নেপাল ভ্রমণের ইতিবৃত্ত-রাফটিং
Oct 8, 2017 | 8627
২০ জুন ২০১৭। নেপালে
আমাদের দ্বিতীয় দিন। সকাল ৫:৩০ টায় জিহান
আমাকে ঘুম থেকে ডেকে
তুললো। পর্দার ফাকঁ দিয়ে বাহিরে
চোখ পড়তেই মনটা ভরে গেলো।
আজ আমাদের গন্তব্যস্থল নেপালের tourist সিটি “পোখারা”। মজার ব্যাপার হলো যাত্রাপথের একটা
বড় অংশ আমরা যাবো
“রিভার র্যাফটিং” করতে করতে।
আমি
আর জিহান মিলে বাকি সবাইকে
ডেকে তুললাম। সাড়ে ছয়টা নাগাদ গাট্টি-বস্তা সমেত আমরা সবাই
হোটেলের রিসিপশনে এসে বসলাম। সেখানে
আমাদের সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ হলো “কেন্দ্রা”র
সাথে।
কেন্দ্রা
আমাদের ড্রাইভার কাম tour guide। বেশ হালকা
পাতলা গড়নের একটা লোক। খুব
বেশী কথা বলা তার
বৈশিষ্ট্য নয়। পাঠক,
এই পর্যায়ে কেন্দ্রার নাম মনে রাখার
জন্য বিশেষ ভাবে
অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ, আমাদের নেপাল tour-এর
অন্যতম বিশেষ এক
চরিত্র এই কেন্দ্রা!
আমরা
সবাই কেন্দ্রার বিশাল tourist বাসে করে যাত্রা
শুরু করলাম পোখারার উদ্দেশ্যে। আমার ব্যাগের মধ্যে ছিলো
Xiaomi এর একটি Bluetooth
স্পীকার। সেইটা পালাবদলে বিভিন্ন জনের মোবাইলে কানেক্ট
করে গান শুনতে শুনতে
অসাধারণ এক যাত্রা উপভোগ
করছিলাম। আমাদের মধ্যে জিহান
হলো গানের পোকা। এরিক ক্ল্যাপটনের
“Layla” গানটা বেজে উঠতেই সে
আমাদেরকে এই বিখ্যাত
গায়কের জীবনের করুন প্রেম কাহিনী
বর্ণনা করতে শুরু করলো।
প্রায়
দশ-টা নাগাদ আমরা
একটা রেস্টুরেন্টে যেয়ে যাত্রা বিরতি করলাম। সকালের নাস্তার পালা এসেছে। নেপালে
নাস্তা করতে গেলেই আপনাকে
প্রায় ৪০০-৫০০ রুপি
গুনতে হবে। tourist স্পট হওয়াতে সবকিছুরই
দাম বেশি। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে আমরা আবার
কেন্দ্রার বাহনে উঠে ছুট লাগালাম
“বাগমাতি”র উদ্দেশ্যে।
প্রায় বারোটা নাগাদ আমরা ত্রিশুলি নদীর
বাগমাতি ঘাটে এসে নামলাম।
ত্রিশুলি
নদীতে আমাদের বোট
রিভার
রাফটিং একটি টিম স্পোর্টস (cost: 35$ per
person)। একটা বাতাসের ফোলানো
নৌকায় প্রায় আটজনের জায়গা হয়। সাথে থাকবেন
একজন গাইড। আমরা সবাই জার্সি
ও হাফপ্যান্ট পড়ে
বাকি সব কাপড়-চোপড়
ও ব্যাগ কেন্দ্রার
গাড়িতে রেখে আসলাম। সবচেয়ে
বড় সমস্যা হলো
এই নদীতে ছবি কীভাবে তুলবো?
