পিজ্জা, রোমান্স, ভেনিস
May 27, 2020 | 7462
অক্সফোর্ডের ছাত্র হবার একটা সুবিধা হলো বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুরতে যাওয়ার আমন্ত্রণ আসে। ২০১৯ সালের গ্রীষ্মকালে ইতালির পাদোভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অক্সফোর্ডের ১০ জন ক্যান্সার গবেষককে এক সামার স্কুলের জন্য নির্বাচন করা হলো। কোন মতে আমিও সেই লিস্টে জায়গা পেয়ে গেলাম। এর মানে হলো, জুন মাসে এক সপ্তাহের জন্য ইতালির পাদোভা শহরে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া-শেখার সুযোগ হবে। ম্যাপ খুলে পাদোভা শহরটা খুঁজে বের করার পর পরই আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। পাদোভা ভেনিস থেকে মাত্র ৫০ মিনিট দূরত্বে! আমাকে আর তখন পায় কে? আমি সামার স্কুল শুরুর দুই দিন আগেই একটা ছোট ভেনিস ট্রিপ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
ছোটবেলায় ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ গল্পটা পড়ে এই শহরটার প্রতি এক অসাধারণ আগ্রহ জন্মেছিলো। অবশেষে ১৫ জুন সকাল নয়টায় সেই আগ্রহের বশবর্তী হয়ে লন্ডন থেকে সকাল দশটার প্লেনে উঠে আড়াই ঘন্টা পর ভেনিস মার্কো পোলো এয়ারপোর্টে এসে নামলাম। প্লেনটা যখন ভেনিসে ল্যান্ড করছিলো আমি তখন ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলছিলাম। কারণ, চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো, প্লেনটা এখনই পানিতে ডুবতে যাচ্ছে। পাইলটরা এই পানির রাজত্বে কীভাবে রানওয়ে দেখতে পায় সেটা চিন্তা করে বেশ অবাক হলাম।
বিশ্বের অন্যান্য শহরে এয়ারপোর্টে নেমে আমি সিটি সেন্টারে যাবার জন্য বাস খুঁজি। কিন্তু, ভেনিস সেদিক থেকে একটু ভিন্ন। এই প্রথম আমাকে সিটি সেন্টারে যাবার জন্য নৌকা খুঁজতে হলো। রিটার্ন টিকেটের দাম দুই হাজার টাকা! প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমি আজ পর্যন্ত যত শহরে গিয়েছি তাদের মধ্যে ভেনিস অন্যতম ব্যয়বহুল জায়গা।
মার্কো পোলোর ঘাট থেকে বিকেল তিনটায় ইঞ্জিন চালিত নৌকা ছাড়লো। চারদিকে যতদূর চোখ যাবে শুধু পানি আর পানি। মাঝে মাঝে কয়েকটা কাঠের গুড়ি পানি থেকে বের হয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছিলো, এই গুড়িগুলোই নৌকার জন্য ল্যান্ডমার্ক হিসেবে কাজ করে। অনেক দূরে ভেনিস শহরের স্কাইলাইন দেখা যাচ্ছে। লালচে বর্ণের এই ঐতিহাসিক শহরটাকে দূর থেকে একবার দেখলেই আপনার মন ভরে যাবে। মাথার উপর গ্রীষ্মের লাল সূর্যটা বেশ বড় একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। চারপাশের বাতাসে আদ্রর্তা অত্যধিক বেশী; ফলশ্রুতিতে আধা ঘন্টার মধ্যেই আমি ঘামতে শুরু করলাম। বাতাসে সমুদ্রের পানির নোনতা গন্ধটা প্রকটভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে। বোটের জানালা দিয়ে আমি মাথাটা বের করে সেই গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করছি। আমার বিপরীত পাশে বসে থাকা এক ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ ধরে আমার কান্ড-কারখানা দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। প্রায় ৫০ মিনিট পর আমি ভেনিসের ‘যাতরে’ ঘাটে এসে নেমে গেলাম।
