পেঙ্গুইন, আটলান্টিক, কেপ টাউন
May 27, 2020 | 6329
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার সাউথ আফ্রিকার এক্সপেরিমেন্ট বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই শেষ হয়ে যায়। সেই সপ্তাহের শুক্রবারটা দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারী ছুটি। এই সুযোগে ড্যান তার বান্ধবীকে নিয়ে শুক্র-শনি-রবি ট্রিপ মারতে চাইছে। তাই সে আমাকেও মোটামুটি জোর করে ল্যাব থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলো। অগত্যা আর কোন উপায় না দেখে ৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল পাঁচটার ফ্লাইট ধরে আমি জোহানেসবার্গ থেকে কেপ টাউনের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম।
কেপ টাউনকে বলা হয় আফ্রিকার ইউরোপ। এখানে রাতে রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো যায়; চাইলেই একা কোথায় চলে যাওয়া সম্ভব। পর্যটকদের এই নিরাপত্তার বিষয়টা আমি এয়ারপোর্টে নেমেই আঁচ করতে পারছিলাম। একজন হাস্যোজ্জ্বল উবার ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে আমি ছুটে চললাম সী পয়েন্ট এলাকার দিকে। সেখানে মোজো হোস্টেলে আমার তিন রাতের বসবাসের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বুকিং.কম। এর জন্য আমাকে সর্বমোট গুনতে হয়েছে মাত্র পনেরো’শ টাকা!
আমার ধারণা ছিলো হোস্টেলটা অনেক সাধাসিধে কিসিমের হবে। কিন্তু, বাস্তবে তা পুরো বিপরীত। মোজো ফুড মার্কেটের বিশাল এলাকা জুড়ে এই হোস্টেল। বড় একটা রুমে চারটা দোতলা বেড। প্রতি রুমে রয়েছে নিজস্ব রান্নাঘর, ফ্রিজ, বাথরুম। এতো পরিষ্কার হোস্টেল এতো কম দামে আমি পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাইনি। হোস্টেলের লকারে ব্যাগ রেখে রাত্রি দশটা নাগাদ চলে গেলাম নিচ তলার ফুড মার্কেটে। সেখানে শা শা ওয়ারী নামক এক স্টল থেকে প্রায় পাঁচ’শ টাকা খরচ করে একটা শর্মা কিনলাম। আফ্রিকান কায়দায় ফেলাফেল আর মাংস দিয়ে ভর্তি এই শর্মাটা অবশ্য আমার তেমন মনমতো হলো না। আমি কিছুটা আশাহত হৃদয়ে হোস্টেল রুমে ফেরত গেলাম। সেখানে আমার পরিচয় হলো ইজমীর সাথে। বিশ বছর বয়সী এই ছোকড়ার মাথায় স্টার্টআপের নেশা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত একমাস ধরে এই হোস্টেলে থেকে সে কেপ টাউনের বিজনেস টাইকুনদের সাথে মিটিং করে বেড়াচ্ছে। ইজমীর পরামর্শে আমি আশে পাশের এলাকায় ক্লাব খুঁজতে বের হলাম। হোস্টেলের ঠিক উল্টা পাশেই একটা স্পোর্টস বার দেখা যাচ্ছে। আমি সেখানে ঢুকে একটা ক্যাসেল লাইট অর্ডার করে বসে পড়লাম।
জায়গাটা একটু অন্ধকার; সেখানে দশটা পুল বোর্ড। কিছু উঠতি বয়সের ছেলে বন্ধুদের সাথে বাজিতে গেম খেলছে। কিছু শুকনো বান্ধবী সেই বন্ধুদের বগলের নীচে বসে আছে। টিভি স্ক্রীনে যথারীতি রাগবী খেলা চলছে। প্রায় আধা ঘন্টা পর সেখানে থেকে আমি বের হয়ে আসলাম। চলে গেলাম সমুদ্রের পাড়ে।
কেপ টাউনের পুরো ট্যুরিস্ট এলাকাটাই বীচ থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দূরত্বে। তাই যেকোন হোটেল থেকেই সমুদ্র দেখা যায়। বীচে কোন বালি নেই; আছে বড় বড় পাথরের টুকরো। সবাই তো আর সেন্ট মার্টিনের মতো বালিময় বীচের অধিকারী হয় না! তবে কেপ টাউনের বীচের পাড়টা খুব সুন্দর করে বাঁধানো। সেই রাস্তা ধরে একটা শান্তির ওয়াক নেয়া সম্ভব।
