নেপাল ভ্রমণের ইতিবৃত্ত-কাঠমন্ডু
Travel Stories

নেপাল ভ্রমণের ইতিবৃত্ত-কাঠমন্ডু

Sep 28, 2017   |    9667


২০১৭ সালটা বেশ ্যস্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা, থিসিস, ১০ মিনিট স্কুলসব কিছু মিলিয়ে দম ফেলবার ফুরসত পাচ্ছিলাম না। জুন মাসের প্রথম দিকে আমার থিসিসের কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে। মনে মনে ঠিক করলাম, এইবার একটু ঘুরে আসা দরকার।

 

 

 

্যাবের ফাকেঁ দুপুরের খাবার খেতে গেলাম আইবিএ ্যান্টিনে। সেখানে দেখা হলো ১০ মিনিট স্কুলের প্রডাকশন হেড জিয়াউস শামস মার্কেটিং হেড জিহানের সাথে। এই দুটো ছেলে ১০ মিনিট স্কুল টীমে আমার ফেভারিট। ওদের দেখা মাত্রই বললাম:

 

            “চল, নেপাল যাই।

 

শামস-জিহান বেশ পোক্ত ট্রাভেলার্স। প্রথম শ্রবণেই দুজন সায় দিলো। দল ভারী করতে ফোন দিলাম সাকিব বিন রশীদ (ওরফে শুভ) কে। মিনিট দশেকের মাথায় সেও রাজি। রাত গড়াতেই আমাদের দলে যোগ হলে ফারহান সিকদার (ওরফে সিকি বেইব) এবং জুবায়ের। মাত্র একদিনের মাথায় আমাদের নেপাল tour-এর পুরো প্ল্যান রেডি।

 

জিহান-জুবায়ের নানা ওয়েব সাইট ঘেটেঁ হোটেলের দাম-দর সব বের করে ফেললো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যত্তসব Daring Sports আছে সবই করবো। মাত্র পাচঁ দিনের tour-এর তাই জনপ্রতি বাজেট দাড়াঁলো ৫০ হাজার টাকার মতো।

 

প্রথমেই বিমান বাংলাদেশের আপ-ডাউন টিকেট কাটলাম ১৭ হাজার টাকায়। এই সিজনটায় এয়ার ফেয়ার একটু কমই হয়। নেপাল ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে কোন ভিসা লাগে না। আপনি কাঠমন্ডু এয়ারপোর্টে নামলেই আপনাকে বিনামূল্যে ভিসা দেয়া হবে। তবে যাবার আগেই এমব‍্যাসির সাইটে একটা ফর্ম পূরণ করে যেতে হয়।

 

১৯ জুন ২০১৭ | সকাল .৩০ টায় ্যাগ ঘুছিয়ে আমি রওনা হলাম এয়ারপোর্টে। .৩০ টায় আন্তর্জাতিক টার্মিনালে দেখা হলো শামসের সাথে। :০০ টার মধ্যেই সবাই এসে উপস্থিত। এটা আমার জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণ। তাই, স্বভাবতই আমি কিছুটা “Noob” আচরণ করছিলাম।



The team at the Shah Jalal International Airport, Dhaka 


সেদিন সকালে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমরা তো ভেবেছিলাম আজকে প্লেন উড়বে কিনা! কিন্তু সবকিছু ঠিক রেখে বেলা ১১.০০ টায় প্লেন উড়লো। বিমান বাংলাদেশ… আকাশে মুড়ির টিন। মাত্র দেড় ঘন্টার ফ্লাইট। মধ‍্যপথে আমাদেরকে দুবছর (নূন‍্যতম) আগে বানানো একটা বার্গার খেতে দিলো। সেটা চাবিয়ে নরম হওয়ার আগেই আমরা কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে পায়ের ছাপ রাখলাম।


 It’s a small step for a man, a giant leap for mankind.

