ঢাকা থেকে অক্সফোর্ড
Dec 15, 2017 | 16799
২৫ নভেম্বর দিনটা ছিলো বাংলাদেশে কাটানো শেষ দিন। সকালে একনজর কার্জন হলকে দেখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। আমার প্রিয় সিড়িঁটায় মিনিট দশেক বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী আরমিন দেখা করতে আসলো। আমাকে একটা বড়সড় ফটোবুক দিয়ে গেলো। বাসায় ফেরত গেলাম। বস্তাগাট্টি বেধেঁ রাত নয়টা নাগাদ এয়ারপোর্ট রওয়ানা দিলাম। ভাইয়া,
মা’মনি আর দুই কাজিন সাথে গেলো। ভেবেছিলাম বিদায় বেলাটা হয়তো বেশ আবেগঘন হবে। কিন্তু,
কাজিনদের সাথে চিল-আড্ডায় কখন যে ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম সেটা বুঝতেও পারলাম না। আমার মা বেশ ইমোশনাল হলেও ছেলের বিদায়ে বেশ শক্ত মনের পরিচয় দিলেন। ব্যাপারটা ভালোই লাগলো। বাসায় এসে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করেছে!
প্লেন উড়াল দিলো আমার স্বপ্নের পাণে। পরদিন দুপুরের দিকে প্লেন থামলো কুয়েতে। সেখানে তিন ঘন্টার যাত্রা বিরতি। ব্যাগ থেকে আরমিনের দেয়া ফটোবুকটা বের করলাম। আমার সব ছাত্রীরা মিলে তাদের সাথে আমার ছবি এবং সুন্দর কিছু বিদায় বেলার চিঠি খুবই শৈল্পিক উপায়ে একটা বইয়ের মধ্যে এটেঁ দিয়েছে। সেটা পড়তে পড়তে আবার প্লেনে চড়ে বসলাম। ইংল্যান্ডের সময় বেলা ৪ টায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর
“হিথ্রো”-তে প্লেন ল্যান্ড করলো।
ব্যাগ সংগ্রহ করে বাহিরে বের হতেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। বেলা বাজে চারটা। ঘুটঁঘুটে আন্ধার চারদিকে। শীতকালে এদের দিন অনেক ছোট। আর গরমের দিনে রাত ১০টায় সূর্য দেখা যায়। মোবাইলটা অন করে দেখি তাপমাত্রা মাত্র ৩ ডিগ্রী। লাগেজটা খুলে বড়সড় একটা জ্যাকেট পড়ে নিলাম। বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে অবশেষে অক্সফোর্ডগামী একটা বাসের দেখা মিললো। বাসে চড়ে বসতেই রাজ্যের ক্লান্তি নেমে এলো।
ইংল্যান্ডের যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো। গুগল ম্যাপেই লোকাল বাসের সময়,
কোন বাসে যাবো তার নম্বর,
সেই বাস আসতে কত সময় লাগবে সবই বলে দেয়। বাসের ভেতরে আছে ওয়াইফাই। সদ্য বিলাতে পা-দেয়া এই বাঙালির চক্ষু তখন সবকিছুতেই চড়কগাছ। কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতেই কেমন যেন নিজেকে অসহায় লাগলো। জীবনে প্রথম একা থাকতে যাচ্ছি। এখন সবকিছুর দায়িত্ব শুধুই আমার।
অবশেষে বাসায় ফোন দিলাম। আশ্বস্ত করলাম যে,
আমি ঠিক আছি। ভয় যে লাগছে একটু একটু সেটা যথারীতিই চেপে গেলাম। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ অক্সফোর্ডে পৌঁছলাম। আমার বাসা আগে থেকেই ভাড়া করা ছিলো। বাড়িওয়ালার নাম দিমিত্রি। বেশ সাধা-সিধে মানুষ। সে আমাকে নিতে বাস স্টপে গাড়ি নিয়ে আসলো। পথে এক দোকান থেকে মোবাইল সিম কিনে ফেললাম। কিন্তু,
মন একটু খারাপ। তার প্রধান কারণ,
আমি ঢাকা বাসী।
রবিবার সন্ধ্যা ৬টার পর অক্সফোর্ড নিথর নগরী। কেউ বাহিরে বের হয় না। অন্যদিকে ঢাকায় প্রায় রাত ১১ টা পর্যন্ত দোকানপাট সব খোলা থাকে। হঠাৎ এই রকম একটা জায়গায় এসে একটু ভয় ভয় লাগছিলো। ঢাকা আর অক্সফোর্ডের এই পার্থক্যটা বেশ প্রকট। এখানে সন্ধ্যা হলেই শহরটা ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঢাকা জাগে তার রাতের সাথে।
বাসায় এসে নিজের রুম দেখে বেশ ভালো লাগলো। সব আসবাবপত্র আগে থেকেই দেয়া আছে। আমি বেশ গোছানো মানুষ। এলোমেলো কিছুই ভালো লাগে না। এই বাসার রান্নাঘর-বাথরুম আমার মতোই গোছানো। নিজের লাগেজের জিনিসপত্র সাজিয়ে নিলাম আলমারিতে। কিন্তু,
ততক্ষণে রাত প্রায় দশটা বাজে। পেটে ভীষণ ক্ষুধা। শেষ খাবার খেয়েছি কুয়েত থেকে লন্ডনে আসার প্লেনে।
পেটপুজা করতে বাহিরে বের হলাম। গুগােল সাহেব বললেন বাসার পাশেই
Papa Jhon’s Pizza নামের একটা দোকান আছে। আমিও তার কথা শুনে পাপা জনের পিজার টুকরায় কামড় বসালাম। অর্ধেকটা পিজা বাসায় নিয়েও আসলাম। দেশের বাহিরে আসলে সব বাঙালীর একটা কমন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেকোন কিছু কেনার সময়ই আমরা ডলার/পাউন্ডের বদলে সেটা কত টাকা দামে কিনছি তা গুণে দেখি। একটা পিজ্জার দাম ১১০০ টাকা!
