ব্রেকফাস্ট, পোর্শে, স্টুটগার্ট
May 27, 2020 | 5514
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বুঝতে পারলাম আমার প্রথম বই “হাইজেনবার্গের গল্প” ফ্রেব্রুয়ারির বই মেলায় পাঠকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এই খবরে আমার পরিবারের মানুষজন খুবই উত্তেজিত; বন্ধুরাও আনন্দিত। দু:খের বিষয় হলো, নিজের প্রথম বই প্রকাশ লগ্নে আমি পাঠকদের মাঝে উপস্থিত হতে পারবো না। অবশেষে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে এবং বন্ধুবর হাসান সাদ ইফতির খপ্পরে পড়ে ইউরো ট্রিপ থেকে ফেরৎ আসার মাত্র সাত দিনের মাথায় জার্মানীর স্টুটগার্ট শহর ভ্রমণের টিকেট কেটে ফেললাম। ক্রিসমাসের পর বিমানের টিকেট বাসের থেকে সস্তা হয়ে যায়। স্টুটগার্টের রিটার্ন টিকেট মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা; সেটাও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মতো ভালো কোম্পানীর প্লেনে!
বসের কাছ থেকে শুক্রবার ছুটি নিয়ে শুক্র-শনি-রবিবারের উইকেন্ড ট্রিপ মারতে ইফতি আর আমি ওস্তাদ। শুক্রবার সকাল এবং রবিবার দুপুরের টিকেটের দাম সাধারণত অনেক কম। অন্যদিকে শুক্রবার রাত আর সোমবার সকালের টিকেটের দাম অনেক গলাকাটা। তাই, মানিব্যাগের সাথে আপোস করে এই দিনগুলোতে ইউরোপ হপিং করাটা আমাদের জন্য খুবই লাভজনক।
যথারীতি ১ ফেব্রুয়ারী সকাল ১১-টায় আমাদের প্লেন উড়াল দেবার কথা। কিন্তু, তার আগের রাত থেকে শুরু হলো তুমুল মাত্রায় তুষারপাত। ফলাফল: ফ্লাইট ডিলেইড। শুক্রবার সকালের বদলে ফ্লাইট ছাড়বে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। মোটামুটি পুরো একটা দিনই ট্রিপ থেকে বাতিল হয়ে গেলো। কিছু জিনিস সবসময়ই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে; সেগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে পারাটাই হয়তো জীবনের বড় শিক্ষাগুলোর একটি।
যথারীতি ইফতি আর আমি সন্ধ্যা বেলায় লন্ডন গ্যাটউইক এয়ারপোর্ট থেকে লাফ দিয়ে দেড় ঘন্টা পর স্টুটগাার্ট এয়ারপোর্টে যেয়ে নামলাম। স্টুটগার্ট জার্মানির ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা; এখানে খুব বেশী ট্যুরিস্ট আকর্ষন নেই। ইফতি স্টুটগার্টে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর স্নাতক করেছিলো। এই শহরের সাথে তার ছয় বছরের সম্পর্ক। ইফতির “স্টুটগার্ট” দেখার উদ্দেশ্যেই মূলত এখানে আসা।
এয়ারপোর্টে নেমেই কিছুটা অবাক হলাম। পুরো জায়গাটা খালি; কোন ভীড় নেই। ইমিগ্রেশনের লাইনে শুধু আমি আর ইফতি দাঁড়িয়ে আছি। ইফতির মুখে জার্মান শুনে পুলিশ আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ছেড়ে দিলো। এয়ারপোর্ট থেকেই একটা মেট্রোরেলে উঠে আমরা চলে গেলাম শোয়াবেনগ্যালেরী এলাকায়। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো ইফতির ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু দারবেশ। ছেলেটা ছোটবেলায় ইরাক থেকে পালিয়ে জার্মানিতে চলে এসেছিলো। এখন পুরোদস্তুর জার্মান শিখে এখানকার স্থানীয় অধিবাসী; পিএইচডি করছে স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দারবেশ আমাদেরকে নিয়ে গেলো এক টার্কিশ রেস্তোরায়। জার্মানীর খাবারে টার্কিশ প্রভাব বেশ প্রকট। এখানকার সমাজে টার্কিশ রুটি আর কাবাব ছাড়া খাবারের কথা চিন্তা করাটাই কঠিন। টার্কিশদের মতো জার্মানদের মাংসপ্রীতিও প্রবল। দোকানটায় ঢুকে বুঝলাম আমার পেট খিদেয় চোঁ-চোঁ করছে। কিন্তু, আমরা অপেক্ষা করছি সামী আর সামারার জন্য। সম্পর্কে তারা ইফতির ভাই-ভাবী; থাকে জার্মানীর আখেন এলাকায়। প্রায় ৫ ঘন্টা ড্রাইভ করে তারা স্টুটগার্টে এসে পৌঁছালো রাত নয়টার দিকে। আমরা পাঁচজন মিলে বেশ কিছু টার্কিশ শর্মা গিলে ফেললাম। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে তুর্কির খাবার আমার সবচেয়ে প্রিয়। শর্মার রুটির উপর খানিকটা হুমাস ছড়িয়ে দেয়া হয়; এরপর আসে পোড়া মাংস আর সালাদ। সবশেষে সেটাকে সুন্দর করে রোল বানিয়ে সার্ভ করা হয়। প্রথম থেকে শেষ কামড় পর্যন্ত একটু হুমাস, একটু সালাদ আর বড় বড় মাংসের টুকরা জিভে এসে লাগবে। খাবার শেষে তৃপ্তির ঢোক তুলে আমরা সবাই দারবেশের বাসায় রাত্রিযাপন করতে চলে গেলাম। সেখানে পৌঁছে আমি “হাইজেনবার্গের গল্পের” পাঠকদের জন্য নিজের হাতে একটা চিঠি লিখে ফেললাম। রকমারী.কম থেকে যারা বই অর্ডার করেছে তাদের অনেকেই সেই চিঠিটা হয়তো হাতে পেয়েছে।
পরদিন সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠে আমরা সবাই চলে গেলাম সেহনে নামক এক জার্মান চেইন বেকারীতে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় এই দোকানটা চোখে পরবে। জার্মানীর ব্রেকফাস্ট কালচার বেশ শক্তিশালী। ভালোমানের রুটি ছাড়া এরা সকালের সূচনা ঘটায় না। এই সংস্কৃতিটা সেহনেতে প্রবেশ করেই ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। বিশাল বড় এক দোকানের এক মাথা থেকে শুরু করে অন্য মাথা পর্যন্ত শুধুমাত্র ব্রেড। ক্যারোট, রাই, বার্লি সহ নাম-না-জানা অসংখ্য শস্যের তৈরি এই সকল রুটির দাম মাত্র ২-৩ ইউরো। প্রায় ১০ রকমের কেকের মেন্যু থেকে একটা টুকরা চেখে দেখতে খরচ পড়বে দেড় ইউরো। বেশ ভালোমানের ফিল্টার কফির দাম ১ ইউরো। সুতরাং, মাত্র ৫ ইউরো খরচেই ভরপেটে সুন্দর একটা সকালের নাস্তা হয়ে যাবে। ইউরোপের অন্য কোন শহরে এই দামে এতো ভালো মানের সকালের নাস্তা আমার চোখে পড়েনি। তবে একটা কথা না বললেই নয়। অর্ডার করার সময় সবগুলো আইটেম একের পর এক গুছিয়ে বলতে না পারলে জার্মানরা বেশ বিরক্ত হয়। সামী আমাদের পক্ষ থেকে জার্মান ভাষায় কথা বলে সব অর্ডার করে দিলো; ইংরেজি এরা বেশ কমই বুঝতে পারে। মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক সেই দোকানে বসে লোভাতুর আমি একের পর এক কফি, কেক আর ব্রেড গিলতে লাগলাম। অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত জিনিস হলো “বাটার ব্রেজেল”। প্যাঁচানো আকৃতির কিছুটা শক্ত এই পেস্ট্রি খেতে খানিকটা নোনতা; উপরে কিছুটা মাখন লাগানো। ইফতির মতো বাকী সকল স্টুটগার্টবাসী এই বাটার ব্রেজেলের বিশাল বড় ভক্ত।