সেই সমস্যার সমাধান
হলো ঢাকার এলিফ্যান্টরোডের মোতালিব
প্লাজা থেকে। নেপালে আসার আগের দিন
আমি সেখান থেকে চারটা ওয়াটার
প্রুফ মোবাইল কভার কিনে এনেছিলাম।
এই কভারের ভিতর ফোন রেখে
সেটাকে পানিতে ফেলে দিলেও তা
ভেসে উঠে। দাম মাত্র
৫০০ টাকা।
রাফটিং
শুরু আগে আমাদেরকে লাঞ্চ
করতে অনুরোধ করা হলো। কিন্তু,
মাত্র কিছুক্ষণ আগেই নাস্তা করায়
আমরা লাঞ্চ বাদ দিয়েই ঘাটেঁ
এসে দাড়াঁলাম। বন্ধুরা, এ পর্যায়ে বলে
রাখা দরকার, আমাদের ছয়জনের মধ্যে কেবল
মাত্র শামস সাতাঁর জানে।
সাতাঁর জানাটা রাফটিং এর জন্য
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কারণ,
ঘাটেঁই আমাদের সবাইকে লাইফ জ্যাকেট,
হেলমেট, গার্ড, বৈঠা দেয়া হলো।
আমরা ছয়জন বরফ শীতল ত্রিশুলি
নদীর গর্জনে তখন উদ্দেলিত।
র্যাফটিং-এর সরঞ্জামাদি
এমতাবস্থায়
আমাদের রাফটিং ব্রো “গণেশ”-এর আগমন ঘটে।
গণেশ প্রায় বিশ মিনিট ধরে
একটা ক্লাস নিলো। আমাদেরকে বুঝিয়ে বললো যে, এটা
দলগত সমন্বয়ের একটি খেলা। পানিতে
পড়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাই,
উদ্ধার করার জন্য
আমাদের আশেপাশে দুটি কায়াকি বোট
থাকবে। তার কাছে উদ্ধার
কাজের জন্য প্রায়
২০ ফুট লম্বা রশি
আছে বলেও আমাদের আশ্বাস
দেয়া হলো।
পাশাপাশি
দুটি বোট তৈরি হলো।
একটাতে টীম “১০ মিনিট
স্কুল”। অন্যটাতে
একদল চাইনিজ। এদের মতো লাইফলেস
আনফান মানুষ আমি আমার জীবনেও
দেখি নাই। আমরা যখন
সবাই চিৎকার করে আনন্দে লাফালাফি
করছি তখন দেখি এরা
পিনপতন নীরবতা পালন করে ছবি
তুলছে। নিজের চোখের বদলে ক্যামেরার
লেন্সের ভিতর দিয়েই যেন
এর বিশ্ব দেখে বেশি মজা
পায়!
রাফটিং
শুরু হলো। প্রথমে নদীর
খুবই শান্ত অংশে আমরা কয়েকবার
নিজের দলগত সমন্বয় সাধনের
কাজটা করে নিলাম। মিনিট
পাচেক পড়েই গনেশ বললো, “তোমরা
চাইলে পানিতে নামতে পারো।”
Team 10 Minute School
এই কথাটা আমরা শুনে শেষ
করতে না করতেই সিকি
বেব নাকটা দুই আংগুলে চেপে
ধরে পেছনে পড়ে গেলো। নদীর
বৃহদাংশ জুড়ে ঝুপ করে একটা
শব্দ হলো। আমাদের আর
তখন কে রুখে? জিহান
বাদে আমরা সবাই তখন
পানিতে নামতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। হিমালয়ের বরফ গলা পানির
আচড় শরীরে পড়তেই একটা শিহরণ বয়ে
গেল। শুভ বারবার বলছিল,
“আমাকে আর নৌকাতে উঠানো যাবে না। আমি স্যরি। ভাসতে ভাসতে পোখারা যাবো বলে এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” বোটোর সাইড
ধরে হঠাৎ করেই আমরা
“ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গাইতে লাগলাম। গণেশ এবং পাশের
নৌকার চাইনিজরা আমাদের কাজ কর্মে বেশ
অবাক।
ত্রিশুলি
নদী, নেপাল
হঠাৎ
সামনে দেখতে পেলাম বড় একটা স্রোত
ধেয়ে আসছে। সবাই নৌকায় উঠে
বসলাম। সময় এসেছে আমাদের
প্রথম মেজর কারেন্টের মোকাবিলা
করার। কিছু বুঝে উঠার
আগেই দেখলাম নৌকাটা বা-দিকে কাতঁ
হতে শুরু করলো। দশ