 

বিমানবন্দরে সার্কভূক্ত দেশের জন‍্য আলাদা লাইনে দাড়াঁলাম। কারণ, এই লাইনে কোন ভিসা ফি লাগে না (এটাকে Gratis Visa বলে)। পাসপোর্টে সিল লাগার সাথে সাথেই আমরা লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দরের প্রধান ফটকে চলে আসলাম। নেপালের tourism বেশ গোছানো। আপনি কিছু না জেনে নেপালে আসলেও লোকজন আপনাকে সবই ব‍্যবস্থা করে দিবে।

 


ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কাঠমন্ডু


প্রথমেই আমরা নিজেদের ডলারকে নেপালি রূপীতে রূপান্তর করলাম। ১ ডলার = ১০০ রূপী। কিছুক্ষণের মধ‍্যই আমাদের পকেট ফুলে উঠলো। সামনেই একটা মোবাইল সিমের দোকান। সেখান থেকে ৮০০ রূপীতে একটা NCell (নেপালের রবি) কোম্পানির সিম কিনলাম। ফ্রি পেলাম ২ জিবি ইন্টারনেট আর বেশ কিছু টকটাইম। শুনলাম নেপালের কিছু জায়গায় নাকি 4G চলে এসেছে! মনে মনে ভাবলাম, বাংলাদেশে আমরা তাইলে কোন দিক দিয়ে ডিজিটাল হয়েছি?

 

বিমানবন্দর থেকে বের হতেই আপনি এক বিড়ম্বনায় পড়বেন। সেটা হলো ট‍্যাক্সি! আমাদের গন্তব‍্যস্থল হলো কাঠমান্ডুর tourist এরিয়া “থামেল। এয়ারপোর্ট থেকে থামেলের ভাড়া কেউ চাইলো ১৪০০ রূপী, কেউ চাইলো ২৫০ রূপী! আমরা তো হতবাক!

 

অবশেষে ২৫০ রূপীর দাবীদার ব্রো-র কাছ থেকে দুটো ট‍্যাক্সি নিয়ে আমরা রওনা হলাম থামেলের পথে। রাস্তাঘাট বেশ সুন্দর। বাড়ি-ঘর গুলো একটু নড়বড়ে, খুব বেশী আভিজাত‍্যের আঁচড় নেই তাতে। তবে রাস্তায় আছে বেসম্ভব পরিমাণ ট্রাফিক জ‍্যাম। এই জ‍্যামের অন‍্যতম কারণ, রাস্তার মধ‍্যে গরু বসে থাকে। নেপালে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ‍্যা অনেক। তই, গরুকে কোন ভাবেই তাই বিরক্ত করা যাবে না।

 

৪০ মিনিটের মাথায় আমরা থামেলে পৌছঁলাম। আমাদের কোন হোটেল বুক করা ছিলো না। ট‍্যাক্সি ব্রো আমাদেরকে নিয়ে গেলো তার ব‍্যবসায়ী অংশীদার ব্রো-র হোটেলে: Pilgrims Guest Houseরিসিপশনে আমাদের পরিচয় হলো দিপাক থাকুরির সাথে। দিপাকের একটা ট্রাভেল এজেন্সী আছে যারা পুরো নেপাল ট‍্যুর আয়োজন করে দেয়। (Mountain King Adventures, Deepak Thakuri: +977 985 108 7142)

 

রিসিপশনে সবাই বসে চা খেতে লাগলো। আমি আর দিপাক শুরু করলাম মাছ-বাজারের দর কষাকষি। জুবায়ের-জিহানের ইন্টারনেট রিসার্চের কারণে সবকিছুর দাম সম্পর্কেই আমাদের কিছুটা আইডিয়া ছিলো। থামেলের হোটেল ভাড়া (এসি রুম) রাখলো ২২ ডলার/রাত। এক রুমে তিন জন থাকতে পারবে। দুটো রুমেই আমাদেরকে প‍্যাক করে দিলো।

 

দিপাক ব্রো-কে আমাদের পুরো প্ল‍্যান খুলে বললাম। সে দু-ঘন্টা সময় নিয়ে পুরো tour-এর সবকিছুর জন‍্য ৩০০ ডলার দাবী করলো। আমরা তখন মনে মনে অসম্ভব খুশি। কারণ, আমাদের বাজেট ছিলো প্রায় ৪০০ ডলার পর্যন্ত। তখন বুঝলাম, বাংলাদেশ থেকে কোন কিছুই বুক করা উচিত না। নেপালে এসে করলে সবকিছুই অনেক কমে পাওয়া যাবে।

 

আমি ৩০০ ডলারেও ছাড়বার পাত্র নই। আরো কিছুক্ষণ দরদাম করে ২৯০ ডলারে সেটেল করলাম। জিহান এসে কানে কানে বললো:

 

          “শোমীর ভাই, আপনি একটা ছেঁচড়া।

 

একনজরে খরচগুলো: রিভার রাফটিং (তিন ঘন্টা, লেভেল ৩): ৩৫ ডলার, বাঞ্জি জাম্প + ক‍্যানিয়ন সুইং = ১২০ ডলার (যেকোন একটা করলে ৮০ ডলার), প‍্যারাগ্লাইডিং + ছবি = ১০৫ ডলার (ছবি ছাড়া ৮০ ডলার). এছাড়া আমাদের ৬ জনের জন‍্য একটা বিশাল tourist bus এই প‍্যাকেজের ম‍ধ‍্যেই চলে আসলো। আমাদের বাজেট তখন প্রায় ৪০ হাজার টাকায় নেমে আসলো!

