার টাকা) খরচ করে ভিআইপি টিকেট কেটে রেখেছিলাম। জীবনে প্রথম চাকরি করছি। প্রথম মাসের বেতনটা তাই ভালো কাজে খরচ করার ইচ্ছা ছিলো।
বেলা ১১টা নাগাদ আমি সি-লাইফের দরজায় এসে দাড়াঁলাম। ভিআইপি টিকেট হওয়ায় আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হলো না। বেশ সমাদর করে আমাকে তারা ভেতরে নিয়ে গেলো। নিরাপত্তা চেকিং এর পর বিশাল এক করিডোর। তার মেঝেটা গ্লাসের তৈরি। সেই গ্লাসের নিচে সমুদ্রের পানি, পানিতে সাঁতার কাটছে হাঙর। গ্লাসের সেই মেঝের উপর দিয়ে হেটেঁ আপনি প্রবেশ করবেন সাগরের বিশাল রাজ্যে। আপনার পায়ের নীচে থাকবে ভয়ানক সেই হাঙরের দল।
প্রথম অংশটা অনেক সুন্দর সুন্দর মাছে ভরা। সি-লাইফের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তারা শুধু মাছ নয়, বরং পুরো সাগরটাই তুলে এনেছে। যে মাছ যে ধরণের গাছের মধ্যে থাকে তার খাচাঁয় সেই প্রজাতির উদ্ভিদই লাগানো আছে। আপনার মনে হবে যে এটা কোন একুরিয়াম নয়। বরং সাগরের ভেতরে ডুব দিয়েই আপনি নিজের চোখে সবকিছু দেখছেন।
পরের অংশে যাবার করিডোরে এবার নতুন খেলা। মেঝের বদলে এখন ছাদটা গ্লাসের তৈরি। মাথার উপরে এবার পানি। এই সরু রাস্তা দিয়ে যখন হাটঁছি তখন হঠাৎ মাথার উপর একটা ছায়া লক্ষ করলাম। উপরে তাকাতেই দেখি আমার মাথার উপর ছাতার মতো ছড়িয়ে একটা স্টিং-রে সাঁতার কেটে যাচ্ছে। এদের মুখ থাকে নীচের দিকে; সেটা দেখতে বেশ রাগী একটা মানুষের মতো। “ফাইন্ডিং নিমো” মুভির প্রায় সব চরিত্রই সেইখানে দেখা গেলো।
তৃতীয় অংশটা রেইন ফরেস্টের জলজ প্রাণীতে ভরা। এটা বোঝাতে তাদের কোন সাইনবোর্ড লাগাতে হয়নি। সে অংশে ঢুকতেই আমার মনে হলো, আমি যেন আসলেই রেইন ফরেস্টে দাড়িঁয়ে আছি। মেঝের গড়নটা একটু কাদাঁটে। চারপাশ থেকে পানি পরে বৃষ্টির শব্দ সৃষ্টি করছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, স্পীকারে বৃষ্টির শব্দ ছাড়লেই তো হতো! কিন্তু, তাতে আসল বৃষ্টির আমেজ তো আর পাওয়া যেতো না। রেইন ফরেস্টে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ব্যাঙের বসবাস। অবশেষে হলুদ রঙের সেই ব্যাঙের দেখা পেলাম। সেটা এতোটাই ছোটো যে এক-পয়সার কয়েনের উপর ব্যাঙটা বসে থাকতে পারবে।
রেইন ফরেস্ট থেকে বের হয়ে আসতেই আমি আবার চমকে উঠলাম। এবার আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম উত্তর মেরুতে! চারপাশে বরফ আর বরফ। সেই বরফের রাজ্যে সাতাঁর কাটছে একঝাঁক পেঙ্গুইন। সেইখানে একটা ছোট ছিদ্র দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে আপনি একেবারে পেঙ্গুইনের রাজ্যের মধ্যে ছবি তুলতে পারবেন। আমার ছবি তুলে দেয়ার মতো সাথে কেউ না থাকায় সেই সুযোগটা হারালাম। হয়তো এই কারণেই মানুষ বিদেশে যাওয়ার আগে বিয়ে করে! অন্তত ছবি তুলে দেয়ার একটা মানুষ তো সাথে থাকবে!
