ড্রাগ, সেক্স, অামস্টারডাম
May 27, 2020 | 14824
জীবনে হয়তো অনেক শহরে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে; তবে তার কোনটাই নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামের মতো ‘সুন্দর মনের শহর’ হবে না।
কিন্তু, মন তো থাকে মানুষের; শহর তো কেবল ভূগোলের এক টুকরো কারসাজি মাত্র। শহরের আবার মন থাকে নাকি?
শহরেরও মন থাকে। তার মধ্যে আমস্টারডামের মনটা সবচেয়ে সুন্দর।
কেন?
কারণ, এই শহরে মানসিক সংকীর্ণতার কোন স্থান নেই। আপনি যা করতে চান, ঠিক তাই করতে পারবেন। কেউ আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে আসবে না। বিশ্বের ১৭৭ দেশের নাগরিক এই শহরের বাসিন্দা। এই একটি তথ্য থেকেই বুঝতে পারা যায় যে, এই শহরের সামাজিক বিচিত্রতা কতটা সমৃদ্ধ। বিশ্বের প্রথম শহর হিসেবে সেই ২০০১ সালে আমস্টারডাম সমকামী বিবাহকে বৈধ ঘোষণা করেছে। এই শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে (সম)আলোচিত পতিতাপল্লী; মোড়ে মোড়ে রয়েছে গাঁজার দোকান।
এ পর্যায়ে হয়তো আপনি ভাবতে শুরু করেছেন, আমস্টারডামবাসীরা মনে হয় অধ:পাতে গিয়েছে। এরা হয়তো সারা দিন গাঁজা খেয়ে হাই হয়ে থাকে আর রাস্তায়-রাস্তায় প্রচুর সেক্স করে বেড়ায়।
সেটা তারা ঠিকই করে। তবে তার মানে এই না যে, তারা অকর্মণ্য। ইউরোপের টেকনোলজিকাল রাজধানী হলো আমস্টারডাম। বুকিং.কম, টেসলা, উবার, নেটফ্লিক্স তাদের কার্যক্রম এই শহরে বসেই চালায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকাতেও বেশ উপরের দিকে থাকে আমস্টারডাম।
সেই আমস্টারডামের শীফোল বিমানবন্দরে ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর বেলা ১-টার দিকে অক্সফোর্ডের একদল বন্ধু নিয়ে অবতরণ করলাম । এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই চোখে পড়লো বেশ বড়সড় করে লেখা— I am sterdam. শুরুতেই বুঝতে পারলাম, এই শহর অন্য স্তরে আছে। আমাদের সবাইকে সেই স্তরে উঠতে হবে।
বাঁধন, অমিতা, ম্যাক, রাইসা, সাকিব আর আমি— মোট ছয়জন। পাবলিক বাসে করে যেতে অনেক টাকা চলে যাবে। তাই সবাই মিলে একটা উবারে উঠে চলে গেলাম স্প্যাকেলওয়েগ এলাকায়। জায়গাটা শহরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে প্রায় ২০ মিনিট দূরত্বে। সেখানে AirBnB-র মাধ্যমে আগে থেকেই পুরো একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে রেখেছিলাম। এপর্যায়ে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো। আমস্টারডামে থাকার খরচ প্রচুর। বেশ বাজে মানের হোস্টেলে থাকতেও রাতপ্রতি ২০ ইউরো চলে যাবে। এই অ্যাপার্টমেন্টের জন্য আমাদেরকে প্রতি দিন ১২০ ইউরো গুনতে হয়েছে। সেখানে রয়েছে একটা ডাবল বেড, একটা দোতলা বাংক বেড, একটা বড় সোফা; অন্যদিকে একটা সুন্দর সাজানো রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরে আমাদের জন্য সব থালা-বাসন, তেল-লবণ মজুদ আছে প্রচুর পরিমাণে। বাসার নিচেই একটা মুদি দোকান, দুই মিনিট দূরত্বে মেট্রোরেল। ব্যস! আর কি লাগে?