 

এরপর রুমে গিয়ে সবাই একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। শুভর তখন জ্বর আসলো। জুবায়ের-সিকিও ক্লান্ত। ওদের তিনজনকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমি-জিহান-শামস বিকাল ৩.০০ টার দিকে কাঠমান্ডুর অলিতে গলিতে হাটাঁ শুরু করলাম।

 


শামস-জিহান-আমি (বা থেকে)


আমরা তিনজনই অসম্ভব এডভেঞ্জারাস। সবকিছুতেই আগ্রহ আমাদের! রেস্টুরেন্ট দেখলেই আমরা ঢুকে menu ঘেটেঁ দেখি। নেপালে প্রথম খাবার খেলাম একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে। থিন ক্রাস্ট পিজ্জাটা অসম্ভব ভালো লেগেছিলো।

 

রাস্তায় হাটাঁর একটা বিড়ম্বনাও আছে। কিছুক্ষণ পর পর কিছু লোক মোটর বাইকে করে সামনে এসে দাঁড়ায় আর বলে, “ম‍্যাসাজ চাহিয়ে? ম‍্যাসাজ?” শামস আমাকে বুঝিয়ে বললো এই ম‍্যাসাজের সাথে “হ‍্যাপি এন্ডিং জাতীয় একটা ব‍্যাপারও জড়িত। আমরা এদের দেখলেই বেশ এড়িয়ে যেতাম। কিছুক্ষণ পর একটা ফ্রেঞ্চ রেস্তোরায় গেলাম। এরা যেন ফরাসি আভিজাত‍্যের এক পসরা সাজিয়ে বসেছে! ফ্রেঞ্চ বেকারি এবং মদের বাহার দেখেই মাথা ঘুরে গেলো। আমরা এক কাপ কফি খেয়ে বের হয়ে আসলাম।


 French Coffee Shop & Bakery


এর পর আমরা তিনজন থামেলের একটা ওপেন ট‍্যারেস রেস্টুরেন্টে গেলাম। সেখানের চেয়ারে বসেই রাস্তাটা দেখা যায়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমরা প্রতি মিনিটে ওই রাস্তা দিয়ে হেটেঁ যাওয়া সুন্দরীর সংখ‍্যা গুনলাম। অংক করতে করতে ততক্ষনে বেশ খিদে লেগে গেলো। অর্ডার করলাম একটা গ্রিল ডিস। মাংসটা সুন্দর করে পুরিয়ে তার উপর আগুন ধরিয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় টেবিলের উপর ডিসটা রেখে গেলো। আমাদের চোখে-মুখে তখন অনাবিল আনন্দ। নেপালের অন‍্যতম সেরা মিল ছিলো এই ডিসটা।

 


The fire on our dish (Drakarys!)



The grilled meat!


সন্ধ‍্যা নাগাদ হোটেলে গিয়ে আমাদের ঘুমন্ত শিশুগুলোকে ডেকে তুললাম। তখন বাজে প্রায় ৭.০০ টা। নেপালের নাইট লাইফ তখন কেবল শুরু হয়েছে। সবাই সুন্দর করে সেজে গুজে বের হলাম “ক্লাবিং করতে। জ্বরাক্রান্ত শুভ তখনো রুমে ঘুমিয়ে রইলো।

 

ক্লাবে এন্ট্রি পাওয়া একটা বিশেষ ব‍্যাপার। প্রবেশ দ্বারে বেশ ষন্ডামার্কা কিছু লোক দাড়িঁয়ে থাকে। এরা আপনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে দেখবে। পছন্দ হলে ঢুকতে দিবে, না হলে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমাদের মধ‍্যে জিহান বেশ শুকনা আর দেখতে ১৬ বছরের কিশোরদের মতো। বেশ কিছু ক্লাবেই বাউন্সারগুলো ওকে দেখে কিছুটা ইতস্তত করলো। কিন্তু, টুরিস্ট কোটায় জিহান পরে ঢুকতে পারলো ঠিকই।

