বিবর্তনের রূপকথা: Abiogenesis
Mar 30, 2018 | 9139
Evolution তথা বিবর্তনবাদ নিয়ে প্রথম জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়তে এসে। ২০১২ সালের নবীন বরণের অনুষ্ঠানে আমি একটি নাটক লিখে ফেললাম। সেই নাটকে চার্লস ডারউইন, আলফ্রেড রাসেলের মতো মানুষদের আত্মাকে অভিনয়ের ছলে মঞ্চে নামিয়ে আনলাম। বিবর্তনবাদ নিয়ে কথা বললেই বিতর্ক হবে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতয় হয়নি। প্রথম বর্ষের একটা ছেলে কেন ডারউইনকে হাসির ছলে পরিহাস করবে তা আমার অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরই ভালো লাগেনি। কিন্তু, পুরো নাটকের প্লটটাই ছিলো একটা স্বপ্নের মাঝে। তাই, কল্পনাপ্রসূত চিন্তার কোটায় সবাই মাফ করে দিলো।
বিবর্তনবাদ নিয়ে আমাদের আগ্রহের কিন্তু শেষ নেই। বিবর্তনবাদ কি সত্য? ধর্ম কি বিবর্তনবাদকে সমর্থন করে? মানুষ কি বানর থেকে এসেছে? একটা বানর কেন নতুন করে মানুষ হয় না?
এই সকল কঠিন প্রশ্নের উত্তর আমার মতো এই কূপমন্ডুকের লেখায় আপনি পাবেন না। আজকে আমি শুধু বিবর্তনবাদের গল্প বলবো। অবসর সময় থাকলে পড়ে দেখতে পারেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাস করা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা, এই পৃথিবীর সকল জীবই একটি মাত্র আদিম কোষ থেকে এসেছে। কিন্তু, কীভাবে সেটা হয়েছে তা ব্যাখা করাটা বেশ কষ্টকর। আমার মনের অবচেতন কক্ষে আমি নিজেকে যেই ব্যাখ্যাটা দেই সেটা অনেকটা এরকম:
Molecular Evolution
সৃষ্টির প্রাথমিক দশায় এই পৃথিবী অনেক উষ্ণ ছিলো। আমাদের বায়ুমন্ডলে ছিলো হাইড্রোজেন সালফাইড, এমোনিয়া গ্যাসের ছড়াছড়ি। আকাশে বারংবার বিদ্যুুত চমকাতো; পৃথিবীর উপরের ভাগে ছিলো পানির প্রাচুর্য। এই পানি, সালফার গ্যাস, এমোনিয়া বিক্রিয়া করলে তৈরি হতে পারে “amino acid” নামক একধরণের যৌগ যা দ্বারা প্রোটিন তৈরি হয়। কিন্তু, এই বিক্রিয়া ঘটাতে অসম্ভব শক্তি দরকার। বায়ুমন্ডলের বজ্রপাত তখন বীরের বেশে আবির্ভূত হলো। বিদ্যুুত চমকানোর ভয়ানক শক্তির আশ্রয়ে সরল কিছু অণু মিলে তৈরি করলো amino acid, যাকে জীবনের প্রথম অণু বলে আখ্যা দেয়া হয়। এই ব্যাখ্যাটি অপারিনের মতবাদ নামে পরিচিত।
কিন্তু, এর প্রমাণ কি? বিজ্ঞান তো রূপকথার গল্পে বিশ্বাস করে না! অবশেষে এই ব্যাখ্যাকে ১৯৫২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমাণের চেষ্টা করলেন বিজ্ঞানী মিলার এবং ইউরেই। তারা একটা বন্ধ পাত্রের ভিতর পানি, সালফার গ্যাস, এমোনিয়া দিয়ে তাতে বারংবার কারেন্টের ছ্যাঁকা দিলেন। আশা করলেন, পাত্রের ভেতরে তারা সবগুলো amino acid তৈরি করে ফেলবেন। কিন্তু, বিধি বাম। মাত্র ৫টি amino acid সনাক্ত করতে পারলেন; কিন্তু জীবনের গল্প লিখতে amino acid দরকার অন্তত ২০টা। বিজ্ঞান হাসির পাত্রে পরিণত হলো। চার্চে-চার্চে তখন বিজ্ঞানের এই