মিনিট পনেরো সেই বীচের পাড়ে হাঁটার পর বুঝতে পারলাম আমিই সেখানে একা। কোন জুলু ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। তাই, রাত বারোটা নাগাদ হোস্টেলে ফিরে গিয়ে সুন্দর একটা ঘুম দিলাম। সেই ঘুম ভাঙলো পরদিন ভোর ছয়টায়।
কেপ টাউনের সূর্য তখন মাত্র উঠবে উঠবে ভাব। আমি দাঁত ব্রাশ করে রানিং স্যু পড়ে সোজা চলে গেলাম সী পয়েন্ট বীচে। সেখান থেকে ওয়াটার ফ্রন্ট বীচে হেঁটে যেতে প্রায় ৫০ মিনিট লাগে। আমি হাঁতের বাম দিকে আটলান্টিকের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ আর চোখের সামনে উদীয়মান আফ্রিকান সূর্য দেখতে দেখতে দৌড়াতে থাকলাম গন্তব্যের পানে। জীবনে অনেক সূর্যোদয় দেখেছি। তবে টেবিল মাউন্টেনের পেছন থেকে উঠতে থাকা সেই সকালের লাল সূর্যটাকে হার মানানো অসম্ভব। এই মর্নিং ওয়াকের সময় আমার বার বার ‘গোল’ সিনেমার সান্তিয়াগো মুনেজের কথা মনে পড়ছিলো। সে যখন নিউক্যাসেলে ট্রায়াল দিতে যায় তখন প্রথম সকালে এরকম একটা সমুদ্রের পাড়ে দৌড়াতে বের হয়েছিলো।
আমি আটলান্টিকের বিশালতায় এতোটাই মুগ্ধ যে সাথে সাথে মা-জননীকে ভিডিও কল করে সেই দৃশ্য দেখালাম। জীবনের কিছু কিছু মুহুর্ত শুধু একা উপভোগ করলে খানিকটা অপূর্ণতা থেকে যায়। কেপ টাউনের মর্নিং রানটা সে তালিকায় পড়বে।
সকাল সাড়ে সাতটায় আমি বিখ্যাত ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকার কেপ হুইলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনের পোর্টে বিশাল বিশাল জাহাজ ডক করা। হুইলের ঠিক পাশেই ভোভো তেলো নামক রেঁস্তোরাটা বেশ মনপূত হলো। তাদের দোকানের বাইরে খোলা আসমানের নীচে সুন্দর একটা বসার জায়গা। সকালের ঠান্ডা রোদে আলোকিত একটা টেবিলে বসে রিচার্ড ডকিন্স সাহেবের সেলফিশ জিন বইটা পড়তে থাকলাম। মজার ব্যাপার হলো, ডকিন্স তার বইতে মানুষের যেই বিবর্তনের কথা বলেছেন তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঘটেছে সাউথ আফ্রিকার এই কেপ টাউন অঞ্চলেই। ভাগ্যের বিবর্তনে আমি সেই জায়গাতে বসেই বইটা পড়ছি।
ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেলো। ডেনিশ ফেতা চীজের পুর দেয়া ডিমের অমলেট, ব্রেড, বাটার তৈরি হচ্ছে। সাথে একটা ফ্ল্যাট হোয়াইট কফি। প্রায় পনেরো মিনিট পর আমার দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ডিম ভাজিটা টেবিলের উপর সার্ভ করা হলো। সেলফিশ জিনটা বন্ধ করে ক্ষুধার্ত শামীর ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই প্লেটের উপর। খুব সুন্দর করে ফ্রেঞ্চ কায়দায় প্যানের উপর ডিম ছড়িয়ে চপস্টিক দিয়ে নেড়ে ফেনা তুলে ফেলা হয়েছে। তারপর তাপে ডিমটা জমাট বেঁধে আসার পর একপাশে অনেকগুলো সাদা ফেতা চীজের টুকরা দিয়ে বাকী অর্ধেকটা ডিম উল্টিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। উপরে সাজানোর জন্য দেয়া হয়েছে কয়েকটি রকেট পাতা। প্রতি কামড়ে ডিমের ভেতর থেকে লুকিয়ে থাকা ফেতা চীজ পুঁত করে বের হয়ে আসছে। একটু ফ্ল্যাট হোয়াইটে চুমুক দিয়ে সেই চীজ আর ডিমের লীলা খেলার অংশে পরিণত হয়ে গেলাম।
সকাল নয়টা নাগাদ নাস্তা শেষ করে চলে গেলাম কেপ টাউন অ্যাকুরিয়ামের কাছে। আমি ট্রিপ অ্যাডভাইজরের মাধ্যমে আগেই সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে একটা ডে-ট্রিপ বুক করে রেখেছিলাম। সেই বাস ছাড়বে সকাল সাড়ে নয়টায়। আমাকে নিয়ে যাবে কেপ অফ গুড হোপ আর পেঙ্গুইন বীচে।
বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কয়েকজন সহ-পর্যটকদের সাথে পরিচিত হয়ে নিলাম। সবচেয়ে মজার লাগতো যখন কেউ জিজ্ঞাসা করতো, “Where are you from?”
