প্রাণের শহর ঢাকারে
May 27, 2020 | 6834
গত ২৫ আগস্ট ২০১৯ সকাল ৮:৩০ মিনিটে ঢাকার বুকে পা রাখলাম। এয়ারপোর্টে ভাইয়া রিসিভ করতে আসলো। দুই ভাই মিলে সোজা চলে গেলাম বনানী স্টার কাবাবে। ডাল-গোস্ত আর পরোটা খাওয়া শেষ করে ছুট দিলাম ঢাবি ক্যাম্পাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নাড়ীর টানটা একটু বেশীই বোঝা গেলো। প্রাণের ক্যাম্পাসটায় সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে দুপুর ২-টা নাগাদ বাসায় এসে পৌছঁলাম।
বাংলাদেশে এসেছি মাত্র ১৮ ঘন্টার সিদ্ধান্তে। মা’মনিকে তো জানানো হয়নি। আমি সোজা ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলাম। মা আমার সহজাত ভঙ্গিতে বললেন, “খেতে বসো”। তারপর বুঝতে পারলেন এইটা তার বড় ছেলে না; ছোটটা। অত:পর মাতৃসুলভ ভালোবাসাটা তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো। এই ছোটখাটো নাটক-সিনেমা করার জন্য সাড়ে ছয় হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে এসেছি।
প্রথম দিন বাকী সময়টা বাসায় বসে রইলাম। আমার মা তার সিগনেচার বিরিয়ানী রান্না করলেন। গত কুরবানীর ঈদে নাকি বাসায় রান্না বেশ কম হয়েছে। আমি সব কড়ায় গন্ডায় উসুল করলাম। সন্ধ্যা থেকে রাত্র সাড়ে বারোটা পর্যন্ত পিএইচডির কিছু কাজ শেষ করলাম। গবেষণা তো পিছন ছাড়ে না! তাছাড়া কাজ করার পেছনে অন্য উদ্দেশ্যটা হলো জেটল্যাগ কাটানো। ঠিক বাংলাদেশী সময় রাত ১-টায় ঘুমাতে গেলাম। পরদিন বাংলাদেশী সময় সকাল সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠলাম। অক্সফোর্ডের আবহাওয়ায় গড়ে ওঠা শরীরটাকে বোকা বানিয়ে মাত্র একদিনেই ঢাকার সময়ে অভ্যস্ত করে ফেললাম।
দ্বিতীয় দিনের পুরোটাই গেলো ঢাবি ক্যাম্পাসে। বিকেল নাগাদ কাছের কিছু মানুষকে সারপ্রাইজ দেয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না। বেইলী রোডের এক ক্যাফেতে শুভ-স্বর্ণা-শামস-অভীপ্সু আড্ডা দিতে আসছে বলে জানতে পেরেছি। কিভাবে যেন রাইসা শাম্মাও সেখানে উপস্থিত। অভীপ্সু ছাড়া এদের কেউ জানতো না যে আমি বাংলাদেশে। ব্রুটাউনের ভেতর ঢোকা মাত্রই জোরে এক চিৎকার। তারপর গল্প। ঠিক আগের মতোই। একটা চুলও পরিবর্তিত হয়নি।
বেইলী রোড থেকে গেলাম ১০ মিনিট স্কুলের নতুন অফিসে। সেখানে আয়মানের সাথে দেখা। তারপর পান্থপথে গিয়ে রাত ১১-টার সময় মুনজেরিনকে টেনে বাসার নিচে আনলাম। যথারীতি ক্লান্ত শরীরটা অবশেষে ১০ মিনিট স্কুলের এক ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন ঘুম ভাঙলো বেলা ১১-টায়। সাড়ে বারোটা নাগাদ অমিতার সাথে দেখা হলো বনানীর নান্দুসে। অমিতা আমার অক্সফোর্ডের বান্ধবী। এখন আইসিডিডিআরবি-তে কাজ করে। জমে থাকা গল্পের ঝুলিটা তার সামনে খুলে বসলাম। গল্প তো শেষই হয় না। রাত আট-টায় দাঁতের ডাক্তারের সাথে একটা মুলাকাত ছিলো। অমিতা আমার অভিভাবক হিসেবে সাথে গেলো। দুই দাঁতের ফিলিং করা হলো। অবশেষে সে আমার বাসায় এসে আম্মার রান্না করা বিরিয়ানী-পোলাও খেয়ে গেলো।