অবশেষে আসলাম লন্ডন একুরিয়ামের প্রধান আকর্ষণ— “শার্ক ট্যাংকে”। প্রায় তিন তলা গভীর একটা পুল। আপনার ভ্রমন শুরু হবে একেবারে নীচের তলা থেকে। এ পর্যায়ে বলে রাখা ভালো, আমি ছোটবেলায় JAWS মুভিটা দেখে শার্কের ব্যাপারে অসম্ভব ভয় পেয়েছিলাম। সেটা এতোটাই বেশী ছিলো যে, আমি প্রায় ১ সপ্তাহ গোসল পর্যন্ত করি নাই! সেই ভয় দূর করার জন্যই আজকের এই সি-লাইফ ভ্রমণ।
শার্ক অসম্ভব মুডি প্রাণী। আপনাকে সে পাত্তাও দিবে না। অসম্ভব ধীরগতিতে কোন প্রকার নড়াচড়া না করেই সে সাতাঁর কাটতে পারে। গায়ের চামড়াটা অসম্ভব মসৃণ, তার ভিতর দিয়ে হাড়গুলো গোনা যায়। এই পুলে ৪ প্রজাতির হাঙর জমা করা হয়েছে- স্যান্ড শার্ক, টাইগার শার্ক, নার্স শার্ক, হ্যামার হেড। শার্কের এই ট্যাংকটার নীচে এসে দাঁড়াতেই আমি কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম অসম্ভব ভয় পাবো। কি অবাক! আমার অসম্ভব শান্তি লাগছিলো। প্রায় পনের মিনিট আমি গ্লাসে উপর চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তাতে প্রাণ ভরলো না। এ পর্যায়ে মেঝের উপর রীতিমতো শুয়ে পড়লাম। আশে পাশে বাচ্চাগুলো আমার আগ্রহ দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলো। আনন্দে আমার চোখে তখন পানি চলে আসার জোগাড়।
প্রায় ঘন্টাখানেক ছিলাম সেই শার্কের ট্যাংকের চারপাশে। সবশেষে গেলাম সবচেয়ে সুন্দর অংশে— “জেলী ফিস”। এই করিডোরটা নি:সন্দেহে সবচেয়ে মনোরঞ্জক। জেলিফিস অসম্ভব ভঙ্গুর প্রাণী। এদেরকে সমুদ্র থেকে ধরে লন্ডনে আনতে আনতেই মারা যাবে। তাই সি-লাইফের লোকজন একুরিয়ামের মধ্যেই জেলিফিসের প্রজনন ঘটায়। সেই পলিপ থেকে মেডুসা সৃষ্টির দৃশ্য আপনি চোখের সামনেই দেখতে পাবেন। জেলী ফিসে GFP নামের এক ধরণের প্রোটিন তৈরি হয় যার কারণে সেটা অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে। ঘুট ঘুটে কালো সেই করিডোরটা দুইপাশ থেকে জেলীফিসের আলোয় আলোকিত। তাদের নড়াচড়ার সেই আভিজাত্য দেখে আমি তখন মুগ্ধ। বেলা ১.০০টা নাগাদ আমি একুরিয়ামের শেষ প্রান্তে এসে পৌছঁলাম। আমার ভিআইপি এক্সপেরিয়েন্স কিন্তু তখনো বাকী। সেটা হলো, শার্কের সাথে একই পুলে নামা!
আপনি হয়তো ভাববেন আমি পাগল। আমি এই প্ল্যানটার কথা সবার প্রথমে বলি আমার সহকর্মী এনামারিয়াকে। ও শুনে সাজিয়ার কাছে যেয়ে বলে, “শুনেছো? শামীর নাকি শার্কের পুলে নামার পরিকল্পনা করছে?” সাজিয়া ওকে বললো:
“শামীর
না করলে এই কাজগুলো দুনিয়ায় আর কে করবে? ওর ফেইসবুকে যেয়ে নেপালের বাঞ্জি জাম্পের ভিডিওটা দেখো। ছেলেটা আসলেই পাগল।”
আমি ছোটবেলা থেকে অসম্ভব ভীতু ছিলাম। আমার উচুঁ জায়গায় যেতে ভয় লাগে, পানিতে ভয় লাগে, হাঙরে ভয় লাগে! এতো ভয় নিয়ে কি বাচাঁ যায়? ২০১২ সালে এক নভোচারীর টেড টক দেখছিলাম- “what I learned from going blind in the space”। সে বলেছিলো, ভয়কে দূর করার একমাত্র উপায় হলো তার মোকাবিলা করা। তোমার যদি মাকড়সায় ভয় লাগে তাহলে মাকড়সার জালের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে যাও। কয়েকবার কাজটা করলেই ভয় সব পালিয়ে যাবে। তার কথাটা আমার বেশ মনে ধরেছিলো। আমার কাছে স্বাধীনতার মানেটা বেশ ভিন্ন। আমার নিজেকে তখনই স্বাধীন মনে হয় যখন আমি ভয় ছাড়া বাচঁতে পারি। বাকী জীবনটায় ভয় দূর করতে যে আর কত কি করবো তার একটা লিস্ট বানিয়ে রেখেছি। এই ব্লগে হয়তো আগামী ১০ বছরে সেই গল্পগুলো শুনতে পাবেন।