বিফলতাকে গর্বের সাথে ব্যাখ্যা করা হলো। কিন্তু, মিলার সাহেব তার সেই পরীক্ষার উপাত্তগুলো কাচের টিউবে ভরে রেখে দিলেন। তার ধারণা, আমি সবগুলো amino acid সনাক্ত করতে পারি নাই তার মানে এই না যে এমিনো এসিড সৃষ্টি হয়নি। হয়তো আমার সনাক্ত করার ক্ষমতা ভালো না। আমার ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো এই পরীক্ষার ফলে সৃষ্ট মিশ্রণে সবগুলো amino acid খুজেঁ পাবে! বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। মিলার সাহেবও সেই দলের ছিলেন।
২০০৭ সালে মিলারের মৃত্যুর পর তার সেই কাচের টেস্টটিউব গুলো পুনরায় পরীক্ষা করা হলো। এখন আমাদের হাতে আছে শক্তিশালী যন্ত্রপাতি যা ১৯৫২ সালে চিন্তাও করা যেতো না। ২০০৮ এবং ২০১০ সালে মিলারের সেই টিউবগুলো বিশ্লেষণ করে ৩০টিরও বেশি amino acid পাওয়া গেল! হায়! অপারিনের সেই বজ্রপাত আর আগ্নেয়গিরির গল্প একেবারে অলীক নয়। আসলেই একেবারে সাধারণ কিছু অণু বিক্রিয়া করে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবগুলো amino acid তৈরি করে ফেলতে পারে।
কিন্তু, তাতে কি? amino acid-ই তো সব না। সবচেয়ে সরল জীবন হলো এককোষী ব্যাকটেরিয়া। তার একটা চর্বিদ্বারা নির্মিত আবরণ থাকে। সেই আবরণের আচ্ছাদনে দৌড়াদৌড়ি করে প্রোটিন, DNA, শর্করা অণু। ব্যাকটেরিয়ার কোষ বিভাজিত হয়। একটা জীবন নতুন আরেকটা জীবনের তৈরি করতে পারে। একটা amino acid তৈরি করে তো আপনি বিবর্তনকে সত্য দাবী করতে পারেন না!
জীবনহীন অণুগুলোকে জীবন্ত হতে হলে তাদেরকে নিজের তথ্যগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু, amino acid সৃষ্টি সেই বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের মাত্র প্রথম ধাপ। It’s a small step for a molecule. A giant leap for life.
RNA World Hypothesis
একটা amino acid অন্যটার সাথে ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে প্রোটিন তৈরি করে। ভালো কথা। কিন্তু, এই বিয়ের ঘটক কে হবে? আধুনিক প্রাণরসায়নবিদরা বলেন, এরকম বিক্রিয়া ঘটাতে দরকার হয় নানা রকম অণু-ঘটকের (অণুর ন্যায় ক্ষুদ্র যেই ঘটক)। ইংরেজিতে এদের বলে enzyme. কয়েক দশক আগে বিজ্ঞানীরা বের করে ফেললেন যে, কিছু RNA অণু আছে যারা অণু-ঘটকের মতো আচরণ করতে পারে। তারা এই ধরণের RNA গুলোর নাম দিলেন “রাইবোজাইম”। অর্থাৎ, রাইবোজাইম দুটো amino acid এর মধ্যে বিক্রিয়া ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। তাই, অপারিনের আদিম পৃথিবীতে হয়তো এই RNA সৃষ্টি হয়ে তার আশেপাশের পরিবেশের amino acid দের জোড়া দিয়ে দিয়ে প্রোটিন তৈরি করেছে। প্রোটিনের ক্ষমতা সীমাহীন। প্রোটিন আমাদের সকল কাজ করে দিতে পারে। একবার প্রোটিন তৈরির পর সেই প্রোটিন চাইলে RNA কে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে।
কিন্তু, RNA নিজে কীভাবে সৃষ্টি হলো?