আমি উত্তরে বললাম, “I am originally from Bangladesh, living in the UK, currently working in Pretoria and on vacation in Cape Town.” সবাই হেসে বলে ফেলতো, “You are the citizen of this world.”
বাসে উঠে সামনের সীটে এক ভদ্রমহিলাকে একা বসে থাকতে দেখলাম। আমি তার অনুমতি নিয়ে পাশে যেয়ে বসলাম। ইসাবেলা নামক এই ডেনিশ মেয়ে একা কেপ টাউন ঘুরতে এসেছে। তার ইংরেজির দক্ষতা খুবই করুন। আমি বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও তার সাথে বন্ধত্ব জমাতে ব্যর্থ হলাম। তখন মনে হচ্ছিলো ফ্রেঞ্চ ভাষাটা শিখে আসা উচিত ছিলো।
আমাদের ট্যুর গাইডের নাম ক্রিস। সে খুব সুন্দর করে প্রতিটা অঞ্চলের ইতিহাস বলতে বলতে আমাদেরকে কেপ টাউন ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলো। প্রথমেই চোখের সামনে পড়লো সেই বিখ্যাত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ স্টেডিয়াম যেখানে ২০১০ সালের অনেকগুলো টান টান উত্তেজনার ম্যাচ প্রদর্শিত হয়েছিলো।
খানিকটা দূরে একটা বীচের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্রীস বলে বসলো, এই পানির জায়গায় একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে। ব্যাপারটা বাসের অন্য কেউ হয়তো বুঝতে পারেনি। তবে আইস এইজ অ্যানিমেশন মুভির যেকোন ফ্যানই বিখ্যাত কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট বা মহাদেশীয় সঞ্চালন থিউরীর সাথে পরিচিত। এককালে পুরো পৃথিবীটাই ছিলো একটা মাত্র মহাদেশ— “প্যানসিয়া”। তারপর কেপ টাউনের কাছে প্যানসিয়া ভেঙ্গে সাতটা মহাদেশে বিভক্ত হয়। আফ্রিকা থেকে আলাদা হয়ে যায় আজকের সাউথ আমেরিকা।
কেপ টাউনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে হলে খানিকটা পড়াশোনা করে আসা দরকার। মানুষের বিবর্তনে কেপ টাউন খুব গুরুত্বপূর্ণ, উদ্ভিদ জগতের একটা ভিন্ন ফ্লোরা অঞ্চল হলো শুধুমাত্র কেপ টাউন। ডাচদের বিখ্যাত সমুদ্র যাত্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টও ছিলো এই কেপ টাউন। পৃথিবীর প্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারী হয়েছে কেপ টাউনে। নেলসন ম্যান্ডেলা কারাবাস করেছেন এই কেপ টাউনে। তাই, কেপ টাউনের রাস্তায় হাঁটতে গেলে রোমাঞ্চিত হওয়াটা খুবই সাধারণ ব্যাপার মাত্র।
আমাদের বাসটা আটলান্টিকের পাশ ঘেঁষে চলছিলো আকর্ষণীয় এক পাহাড়ের দিকে। কেপ টাউন নাবিকদের জন্য অসম্ভব কঠিন একটা প্রান্ত। কারণ এখানে দুই আটলান্টিক এসে “ফলস বে” নামক স্থানে মিশে গেছে। একদিকের আটলান্টিক ঠান্ডা পানির স্রোত নিয়ে আসছে; অন্যদিকে উষ্ণ। একই ছবিতে এই দুই আটলান্টিককে ধরে রাখতে চাইলে কেপ টাউনই একমাত্র উপযুক্ত স্থান।
‘ফলস বে’ নামকরণের পেছনে একটু মন খারাপ করা গল্প রয়েছে। ডাচদের অনেক জাহাজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মালপত্রের চালান নিয়ে এই কেপ টাউনে এসে দিক হারিয়ে ফেলতো। ফলস বে আর টেবিল বে’র মাঝে তারা পার্থক্য করতে পারতো না। এর অন্যতম কারণ হলো কেপ পয়েন্টের পুরাতন লাইট হাউজটা এতো উপরে ছিলো যে তা প্রায়ই মেঘে ঢেকে যেতো। অবশেষে নাবিকদের সুবিধের জন্য নীচে একটা নতুন লাইট হাউজ নির্মাণ করা হয়। সমুদ্রের এই স্থানে এসে নাবিকরা বার বার ভূল করার কারণে একে ‘ফলস বে’ নাম দেয়া হয়।