খেতে খেতে আমাদের যখন পেট ফেটে যাবার অবস্থা তখন আরো একটু খেতে সবাই মিলে চলে গেলাম ‘হান্স ইম গ্লুক’ নামক একটা বার্গার শপে। সেখানে আমাদের সাথে যোগ দিলো ময়মনসিংহের ছেলে আনিস। সে স্টুটগার্টে মাস্টার্স করছে; ইফতির ছেলেবেলার বন্ধু। আমরা সবাই মিলে ডাবল প্যাটি, চিজ, ব্যাকন দিয়ে বেশ বড়সড় একটা বার্গার অর্ডার করলাম। জনপ্রতি খরচ ১২ ইউরো। বার্গারে প্রথম কামড় দিতেই খানিকটা হতাশ হলাম। কারণ, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো এখানেও বার্গার বেশ শুকনা। আমি সস-মাখানো, চিজ-গলা বার্গারের ফ্যান। তাছাড়া বার্গারটা খুব বেশী ঝালও নয়। তবে সাথে সাইড হিসেবে আসা লাল-আলুর ফ্রাইটা ঠিকই মন জয় করে নিলো। এই দোকানটায় উঠতি বয়সের কিশোরদের বড় ভীড়। তাই, প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জায়গাটা আমার কাছে খুব বেশী উপযুক্ত বলে মনে হয়নি।
বেশ বড়সড় দুই প্রস্থ খাবারের পর মনে হলো শহরটা এবার একটু ঘুরে দেখা উচিত। কিন্তু, স্টুটগার্ট তার ইতিহাসের জন্য খুব বেশী বিখ্যাত নয়। তাই এখানকার কালচারাল মিউজিয়াম আপনাকে খুব বেশী চমক দেখাতে পারবে না। স্টুটগার্ট বিখ্যাত এর গাড়ির জন্য। পোর্শে আর মার্সিডিজ বেঞ্জ— বিশ্বের প্রতাবশালী দুই ব্যয়বহুল গাড়ির কোম্পানীর বসবাস এই শহরে। এখানে রয়েছে দুটি অসাধারণ কার মিউজিয়াম। আমি আর ইফতি অনেক তর্কাতর্কি করবার পর অবশেষে পোর্শে মিউজিয়ামে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাস্তায় একটা সিগনালে জ্যামে আটকে আছি। আমাদের গাড়ির ডানে, বামে এবং পিছনে তিনটে পোর্শে। দুনিয়ার অন্য কোন শহরে হয়তো এতো বেশী পোর্শের আধিক্য দেখা যাবে না।
ফার্দিনান্দ পোর্শে নামক এক ভদ্রলোক পোর্শে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুরুতে তারা শুধু গাড়ির ডিজাইন আর কনসালটেন্সী করলেও পরবর্তীতে তারা দ্রুতগতির রেসিং কার বানাতে মনোনিবেশ করে। পোর্শে ৯১১ গাড়ির ডিজাইন রেসিং ইন্ডাস্ট্রিতে এখন মোটামুটি একটা আইকনে পরিণত হয়েছে। পোর্শে চালানোটাকে পাশ্চাত্যে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। সেই পোর্শে কোম্পানীর মিউজিয়ামটা অবস্থিত স্টুটগার্টের প্রাণকেন্দ্রে পোর্শেপ্লাটজ নামক এলাকায়। কোন এক বিশেষ কারণে ২ ফেব্রুয়ারী মিউজিয়ামের এন্ট্রি ছিলো পুরোপুরি ফ্রি। খুশিতে হই হই করতে করতে আমরা সবাই বিশাল লম্বা একটা সিঁড়ি বেয়ে পোর্শে মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। পুরো জায়গাটা একটা অভিজ্ঞতার মতো। পোর্শে কোম্পানির ইতিহাস দিয়ে শুরু; একের পর এক তাদের গাড়িগুলো সাজানো। সেই ১৯৬০ থেকে শুরু করে ২০১৫ পর্যন্ত তাদের মডেলের বিবর্তনগুলোকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইফতি এখানে সুন্দর একটা লাইভ ক্লাস নেয়ার পরিকল্পনা করে ফেললো।