মিলার-ইউরেইর পরীক্ষার আদলে আরো কিছু পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা ছোট ছোট অণু থেকে কৃত্রিম পরিবেশে RNA তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার মানে, শুধুমাত্র যে কোষের মধ্যেই RNA তৈরি হতে পারে ব্যাপারটা এমন নয়। সরল অণু থেকে জীবনের এই বড় বড় অণুগুলো তৈরির প্রক্রিয়াটাকে বিজ্ঞানীরা একটা গালভরা নাম দিয়েছেন- “abiogenesis”. আদিম পৃথিবী ছিলো এই abiogenesis এর কারখানা। সেই জলজ পরিবেশে প্রতি নিয়ত সৃষ্টি হয়েছে amino acid এবং RNA. সেই বুদ্ধিমান RNA অণু-ঘটক হিসেবে কাজ করে amino acid দিয়ে প্রোটিন তৈরি করেছে। কিছু RNA নিজে নিজেই তার একটা বাচ্চা RNA তৈরি করতে পেরেছে। একসময় কিছু RNA আর কিছু প্রোটিন জোড়া লেগে একটা জটিল গঠন তৈরি করে ফেললো। এই জটিল গঠনটাকে আমরা “রাইবোসোম” বলি। আমরা জানি, রাইবোসোম কোষের ভিতরে প্রোটিন তৈরি করে। কিন্তু, আদিম পৃথিবীতে কোষ ছাড়াই হয়তো abiogenesis হয়ে রাইবোসোম সৃষ্টি হয়েছিলো।
মজার ব্যাপার হলো, RNA আবার DNA-র কাজও করে দিতে পারে। DNA-এর কাজ হলো বংশগতির তথ্য ধারণ করা। বেশ কিছু ভাইরাস (যেমন HIV) রয়েছে যাদের RNA অণু জেনেটিক তথ্য বহন করে। বাহ! RNA হলো মলিকুলার বায়োলজির সাকিব আল হাসান। RNA তার অলরাউন্ডার পারফর্মমেন্স দিয়ে জীবনের অনেক ঘটনাই ঘটিয়ে দিতে পারে।
বিশ্বে কিন্তু তখনও DNA এর আবির্ভাব ঘটেনি। আদিম পৃথিবীতে শুধু ছিলো RNA-এর জয়কার। DNA বিহীন এই পৃথিবীর গল্পটাকে বিজ্ঞানে বলা হয় RNA World Hypothesis.
এটা Hypothesis; মানে এটা বিজ্ঞানীদের কল্পনার ব্যাখ্যা। এর পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ ততটা শক্তিশালী নয়। বিজ্ঞানীরাও অনেকটা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কাজ করেন। কারণ মলিকিউলার এভুলিউশনের অনেক কিছুই আমরা “এখন পর্যন্ত” পরীক্ষলব্ধভাবে প্রমাণ করতে পারিনি।
The First Cell
আদিম দুনিয়ায় প্রোটিন সৃষ্টি হলো, সৃষ্টি হলো RNA। কিন্তু, এরা তো জৈব অণুমাত্র। এদেরকে তো জীবন বলা যায় না। কোষ হতে হলে লাগবে অন্তত একটা প্রাচীর যার মধ্যে এই প্রোটিন, RNA শুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। কোষ যাদেরকে নিজের “সম্পত্তি নয়; বরং সম্পদ” বলে দাবী করবে। কিন্তু, এই আবরণ কীভাবে তৈরি হলো?
সমুদ্রের পাড়ে কখনো বেড়াতে গিয়েছেন? একটু পর পর ঢেউ আছড়ে পরে তীরের বালিতে। সেখানে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন অনেক ফেনা সৃষ্টি হয়। এই ফেনার গল্পটা বেশ সুন্দর। বিজ্ঞানীরা সেই ফেনাগুলোর আণবিকগঠন নিয়ে বেশ পরীক্ষা করে দেখেছেন। মজার ব্যাপার হলো, এই ফেনাগুলো তৈরি হয় “ফ্যাটি এসিড” নামক একধরণের অণু দিয়ে। এইটা সেই ফ্যাটি এসিড যা দ্বারা কোষের বাহিরের আবরণও সৃষ্টি হয়।
এক বোতল পানিতে কয়েক ফোটাঁ তেল ঢেলে জোড়ে জোড়ে ঝাঁকান। তেলে আর জলে তো মিশ খায় না। তাই, দেখতে পারবেন, তেলের বড় ফোটাঁ ভেঙে দিয়ে ছোট ছোট কয়েকটা ফোটাঁয় পরিণত হয়েছে। সেই ফোঁটা গুলোও কোষের মতে দুইস্তর বিশিষ্ট ফ্যাটের আবরণ দ্বারা তৈরি।
এর মানে কি?