নিজের অন্তর্নিহিত গরীব সত্ত্বাটায় আগুন ধরলো!
তখন গ্রাম-বাংলার পিজ্জা ইনের
menu-র দামের কথা চিন্তা করে সেই আগুনে পানি ঢাললাম।
পরদিন বাংলাদেশ থেকে প্রথম ফোন দিলো শুভ আর শামস। বাংলাদেশে আমার শেষদিনটায় শুধুমাত্র এই দুইজনকে বিদায় বলতে বেশ খারাপ লাগছিলো। শুভ-শামস-রামিম-সিকি-আয়মান শেষ রাতটা আমার বাসায় থাকতে এসেছিলো। সেই নাইট চিল পরদিন রাত পর্যন্ত গড়ালো। অবশেষে যখন উবার ডেকে এই দুইজন উঠে গেলো তখন মনে হলো,
আসলেই তো চলে যাচ্ছি। যাইহোক,
এদের সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো। ভাইয়া-আম্মু প্রায় প্রতিদিনই ফোন দিলো। নিজের ব্যস্ততার কারণে সবার কল ধরতে পারছিলাম না। অগত্যা আমি ডিজিটাল সুইসাইডটা করলাম। নিজের মা-কে ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম। অন্তত মহিলা ফেইসবুকে দেখে তো খবর জানতে পারবে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আমার সব পোস্টে আম্মাজান বাংলায় কমেন্ট করেন। মাত্র দুইদিনের ব্যবধানে মায়ের এই ডিজিটাল আপগ্রেডে আমি বেশ অবাক হলাম।
অক্সফোর্ডে আমার কর্মস্থল জন র্যাডক্লিফ হাসপাতালের ভিতরে। আমার বসের নাম সাজিয়া,
জন্মসূত্রে কাশ্মীরী,
অনুমোদনসূত্রে তিনি ব্রিটিশ। প্রথম দিন আমাকে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ দিলেন। বেলা ১২.০০টায় তার সাথে দেখা করতে গেলাম। সাজিয়া আমার মতোই অনেক কথা বলে। আমাদের সেই লাঞ্চ মাত্র সাড়ে আট ঘন্টা ধরে চললো। অবশেষে ডিনার করে ও লন্ডনের বাসে উঠে বাড়ি গেলো। প্রথম দিনেই বুঝলাম,
বস বেশ কুল আছে। বেশ চিল পরিবেশে রিসার্চ করা যাবে।
অক্সফোর্ড হলো সাইকেলের শহর। গাড়িতে করে যেতে চাইলে জ্যামে আটকে থাকতে হয়। কারণ,
রাস্তাঘাট ঢাকার থেকেও চিকন। উপায় একটাই— সাইকেল। মাত্র ৪০ পাউন্ডে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল কিনলাম। নাম দিলাম
Pinkman 2.0। পিংকম্যানের জন্য তালা কিনা লাগলো ২০ পাউন্ড দিয়ে। কারণ,
অক্সফোর্ডে সাইকেল চুড়ি খুবই কমন ঘটনা।
সাইকেল কেনার পর আমার অক্সফোর্ড জীবন ভালোমতো শুরু হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানাই— টোস্ট ব্রেড,
কলা,
সিরিয়াল,
দুধ,
ডিম;
সনাতনী ব্রিটিশ নাস্তা। এরপর গোসল করে সাইকেল নিয়ে বের হই। অলিগলি ঘুরে প্রাসাদসম বিল্ডিংগুলো দেখতে দেখতে ল্যাবে যাই। কাজ শুরু করি সাড়ে নয়টায়। আমি সবার আগে ল্যাবে ঢুকি। ঠান্ডা মাথায় কাজ শুরু করি। বেলা ১২.৩০ এ দুপুরের খাবার খাই। সেই খাদ্য তালিকায় থাকে স্যান্ডউইচ। বাসা থেকে সেটা সকালের নাস্তার সময় বানিয়ে নিয়ে আসি। ভরপেট খেলে খুব বেশি কাজ করতে ইচ্ছা করে না।
ঢাকার সাথে অক্সফোর্ডের বড় এক তফাত হলো গতির। ঢাকা অনেক ধীরে চলে। অক্সফোর্ডে সবই দৌড় দেয়। যেই কাজ দেশে করতে একমাস লাগে সেটা দেড় দিনে করে ফেলা যায়। কারণ,
এদের অনেক টাকা,