চারপাশে শুধু পানি আর পানি; সেই পানির বুক চিরে গড়ে উঠেছে এক চিলতে শহর। সেই শহরে কোন ট্যাক্সি-উবার নেই; আছে ওয়াটার ট্যাক্সি। সারাদিনের ডে-টিকেটের দাম প্রায় দুই হাজার টাকা। মাত্র ১ মিনিট দূরত্বের একটা খ্যাপের জন্য গুণতে হবে প্রায় সাতশ টাকা। ভেনিসের যাতায়াতের খরচ তাই প্রথমেই আমাকে একটু হতাশ করলো। বোঝা গেল, অনেক বিখ্যাত শহরে ঘুরতে আসলে পকেটটা একটু শক্তিশালী করে নেয়া উচিত।
ভেনিসে আমার বাস জেনারেটর হোস্টেলে। যাতরে ঘাট থেকে নৌকায় উঠে অন্যদিকে রোদেনতোরে ঘাটে যেয়ে নামলাম; সেখান থেকে ১০ মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম হোস্টেলের দরজায়। মজার ব্যাপার হলো, ভেনিস শহর তার ঐতিহ্যকে কোনভাবেই পরিবর্তন করতে দেয় না। তাই হোটেল যতই আধুনিক হোক না কেন, বাহির থেকে সেটা দেখতে ভেনিসের আর দশটা বাহির মতই ম্যাড়ম্যাড়ে; তার দেয়ালের চুন-সুড়কি উঠে গেছে। আমি প্রায় দশ মিনিট হোস্টেলের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার পর বুঝতে পেরেছিলাম এটাই আমার বাসস্থান।
হোস্টেলে চেক ইন করে ব্যাগটা সেইফটি বক্সে তালা দিয়ে রেখে বের হয়ে আসলাম গুদেসা এলাকার ঘাঁটে। ভেনিসের প্রায় সব বাড়িই ঘাঁটের পাড়ে অবস্থিত। কারণটা অবশ্যই সোজা সাপটা— মার্চেন্ট অফ ভেনিসরা তাদের নৌকাভর্তি মালামাল নিয়ে যাতে দোকান-পাটে সহজেই চালান দিতে পারে। পুরো শহরটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে করে আপনি নৌকা দিয়েই শহরের যেকোন অলি গলিতে চলে যেতে পারেন। যেহেতু ভেনিসে কোন চাকা চালিত যানবাহন নেই; নৌকাই আপনার একমাত্র ভরসা।
আমার হোস্টেল থেকে বের হয়ে ঘাঁটে দাঁড়ালেই অপর পাশের পাড়ের যে দৃশ্যটা চোখে পড়ে তা সম্ভবত ভেনিসের সবচেয়ে আইকনিক দৃশ্য। বিখ্যাত সঁ মার্কো চার্চের গম্বুজ এবং তার ঠিক সামনে অবস্থিত ব্রীজ অফ সাইস। এই দুই বিখ্যাত নিদর্শন একসাথে দেখে আমি আর তর সইতে পারলাম না। সোজা নৌকা নিয়ে ছুটে গেলাম ওপারের ঘাটে। যাতরে ঘাট থেকে মাত্র ১ মিনিট হাঁটলেই দেখা যাবে পাড়ের পাশে অনেক মানুষ ভীড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেল পাঁচটার হালকা হয়ে আসা রোদে সাদা পাথরের এক ‘নির্দয়’ ইমারতের সামনে পর্যটকরা ছবি তোলার জন্য মড়িয়া হয়ে উঠেছে। এই সেই “Bridge of Sighs”.
লর্ড বাইরন সাহেবের কৃতিত্বে আজকের দুনিয়ার কাছে Bridge of Sighs বেশ সুপরিচিত। বাংলায় এর নাম দিলাম “দীর্ঘশ্বাসের ব্রীজ”। কোর্টে অপরাধীদের সাজা দেয়ার পর তাদেরকে এই ব্রীজের মধ্য দিয়ে কারাভোগের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। ব্রীজটির ফাঁক দিয়ে তারা শেষ বারের মতো ভেনিস শহরের নৈসর্গ দেখে নিতো; আর বুক থেকে ছেড়ে দিতো এক দীর্ঘশ্বাস। সেই থেকে এই ব্রীজের নাম “দীর্ঘশ্বাসের ব্রীজ”।
আমার অবশ্য সেই ব্রীজের সামনে বেশ মজার অভিজ্ঞতা হলো। আমেরিকা হতে আগতো তিন লাস্যময়ী তরুণী সেই ব্রীজের সামনে ছবি তোলার জন্য লোক খুঁজছিলো। তাদের মধ্যে একজন এসে আমাকে অনুরোধ করলো। আমি ছবি তুলে দিলাম। সাদা পোশাক পরিহিতা মিশেল নামের মেয়েটা আমার সাথেও একটা ছবি তুলতে চাইলো। আমি হালকা হেসে বললাম, “Yes, I am also a ‘thing-to-do’ in venice.”