ফ্যাটের অণু জলীয় পরিবেশে আলোড়িত হলে কোষের আবরণী পর্দার অণুরূপ আবরণ সৃষ্টি করতে পারে। এই দ্বিস্তরী পর্দার গল্প বিজ্ঞানীরা “ফ্লুইড-মোজাইক মডেল” বলে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু, এই পর্দা সৃষ্টি হতে যে জীবন থাকা লাগবে তা নয়। জীবনের অস্তিত্ব ছাড়াও আদিম পৃথিবীর রুক্ষ পরিবেশে জীবনের প্রতিটি অণুই সৃষ্টি হয়ে পেরেছে। Abiogenesis হয়তো পুরোটা রূপকথা নয়!
RNA, amino acid, রাইবোসোম, কোষ আবরণ সবই হলো। পৃথিবীর বিশাল মহাসমুদ্রের কোন এক প্রান্তে হয়তো সেই RNA, amino acid, রাইবোসোম একটা দ্বিস্তরী আবরণের মধ্যে ঢুকে বসলো। প্রকান্ড মহাবিশ্বের মাঝে সেই ক্ষুদ্র অণুগুলো তাদের নিজেদের জন্য একটা জগত তৈরি করে ফেললো। তারা পরম ভালোবাসায় সেই জগতটার নাম দিলো- cell. এই কোষের সাথে আমাদের বর্তমান কোষ হয়তো খুব বেশি মিল নেই। কিন্তু, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন জনপ্রিয় হয় ২০০০ সালের দিকে। শুরুতে আমরা নোকিয়া ফোনে স্পেস-ইমপ্যাক্ট নামের গেইম খেলতাম। সেই ফোন এখন স্মার্ট হয়েছে; সেই ফোনে এখন দুনিয়া দেখা যায়। সবকিছুরই প্রথম ভার্সনটা দূর্বল হয়; ধীরে ধীরে সে নিজের দূর্বলতাকে কাটিয়ে উঠে। আমাদের আদিম দুনিয়ার প্রথম কোষটাও ছিলো দূর্বল। কারণ, তার তথ্য সে জমা রেখেছে RNA-তে। RNA খুবই নশ্বর একটা অণু। কিন্তু, হয়তো কোন একদিন ভুল করে RNA অণুর একটা অক্সিজেন বিক্রিয়া করে ধ্বংস হয়ে গেলো। ছোট-ছোট এক-দুইটা পরিবর্তন সেই RNA-কে বানিয়ে দিলো DNA. কি মজা! এই DNA ব্যাটা বেশ স্থায়ী। RNA যেখানে মিনিটের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়, DNA বেচেঁ থাকতে পারে হাজার বছর। কিন্তু, এদের মধ্যে তফাত কিন্তু খুব বেশি নেই। মাত্র একটা-কি-দুইটা পরমাণুর তফাত।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আদিম পৃথিবী সর্বপ্রথম অবলোকন করলো “survival of the fittest”. কোষ তার তথ্য ধারণ করার দায়িত্ব চাপিয়ে দিলো DNA অণুর ঘাড়ে। আর RNA কে করতে দিলো অন্য কাজ। সাকিব আল হাসান যখন বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন তখন তাকে নিজের খেলার পাশাপাশি দলের সমন্বয়তা নিয়েও ভাবতে হতো। অধিনায়কত্বের সেই দায়িত্ব যখন মুশফিকের ঘাড়ে চলে গেলো তখন সাকিব তার সমগ্রটা দিলেন নিজের পারফর্মেন্সে। RNA অণুর কাছ থেকে DNA ছিনিয়ে নিলো জিনের তথ্য ধারণ ক্ষমতা; আর RNA তখন মনোনিবেশ করলো সম্ভবনার সকল প্রান্তে। আজকের দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা এর RNA অণুর কাজ দেখে বেশ মজা পান। কত ধরণের RNA যে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তা বলে শেষ করা যাচ্ছে না। গল্পের নায়ক RNA তার মহাকাব্য আজও লিখে যাচ্ছে।
বিবর্তনের রূপকথার আজকের পর্বের এইখানে সমাপ্তি। প্রাচীন সেই কোষ বিরূপ প্রকৃতিতে কীভাবে টিকে রইলো সেই গল্প ব্যাখ্যা করবো আগামী পর্বে।