ঘন্টা দুয়েক পর আমরা সবাই ফলস বে পার হয়ে সেই কেপ পয়েন্টে এসে পৌঁছলাম। ইসাবেলা আর আমি একসাথে সেই ওল্ড লাইট হাইজে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুজনে পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে সুবিশাল আটলান্টিকের শান্ত ঢেউয়ের মোহে কিছুক্ষণ সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিলাম। অসুস্থ কোন মানুষকে এই জায়গায় নিয়ে আসলে তার অন্তত মনটা ঠিকই ভালো হয়ে যাবে। দূরে টেবিল মাউন্টেনের চূড়া দেখা যাচ্ছে; সামনে সবুজ-নীল আটলান্টিক। আমরা দুজনে সেটাকে পেছনে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছি লাইট হাউজের চূড়ায়। সেখানে একটা পোলে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের দূরত্ব লেখা আছে। লন্ডন ৯৬২৩ কিমি, রিও ডি জেনেরিও ৬০৫৫ কিমি, আমস্টারডাম ৯৬৩৫ কিমি, সিডনী ১১৬৪২ কিমি। ইসাবেলা আমাকে হাতের ইশারায় নিচের নিউ লাইট হাউজে যেতে আমন্ত্রণ জানালো। জায়গাটা একটু নিরিবিলি দেখে আমরা দুজনে সেদিকে হাঁটা দিলাম। প্রায় পনেরো মিনিট পর আমরা পৌঁছে গেলাম নিচের লাইট হাউসে।
হাঁটতে হাঁটতে আমি ফিরে গেলাম আমার ক্রিসমাস ট্রিপের মেমোরি লেনে। গত ডিসেম্বরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ডাচদের রাজধানী আমস্টারডামে ক্যানেলের পাড়ে। সেখান থেকে জাহাজগুলো ছেড়ে এই ফলস বে’র নিউ লাইট হাউস দেখে সঠিক পথে এশিয়ার দিকে চলে যেতে পারতো। আমি যেন আজ শত বছর পর সেই ডাচ রুট তাড়া করে বেড়াচ্ছি পৃথিবী জুড়ে। ডাচদের কাছ থেকে কেপ টাউনের কর্তৃত্ব পরবর্তীতে চলে যায় নেপোলিয়নের ফ্রান্সে। আর আমরা বর্তমান বাসস্থান ইংল্যান্ডের মানুষজনই পরবর্তীকালে ফ্রেঞ্চদের পরাজিত করে কেপ টাউনের শাসনভার অর্জন করে।
নিউ লাইট হাউস থেকে নিচের দিকে তাকালে এক অসাধারণ চিত্র দেখা যায়। খুব সুন্দর একটা বালির বীচের উপর নীল সমুদ্রের পানি ঢেউয়ের আকারে আছড়ে পড়ে সাদা সাদা ফেনা তৈরি করেছে। নীলাভ-সবুজ পানির রাজত্বের বুক চিড়ে সেই সাদা ফেনার বাহারি চিত্রকর্ম পিকাসোর রং তুলির আঁচড় অপেক্ষা কোন অংশেই কম নয়।
ক্রিস আমাদেরকে ঠিক বেলা ১-টায় বাসে ফেরত যেতে বলেছিলো। তবে খাবার কিনতে যেয়ে দেরী করে ফেলায় আমি বাসটা মিস করলাম। ইসবেলাও চলে গেছে। তবে আমি শুধু একা নই; ফ্রান্সোলিসি নামের এক ব্রাজিলিয়ান মেয়েও আমার মতো বাস ধরতে পারেনি। আমাদের দুজনকে রেখে বাকী দল মিলে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ট্যুরিস্ট আকর্ষণ কেপ অফ গুড হোপে চড়তে শুরু করে দিয়েছে।
আমি হাল ছাড়বার পাত্র নই। এর আগেও গোটা দশেক পাহাড়ে চড়েছি। এর জন্য গায়ের জোর লাগে না; দরকার হয় ভালো একজন সঙ্গীর। ফ্রান্সোলিসির ইংরেজি বেশ ভালো; তবে সে উঁচু জায়গায় উঠতে বেশ ভয় পায়। অবশেষে তাকে নানা রকম আশ্বাস দিয়ে আমার সাথে হাইকিং করতে আশ্বস্ত করে ফেললাম।
আমার উদ্দেশ্য ছিলো অনেক দ্রুত হাইক করে আমাদের গ্রুপটাকে ধরে ফেলবো। তাই আমি সামনে উঠে পথ বের করছি; আর ফ্রান্সেলিসি আমাকে অনুসরণ করছে। তবে একটু উঁচু জায়গায় আসার পর পরই তাকে এগিয়ে আনার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিতে হয়। কঠিন জায়গাটুকু পার করার পরও লক্ষ্য করলাম সে হাতটা ছাড়তে চায় না। ব্যাপারটাকে আমি ভালোবাসার বদলে ভয়ের কোটায় অবজ্ঞা করলাম। অবশেষে প্রায় ত্রিশ মিনিটের মাথায় আমাদের গ্রপের সাথে মিলিত হলাম। ড্যানিশ বান্ধবী ইসাবেলা আমার নতুন ‘প্রণয়ে’ বেশ হতাশ হলো। তার ব্যাগে রেখে আসা আমার সোয়েটারটা বের করে গাড়ির সিটে রেখে দিলো।
আরো আধা ঘন্টা পাহাড় চড়ার পর আমি আর ফ্রান্সোলিসি পৌঁছে গেলাম আফ্রিকান মহাদেশের দক্ষিণতম প্রান্তে— “দ্য কেপ অফ গুড হোপ”। (এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা যা কেপ টাউনের ট্যুর গাইডরা বলে থাকেন। আসল দক্ষিণতম প্রান্ত হলো কেপ আগুলহাস।) আটলান্টিকের নীল সমুদ্রের মাঝে অবস্থিত ছোট এই পাহাড়ের কিনারায় বসে থেকে আমার স্টিভ জবসের একটা কথা বার বার মনে পড়ছিলো— “Death is the single best motivation for life.”