বান্ধবী-বন্দনার পাট চুকিয়ে হাতের ডান দিকে মোড় নিতেই চোয়ালটা খুলে মাটিতে পড়ে গেলো। এ কি অবস্থা! সম্ভবত আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় চার্চ। একে চার্চ না বলে রাজ প্রাসাদ বললেও ভুল হবে না। পিয়াজ্জা সঁ মার্কো— দ্য সেন্ট মার্ক স্কয়ার; বাংলায়— পুরোহিত মার্কের উঠান।
নেপোলিয়নের ভাষায়, “সঁ মার্কো স্কয়ার হলো ইউরোপের ড্রয়িং রুম।” দ্বিগবিজয়ী এই সম্রাট জায়গাটা এতোটাই পছন্দ করতেন যে, ভেনিস জয়ের পর এই স্কয়ার থেকে চারটা ঘোড়ার মূর্তি নৌকায় তুলে তিনি প্যারিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্কয়ারের পূর্ব দিকের পুরোভাগ জুড়ে অবস্থিত সঁ মার্কো ব্যাসিলিকা; সহজ বাংলায় উপাসনালয়। সনদটির সামনের ভাগে সাতটা অর্ধবৃত্তাকার আর্চ। মাঝখানের বড় আর্চের নিচে প্রবেশ দরজা, দুইপাশে তিনটে করে ছোট আর্চ দুই সীমানা অবধি ছড়িয়ে আছে। প্রতিটা আর্চের নীচে পরম যত্নে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মধ্যযুগের স্থাপত্য শৈলীর কারুকাজ। ব্যাসিলিকার উপরে আছে বেশ কিছু গম্বুজ; যেগুলো দূর থেকে দেখলে অনেকটা মসজিদের মতো লাগে। হোস্টেল থেকে আমি এই গম্বুজগুলোই দেখতে পাচ্ছিলাম। ব্যাসিলিকার সামনের আয়তাকার উঠানে বসে থাকে শত শত কবুতর। ট্যুরিস্টরা তাদের হাতে কিছু শস্য দানা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কবুতরগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে এসে তাদের হাতের উপর বসে। দুই দিকে কবুতর-বসা হাত ছড়িয়ে বিখ্যাত সঁ মার্কো ব্যাসিলিকাকে পেছনে রেখে ভেনিসের পর্যটকেরা সবচেয়ে আইকনিক ছবিটা তুলে ফেলে। কবুতরকে বলা হয় আকাশের ইঁদুর; কারণ এরা শত রোগের বাহক। তাই, আমি এই কাজ করা থেকে বিরত থাকলাম।
প্রায় ঘন্টা খানেক মুগ্ধ হয়ে আমি পুরোহিত মার্কের উঠানের সৌন্দর্য দেখতে থাকলাম। চারপাশে অনেকগুলো রেঁস্তোরা; প্রতিটার সামনেই খোলা উঠানে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। ভেনিসের রেঁস্তোরায় বাহিরে বসতে চাইলে অতিরিক্ত ২ ইউরো বিল গুনতে হয়। পর্যটকদের যত ভাবে খসানো সম্ভব ততভাবেই তারা চেষ্টা করে থাকে। সন্ধ্যা সাতটার ঝকঝকে আলোয় ডিনারের টেবিলে বসে থাকা প্রেমময়ী যুগলেরা ইতালিয়ান লাইভ মিউজিক উপভোগ করতে করতে স্প্রিটজ নামক মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো। এধরণের রেঁস্তোরায় দুজনে খেতে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বিল গুনতে হয়।
আমি মার্কের উঠান থেকে দৈবচয়নে একটা গলিতে ঢুকে হাঁটা শুরু করলাম। ভেনিস হলো অ্যালিওয়ের (চিপা গলি) শহর। প্রতিটা গলি থেকে ডানে বামে চলে গেছে আরো অনেকগুলো গলি। একটার পর একটা গলি পার হয়ে শহরের ভেতরের দিকে ঢুকতে থাকলে রাস্তাগুলো একটু একটু করে অন্ধকার হতে থাকে। একসময় গলিগুলো এতোটাই নীরব হয়ে যায় যে আপনার নিজের জুতোর শব্দই গলির দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরত আসে। প্রতিটা গলির দুই পাশ জুড়ে তিন থেকে চারতলা লম্বা বিল্ডিং। তাদের ইটগুলোর লাল রং সময়ের চুম্বনে ফিকে হয়ে গেছে। দেয়ালের আস্তরণ জায়গায় জায়গার খসে পড়েছে। গলির দুইপাশের বিল্ডিংগুলো উপরের দিকে এতোটাই কাছে চলে এসেছে যে, এক বাসার ব্যালকনি থেকে অন্য বাসায় প্রেমপত্র ছুড়ে মারা যাবে। নিশ্চয়ই ভেনির সাহিত্যে এই ব্যালকনি-প্রেমের ছড়াছড়ি দেখা যাবে।
গলির এই ল্যাবেরিন্থ (প্যাঁচানো পাজেল) অবশেষে গিয়ে শেষ হয় কোন এক পানির পাড়ে। সেই পানির অন্যপাশে চলে যাওয়ার জন্য থাকবে ছোট ছোট কিছু ব্রীজ। পড়ন্ত বিকেলে বান্ধবী বগলদাবা করে ইউরোপের পুরুষেরা সেই ব্রীজের উপর ছবি তুলে তাদের প্রেমকে সেলুলয়েডের আস্তরণে ধরে রাখে। এই পর্যায়ে আপনার মনে হতে পারে, সঙ্গী ব্যতীত ভেনিস ভ্রমণ হয়তো বেশ দু:খজনক হবে। পাঠক, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ভেনিসে সঙ্গী জুটানো সেকেন্ডের ব্যাপার।