বাসায় প্রাথমিক শিকড় গাড়ার পর পরই আমি সবাইকে নিয়ে বের হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। অমিতা-ম্যাক আর আমাদের আমারপ্রিয় বাঁধন মুখের উপর ‘না’ বলে দিলো। সাকিব আর রাইসাকে সাথে নিয়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমি একটা মেট্রোতে উঠে সিটি সেন্টারে চলে গেলাম। প্রতিদিনের অফুরন্ত যাতায়াতের টিকেটের দাম প্রায় সাড়ে সাত ইউরো। ইউরোপে ঘুরতে আসার অর্থনৈতিক চাপটা পকেটের উপর ভালোভাবেই অনুভব করতে পারলাম।
আমস্টারডামের সবচেয়ে ব্যস্ত স্থান হলো সিটি সেন্টার। যাকে সবাই “আমস্টারডাম সেন্ট্রাল” বলে ডাকে। মেট্রো স্টেশনের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বের হয়ে চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে যখন আস্তে আস্তে উপরে উঠছিলাম, তখন আলোয় ঝলকানো-ঐতিহ্যে মোড়ানো এক শহর তার সুন্দর এক সন্ধ্যা সাজিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। প্রথম দর্শনেই আমস্টারডামের আভিজাত্যের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। আমস্টেল নদী/নালার বাঁধের (Dam) উপর গড়ে ওঠা এই শহর— “আমস্টারডাম”। সেই নালার অংশ বিশেষকে কেটে কেটে এই শহরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ তাদের মশলার চালান নিয়ে শহরের ভিতরে ঢোকার জন্য এই পানিপথ ব্যবহার করতো। গুগল স্ট্যাটেলাইটে দেখলে মনে হবে বিভিন্ন ব্যাসার্ধের অনেকগুলো সমান্তরাল অর্ধবৃত্তাকার নালা শহরের বুকে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে গেছে। প্রতিটি নালার দুপাশে রয়েছে বাড়ি-ঘর। প্রতিটা বাড়িই অসম্ভব মাত্রায় সরু। এর পেছনে একটা কারণ অবশ্য রয়েছে। ব্যবসায় সুবিধার জন্য সবাই নালা-মুখী বাড়ি চাইতো। ব্যাপারটা আমাদের পুরান ঢাকার মতো। আমস্টারডামের সবচেয়ে সরু বাড়িটা মাত্র এক জানালা পরিমাণ চওড়া!
ক্যানাল ট্যুর আমস্টারডামের প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষণগুলোর একটি। আমি, রাইসা আর সাকিব আমস্টারডাম সেন্ট্রালে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে শহরটাকে বোঝার চেষ্টা করলাম। স্টেশনের পাশেই সবচেয়ে চওড়া নালাটা। চোখের সামনে বিশ্বের সব নামি-দামী হোটেলগুলো জ্বলজ্বল করছে। শহরের পুরোটাই মিট মিট আলোয় সাজানো। রাস্তার উপর দিয়ে একটু পর পর ট্রাম চলে যাচ্ছে। ক্রিসমাসের বন্ধে পুরো ইউরোপটাই যেন এই শহরে এসে জটলা পাকিয়েছে। প্রথম কয়েক মুহুর্ত দর্শনের পরই আমি মনে মনে এই শহরের নাম দিলাম— The city of light.
পায়ে হেঁটে একটা শহর ঘুরে দেখা আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজগুলো একটি। দুই বন্ধু সমেত আমি আমস্টারডামের কোন এক নালার গলিতে ঢুকে হাঁটতে থাকলাম। যথারীতি নালার দুইপাশ দিয়ে দুটো ছোট চিকন রাস্তা। কিছুক্ষণ পর পর একটা ব্রীজ এসে দুই পাড়ের রাস্তার মাঝে মধুর মিলন ঘটিয়েছে। এই ব্রীজগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আমস্টারডামের সেই ক্ল্যাসিক ছবি তুলে ফেলা যায়। রাতের আমস্টারডামের নেশা তখন আমায় মাত্র পেয়ে বসেছে। একের পর এক চিকন চিকন গলি। যেটাতেই ঢুকি না কেন সেটা অন্য দিকে একটা নালায় গিয়ে শেষ হয়। কি মুশকিল!