জীবনে যত কষ্ট করেছি তার সবই ১০ আগস্ট ২০১৯ তারিখে সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে স্বার্থক মনে হচ্ছিলো। ফ্রান্সোলিসি অনেক ধৈর্য্য করে আমার জীবনের সেরা কয়েকটা মুহুর্তকে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখলো। এই মেয়েটাকে সে কারণে কখনো ভুলতে পারবো না। বিশ্বের কোণায় কোণায় রেখে আসা এরকম অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়েই রচিত হয়েছে আমার জীবনের ভ্রমণ উপাখ্যান।
পাহাড়ে ওঠা কঠিন; নামাটা তার থেকে বেশী বিপদজনক। একটু ভুল হলেই পা মচকে যাবে। সুতরাং, আমি আর বান্ধবী মিলে এক ঘন্টা লাগিয়ে কোন রকমে সমতল ভূমিতে ফেরত আসলাম। আমাদের আনন্দ আর তখন পায় কে?
দু’জনে মিলে গিয়ে বসলাম বাসের সীটে। ক্রিসের বর্ণণায় শুনতে থাকলাম দক্ষিণ আফ্রিকার বিজয় গাঁথা; চোখ দুটো পড়ে রইলো ব্রাজিলিয়ান বান্ধবীর চুলের ফাঁক দিয়ে বাইরের আটলান্টিকের ওপর। একসময় রাস্তার ধারে এক দল বেবুনকে দল বেঁধে পার হতে দেখলাম। এই বেবুনরা বেশ ভয়ানক প্রজাতি। কোন বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারলে সব কিছু তছনছ করে ফেলে। তাই, কেপ টাউনে যাদের বাড়ি আছে তারা সবাই বেবুন ইন্সুরেন্স পর্যন্ত কিনে থাকে!
বিকেল চারটা নাগাদ আমাদের বাস গিয়ে থামলো সায়মন’স টাউন এলাকায়। এবার আমরা ঘুরে দেখবো এমন এক পেঙ্গুইন কলোনী যারা উষ্ণ পরিবেশে বাস করে। কেপ টাউনের দক্ষিণে মাটি পাওয়া যায় কেবল এন্টার্কটিকায়। ধারণা করা হয়, এই পেঙ্গুইনদের পূর্ব পুরুষেরা সেই দক্ষিণ মেরুর বাসিন্দা।
সায়মান’স টাউনের সেই পেঙ্গুইনেরা বাস করে বোল্ডার্স বীচ নামক সমুদ্র সৈকতে। আমরা দল বেঁধে প্রবেশ করলাম পেঙ্গুইনদের স্বর্গ রাজ্যে। প্রথম পক্ষী দর্শনেই আমি খানিকটা হতাশ হলাম। পেঙ্গুইনের যে বিশালাকার তুলতুলে দেহ আমি টিভি পর্দায় দেখে অভ্যস্ত তার তুলনায় এই উষ্ণ অঞ্চলের পাখিগুলো বেশ ভিন্ন। পেঙ্গুইনের চর্বির আস্তরণ মূলত তাকে এন্টার্কটিকের তীব্র ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে থাকে। কিন্তু, গরম এলাকায় শত বছর ধরে বসবাসের কারণে এই কলোনির পেঙ্গুইনেরা তাদের সেই চর্বির প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান বাসিন্দারা প্রায় এক থেকে দেড় ফুট লম্বা হয়ে থাকে; ওজনে বড় জোড় দশ কেজি হতে পারে।
বোল্ডার্স বীচের নীল পানিতে সেই স্লিম পেঙ্গুইনেরা সাঁতার কেটে বেড়ায়। তারপর পাড়ের চিকচিকে সাদা বালিতে বসে রৌদ্রস্নান করে। পেঙ্গুইন অসম্ভব মাত্রায় সামাজিক প্রাণী। তাদের জুটির ভালোবাসাটা বেশ প্রকট। একটা বড় পেঙ্গুইন অন্য জুটির বাচ্চার ধারে কাছে আসলে তাকে বেশ বড়সড় আক্রমণের সম্মুক্ষীণ হতে হয়। মা পেঙ্গুইন মাসের পর মাস বাচ্চার ডিমে তা দেয়; বাবা ছুটে যায় পানির ভেতরে থেকে মাছ ধরে আনতে। কী অসাধারণ এক পারিবারিক বন্ধন!
