পূর্বকথা: উড়ছে হাইজেনবার্গ
May 27, 2020 | 6768
বিশ্বভ্রমণ অনেকটা নেশার মতো। সেই অর্থে আমি একজন নেশাখোর। পিএইচডি গবেষণার সুবাদে আমাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে হয়েছে। প্রতিটি যাত্রার সময়ই আমি কিছুটা অতিরিক্ত সময় আর টাকা খরচ করে মূল গন্তব্যস্থলের পার্শ্ববর্তী শহরগুলোও ঘুরে এসেছি। গত গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেটোরিয়া শহরে গিয়েছিলাম কিছু এক্সপেরিমেন্টের জন্য। শত ব্যস্ততার মাঝেও মাত্র ২ ঘন্টার বিমান দূরত্বে অবস্থিত কেপ টাউন শহরটি ঘুরে আসার লোভ আমি কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। তাই, বলা যেতেই পারে, মানুষ হিসেবে আমি কিছুটা লোভী প্রকৃতির।
আমার ভ্রমণের শুরু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। শুরুতে ভারত, নেপাল, ভূটান আর থাইল্যান্ড ঘুরে প্রাথমিক ব্যাপারগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এরপর ইউরোপে এসে ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, স্পেন ঘুরে দেখেছি। তবে নি:সন্দেহে জীবনের সেরা যাত্রা ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে। ঢাকার ইট-কাঠের রাজ্যে বড় হওয়া নিদারুন ভীরু প্রকৃতির এই আমি দলেবলে রাতের অন্ধকারে ঘন সাভানায় আর্দভাক নামক জন্তু ধরার ফাঁদ পেতেছি। সেই গল্প বলতে গেলে এখনো নিজের শিরা-উপশিরায় রোমাঞ্চ ছড়িয়ে যায়।
পর্যটক থেকে লেখক হয়ে ওঠার পেছনে আমার মূলত তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে:
প্রথমটি খুবই স্বার্থপর একটি উদ্দেশ্য। আমি অসম্ভব মাত্রায় বাজে স্মৃতিশক্তির অধিকারী একজন মানুষ। গতকালের ঘটনাও আমার আজকে মনে থাকে না; আমাকে তাই সবকিছুই লিখে রাখতে হয়। বিশ্বের কোণায় কোণায় কাটিয়ে আসা রোমহর্ষক সব মুহুর্তগুলো আমি বছরান্তেই ভুলে যেতে পারি। তাই, এই বইতে সেই গল্পগুলো লেখার মাধ্যমে আমি আসলে নিজের জন্যই একটি স্থায়ী স্মৃতি নিশ্চিত করেছি। বুড়ো বয়সে এই বই খুলে হয়তো আমি ভেনিসের বান্ধবী কিংবা বেলফাস্টের বন্ধুর কথা চিন্তা করে স্মৃতিকারত হবো। লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, গল্পগুলোতে তাই বেশ কিছু অবাঞ্চিত ঘটনাক্রম বর্ণিত হয়েছে যা হয়তো পাঠকের বিরক্তির উদ্রেগ ঘটাবে। সেগুলো আসলে আমার বুড়ো বয়সের জন্য স্মৃতির পদচিহ্ন।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি হলো ঈর্ষা সৃষ্টি। আমি খুব বেশী বাংলাদেশীকে বিশ্ব ভ্রমণে যেতে দেখিনি। কারণটাও খুব স্পষ্ট। আমাদের দেশের মানুষ চাকুরি করে টাকা জমিয়ে বাড়ি-গাড়ি-বাচ্চা সৃষ্টি করতে চায়। বিশ্বভ্রমণ আমাদের দেশে বড়লোকের বিলাসিতা। যার ফলশ্রুতিতে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের প্রতি আমরা খুবই অসহনশীল। মাছ-ভাত-ডালের বাহিরে যে অন্য খাবার পৃথিবীতে থাকতে পারে তা আমরা মানতে নারাজ। আমাদের কবিরাই লিখেছেন— “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…”
আমার মতে, ডাল-ভাত-আলুভর্তা অবশ্যই স্বর্গীয় খাবার; বাংলাদেশ অবশ্যই সুন্দর। তাই বলে এর সবকিছু বিশ্বসেরা দাবী করাটা একটু অপরিণত শিশুর আবদার বলে মনে হয়। এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব অভিমত: একবারের জন্য হলেও আমাদের উচিত জাপানিজ রামেন, হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ কিংবা ইবেরিয়ান খামোন চেখে দেখা; অপরিচিত একজন ভিনদেশী ভ্রমণকারীর সাথে একটা রাত হোস্টেলে কাটানো। বিশ্ব ভ্রমণ করলে ভিন্ন মতের মানুষের সংস্কৃতি, খাদ্যাভাসের সাথে পরিচিত হওয়া যায় যা আমাদেরকে একটু বেশী সহনশীল মানুষে পরিণত করে। তাই, এই বইতে প্রতিটি জায়গার খাবার আর প্রকৃতির কথা আমি বিস্তারিতভাবে বর্ণণা করার চেষ্টা করেছি। এগুলো পড়ে আপনি একটু হলেও যাতে ঈর্ষান্বিত হন। ভ্রমণ করতে অর্থ দরকার তা সত্যি। তবে তার থেকেও বেশী দরকার ইচ্ছাশক্তি। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এই মুহুর্তে সঞ্চয়ের পরিমাণ মাত্র সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশী টাকা। কিন্তু, আমার স্মৃতির অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্সটা এই বই পড়ে আপনি হয়তো আন্দাজ করতে পারবেন। যদি এই বইয়ের শেষ পাতায় যেয়ে আপনার মনে হালকা একটু হলেও হিংসের সৃষ্টি হয়, তবে লেখক হিসেবে আমি নিজেকে স্বার্থক বলে মনে করবো।
তৃতীয় উদ্দেশ্যটি হলো সাহিত্যচর্চা। ছোটবেলায় আমি অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা “পারী” গল্পটি পড়ে প্যারিস যাবার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলাম। কিন্তু, আমাদের বাংলা সাহিত্যে খুব বেশী ভ্রমণ কাহিনীর বই এখন আর পাওয়া যায় না। যে গুটি কয়েক বই আমি পড়েছি তাও ইন্টারনেট যুগের পূর্বে লেখা হয়েছে। ভ্রমণ আজকের পৃথিবীর ইন্টারনেট বিপ্লবের অংশ। এখনকার যুগের ভ্রমণ কাহিনীতে এয়ারবিএনবি, বুকিং.কম, লোনলি প্ল্যানেট কিংবা ট্রিপ অ্যাডভাইজারের কথা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এককালে কোথাও ঘুরতে গেলে একটা ম্যাপ কিনে মানুষ কম্পাস ধরে ধরে রাস্তায় হাঁটতো। কিন্তু, বর্তমান শতাব্দী হলো গুগল ম্যাপ আর অনলাইন রিভিউের যুগ। এখন ভ্রমণের প্রতিটি ধাপই চলে এসেছে ডিজিটাল মাধ্যমে। তাই ভ্রমণকাহিনীর গল্পেও এই ডিজিটাল ছোঁয়া থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। তাই, “উড়ছে হাইজেনবার্গ” হলো একবিংশ শতাব্দীর এক মিলেনিয়াল যুবকের ডিজিটাল যাত্রার উপাখ্যান।
এই বই প্রকাশের পেছনে কিছু মানুষের অবদান অসামান্য। আমার বস সাজিয়া ছুটি না দিলে এই ট্রিপগুলোর কোনটিতেই আমার যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠতো না। আমার মা’মনি তার ছেলের ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত কোন বিষয়েই এখন আর মাথা ঘামান না যা আমার পর্যটক জীবনকে খুবই সহজ করে দিয়েছে। সাদমান সাদিক আর মালিহা উলফাত এই বইটির প্রাথমিক পান্ডুলিপি পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করেছে যা বইটির জন্য ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মারযুক রিফাত তার অ্যাপেল পেন্সিলের আঁচড়ে ‘মাত্র’ তিনমাস ব্যয় করে এই বইটির কভার ডিজাইন করে দিয়েছে যা অন্তত আমার কাছে বেশ সুন্দর বলে মনে হয়েছে। বইটির দাম পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার সাধ্যের মাঝে রাখতে আমার প্রকাশক তাসনূভা আপু পান্ডুলিপি থেকে বেশ কয়েকটি গল্প বাদ দিতে বাধ্য করেছেন তার জন্য আমি নির্লজ্জের মতো যাবতীয় দোষ তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। সেই গল্পগুলো পড়তে চাইলে আপনি আমার ব্লগসাইট www.shamirmontazid.com এ ঘুরে আসতে পারেন।
এই বইটির প্রতিটি অধ্যায় লেখা হয়েছে পরবর্তী কোন অধ্যায়ের লোকেশনে বসে। আমার ভ্রমণ জীবনের তাই একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নতুন কোন শহরের কফিশপে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা লিখে যাওয়ার রেওয়াজ। বিগত সাতদিন ধরে আমি অবস্থান করছি স্পেনের বার্সেলোনা শহরে। এই বইয়ের অনন্ত ২৫% লেখা হয়েছে এই শহরে বসে। বইটির শুরু হয়েছে নেপালের কাঠমন্ডুতে, শেষ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে। তাই বলে আমার উড়াউড়ি কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। হাইজেনবার্গ এখনো উড়ছে। সেই গল্পগুলো ভবিষ্যতের বইগুলোতে বর্ণণা করার আশাবাদ ব্যক্তি করছি।
Happy reading. Happy travelling.
Cafe de l’Opera
বার্সোলোনা, কাতালুনিয়া
৩০ ডিসেম্বর ২০১৯