কিছুক্ষণের মাঝে ইফতি আর আমি ফেইসবুকে লাইভে গেলাম। পোর্শে মিউজিয়াম থেকে আমার প্রথম বই “হাইজেনবার্গের গল্প”-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করা হলো। তারপর একের পর এক গাড়ির সামনে হেঁটে গেলাম এবং ইফতি প্রতিটি গাড়ির পেছনকার ইঞ্জিনিয়ারিংটা বুঝিয়ে বললো। পোর্শের চাকাগুলো একটি মাত্র নাট দ্বারা লাগানো হয়; সুন্দর একটা ছবি দিয়ে এর পেছনকার বলবিদ্যাটা বুঝিয়ে বলা হয়েছে। যতই নতুর মডেল বানানো হয়েছে ততই গাড়ির দুই পাশ এবং পেছন দিকটা বাতাসের বাধা কমানোর জন্য খানিকটা নিচের দিকে নামিয়ে আনা হয়েছে। ছাদখোলা হলুদ রঙের পোর্শে ৯১১ কেনার একটা মনবাসনা পুষে রেখে সেই লাইভ শেষ করলাম।
মিউজিয়াম থেকে যখন বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই দেখতে পেলাম কর্তৃপক্ষ সেখানে একটা পোর্শে এক্সপেরিয়েন্সের ব্যবস্থা রেখে দিয়েছে। আমি আর ইফতি গাড়িটায় উঠে বসলাম। তার লেদার সিট, স্টেয়ারিং, টাচ স্ক্রিন কন্ট্রলার আর আউটলুক দেখে আমাদের চোখ ততক্ষণে কপালে উঠে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে দুজনেই বললাম, “জীবনে একটা পোর্শে কিনতেই হবে!”
এধরণের জায়গা থেকে বের হবার পর নিজেকে অনেক গরীব মনে হয়। কারণ, যা দেখে এসেছেন তা সম্ভবত এই জীবনে কেনার সৌভাগ্য নাও হতে পারে। তবুও কেউ স্টুটগার্টে গেলে এই পোর্শে রাজ্য ঘুরে দেখার জন্য বিশেষ অনুরোধ রইলো।
মিউজিয়াম পর্ব শেষে আনিস আমাদেরকে শোলোসপ্লাটজ নামক একটা এলাকায় নিয়ে গেলো। এটা স্টুটগার্টের সবচেয়ে বড় স্কয়ার। ২০০৬ ফুটবল বিশ্বকাপের সময় এখানে বড় স্ক্রীনে হাজার হাজার দর্শক খেলা দেখতে আসতো। জায়গাটা এককালে জার্মান আর্মির ট্রেনিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে সেখানে বড় বড় কনসার্টের আয়োজন করা হয়। লোকমুখে প্রচলিত গুজব হলো, শোলোসপ্লাটজের মধ্যখানে যে লম্বা টাওয়ার রয়েছে তার ঠিক চূড়ায় আমেরিকান বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে জার্মানদের উপর মনিটর করে চলেছে। এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করা অবশ্য সম্ভব হয়নি।
রাত্রি আট-টায় সবাই চলে গেলাম Abacoss’s Steak House-এ ডিনার করতে। নাম শুনলেই বোঝা যাচ্ছে ইফতি আর আমার মাংসপ্রীতি আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছে। তবে আমরা শুধু চারজনই নই; বরং ইফতির ভার্সিটি জীবনের ছয়জন বন্ধুও এসে আমাদের সাথে জুটেছে। এই বাল্যবন্ধুদের একটা টেবিলে পাঠিয়ে সামী-সামারা-আনিস-শামীর গ্যাং পাশেই একটা ছোট টেবিলে বসে পড়লো। আর্জেন্টিনার গরুর সারলোইন, রাম্প, রিব-আই কাট রেয়ার মিডিয়াম লেভেলে রান্নার ফরমায়েশ করা হলো। এই রেঁস্তোরার উপস্থাপনটা বেশ ভিন্ন রকমের। ৩০০ গ্রাম ওজনের গরুর টুকরাটা একটা গরম লোহার পাটাতনের উপর উপস্থাপন করা হবে। নিজের চাহিদা মতো সেখান থেকে মাংস কেটে কেটে গরম লোহার ওপর নিজের চাহিদামতো পুড়িয়ে নেয়া যাবে। সাথে আছে আলু আর সবজির কয়েকপদের ফ্রি