প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর আমি অবশেষে উপস্থিত হলাম ভেনিসের দ্বিতীয় আকর্ষণ “রিয়ালতো ব্রীজ”-এ। জায়গাটায় ঢাকার নিউমার্কেট-গাউসিয়ার মতো হাজার খানেক মানুষের ভীড়। এমনকি গোটা দশেক বাংলাদেশীকে এই এলাকায় গোলাপ ফুল, বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করতে দেখা যায়। এসব কিছুর মাঝে ঘর্মাক্ত এই পরিবেশে আমি খানিকটা ঘরকাতুরে হয়ে গেলাম।
রিয়ালতো ব্রীজটার দুইপাশে ভেনিসের অর্থনৈতিক হাব; নীচে বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানাল। সেই পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে ‘গান্ডোলা’ নামক আলিশান কিছু নৌকা। পর্যটকেরা অনেক টাকা খরচ করে এই গান্ডোলায় চড়ে ভেনিসের রূপসূধা পান করে। আমি গরীব হওয়ায় ব্রীজের উপর থেকে সেই দৃশ্য দেখেই মন ভরলাম। রিয়ালতো ব্রীজে ত্রিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার মানসিক শান্তি বিনষ্ট হয়ে যাবে। এতো মানুষের ভীড়ে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করাটা বেশ দায়।
অবশেষে আমি ব্রীজ থেকে খানিকটা দূরে খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। রাত্র নয়টায় সূর্যের আলো দূর্বল হয়ে এসেছে। গ্র্যান্ড ক্যানেলের সবুজ স্রোতের দুই পাশে ঠিক পানির উপর দাঁড়িয়ে আছে ভেনিসের সবচেয়ে পরিচিত বিল্ডিংগুলো। তাদের প্রতি তলা থেকে বাহিরের দিকে ঝুলে পড়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট সাদা ব্যালকনি। অনেক দূরে কোন এক চার্চের টাওয়ার দেখা যাচ্ছে; মাথার উপরে রয়েছে পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভা। এই দৃশ্য একবার শান্ত মনে উপভোগ করতে পারলে আপনার ভেনিস ভ্রমণ স্বার্থক হবে।
যথারীতি আমার পাকস্থলি মনে করিয়ে দিলো, কিছুটা পেটপূজোর সময় হয়েছে। এই অলিগলির প্রতি বাঁকে হাজারটা খাবারের দোকান। কোনটা ভালো তা বোঝার জন্য গুগলের দ্বারস্থ হলাম। পাঁচশ’র অধিক রিভিউয়ের পর কোন রেঁস্তোরার পাশে চার তারকা দেখতে পেলেই আমি চোখ বুঝে তাতে ঢুকতে রাজি হয়ে যাই। সব ভূল হতে পারে, ডেটা সাধারণত ভূল হয় না। এই মন্ত্রে গুগল বাবা আমাকে আন্তিকো পানিফিসিও পিজ্জেরিয়াতে নিয়ে গেলেন। অলি গলি পার হয়ে এক অন্ধকার রাস্তার কোণায় এই ইতালিয়ান পিজ্জাশপ। বাহিরের টেবিলে বসামাত্র এক বাংলাদেশী ওয়েটার মেন্যু দিয়ে গেলো। কেন যেন ভদ্রলোক আমাকে এড়িয়ে চলে যেতে চাইছিলো। আমি সী-ফুড পিজ্জা অর্ডার করলাম; সাথে সাথে সেই বাংলাদেশীকে কাছে ডেকে কিছুক্ষণ গল্পও করলাম। দোকানের মালিক এদের সাথে দাসপ্রথার আচরণ করে। ইতালিয়ান সেই লোকটা রিয়াদ ভাইকে ইতালিয়ান ভাষায় এসে কিছুক্ষণ গালিগালাজ করে গেলো। আমি খানিকটা মন খারাপ করে উঠে যেতে চাইছিলাম। পরে রিয়াদ ভাই এসে জোর করে আমাকে বসতে বাধ্য করলেন। সাথে দিয়ে গেলেন ঝাল একটা তাবাস্কো সস।
পনেরো মিনিটের মাথায় আমার জীবনে খাওয়া শ্রেষ্ঠ পিজ্জাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আসল ইতালিয়ান পিজ্জার কিছু বৈশিষ্ট্য হলো— কাঠের তৈরি ওভেনে একে তাপ দেয়া হবে; রুটির আস্তরণটা হবে খুবই পাতলা আর উপরের টপিং হবে খুবই সাধারণ। আমরা বাংলাদেশে যে মোটা রুটির উপর চার লেয়ারের চীজের আস্তরণ দেয়া পিজ্জা খাই তাকে ইতালিয়ানরা ‘আমেরিকান পিজ্জা’ বলে নাক সিটকায়। ইতালিয়ান পিজ্জার দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, প্রতিটা মানুষ একটা পিজ্জা আলাদা করে অর্ডার করবে। পিজ্জা এখানে ভাগাভাগি করে খাওয়ার বস্তু নয়। তেরো ইউরো দামের এই পিজ্জার পাতলা ডো’র উপর খানিকটা টমেটো, কিছু শামুক, কিছু ঝিনুক, কয়েকটা চিংড়ি আর স্কুইডের টুকরা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সবার উপরে আছে কিছু মোজোরেলা পনীর, ওরেগানো আর বাসিল পাতা।