এই পেঙ্গুইনদের ডিম পাড়ার সুবিধার জন্য পুরো এলাকা জুড়ে অনেকগুলো ছোট ছোট গর্ত বানিয়ে দেয়া হয়েছে। সবুজ গাছের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমি আর ফ্রান্সোলিসি এই কিউট-কাডলি গর্তবাসীদের একে একে খুঁজে বের করতে থাকলাম।
বেলা সাড়ে পাঁচটায় ক্রিস এসে আমাদের বাসে তুলে নিলো। সন্ধ্যা সাতটায় আমরা নেমে গেলাম ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায়। আমি আর ফ্রান্সোলিসি ভোভো তেলোতে বসে আরেক কাপ ফ্ল্যাট হোয়াইট কফিতে চুমুক দিলাম। হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে, বান্ধবী আরো একটু সময় থাকতে চাইছে। (ব্যাপারটা এমন না যে আমিও সেটা চাচ্ছি না।) অগত্যা দুজনে গিয়ে কেপ পোর্টের সামনে একটা বেঞ্চে যেয়ে বসলাম। চোখের সামনে আটলান্টিক, দুপাশে ডক করা গোটা বিশেক জাহাজ। সীগালগুলো আজকের মতো তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে; খুব সুন্দর একটা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ফ্রান্সোলিসি আর আমি সেই বেঞ্চে বসে ঘন্টা তিনেক একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করলাম। ভালো গল্প বলার অভ্যাসটা অবশেষে জীবনে কাজে লাগতে শুরু করেছে।
রাত্র ১১-টার দিকে একটা উবার ডেকে বান্ধবীকে তার হোস্টেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি ফেরত গেলাম সী পয়েন্টে। গাড়ি থেকে নামার সময় উবার ড্রাইভার আমাকে অনেক ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলো, “আমি গত তিনবছর ধরে এই এলাকায় গাড়ি চালাই। এই প্রথম তোমার চামড়ার কোন ছেলেকে একটা সাদা চামড়ার বান্ধবী জোটাতে দেখলাম।”
উত্তরে আমি বললাম, “চামড়ার রংটা বাদ দিয়ে মনের রংটা দেখতে শিখো। তোমাদের দেশটাই তাহলে বদলে যাবে।”
হোস্টেলে গিয়ে গোসল শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল ছয়টায় যথারীতি ঘুম থেকে উঠে আমার সেই পছন্দের সমুদ্র বিলাসের দৌড় দিলাম। ওয়াটার ফ্রন্টের কাছে ন্যাটিভ কাফে নামক একটা কফিশপে ঢুকে বসলাম। মাত্র চারশ টাকার বিনিময়ে এক কাপ ফ্ল্যাট হোয়াইট আর একটা চকোলেট ক্রোসোঁ মিলে গেল। এই কফি শপের আবহাওয়াটা খুবই সুন্দর। কাঁচের দেয়াল ঘেরা আরামদায়ক একটা ড্রয়িং রুমের আমেজ রয়েছে জায়গাটায়। বেশ আলিশান একটা সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে চোখের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা টেবিল মাউন্টেনের শোভা দেখতে থাকলাম। এর নাম ‘টেবিল’ মাউন্টেন হওয়ার পেছনে অবশ্যই যৌক্তিকতা রয়েছে। পুরো পাহাড়টার কোন চূড়া নেই। উপরের দিকে এটা খুবই সমতল। একটা কোণায় খানিকটা উঁচু বৃত্তাকার একটা অংশ রয়েছে। সেটাকে টেবিলের কোণায় রেখে দেয়া অ্যালার্ম ঘড়ি বলে মনে হয়। কেপ টাউনে প্লেন দিয়ে ল্যান্ড করার সময়ও এই টেবিল মাউন্টেন দেখে তার নামের স্বার্থকতা উপলব্ধি করা যায়।
বেলা এগারোটার সময় আমি ওয়াটার ফ্রন্টের পাশে অবস্থিত ফুড কোর্টে প্রবেশ করলাম। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে তাদের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছে। এক ইরানিয়ান জুটি উটপাখির রোল বিক্রি করছে। সাভানায় সেই পাখি দেখে আসার পর থেকেই আমি তার স্বাদ নেয়ার জন্য বেশ মুখিয়ে আছি। অবশেষে আমার আশা পূরণ হলো। গরম গরম রুটির ভেতরে ঠেসে দেয়া উটপাখির মাংস আমার মুখ গহবরে জায়গা করে নিলো। চরম আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, এর স্বাদ খানিকটা গরুর মাংসের মতো। উটপাখি রেড মিট হিসেবে খাওয়া হয়। আমার ধারণা এর স্টেকও খেতে অসাধারণ হবে।