১.১৫ মিনিটে আন্দ্রে নামের এক ভদ্রলোক এসে আমার সাথে পরিচিত হলেন। আন্দ্রে প্রফেশনাল শার্ক ডাইভার। গত ১৩ বছর ধরে সে এই কাজ করছে। আমরা মোট তিনজন একসাথে ডাইভ দিবো। আমি, টেইলর আর একটা ১০ বছরের বাচ্চা মেয়ে। সত্যি কথা বলতে, আমাদের তিন জনের মধ্যে সেই মেয়েটাই সবচেয়ে কম ভয় পাচ্ছিলো।
প্রথমেই একটা কাগজে বন্ড সই নেয়া হলো- “আমি মারা গেলে কেউ দায়ী থাকবে না।” জীবনে এই সই ইতোমধ্যে চারবার করেছি। কি আর যায় আসে? আমাদেরকে সুইম সুট আর নিরাপদ চশমা দেয়া হলো। ১.৩০ নাগাদ আমি পুলের পাশে সবকিছু পড়ে দাড়িঁয়ে আছি। দূরে একটা হাঙরের ফিন (উপরের পাখনা) দেখা যাচ্ছে। আমার সাথের বাচ্চা মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলাম— “তুমি কি ভয় পাচ্ছো?” মেয়েটা বললো— “একদমই না!” ওর কথা শুনে আমি কিছুটা সাহস পেলাম।
সবার প্রথমে টেইলর পুলে নামলেন। শার্ক ট্যাংকের একপাশে একটা ছোট খাচাঁর মতো অংশ আছে। খাচাঁটা দড়ি দিয়ে তৈরি; মেঝেটা গ্লাসের। খুব যে বেশী শক্ত কিছু এমন নয়। আমি আস্তে আস্তে সেই গ্লাসের উপর গিয়ে দাড়াঁলাম। আমার গলা পর্যন্ত বরফ শীতল পানি। প্রথম এক-দুই মিনিট ঠান্ডা লাগে; আস্তে আস্তে তা সয়ে যায়। বিবর্তন আমাদেরকে পরিবর্তনশীল তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নেয়ার এক অসামান্য ক্ষমতা দিয়েছে।
অবশেষে সাহস করে প্রথম ডুবটা দিলাম। পানির নীচটা অসম্ভব পরিষ্কার। দূরে একটা শার্ক দেখা যাচ্ছে। কিছু বোঝার আগেই দেখলাম আমার ঠিক পেছন থেকে একটা হাঙর এসে বা দিক হয়ে চলে গেলো। আন্দ্রে আমাকে বলেছিলো শার্ক নাকি খুব বেশী কাছে আসে না। কারণ, এরা মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। মজার ব্যাপার হলো আমরা তিনজনই পানির নীচে খুবই চুপচাপ ছিলাম। তাই শার্কগুলো হয়তো একটু বেশীই কাছে আসছিলো। অবশেষে আমার ফোনটাকে পানিরোধক কভারে ভরে ছবি তোলা শুরু করলাম। সেলফি ক্যামেরায় ভিডিও করছিলাম। মোবাইল স্ক্রীণে দেখলাম আমার পেছন থেকে একটা শার্ক এসে চলে গেলো। মাত্র এক-দুই হাত দূরত্বে ছিলো। সেই সময় বুঝতে পারলাম, আমার হাঙর ভীতি আর নেই। আমি চাইলে এখন এই খাচাঁর বাইরে গিয়েও একটা ডুব দিতে রাজি। প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট আমরা পুলের ভেতর ছিলাম। অবশেষে বিদায় ঘন্টা বাজলো। গোসল করে কাপড় পড়ে সি-লাইফ থেকে বের হয়ে আবার নেমে আসলাম রাস্তায়। বেলা বাজে ২.২৪ মিনিট। ২.৩০ মিনিটে আমার লন্ডন আই-তে চড়ার জন্য টিকেট বুক করা। ভাগ্যিস জায়গাটা সি-লাইফের ঠিক পাশেই অবস্থিত। তার মানে দুপুরের খাবার জন্য সময় আছে মাত্র ৬ মিনিট!