ক্ষুধার্ত পেটে দানবের মতো একটার পর এক পিজ্জার টুকরো ঢুকিয়ে দিলাম। প্রতিটা পিসের উপর ছড়িয়ে দিলাম খানিকটা তাবাস্কো সস আর ইতালিয়ান জলপাইয়ের তেল। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত পিজ্জা খেতে গেলো কেমন যেন কষ্ট হয়। যতই খুঁজি না কেন, কাঠের ওভেনের সেই আসল ইতালিয়ান পিজ্জা খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। ইতালির সনাতনী পরিবারে পিজ্জার খামির (ডো’হ) বংশ পরম্পরায় এক জেনারেশন থেকে পরবর্তী জেনারেশনে হস্তান্তরিত হয়। কোন কোন খানদানী বংশে প্রায় একশ বছর পুরোনো মাদার ডো’হ পাওয়া যায়।
সারাদিনের হন্টন চক্রে শরীরটা ততক্ষণে বেশ ক্লান্ত হয়ে এসেছে। নিকটবর্তী ঘাঁট থেকে আমি প্রায় ত্রিশ মিনিট দূরত্বে অবস্থান করছি। তাই, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুসাফিরের বেশে কোন রকমে একটা ক্যানেলের পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরে রাতের ভেনিসের সৌন্দর্য দেখতে থাকলাম। টলটলে পানির উপর দোকানগুলোর হলুদ আলো পড়ে পাড়ের কাছটা আলোকিত করে রেখেছে। ক্যানেলের অপর পাশের পাড়েও একই অবস্থা। এক পাড়ে বসে অন্য পাড়ের মানুষের কাজকর্ম দেখতে বেশ মজা লাগছিলো। একটা কাপল অনেকক্ষণ ধরে নাকে নাক লাগিয়ে বসে আছে; পনেরো মিনিট পর ওয়েটার এক বোতল শাম্পেইন নিয়ে এসে দুটো গ্লাসে ঢেলে দিয়ে গেলো। মেয়েটা গ্লাসের শাম্পেইনে একটা চুমুক দিতেই লক্ষ্য করলো ভেতরে পড়ে আছে একটা হীরার আংটি। টেবিলের পাশে ছেলেটা তখন হাঁটু গেড়ে বসে আছে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে মন ভরে গেলো; যদিও মেয়েটা ‘ইয়েস’ বলেছিলো কিনা তা জানার ইচ্ছে করছিলো। তবে তাদের হাবভাব দেখে মনে হলো, ছেলের এই রোমন্টিক প্রস্তাব সফলতার মুখ দেখেছে।
ইউরোপিয় বাগদানের মিউট ভার্সন দেখা শেষ করে আমি ফিরে গেলাম যাতরে ঘাঁটে। জায়গাটা এখন অনেক শান্ত; ভীড় নেই ট্যুরিস্টের। শান্ত একটা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বোটে উঠে আমি ফিরে গেলাম আমার পাড়ে। রাতে ক্যানালের পাড়ের সরু রাস্তায় জ্বলজ্বল করে সোডিয়াম বাতি জ্বলছে। এতো সুন্দর আবহাওয়াতে হোস্টেলে ফেরত যেতে ইচ্ছে করছিলো না। সঁ মার্কোর ঠিক বিপরীতে এসে ঘাঁটের পাড়ে নিজের পায়ের জুতোকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়লাম। চারদিকে পানির কল কল শব্দ হচ্ছে; অপর পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকা। কানের হেডফোনে বাজছে বব ডিলান সাহবের গান।
If you see her, say hello
She might be in Tangier…
জীবনের সুখকর মুহুর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো ভেনিসের পাড়ে কাটানো সেই তিনটে ঘন্টা। অবশেষে রাত্র সাড়ে তিনটায় ঘুম ভাঙলো আমার। চোখ কচলে বুঝতে পারলাম, এখনো সেই ঘাঁটেই শুয়ে আছি। আবহাওয়া হাল্কা ঠান্ডা হতে শুরু হয়েছে। আমি হেলেদুলে হোস্টেলে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। পরদিন ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টায়।
হোস্টেলের লবিতে এসে এককাপ কফি আর একটা চকোলেট মাফিন নিয়ে ডাইনিং হলে ঢুকলাম। দূরে একটা টেবিলে একজন অসম্ভব সুন্দরী ল্যাতিন মেয়ে বসে আছে। আমি তার কাছে যেয়ে বললাম, “তোমার সাথে বসতে পারি?”