 

Purple Haze ক্লাবটার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। Night happens in purple haze. বিশাল এই জায়গাটার এক অংশে স্টেজের উপর কনসার্ট হচ্ছে। তার সমানে কিছু ছেলে-মেয়ে উন্মত্ত! পাশেই পানশালায় মদের আসরে বুদ হয়েছে কিছু ক্লান্ত যুবক-যুবতী। অন‍্যদিকে আছে একটা পুল জোন। সেখানে আমরা ঘন্টা দুয়েক পুল খেললাম। সিকি বেইব তার পুল খেলার দক্ষতা ‍‍দেখিয়ে আমাদের মুগ্ধ করলো। এর মধ‍্যে জিহান এসে খবর দিলো, ক্লাবের পিছনে একটা দোলনা আছে যেখানে বসে নাকি দোল খেতে খেতে বিড়ি ফুকাঁ যায়। আমরা ওদিকে না গিয়ে বের হয়ে আসলাম।



Pool @ Purple Haze 


একটার পর একটা ক্লাবে ঢুকলাম। মিনিট দশেক থেকে আবার পরেরটাতে গেলাম। কিন্তু, কোনটাতেই নাচানাচি করলাম না। এইটা নিয়ে আমার মন উশখুশ করছিলো। তাই সিকি-কে বললাম, চল ফ্লোরে ঢুকে নাচা শুরু করি। সিকি ছেলেটা বেশ নিষ্পাপ। সব কথায়ই ওর সায় থাকে। আমি আর সিকি ডান্স ফ্লোরে ঢুকলাম। নাচতে তো আমরা পারি না। মোটামুটি “জাম্পিং জ‍্যাকস করা শুরু হলো। যে ব‍্যাপারটায় আমার খুব ভালো লাগলো, No one cares what you are doing! কেউ হাসাহাসি করে না। সিকির নাচে এক আমেরিকান ভদ্রমহিলা বেশ মজা পেলো। সিকির টি-শার্টের একটা ছবিও সে তুলে নিলো। বেচারা তখন খুশিতে আত্মহারা। আমাকে এসে বললো: "Shamir Bhai, I can be a meme in america now!” উত্তরে আমি বললাম: “That could be the biggest achievement of your life.”



 সিকি আর আমি!


রাত বাজে বারো-টা। মদের প্রভাব থামেলের পরিবেশে পড়তে শুরু করেছে। কিছু স্থানীয় যুবক মারা-মারি শুরু করলো। “রাতের রানী-দের দামের বনিবনা নিয়ে এলাকা তখন কিছুটা আক্রমণাত্মক। রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছে। জিহান বললো, “চলো বাড়ি ফিরে যাই। কাল অনেক পরিশ্রম হবে। হোটেলে আসার পথে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে নেপালের বিখ‍্যাত খাবার “মোমোর স্বাদ নিলাম। ঢাকার হাতিরপুলের ক‍্যাফে ফাইভ এলিফেন্টেও প্রায় একই রকম স্বাদের মোমো পাওয়া যায়। নেপালে প্রথম দিনটা এককথায় অসাধারণ ছিলো। একদিনেই যে এতো কিছু করে ফেলবো ভাবতেই পারিনি।


 

নেপালের মোমো


হোটেলে ঢুকে দেখি সাকিব বিন রশীদ প্রেমিকার সাথে সাইবার ন‍্যাস্টিতে ব‍্যস্ত। বেচারা জ্বরে বেশ কাতর। বারবার বলছিলো:

 

আমি বাঞ্জি জাম্প করতে পারবো না। আমার টাকা ফেরত দে!”

 

রাত তখন ১.০০ টা। একরুমে শুভ-সিকি-জুবায়ের শুয়ে পড়লো। অন‍্যরুমে ঢুকে দেখি শামসু সোফার উপর উঁবু হয়ে পড়ে আছে। জিহান একটা বিছানায়। অন‍্যটা আমি দখল করলাম। অসম্ভব ক্লান্তি, কিন্তু অফুরন্ত তৃপ্তিতে নেপালের প্রথম দিনের ইতি ঘোষনা করলাম।

 

দ্বিতীয় দিনটায় আমাদের জন‍্য অপেক্ষা করছে বেশকিছু চ‍্যালেঞ্জ। সেগুলোর গল্প শুনতে পড়ে ফেলুন এই সিরিজের  দ্বিতীয় ব্লগটি




Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.