অনেক যন্ত্রপাতি। হুকুম দেয়ার পরের দিনই আমার যন্ত্রপাতি ল্যাবে হাজির হয়। বেশ আনন্দ লাগে তখন।
প্রায়ই ল্যাবে আটটা-নয়টা পর্যন্ত থাকি। যখন ল্যাব থেকে বের হই তখন দেখি হাসপাতালে আর কেউই নেই। আমার বস অবশ্য থাকে তার রুমে। আমাকে প্রথম একমাস উনি বেইবি-সিট করবেন। আমরা দুইজন বের হয়ে একজন বাস অন্যজন সাইকেল ধরে বাড়ি ফিরি। বাসায় আসলেই রাজ্যের ক্লান্তি নেমে আসে। ঢাকায় থাকতে রাতে চারটা/পাচঁটা পর্যন্ত জেগে থাকতাম। এখানে ১১টায় ঘুমিয়ে যাই। ঘুম ভাঙ্গে সকাল ৬ টায়। হঠাৎ করেই কেমন যেন নিয়মের জালে বাধাঁ পরে গেছি। রাজ্যের অনিয়ম থেকে হঠাৎ এক নিয়মের রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে গেলাম কেমন করে তা বুঝতে পারলাম না।
প্রথম ১৫টা দিন দেখতে দেখতেই চলে গেলো। শুরুতে বাসায় প্রতিদিনই ফোন দেয়া হতো। এখন সবাই ব্যস্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় বন্ধু-বান্ধব গুলো ফোন কেন দেয় না?
আমি আসার পর ১০ মিনিট স্কুলের পুরস্কার জেতার হিড়িক পড়েছে। প্রতিরাতে বাসায় ফিরে দেখি নতুন ভিডিও আসছে। সবাই গালা ডিনারে গিয়ে হারামীর মতো আমাকে ট্যাগ করেছে। এগুলো দেখলে বেশ মজাই লাগে। দেশের টানটা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করি। অক্সফোর্ড ভালো লাগলেও মনে হয় একদিন হয়তো বাংলাদেশে গিয়েও এই রকম গবেষণার সুযোগ পাবো। তখন বাসায় ফিরে এই হারামীগুলোর সাথে অন্তত চিল করা যাবে।
শনিবার অক্সফোর্ডের সাপ্তাহিক ঈদ। কেউ কোন পড়াশোনা করে না। প্রথম শনিবারে বাঙালী ভাইদের সাথে ঘুরতে গেলাম। তারা আমাকে বিভিন্ন ক্যাফেতে নিয়ে গেলো। প্রতিটা শনিবার আমাদের এই বাঙালী আড্ডটা বেশ জমে। গত সপ্তাহে আমার বাল্যবন্ধু ফাইয়াজ বার্মিংহাম থেকে আমার সাথে দেখা করতে আসলো। ওকে সাথে নিয়ে অক্সফোর্ড ঘুরলাম। আনিস ভাই,
বাধন ভাই আর ইফতি ভাইদেরকেই এইখানে ফ্যামিলি মনে হয়। সেইদিন সবাই আনিস ভাইয়ের প্যালেসে বসে বিনা ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার এক সুন্দর প্রতিযোগিতা শুরু করলাম। আমার আর বাধন ভাইয়ের বাংলার দৌরাত্ম্যে আনিস ভাই বেশ মুগ্ধ। শনিবারের এই আড্ডা প্রায় রাত ১টা কি দুটা পর্যন্ত গড়ায়। তাই রবিবার সকালে সবাই ঘুমে নিশ্চুপ। সোমবার থেকে আবার শুরু হয় ল্যাবে যাওয়া,
খাওয়া,
বাসায় আসা,
ঘুমানো।
ঢাকায় থাকতে প্রায়ই বাসায় আসার সময় বন্ধু-বান্ধবদের ফোন দিয়ে আড্ডা জমাতাম রেস্টুরেন্টে। আর এখন অনেক ক্যাফে আছে,
বন্ধুগুলো নেই। বাসায় এসে প্রতিদিন একটা করে হিন্দী মুভি দেখি। এর কারণ কি আমার জানা নেই। নেটফ্লিক্সে বাংলা মুভি থাকলে ভালো হতো।
অক্সফোর্ডের শুরুটা বেশ ভালো লাগছে। রিসার্চ এমন একটা কাজ যেখানে প্রতিদিনই ব্যর্থ হতে হয়। সেই ব্যর্থতা মেনে নিয়ে প্রতিদিনই কিছু ছোট-ছোট প্রাপ্তি থাকে। জীবনের সেই ছোট-ছোট প্রাপ্তিগুলোই সবচেয়ে বেশী মূল্যবান।
The end result does not matter. it’s the
journey that matters the most.