বান্ধবী হাল্কা হেসে বললো, “নিশ্চয়ই।”
শুরু হলো আমার আর এলিজাবেথের সুন্দর একটা বন্ধুত্ব। আমার মতো সেও কাজের বিরতিতে ভেনিসে এসেছে। একা হোস্টেলে থাকছে নতুন বন্ধু বানানোর জন্য। যথারীতি ভাগ্য দুইজনকে একই নাস্তার টেবিলে বসিয়ে দিলো। “লিজ” আমাকে তার সাথে ভেনিস ঘুরতে যাবার আমন্ত্রণ জানালো। আমি তাকে ফেসবুকে অ্যাড করে নিলাম; আশ্বাস দিলাম দুপুরে তাকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা রেঁস্তোরায় খেতে যাবো।
বেলা এগারোটায় আমি ফেরত গেলাম সেন্ট মার্ক স্কয়ারে। এবার খুব দ্রুত একের পর এক অলিতে গলিতে হেঁটে দেখতে থাকলাম। গ্যান্ড ক্যানেল ও গুদেসা ক্যানেলের সম্মিলনস্থলে তিনকোণা জায়গাটায় সান্তা মারিয়া দো সালু (সেন্ট ম্যারি অফ হেল্থ) চার্চ। ধূসর বর্ণের বিশাল এক গম্বুজের নীচে অবস্থিত আলিশান দরজা দিয়ে আমি রোমান ক্যাথলিক সাম্রাজ্যের আভিজাত্যে প্রবেশ করলাম। বিশাল উচুঁ ছাদের ঠিক মধ্যখানে একটা ঝাড়বাতি ঝুলছে; তার নীচের মেঝেতে বৃত্তাকার এক জ্যামিতিক ডিজাইন। সাদা, হলুদ, লাল আর কালো বর্ণের ত্রিভুজাকৃতির মোজাইক পাথরকে একের পর এক বসিয়ে এক ধরণের পৌণপুণিকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। উপাসনালয়ের ঠিক কেন্দ্রে মাতা মেরী এবং শিশু যিশুর মূর্তি। ডানপাশে একটা কনফেশন ঘর; সেখানে মানুষ তার সারা জীবনের পাপগুলো পাদ্রীদের কাছে যেয়ে স্বীকার করছে। আর চারপাশ জুড়ে জ্বলে আছে অনেকগুলো ছোট ছোট মোমবাতি। উপর থেকে দিনের আলো সাদা পাথরে বাড়ি খেয়ে নিচের মোমবাতির হলুদ আলোর সাথে গভীর প্রণয়ে উন্মত্ত হয়েছে।
ঠিক এই সময়ে মেসেঞ্জারে লিজের বার্তা ভেসে উঠলো, “তুমি কোথায়? এখনই উমুক জায়গায় আসো।”
কি আর করার? মেক্সিকান বান্ধবীর কথা ফেলতে পারলাম না। আবার নৌকায় উঠে চলে গেলাম বান্ধবীর পছন্দের বারে। দোকানের সামনের টেবিলে ছাতার নীচে শুভ্র রৌদ্রপোশাক পরিহিতা সুচিস্মিতা বান্ধবী বসে আছে। আমি তার উল্টো দিকের চেয়ারে বসে একটা আইস টী অর্ডার করলাম। ওয়েটার মেয়েটা আমার কানে কানে এসে বললো, “Be careful! Your date is very drunk.”