ততক্ষণে হালকা খিদে লাগতে শুরু করছে। রাস্তার পাশের একটা দোকান থেকে আমরা তিন জনে আলু ভাজা কিনে খেয়ে নিলাম। এই বস্তুকে ‘ফ্রেঞ্চ’ ফ্রাই বললে ইউরোপের অনেক দেশের মানুষই বেশ বিরক্ত হয়। পেটপূজো শেষে আমরা একটা সুন্দর সাজানো গোছানো পাবে গিয়ে বসলাম। অর্ডার করা হলে আমস্টারডামের বিখ্যাত ‘আমস্টেল’ বিয়ার। সারা দিনের হন্টনজনিত ক্লান্তি থেকে মুহুর্তেই যেন পরিত্রাণ পেলাম। এক সময় বাকি বন্ধুরা এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো। দল পুরো হবার পর সবাই মিলে আমস্টারডামের প্রধান আকর্ষণ “কফিশপ” খুঁজতে বের হলাম।
কফিশপ বলতে সারা বিশ্বে কফি পানের দোকান বোঝায়; আমস্টারডামে কফিশপ বলতে বোঝায় গাঁজার দোকান। ক্যানাবিস গাছের ফুল/পাতা নেশার উদ্রেগ ঘটানোর জন্য দুনিয়া বিখ্যাত। বিশ্বজুড়ে এখন ক্যানাবিসকে আঈনসম্মত করার জন্য আন্দোলন চলছে। মাত্র কিছুদিন আগে কানাডা সেই দলে যুক্ত হয়েছে। তবে আমস্টারডাম হলো গাঁজা রাজ্যের রাজধানী। এখানে যে গাঁজা পাওয়া যায় তার তুলনা অন্য কোথাও পাওয়া মুশকিল।
‘গ্রীনহাউজ ইফেক্ট’ নামক এক কফিশপে ঢুকতেই গাঁজার বোঁটকা গন্ধ এসে নাকে লাগলো। মেন্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত ব্লেন্ডের গাঁজার নাম লেখা। পাশে কোনটা কতটুকু শক্তিশালী তাও উল্লেখ করা আছে। গ্রামপ্রতি ১০ থেকে ৩৫ ইউরো খরচ করলে আপনি তা চেখে দেখতে পারবেন। গাঁজা মেশানো কেকের (হ্যাশ ব্রাউনী) দাম পাঁচ ইউরো। সেটা খাবার ১ ঘন্টার মধ্যেই আপনি অন্য স্তরে উঠে যাবেন। আর গাঁজা দিয়ে বানানো সিগারেটের (জয়েন্ট) দাম সাত ইউরো। সামাজিকভাবে কফিশপে বসে জনসম্মুখে গাঁজা খাওয়ার এই দৃশ্য দেখে আমি বেশ অভিভূত হয়ে গেলাম। কালি কুশ নামক এক বেগুনী বর্ণের গাঁজার বাহার দেখে কিছুটা আগ্রহ জন্মালো। তার দাম জিজ্ঞাসা করতেই মানিব্যাগটা কামড় দিয়ে বসলো।
ব্যাপারটা কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য আমরা সবাই দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলাম। বেশ ছোট একটা রুমে ২০-২৫ জন মানুষ একত্রে গাদাগাদি করে গাঁজা সেবন করছে। আমার ঠিক উল্টাপাশে তিনজন আরব্য রমণী বসে আছেন। মুসলিম বিশ্বের এই তিন বোনের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ জুড়বার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলাম। ইতোমধ্যে ম্যাক তার পাশে বসে থাকা বিশালাকৃতির এক আমেরিকান ভদ্রলোকের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলছে। সংগত কারণে বাঁধন আর অমিতা হাসি থামাতে পারছে না। ম্যাকের এই নতুন বন্ধুর নাম অ্যান্টন। অ্যান্টন ঠোঁটের কোণায় একটা জয়েন্ট ধরিয়ে তার আইপ্যাডে কার্টুন আঁকছে। তার সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম, সে হলিউডে স্ট্যান্টম্যান হিসেবে কাজ করে। বড় বড় বিল্ডিং থেকে জীবন বাজি রেখে মোটর সাইকেল নিয়ে সে লাফ দেয়। অবসর সময়ে সে নিজের কার্টুন চরিত্রকে সঙ্গ দেয়। আমস্টারডাম এসেছে একা; উদ্দেশ্য আমাদের মতো ভবঘুড়ে মানুষের সাথে বসে আড্ডা দেয়া। ব্যস! এক রাতের জন্য অ্যান্টন আমাদের দলের অংশ হয়ে গেল।