উটপাখি ভক্ষণ সমাপ্ত করে আমি তখন ওয়াটার ফ্রন্টের পোর্টে হেঁটে বেড়াচ্ছি। এলাকাটা খুবই উৎসবমুখর। একটু পর পর একটা গন্ডারের মূর্তি দেখা যায়; তার গা জুড়ে আফ্রিকান রঙিন চিত্রকর্ম। আমি যথারীতি এবার পর্যটক এলাকা থেকে বের হয়ে একটু আবাসিক এলাকার দিকে চলে গেলাম। কারণ, একটা শহরের দুটো অংশই দেখে নেয়া উচিত। নতুবা খুবই পক্ষপাতদুষ্ট একটা মনোভাব তৈরি হতে পারে।
আসল কেপ টাউন বাসীরা এই পোর্ট এলাকার তোয়াক্কা হয়তো করে না। তারা বাস করে যথারীতি বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংগুলোতে। সেই এলাকাটা অসম্ভব নির্জন; নেই কোন পর্যটকবান্ধব কফিশপ। সেখানে আছে নিত্য দিনের ব্যস্ততা; আছে মুদি দোকান আর বাচ্চাদের খেলার মাঠ।
বেলা দুটো নাগাদ আমি আবার ফেরত আসলাম কেপ হুইলের পাশে। আমার চারপাশে যেন মানুষের এক মেলা বসেছে। আফ্রিকান উপজাতিরা তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির রংচঙ্গা ঐতিহ্যবাহী নাচ উপস্থাপন করছে। সামনে বিশাল বড় একটা শপিং মলে যথারীতি আমেরিকান ফাস্ট ফুডের রাজত্ব। আমাদের বহুল পরিচিত নান্দুস কিন্তু অবশ্য একটা সাউথ আফ্রিকান চেইন রেঁস্তোরা।
কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে কেউ আমাকে ডাক দিলো। মাথা ঘুরিয়ে দেখি ফ্রান্সোলিসি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে মিলে পরবর্তী চার-পাঁচ ঘন্টা কেবল কফি খেতে খেতে সেই ন্যাটিভ কাফেতে গল্প করলাম। ছুটি কাটানোর একটা বড় সুবিধে হলো আলসেমী। চাইলেই কিছু না করে একটা বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয়া যায়। এখন এটাকে আমার কাছে অনেক বড় এক বিলাসিতা বলে মনে হয়।
ফ্রান্সোলিসি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে টেবিল মাউন্টেনে যেতে অনুরোধ করতে থাকলো। সেখানে নাকি একটা কেবল কারে করে চারপাশের এলাকাটা ঘুরে দেখা যায়। কিন্তু, আগামীকাল দুপুরে আমার ফ্লাইট থাকায় আমি রাজি হলাম না। দুজনে মিলে নান্দুসে রাতের খাবার খেয়ে ফেরত গেলাম নিজ নিজ নীড়ে।
১২ আগস্ট ২০১৯; ঈদ-উল-আজহার দিন। ঈদে সবাই নিজের পরিবারের কাছে ফেরৎ যেতে চায়। জীবন আমাকে এমন এক মোড়ে এনে দাঁড়া করিয়েছে যেখানে বাংলাদেশে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু, কেপ টাউনে ঘুরতে আসার সামর্থ্য রয়েছে। জীবনের এই চাকা যাতে সবসময় ঘুরতেই থাকে সে বাসনা রইলো মনে মনে।
সকাল বেলা সেই ন্যাটিভ কাফেতে গিয়ে কফির কাপটা হাতে নিয়ে মা’মনিকে ফোন দিলাম। মা-ছেলের দুই ঘন্টার ঈদ আয়োজন অবশেষে সমাপ্ত হলো বেশ অপ্রত্যাশিতভাবে। সকাল সাড়ে নয়টায় আমার ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী কাফেতে এসে উপস্থিত। আমাকে বলপূর্বক সে টেবিল মাউন্টেনের বাসে তুলে নিলো। আমি বলতে থাকলাম, “যদি আমার ফ্লাইট মিস হয় তাহলে তুমি আমাকে রিও-ডি-জেনেরিও নিয়ে যাবা।”
সকাল সাড়ে এগারোটায় কেপ টাউনের বিখ্যাত টেবিল মাউন্টেনের পাদদেশে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বেল লম্বা একটা লাইন সেখানে। স্টুডেন্ট আইডি কার্ডটা থাকায় প্রবেশ্য মূল্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ছাড় পেলাম। আমাদের সামনে প্রায় দুশো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখছি আর ফ্লাইটের জন্য টেনশন করছি। এই অবস্থা দেখে আমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা বললো, “দেখো জীবনে একটা ফ্লাইট মিস করলে আরকেটা ধরতে পারবে। কিন্তু, টেবিল মাউন্টেন না দেখে গেলে অন্য কোথাও গিয়ে সেই অভিজ্ঞতাটা মেলাতে পারবে না।”
ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ডারবানবাসী পেশায় টিভি হোস্ট। সাউথ আফ্রিকার মর্নিং শোগুলোতে সে রন্ধক হিসেবে কাজ করে। প্রতিবছর এই সময়টায় লুকাস তার বাবা আর ভাইকে নিয়ে টেবিল মাউন্টেন ঘুরতে আসে। লুকাসের কথায় আমি খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। ফ্রান্সোলিসি যথারীতি উঁচু জায়গায় উঠতে ভয় পাচ্ছে। বন্ধুত্বের হাতটা বাড়িতে তাকে সেই কেবল কারে টেনে তুললাম আমি। সমুদ্রের কাছ থেকে শুরু করে সেই তারের গাড়ি আস্তে আস্তে পাহাড়ের চূড়োর দিকে চলতে শুরু করলো। ভ্রমণকালে গাড়িটা ৩৬০ ডিগ্রী কোণে ঘুরতে ঘুরতে একপাশের সমুদ্র আর শহর এবং অন্যপাশের পর্বতের অংশ বিশেষ দেখাতে থাকলো। প্রায় সাড়ে ছয় মিনিট পর আমরা টেবিল পর্বতের চূড়ায় বসে আছি। (এই রাইডের সুন্দর একটা ভিডিও আমার ইন্সটাগ্রামের IGTV-তে রয়েছে। আইডি: heisenberg.shamir)
টেবিল পর্বতের শীর্ষটা একটা মোটামুটি সমতল ভূমি। বুদ্ধিমান সাউথ আফ্রিকানরা জায়গাটাকে খুবই পর্যটনবান্ধব করে সাজিয়েছে। সেখানে রয়েছে একটা কাফে, স্যুভেনির শপ আর মিউজিয়াম। আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ হলো উঁচু একটা স্থানে দাঁড়িয়ে দূরের শহরটাকে দেখা। কেপ টাউনের সেই প্যানারোমিক দৃশ্য দেখতে হলে টেবিল মাউন্টে খুবই উপযুক্ত জায়গা। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে আপনি কেপ হুইল, স্টেডিয়াম, ওয়াটার ফ্রন্ট আর উত্তাল আটলান্টিকের শোভায় চোখ জুড়াতে পারবেন।
বেলা সাড়ে বারোটায় আমি ফেরত যেতে চাইলাম। ফ্রান্সোলিসি একধরণের বালিকা সুলভ জেদ ধরে আমার সাথে নিচে নেমে আসলো। আমি একটা উবার ডেকে এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। গাড়ির বামদিকের আয়নার প্রতিফলনে দেখলাম মেয়েটা অঝোড়ে কাঁদছে। আমি তাকে ক্ষুদে বার্তায় মেসেজ পাঠালাম, “Hey! Hope to see you again in some unknown land.”
উত্তরে সে বললো, “Please, come to Rio.”
বেলা তিনটার প্লেনে আমি কেপ টাউন থেকে জোবার্গে এসে নামলাম। সেখান থেকে গাউট্রেনে চড়ে প্রেটোরিয়ায় ফেরৎ গেলাম। আমার সাউথ আফ্রিকা ট্রিপ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন ব্যাগ গোছানোর পালা। অক্সফোর্ড থেকে যেই ল্যাবটা প্যাক করে এনেছিলাম সেটাকে পরবর্তী তিন দিন ধরে আবার প্যাক করে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। শেষ রাতে ড্যান-ব্যারি-ক্যারেনকে সাথে নিয়ে ক্যাপিটাল দোকানটায় বার্গার আর বিয়ার খেতে গেলাম। আমাদের সেরাতের আড্ডা যেন ফুরাবার নয়।
১৫ আগস্ট ভোর ছয়টায় ড্যান আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে গেলো। চেক ইন শেষ করে এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি দোকানগুলোতে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ একটা টিশার্ট দেখে অসম্ভব ভালো লেগে গেলো। কিন্তু, প্রায় ১৫ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই টিশার্টটা কেনা ঠিক হবে না। কারণ, এটা পড়ে থাকলে প্রতিদিন আমার মন খারাপ হবে।
সে টিশার্টে লেখা ছিলো—
You can leave Africa. But Africa will never leave you.