যা বুঝতে পারলাম তা হলো, মেক্সিকান সংস্কৃতিতে টেকিলা নামক সর্বনাশী অ্যালকোহল খুবই জনপ্রিয়। সুন্দর আবহাওয়ায় রোদের নীচে সাজানো লেবু, লবণ আর টেকিলার বোতল মেক্সিকান স্বর্গের সংজ্ঞা রচনা করে। লিজ ততক্ষণে মেক্সিকান স্বর্গের বাসিন্দা। আমি তাকে জোর করে অনেকক্ষণ পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম। সে টেকিলা ছাড়া কিছুই খাবে না। অবশেষে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে একটা ক্রিম ব্রুলে খেতে থাকলাম। আমারটা দেখে লিজেরও ডিম দেয়া এই খাবার খেতে ইচ্ছে করলো। যথারীতি যা হবার, তাই হলো। আধাঘন্টা ধরে লিজ বাথরুমে বমি করলো। তারপর আমি তাকে কাঁধে তুলে তার হোটেলে নিয়ে গেলাম। পথিমধ্যে সে বার বার বলছিলো, “I think my drink was adulterated.”
এলিযাবেথকে তার বিছানায় এলিয়ে দিয়ে আমি আবার ফেরত আসলাম ভেনিসের পাড়ে। ফিরে গেলাম রিয়ালতোর বাজারে। মাত্র পনেরো মিনিট হাঁটার পর হঠাৎ এক বাংলাদেশী মেয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। সেও ভেনিসে ঘুরতে এসেছে আমার মতো। কুসংস্কারে বলা হয়, “When one door closes, another one opens.” যাই হোক, আমি আর ‘আনিকা তাহসিন’ (ছদ্মনাম) মিলে তখন ভেনিসের ভালো খাবার খোঁজা শুরু করলাম। আনিকা ছোটবেলায় রোমে বড় হয়েছে; সে বেশ ভালো ইতালিয়ানও বলতে পারে। দুজনে মিলে চলে গেলাম এক ইতালিয়ান দোকানে। অর্ডার করা হলো স্ফ্যাগেটি পাস্তা আর ফ্রিত দি মারে (ভাজা মাছ)। ইতালিয়ান পাস্তা হয় খুবই সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস। পাস্তাকে তারা খানিকটা শক্ত থাকতেই ফোটানো বন্ধ করে দেয়া যাতে খেতে গেলে তা দাঁতে লাগে। এই লেভেলের পাস্তাকে বলা হয় “আলদন্তে” বা দাঁতে-লাগা পাস্তা। সেই সুন্দর সরু সরু সিদ্ধ স্ফ্যাগেটিকে কিছু হার্ব আর জলপাইয়ের তেল দিয়ে হালকা আঁচে নেড়ে সামুদ্রিক প্রাণীর সাথে সার্ভ করা হয়।
ইতালিয়ান সংস্কৃতিতে একটা কথা রয়েছে— “ভেজে দিলে শুকনো জুতাও খেতে ভালো লাগে।” এই বাক্য থেকেই বোঝা যায় ফ্রিত দি মারে তাদের কতখানি পছন্দের বস্তু। আমার পছন্দের স্কুইড, শামুক, চিংড়িকে ব্যাটারের আবরণে ভেজে একটা প্লেটে সার্ভ করা হলো। আনিকা আর আমি গল্পে গল্পে ইতালিয়ান খাবারের জগতে হারিয়ে গেলাম। সূর্যাস্তের সময় আনিকাকে নিয়ে গেলাম রিয়ালতোর পাশের সেই সুন্দর নিরিবিলি জায়গায়। একটা একান্নবর্তী ইতালিয়ান পরিবার সেখানে বিশাল বড় এক টেবিলে ডিনার করছে। দুটো ছোট বাচ্চা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের পাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আনিক আর আমি ক্যানেলের পাড়ে পা ঝুলিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আমাদের জীবনের গল্পগুলো বলতে থাকলাম।
রাত্র দশটার পর চারদিক অন্ধকার হয়ে আসলো। আনিকার ফেরার সময় হয়েছে; আমি তাকে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলাম। ততক্ষণে আমার পা খুলে পড়ার অবস্থা হয়েছে। বান্ধবীকে বিদায় জানিয়ে নৌকায় উঠতেই দেখলাম এলিজাবেথের ম্যাসেজ— “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবার জন্য। আমি এখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। তোমার সাথে ভবিষ্যতে অবশ্যই কোথাও ডেটে যাবো। আর আমি টেকিলা অর্ডার করবো না।”
আমি হেসে লিখলাম, “হাভ আ সেইফ ফ্লাইট।”
রাত্র প্রায় দুইটা নাগাদ হোস্টেলে ফেরত আসলাম। কোনমতে হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন দুপুর দুটোয় আমাকে পাদোভা-তে থাকতে হবে। সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে চেক আউট করলাম। মজার ব্যাপার হলো, গত দুই দিন আমার ব্যাগ লকারে ছিলো; একবারও এটা খুলে দেখা হয় নি। হোস্টেল থেকে বের হয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিতেই কেমন যেনো হাল্কা হাল্কা অনুভব হতে লাগলো। ব্যাগটা খুলে বুঝলাম, আমার অনেক সাধের ম্যাকবুকটা বন্ধ লকার থেকেই চুরি হয়েছে!