পরদিন দুপুর বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ইন্টারভিউ। কোট-টাই পড়ে হাজির হলাম রেজিস্টার বিল্ডিং-এ। ইন্টারভিউ দিয়ে বুঝতে পারলাম, পিএইচডি করা অবস্থায় এখানে জয়েন করা যাবে না। অনেকটা দেশের প্রতি অযৌক্তিক টানেই এই ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম। কিন্তু, এখানকার নিয়ম-কানুনগুলো প্রবাসীদের ধরে রাখার প্রতি বেশ অনিচ্ছুক। পরদিন রাত নাগাদ জানতে পারলাম চাকুরিটা আমার হয়নি। প্রথমে একটু খারাপ লাগলো। দেশে থেকে কাজ করার জন্য এর থেকে ভালো সুযোগ হয়তো আর নেই। কিন্তু, তখন আমার দুই আদরের ছোটভাই স্রীজন আর লাবীবের সাথে শিশুসুলভ আড্ডা দিতে দিতে সব ভুলে গেলাম।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা অবশেষে দেখা হলো নায়লার সাথে। মেয়েটা দেশ-বিদেশ ঘুরতে ভালোবাসে। মাংস খাওয়ার জন্য তার একটা বিশেষ টান আছে। সেই টানকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার নতুন সব রেঁস্তোরা চেটে/চেখে ফেললাম। গত দুই সপ্তাহে আমি আমার বন্ধু-বান্ধবীদের কর্ম জীবনে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করেছি। নায়লা প্রায়ই বেলা বারোটায় তার সহজ চাকরী থেকে বের হয়ে যেতো। ধুমধাম সে গাড়ি চালিয়ে এসে আমাকে কিডন্যাপ করে কখনো বনানী, কখনো গুলশান কিংবা ধানমন্ডির কোন এক কফি শপে নিয়ে গেলো। এক বিকেলে আমি আর অমিতা বনানিতে বসে আছি। নায়লা আসলো। আমি জ্যামের কাছে পরাজিত এই নগরীর বুকে এক অযথা আবদার করে বসলাম— “মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে মুন্না মামার কোয়েল পাখির ডিম দেয়া হালিম খেতে যাবো।” জ্যাম ঠেলে এতদূর যেতে কেউ রাজি না। নায়লা টু সেভ দ্য ডে। মেয়েটা অসীম ধৈর্য্য সহকারে ড্রাইভ করে শামস, অমিতা আর আমাকে নিয়ে গেলো সলিমুল্লাহ রোডে। হালিম আসলো; তারপর নাই হয়ে গেলো। আরেক বাটি আসলো; সেটাও নাই হয়ে গেলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মেয়েটা আমাকে নতুন টোপ দিলো— “লেজার ট্যাগ”।
ঢাকায় গত এক বছরে এত কিছু নতুন হয়েছে সেটা জানতাম না। দুই বাটি হালিম খেয়ে বনানী ফেরত আসলাম। দশ মিনিটের এই খেলার ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম স্কোরটা করে বীরদর্পে শেষ স্থান দখল করে ফেললাম। ঘামে চুপচুপ দেহ নিয়ে সেরাতে বাসায় এসে ঘুম দিলাম।
নায়লার প্রতি ধন্যবাদের শেষ নেই। আমি “লিভিং দ্য মোমেন্ট” গোছের মানুষজনের বেশ ভক্ত। চিল পরশু হয় না, কালকেও হয় না; চিল হতে হয় আজকেই। নায়লার কারণে গত ১২ দিনের ঢাকা চিল বেশ ভালোই কেটেছে। কোন একদিন হঠাৎ করে মেয়েটা ওয়াটস্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে দেয়। খুলে দেখি সুন্দর একটা আকাশের ছবি। ইট-কাঠের এই শহরের কোণা দিয়ে কিছু মানুষ এখনো যে আকাশ দেখে তা জেনে মনটা কিছুটা আশ্বস্ত হয়; ক্লান্তি কিংবা শান্তির এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বন্ধু-আড্ডার পাশা-পাশি কিছু পাবলিক ইভেন্টে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ৩১ আগস্ট সকাল বেলা শান্তিনগরের PBS-এ “হাইজেনবার্গের গল্প” বইটার পাঠকদের সাথে দেখা করলাম। আমি আর শুভ দুইটা ছোট বক্তৃতাও দিলাম। বিজ্ঞানপ্রেমীদের মিলনটা বেশ ভালোই লাগলো। রবিবার রাতে গেলাম ATN News এর অফিসে। আমি আর আকাশ সেদিন ইন্টারভিউ দিলাম বিখ্যাত ফটোগ্রাফার প্রীত রেজার সাথে। “বিজ্ঞান পড়ে কি করবো?” শিরোনামে সেই ভিডিওটা এখনো তাদের ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যাচ্ছে। বেশ মজার একটা আড্ডা হয়েছে!