গাঁজার গন্ধের একটা বড় প্রভাব হলো তা প্রচুর খিদের উদ্রেগ ঘটায়। আমরা সবাই তাই পার্শ্ববর্তী এক ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকে ইচ্ছেমতো চিপস আর বার্গার মুখে পুড়লাম। তারপর অ্যান্টনকে বিদায় জানিয়ে সেরাতের মতো আমাদের নীড়ে ফেরত গেলাম। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীরটাকে কোনমতো সোফার ওপর বিছিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই গভীর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
পরদিন সকাল ন’টায় ঘুম ভাঙলো আমার। বন্ধুরা তখনো অচীন দেশে। অগত্যা আমি পাউরুটি আর সসেজ দিয়ে কোনমতে নাস্তা সেরে বাহিরে বের হয়ে আসলাম। মেট্রোতে উঠে সোজা চলে গেলাম আমস্টারডামের বিখ্যাত কফিশপ ভাস্কোবেলোতে। এই জায়গাটা কফি আর বইয়ের জন্য বিখ্যাত। আমার খুবই পছন্দের দুটো বস্তু এখানে একসাথে পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপের নামকরা যেকোন শহরে নাস্তা/কফির জন্য বেশ ভালো পয়সা খরচ করতে হয়। কিন্তু, সুন্দর একটা জায়গায় বসে থাকার জন্য এক কাপ অামেরিকানো অর্ডার করে ল্যাপটপটা খুলে “হাইজেনবার্গের গল্প” বইটার অসমাপ্ত অধ্যায়গুলো লেখা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমার মতো অনেকেই বেশ ভুরু কুচঁকে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে লিখে যাচ্ছে। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, আমি জায়গা মতো চলে এসেছি।
এই ট্রিপের পরবর্তী চারদিন আমি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কফি শপে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লিখে গেছি বিজ্ঞানের বেশ কিছু জনপ্রিয় গল্প; একটু পর পর চুমুক দিয়েছি কফির কাপে। প্রায় বেলা একটায় গিয়ে আমার লেখা শেষ হতো। তখন আবার মেট্রো করে বাসায় ফেরত আসতাম। সবাই মিলে বাসায় রান্না করে দুপুরের খাবার খেয়ে অনেক টাকা সাশ্রয় করেছি। বিকেল নাগাদ দলেবলে আবার ফেরত যেতাম শহরের কেন্দ্রে।
সফরের তৃতীয় দিন আমাদের উদ্দেশ্য একটু ভিন্ন। সন্ধ্যা বেলা নিউ মার্কেট স্টেশনে নেমে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটার পর একটা মোহান্বিত রাস্তায় প্রবেশ করলাম। চিকন এক নালার দুই পাশের রাস্তায় লাল রঙের বাতি জ্বালানো। বুঝতে বাকি রইলো না, এই সেই বিখ্যাত “রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট”।
মানব সভ্যতার প্রথম পেশাগুলোর একটি হলো পতিতাবৃত্তি। আমাদের দেশে এই পেশার মানুষদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই। তবে আমস্টারডাম সেই বিবর্তনে অনেক যুগ সামনে। রেড লাইট ডিস্ট্রিক্টে বেশ সাজানো গোছানো দোকানের মতো বেশ্যা ব্যবসাটা গড়ে উঠেছে। রাস্তার দুই ধারে অনেকগুলো ছোট ছোট কাঁচের জানালা। প্রতি জানালায় দাঁড়িয়ে আছে অসম্ভব সুন্দর করে সাজা স্বল্প বসনা কিছু মেয়ে। জানলার সমানে একদল ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের রূপসুধা উপভোগ করছে। মেয়েগুলো একটু পর পর তাদের নিতম্ব কাঁত করে যুবক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত হেঁটে গেলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ব্লন্ড, ব্রুনেট, স্লিম, হেভী, এশিয়ান বিভিন্ন গোত্রের পতিতার দেখা মেলে। তাদের সার্ভিসের মূল্য প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ইউরো। খদ্দেরদের অধিকাংশই ব্রিটিশ ভদ্রলোক!