আমি হোস্টেলে গিয়ে নালিশ করলাম। সমস্যা হলো, পৃথিবীর কোন দেশেই চুরি হওয়া জিনিস ফেরত পাওয়া যায় না। আমার একমাত্র ভরসা হলো ট্রাভেল ইন্সুরেন্স। আমি সাথে সাথে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে জিডি করলাম। সেটার কপি ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে পাঠিয়ে দিলাম। তারা আমাকে মাত্র ১০ হাজার টাকা ফেরত দিলো (কারণ, আমি সস্তা ইন্সুরেন্স কিনেছিলাম। এরপর থেকে ইন্সুরেন্স ক্রয়ের সময় আমি অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ল্যাপটপের জন্য আলাদা করে প্যাকেজ নিয়ে নেই। এই প্যাকেজের দাম প্রায় ৫ হাজার টাকা।) কিন্তু, এখন নতুন একটা ল্যাপটপ কিনতে দরকার এক লাখ বিশ হাজার টাকা। অগত্যা উপায় না দেখে আমি আমার কলেজকে ইমেইল লিখে পাঠালাম। ব্যালিয়ল কলেজ আমাকে শূণ্য-মুনাফার চুক্তিতে ধারে একটা ম্যাকবুক কিনে আমার বাসায় পাঠিয়ে দিলো। যেহেতু আমার সব ডেটা বাসায় আলাদা হার্ড ড্রাইভে ব্যাকআপ করা ছিলো, সেহেতু আমি কোন তথ্যই হারাই নি। শুধুমাত্র মাসে মাসে কলেজকে পাঁচ হাজার টাকার ধার ফেরত দিতে হয়। সেটা তিন মাস দেবার পর কলেজ বিশেষ বিবেচনায় আমার কর্জ মাফ করে দিলো। সুতরাং, ভেনিস নিয়ে আমার মনে আর কোন ক্ষোভ কাজ করে না। ভেনিসের কথা মনে পড়তেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিয়াজ্জা সঁ মার্কো, থিন ক্রাস্ট পিজ্জা, ফ্রিত দি মারে আর আনিকার হাসি।
এই ল্যাপটপ হারানোর ঘটনা থেকে জীবনে একটা বড় শিক্ষা পেয়েছিলাম। তা হলো, একটা বাজে অভিজ্ঞতার কারণে পুরো যাত্রাটাকে নষ্ট করে ফেলা যাবে না। জীবনে দূর্ঘটনা ঘটবেই। সবকিছু সামাল দিয়ে আবার হাসতে শেখার নামই জীবন। ল্যাপটপ হারানোর পর যখন পুলিশ স্টেশনে বসে ছিলাম তখন প্রায় এক ঘন্টা পর্যন্ত মন অসম্ভব খারাপ ছিলো। কিন্তু, কীভাবে যেন আমি এক ইতালিয়ান পুলিশের সাথে স্টেম সেল নিয়ে গল্প শুরু করে সব কিছু ভুলে গেলাম।
বেলা একটার ট্রেনে আমি চলে গেলাম গ্যালেলিওর বিশ্ববিদ্যালয় পাদোভায়। সেখানে ইতালিয়ানরা তাদের সকল আতিথেয়তা প্রদর্শন করে বিখ্যাত “বো প্যালেস”-এ আমাদের বরণ করে নিলো। অসাধারণ কাটলো সেই সপ্তাহটা। ক্যান্সার, স্টেম সেলের গবেষণার সাথে ইতালিয়ান খাবারের সম্মিলনটা হৃদয় জয় করে নিলো। নোংরা হোস্টেলের বদলে রাত কাটালাম পাঁচ তারকা হোটেলে। অবশেষে শুক্রবার রাতে অক্সফোর্ডে ফিরে এসে দেখলাম বাসার দরজার সামনে পড়ে আছে একটা সাদা বাক্স ।
নতুন ম্যাকবুক; নতুন এক যাত্রা।
Things always go wrong in life. That does not mean you have to stop living.
——————————————————————————————
পাদটীকা: এই গল্পটি আমি লিখেছি বার্সেলোনা শহরের গার্সিয়া এলাকার সাবিও ইনফান্তে কাফেতে বসে। সুন্দর একটা ঘরোয়া পরিবেশে তারা আমাকে একটা ক্রিসমাস ট্রির পাশের টেবিলে গত ছয় ঘন্টা বসে থাকতে দিয়েছে। ল্যাপটপের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের ক্রিসমাস লাইটের কানেকশন খুলে আমাকে চার্জ দিতে দিয়েছে। এই কফি শপগুলো না থাকলে আমার এই বই হয়তো কখনো ছাপা হতো না।