সাইড। জনপ্রতি মাত্র ২০-২২ ইউরো খরচেই ভালোমানের স্টেক ডিনার সেরে ফেলা সম্ভব হলো। স্টুটগার্ট ট্রিপটা ততক্ষণে মোটামুটি একটা ফুড ট্যুরে পরিণত হয়েছে। এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঢুকছি; কারণটা অবশ্যই প্রকট। যে শহরে খুব বেশী কিছু করার নেই সেখানে মানুষ বিনোদনের জন্য খেতে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। আমার প্রাণের শহর ঢাকাও সেই কাতারেই পড়ে।
রাত এগারোটার দিকে সবাই মিলে ফিরে গেলাম দারবেশের বাসায়। খানিকটা বন্ধুসুলভ খুনসুটির পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। সেই ঘুম ভাঙলো পরদিন সকাল ১১-টায়। বেশ হেলে দুলে আমরা সবাই ফিরে গেলাম ‘সেহনে’ দোকানটায়। আবারো একই পদ্ধতিতে জনপ্রতি তিনটা কেক, দুটো রুটি আর দুই কাপ কফি খেতে খেতে বেলা দুইটা বাজিয়ে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর আনিস আমাদেরকে নিয়ে গেলো এক টার্কিশ দোকানে। সেখানে অর্ডার করা হলো গরুর পাকস্থলি-ভুড়ি দিয়ে তৈরি সাদা রঙ্গের Tripe Soupe. টার্কিশ রুটি সেই স্যুপে ডুবিয়ে মুখে দিতেই একটু অবাক হয়ে গেলাম। জিনিসটা খেতে অনেকটা ক্রিম অফ মাশরুম স্যুপের মতোই। তবে ভুড়ির টুকরোগুলোর তেলতেলে চর্বিত চর্বনে মুখের ভেতর বেশ মাংসল একটা আবহাওয়া তৈরি হয়। সেই টার্কিশ মিলের শেষে সামী-সামারা আমাদের বিদেয় জানিয়ে আখেন অভিমুখে যাত্রা শুরু করলো। আনিস ইফতি আর আমাকে কফি খাওয়াতে নিয়ে গেলো রোতেভুলপ্লাটজ এলাকায়। তিনজনে তিনকাপ লাটেতে চুমুক দিতে দিতে জার্মানীতে বাদামী-কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণের গুষ্টি উদ্ধার করলাম। এখানকার সমাজটা নিজেদের সাদাজাত ছাড়া অন্য কাউকে দেখলেই একটু নান সিকটায়। এই আচরণ লন্ডন কিংবা অক্সফোর্ডের মতো কসমপলিটন জায়গায় আমি কখনোই দেখিনি।
সন্ধ্যা প্রায় ছয়টা নাগাদ আমরা ফিরে গেলাম স্টুটগার্ট এয়ারপোর্টে। রাত্র ১০-টা নাগাদ গিয়ে নামলাম লন্ডনে। সাড়ে এগারোটায় অক্সফোর্ডে ফিরে দেখি আমাদের বন্ধু ম্যাক সবার জন্য পাস্তা বানিয়ে রেখেছে। ম্যাকের পাস্তায় পেট পুড়িয়ে অবশেষে ফেরত গেলাম অক্সফোর্ডের সনাতনী জীবনে। সেই জীবনে আগামীকাল থেকে শুরু হবে এক্সপেরিমেন্ট। তার শেষ কবে হবে জানা নেই। তবে ল্যাবের ফাঁকে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা জার্মান ব্রেড আর টার্কিশ ত্রিপ স্যুপের স্মৃতি রোমন্থন করে পেটে খানিকটা আলোড়ন তো হবেই!
Not every trip is about the history of a place. This one was about the people and their food.
————————————————————
পাদটীকা: এই গল্পটি আমি লিখেছি বার্সেলোনার মাউন্ট তিবিদাবোর চূড়ায় বসে। সুন্দর একটা কফি শপের জানালার পাশের টেবিলটায় বসে রোমন্থন করেছি জার্মানির সেই দিনগুলো। এক কাপ লাতের কোণায় চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে থেকেছি সমুদ্রের পাড়ে গড়ে ওঠা বার্সেলোনা শহরটার দিকে। আর মনে মনে বলেছি, “Life is beautiful”.