সেকেন্ড পর আবিষ্কার করলাম
আমি নৌকার ঠিক নিচে। শুধু
তাই নয়, আমার নীচে
আছে শামস। পাশেই শুভ। আকস্মিক ধাক্কায়
বাম দিকে বসে থাকা
আমরা তিনজন পড়ে গিয়ে তখন
বেশুমার পানি খাওয়ায় ব্যস্ত। হঠাৎ আমার মনে
পড়লো গণেশের সেই ক্লাসের কথা।
কোনোমতে নৌকার নিচ থেকে বের
হয়ে আসলাম। দেখলাম আমার দিকে একটা
বৈঠা ধরে রাখা হয়েছে।
কিন্তু, উঠবো কীভাবে? অগত্যা বন্ধু শামসের
উপর ধাক্কা দিয়ে তাকে আরো তিনফুট
পানির নীচে পাঠিয়ে স্বার্থপরতা
দূর্দান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমি উঠে
আসলাম চাইনিজ বোটে। শামস সাতাঁর জানায়
ঠিকমতই আমাদের বোটে পৌছেঁ গেলো।
চাইনিজরা আমার ওয়াটার প্রুফ
মোবাইল কভার দেখে বেশ
পুলকিত। আপাদমস্তক পানিতে ভিজে আমার নাজেহাল
অবস্থার ছবিও তারা তুলে
রাখলো। অত:পর আমি
আমার নিজের বোটে ফেরত গেলাম।
During the Rafting Break
আবার
শুরু হলো রাফটিং। একের
পর এক ঢেউ সামলাতে
সামলাতে হাত তখন প্রায়
ব্যথা হয়ে এসেছে।
এমতাবস্থায় গণেশ একটা দ্বীপের
মতো জায়গায় যাত্রা বিরতি করলো। সেইখানে তোলা ছবিগুলো নেপাল
ট্রিপে আমাদের সেরা ছবি। প্রতিটি
মুহুর্তই আমাদের জন্য ছিলো
অসম্ভব উপভোগ্য। প্রায় তিনঘন্টার
রাফটিং শেষে অবশেষে প্রায়
তিনটার দিকে আমরা শেষ
প্রান্তে পৌছঁলাম। সেখানে আগে থেকেই আমাদের
জন্য অপেক্ষা করছিলেন
our old friend, কেন্দ্রা।
আমাদের সকল কাপড়-চোপড়
নিয়ে সে আগেই এন্ড
পয়েন্টে চলে এসেছে।
রাফটিং-ব্রো গনেশকে শেষ
বিদায় জানিয়ে আমরা রাস্তায় উঠে
আসলাম। সামনেই দেখলাম কলা বিক্রি হচ্ছে।
ক্ষুধায় আমরা তখন দিশেহারা।
কোন দিকে না তাকিয়েই
ডজন খানেক কলা সাবার করে
দিলাম। সাকিব বিন রশীদ একটি
ম্যাগি নুডুলসের প্যাকেট দেখেই
সেটা কীভাবে রান্না করা যায় তার
ফন্দি করতে লাগলো। আমাদের
বাসটা বেশ বড় হওয়ায়
সেটার ভিতরেই আমরা কাপড় পরিবর্তন
করে ফেললাম। ভেজা কাপড় গুলোকে
পলিথিনে ভরে রাখা হলো।
অত:পর আবার ছুটলো
কেন্দ্রা-এক্সপেস। স্পীকারে বাজলো এরিক ক্ল্যাপটন
সাহেব।
ঘন্টা
খানেক পর একটা হোটেলে
দুপুরের খাবারের জন্য থামলাম।
সম্ভবত নেপাল ভ্রমণের সবচেয়ে গলাকাটা দামের খাবার ছিলো এইটা। আমি
আর শামস ভাত আর
মুরগী খেলাম। তার বিল আসলো
জনপ্রতি ৪৫০ রুপি। অন্যদিকে, এই পর্যায়ে সাকিব বিন রশীদ এবং সিকি বেইব পরস্পরের কমন ব্রো হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। তখন থেকে শুরু
করে আজ অবধি এই
দুইজন মিলে টাকা বাচাঁতে
একটা মাত্র ডিস অর্ডার করে
শেয়ার করে খায়। সর্বশেষে
তারা ঢাকার ম্যাডশেফেও এই
কাজ করেছে।
বেলা
ছয়টা নাগাদ আমরা পোখারায় পৌঁছলাম।
Hotel Diplomat নামের
একটা রেস্ট হাউস এগেই বুকিং.কম থেকে প্যাক করা ছিলো।
পোখারার বিখ্যাত আকর্ষণ
হলো “ফেওয়া লেক”। সেই
লেক সাইড অঞ্চলেই ছিলো
আমাদের হোটেলটা। জনপ্রতি প্রতি রাতের ভাড়া মাত্র ৬ ডলারের মতো!