আমার গুরু মুশতাক স্যার অক্সফোর্ড থেকে বাংলাদেশে এসে এখন ঢাবিতে কর্মরত আছেন। Mented নামক একটা সংগঠন বানিয়েছেন তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে। স্যার অনুরোধ করলেন বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক একটা লেকচার আয়েজন করতে। আমিও সায় দিলাম। ৩ দিনের মাথায় বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে ঢাবির বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের গ্যালারীতে এসে বসলে। এক ঘন্টার জায়গায় দুই ঘন্টা ধরে বললাম আমি কীভাবে নিজেকে অক্সফোর্ডের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসলে এধরণের ইভেন্ট আরো বেশি বেশি করার চেষ্টা করবো। কোন না কোন ভাবে এই দেশে কাজে নিজেকে লাগাতে পারলে ভালোই লাগে।
আড্ডা-চিল-বন্ধু-পাবলিক ইভেন্ট শেষে অনুধাবন করলাম পরিবারের সাথে সময়টা হয়তো একটু বেশীই কাটানো উচিত ছিলো। সেই পাপে আমি গত দশ বছর ধরেই পাপী। বাসায় যত দিনই রাতে ফিরেছি মা’মনি তার অসাধারণ সব ডিশ রান্না করে দিয়েছে। আমি ভাত খাই না দেখে রুটি বানানো হয়েছে। গতকাল বাসায় এসে দেখি সালাম ডেইরি ফার্ম থেকে মালাই চপও আনা হয়েছে। আফ্রিকার জঙ্গলে দেখেছি মা পাখি তার বাচ্চাকে প্রথম বেশ কিছুদিন মুখে তুলে খাবার খাওয়ায়। তারপর উড়তে শেখায়। একসময় বাচ্চাটা উড়ে যায়; মা পাখিটা বেশ কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে থাকে। বুঝতে পারে সেটাই জীবনের বাস্তবতা।
গত দুই সপ্তাহ ধরে জীবনটাকে বেশ সুন্দর মনে হয়েছে। অসাধারণ কেটেছে সময়টা। আজ রাত দেড়টার ফ্লাইটে ফেরত যাচ্ছি আমার জীবনের বাস্তবতায়। সকালে স্টার কাবারের মগজটা হয়ে যাবে ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, দুপুরের বিরিয়ানী হবে স্যান্ডউইচ, দৈনিক চিলটা হয়ে যাবে পাক্ষিক, জীবনটা আবার ফিরে যাবে নিয়মের রুটিনে। সেই রুটিনে আছে ল্যাব, এক্সপেরিমেন্ট, ল্যাব এবং আরো বেশি ল্যাব। সেই রুটিনে সপ্তাহে একবার মার সাথে কথা হবে, সেই রুটিনে মোহাম্মদপুরে মুন্না মামার হালিম নেই, সেই রুটিনে হালিম খেতে নিয়ে যাবে এমন মানুষও নেই। তারপরও ফিরে যাবো সেই রুটিনটায়… কারণটা বেশ অযৌক্তিক অথবা অযাচিত যুক্তিতে ভরপুর।
প্রিয় বাংলাদেশ, ভালোবাসাটা রেখে গেলাম… দেখা হবে শীঘ্রই; অথবা দেরীতে।