দৌড় দিয়ে ঢুকলাম “The Great British Fish & Chips” নামের দোকানে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত খাবার হলো এই ফিস এন্ড চিপস। মূলত কড মাছের বিশাল একটা কাটাবিহীন টুকরাকে বেশন দিয়ে মচমচে করে ভেজে দেয়। সাথে থাকে কিছু ফ্রেঞ্চ ফাই। এর দাম ১০ পাউন্ড। হাতে খাবারের প্যাকেটটা নিয়েই আমি লন্ডন আই-এর লাইনে দাড়িঁয়ে গেলাম। এইবার আর ভিআইপি টিকেট নেই আমার কাছে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে লাইনে দাঁড়িয়েই আমি আমার লাঞ্চ করে নিলাম। অবশেষে দরজার সামনে আমার টিকেট দেখতে চাইলো। আমি মোবাইল থেকে আমার অনলাইন বুকিং এর ইমেইলটা দেখালাম। লোকটা মোবাইল স্ক্রীণের উপরেই একটা রিডার ধরে বারকোডটা পড়ে নিলো। আমাকে বললো, “আপনি একদম সময় মতো এসেছেন।”
সহজ কথায় “লন্ডন আই” হলো একটা নাগরদোলা। বিশেষত্ব হলো এইটা লন্ডনের সবথেকে উচুঁ জায়গা। বিশাল এই চড়কি একপাক ঘুরে আসতে আধা ঘন্টা সময় নিবে। সেই পুরো সময় জুড়ে আপনি লন্ডনের বিভিন্ন দিকের দৃশ্য নানা রূপে দেখতে পারবেন। আমি ইতোমধ্যে কিছুটা ক্লান্ত। তাই লন্ডন আইতে বসে চুপচাপ দেখলাম কীভাবে টেমস নদীটা লন্ডনের বুক চিরে চলে গেছে। বিশ্বের অন্যতম বড় মেগা-সিটি এই লন্ডন। এখানকার বাসিন্দারা একে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুভাবে। তাই লন্ডনীদের একটা আলাদা দেমাগ দেখা যায়। চারপাশে বিল্ডিং আর বিল্ডিং। একটা আরেকটার সাথে পাল্লা দিয়ে উপরে উঠেছে। দূরে বিগ বেনটা দেখা যাচ্ছে। পাশের ওয়েস্টমিন্সটার ব্রীজটাও অসাধারণ লাগছে। অদূরেই একটা ক্রিসমাস মেলা বসেছে। সেখানে একটা caraosel (চলন্ত ঘোড়ার একটা রাইড) ঘুরছে। কি সুন্দর একটা আবহাওয়া। প্রায় সোয়া তিনটায় আমি আবার মাটিতে নেমে আসলাম।
পাশের ক্রিসমাস মেলার মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতেই দেখলাম “চার্লি চ্যাপলিন” সেজে এক ভদ্রলোক ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং সবার সাথে সেলফি তুলছে। আমিও সুযোগটা নিলাম। এখানকার ভিক্ষুকরা অনেক ক্রিয়েটিভ। ব্যক্তিগতভাবে আমি এদের ভিক্ষুক না বলে পারফর্মার বলবো। একটা লোক রোবটম্যান সেজে রোবটের মতো করে অভিনয় করছে। মানুষ তার পারফর্মেন্স দেখছে আনন্দ পাচ্ছে। এক পর্যায়ে তাকে এক-দুই পাউন্ড দিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে হিসাব করে দেখলাম, তার মাসিক ইনকাম আমার থেকে অনেক বেশী!