এই খবর পেয়ে সাকিব
বিন রশীদ আনন্দ উৎসবে
মত্ত। কিন্তু, রুমে ঢুকে দেখলাম
এসি নেই, যদিও পোখারাতে
এসি লাগে না। ওয়াশরুমের
কমোডে হ্যান্ড শাওয়ারও
নেই। কারণ, এই অঞ্চলে শুধু
tissue paper ব্যবহারেই কার্য সম্পাদন করা হয়। অবশেষে
শুভ মামের বোতল দিয়ে কীভাবে
হ্যান্ড শাওয়ারের কাজ করা যায়
তা আমাদেরকে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে বললো।
আমি
গোসল করতে ঢুকলাম। বের
হয়ে দেখি কেউ নেই।
সবাই আশেপাশের এলাকা ভ্রমণে বেরিয়েছে। আমি তখন অসম্ভব
ক্লান্ত। সুযোগ পেয়ে শুভ্র বিছানায় পিঠ লাগালাম। ঘন্টা
খানেক পরেই পাচঁ জন
এসে বেশ উৎসাহের সাথে
আমাকে ডেকে তুললো। শামস
এবং জিহান অত্র এলাকার ভালো
খাবারের দোকানের সন্ধান নিয়ে এসেছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা খেতে বের
হলাম।
হোটেলের
ঠিক নিচেই একটা দোকান। পারিবারিক
ব্যবসা। রেস্টুরেন্টের শেফ তার মেয়েকে
ইউটিউবে ভিডিও দেখাচ্ছে। আমরা সবাই দোকানে
বসে আরেকদফা মোমো অর্ডার করলাম।
দেরি হচ্ছিলো দেখে শুভ বারবার
চিৎকার করে বলতে লাগলো,
“এই বাচ্চাটা রান্না করে দেন।” ভাগ্যিস শুভ
বাংলায় বলেছিলো। মজার ব্যাপার
হলো, হিন্দী জানা সত্ত্বেও পুরো
সময় জুড়ে শুভ বাংলায় কথা
বলে। তার অঙ্গভঙ্গি দেখে
নেপালে মানুষ বুঝতেও পারে! সাইন ল্যাংগুয়েজের
যে কোন ব্যারিয়ার
নেই সেটা আরেকদফা প্রমাণিত
হলো।
আমি-শামস-জিহান খাবারটা
নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট ছিলাম।
আমরা তিনজন তখন পাশেই Javista Cafe & Bar-এ
ঢুকলাম। সেখানে Pasta Arabiata
& Meat Chop অর্ডার
করা হলো। নি:সন্দেহে
এইটা নেপালে আমাদের শ্রেষ্ঠ খাবার ছিলো। দোকানটার পরিবেশটাও ছিলো অসাধারণ। গেইম
অফ থ্রোন্সের নেকড়ে গুলোর মতো দেখতে বড়
একটা কুকুর আমাদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিলো। জিহান বারবার সেই জন্তুটার সাথে
খেলা করার চেষ্টা চালিয়ে
গেলো। অজানা একটা কুকুরের কাছ
থেকে সুন্দর ব্যবহার পেয়ে
সে বেশ মুগ্ধ।
Meat Chop
Pasta Arabiata
পোখারার
সাথে কাঠমন্ডুর বড় পার্থক্য
হলো নাইটলাইফ। রাত ১১ বাজতেই
পোখারা ঘুমন্ত নগরী। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও
জোর করে আমাদেরকে রেস্টুরেন্ট
থেকে বের করে দেয়া
হলো। রাফটিং করে আমরা অসম্ভব
ক্লান্ত ছিলাম। এরপর দিন ভোরে
আমাদের সূর্যোদয় দেখতে যাওয়ার কথা। তাই তাড়াতাড়ি
হোটেলে চলে গেলাম। কেন্দ্রাকে
ভোর চারটায় হোটেলের নীচে থাকতে বললাম।
এরপর সবাই ঘুমে অজ্ঞান
পরদিন
ঘুম ভাংলো সকাল ৮ টায়…
সূর্যোদয়ের প্রায় ৪ ঘন্টা পর
ঘুম থেকে উঠেও কীভাবে
আমরা অসাধারণ একটি দিন কাটালাম
সে গল্প শুনতে চোখ
রাখুন আমার সাইটের ব্লগ
সেকশনে।