যথারীতি আবারো ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। ব্যাগ থেকে কানটুপিটা বের করে পড়ে নিলাম। এবার হাটাঁ দিলাম ওয়েস্টমিন্সটার ব্রীজের উপর। পায়ের নীচে টেমস নদী। প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা। অন্যপাশে গিয়ে এবার দূর থেকে লন্ডন আইয়ের সৌন্দর্য দেখতে থাকলাম। বেলা বাজে চারটা। আকাশ ইতোমধ্যেই প্রায় অন্ধকার হতে শুরু হয়েছে। ইংল্যান্ডের শীতকালের এই জিনিসটা আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে। দিনের আলো খুব বেশীক্ষণ থাকে না।
ব্রীজের অন্যপাশেই “White Hall Garden”। চার্চিল সাহেব এইখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করতেন। আমি সেই বাগানের ভিতর দিয়ে হেটেঁ অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে আসলাম। আমার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে “The Big Ben”। সেই বিশাল ঘড়ি যার সময়কে পৃথিবীর মূলবিন্দু (Greenich Mean Time) ধরা হয়। সংস্কার কাজের জন্য এর বাহ্যিক সৌন্দর্য খুব বেশী দেখা গেল না। কিছু স্বাদ অপূর্ণ থাকা ভালো। এই টানে হয়তো আবার লন্ডন ফেরত আসবো।
বেলা বাজে পাচঁটা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে আমি ওয়েস্টমিন্সটারের মূর্তি গুলোর সামনে দিয়ে হেটেঁ গেলাম। তাদের বিখ্যাত চার্চিল, বাইরন তো আছেই; নেলসন মেন্ডেলা, গান্ধীও বাদ যাননি। এর ঠিক পাশে ওদের পার্লামেন্ট ভবন, হাউস অব কমন্স। এক জায়গায় এতো কিছু যে কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ এক স্পানিস মেয়ে এসে বললো, সে একা লন্ডন ঘুরছে। তার ছবি তুলে দেয়ার কেউ নেই। আমি তার ফোনটা নিয়ে কিছু ছবি তুলে দিলাম। ফোনটা ফেরত দিয়ে বললাম, সি-লাইফে তুমি থাকলে তোমাকে দিয়ে আমি পেঙ্গুইন ওয়ার্ল্ডে ছবি তুলাতাম। সে হেসে বললো, নিশ্চয়ই!
বৃষ্টি আর ভালো লাগছিলো না। আমি আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে ট্রেন নিয়ে চলে গেলাম ভিক্টোরিয়া স্টেশনে। সেখান থেকে ১০ মিনিট হেটেঁ সন্ধ্যা (রাত্রি) সাড়ে পাচঁটায় গিয়ে দাড়াঁলাম “Buckingham Palace” এর আঙ্গিনায়। সত্যি বলতে, বিল্ডিংটা দেখে একেবারেই প্রাসাদ প্রাসাদ মনে হয় না। কার্জন হলকে বিজয় দিবসে এর থেকে ভালো দেখায়!
আমার বাস ৬.৪৫ মিনিটে। হাতে সময় আছে দেখে ঢুঁ মারলাম ShackShake নামের একটা বিখ্যাত বার্গারের দোকানে। লন্ডনে খাবারের দাম অসম্ভব বেশী। খেতে বসলেই ১০-১৫ পাউন্ড চলে যায়। যদিও এদের চেডার চীজের বার্গারের তুলনা নেই। সেটা কোনমতে খেয়ে শেষ করেই আমি হাটাঁ দিলাম ভিক্টোরিয়া স্টেশনের দিকে। অত:পর অপেক্ষা আমার ফিরতি বাসের জন্য। প্রায় ১৫ মিনিট পর আসলো সেই বাস। শীতে কাপঁতে কাঁপতে বাসে উঠে বসলাম। শীতের দেশে রাস্তায় থাকাটা বড়ই কষ্টের কাজ। আপনি দশটা জ্যাকেট পড়লেও ঠান্ডা লাগবে। তাই হয়তো সবাই ঘরের ভেতরে থাকতে পছন্দ করে।
রিটার্ন যাত্রায় রাজ্যের ক্লান্তি নেমে এলো আমার শরীরে। নিজের প্ল্যানের লিস্টটা দেখে মনে মনে হাসলাম। আমি আসলেই প্রতিটি জায়গা নির্ধারিত সময়ে যেতে পেরেছি। একা ঘুরতে আসার এই একটা মজা। নিজের প্ল্যানে ঠিক থাকা যায়। বক্সিং ডে- লন্ডন ভ্রমণ এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডে কাটানো আমার সেরা দিন। বাসে বসে বসে সেই গল্পটা আপনাদের জন্য লিখছি। কাল সকাল থেকে আমার ডিজাইন করা বিশাল একটা এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবে। দিনে প্রায় ১৫ ঘন্টা তখন ল্যাবে থাকতে হবে। সেটা শুরু করার আগে এই ভ্রমণটা বেশ কাজে দিয়েছে। মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে।
রাত ৯.০০টায় আমি আবার অক্সফোর্ড ব্রুকস স্টপে নামলাম। পাশেই পার্ক করা আমার সাইকেল পিঙ্কম্যান ২.০। তাকে সাথে নিয়ে ফেরতে আসলাম মার্স্টনের বাসায়। গোসল করে ঘুমাতে যেতে যেতে মনে পড়লো সেই শার্ক গুলোর কথা। কী সুন্দর সেই দৃশ্য!
"Fear can hold you a prisoner. Hope can set you
free." (Shaw Shank Redemption)