লাল আলোর কলিযুগে হাঁটার এক সময় আবিষ্কার করলাম “কনডম মিউজিয়াম”। এই রাবারের জন্মনিধোরকের ইতিহাস, প্রকৃতি, বিচিত্রতা দেখে আমি বেশ মুগ্ধ। প্লাস্টিকের ছোট ছোট কাঁটা যুক্ত কনডম যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তা আমার ধারণায় ছিলো না। তবে আমস্টারডাম আমার সেই চেতনা বদলে দিলো। কনডম মিউজিয়ামের ঠিক পাশেই চলছে সেক্স শো। ব্যাপারটা অনেকটা লাইভ পর্ণ দেখার মতো। তবে সবকিছুর দামই থাইল্যান্ডের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ বেশী। প্রায় ঘন্টা দুয়েক সেই পাপের রাজ্যে হেঁটে বেড়ানোর পর আমরা সবাই ফিরে গেলাম গ্রিন হাউজ ইফেক্টে। আজকে দোকানটার বাহিরে বসে সবাই মিলে তুমুল আড্ডা জুড়ে দিলাম; পরিকল্পনা করতে থাকলাম পরবর্তী দিনগুলো। আমি বেশীক্ষণ বসে থাকার বান্দা নই। তবে অমিতা রাতে কেক বেক করার টোপ ফেলে আমাকে বাসায় নিয়ে গেলো। সেই রাতের কোন এক পর্যায়ে আমি, বাঁধন আর ম্যাক বসে নিজেদের পুরোনো বান্ধবীদের স্মৃতিচারণের প্রতিযোগীতায় নামলাম; সেই প্রতিযোগীতার বিজয়ী সবার প্রথমে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো।
পরদিন যথারীতি ঘুম ভাঙলো সকাল ন’টায়। আজকে বাসার নিচের কফিশপটায় ঢুকলাম। এটা খুব সুন্দর একটা রিডিং স্পেস। এক কাপ কফি কিনে এখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা লেখালেখি করা যাবে। ব্যস! কি আর লাগে? আমি কাজে নেমে পরলাম। My Coffee নামক সেই দোকানে বসে “ভুল যখন ভালো” শিরোনামে ফ্লেমিং সাহেবের পেনিসিলিন আবিষ্কারের কাহিনী বর্ণণা করে ফেললাম। তবে আজ বেলা ১১-টায় লেখা ইস্তফা দিতে হলো। কারণ, রাইসা “স্যান্ডিম্যান’স ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর” নামক একটা ব্যাপার খুঁজে বের করেছে। একটা শহরের ইতিহাস তার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে জানার জন্য এই ট্যুরগুলো বেশ কার্যকরী।
ট্যুর গাইড সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। এই গাইডদের অনেকেই বেশ ম্যারম্যারে কন্ঠে ইতিহাস বলে যায়; সেটা বেশীক্ষণ শুনতে কারো ভালো লাগে না। তাই আমি এই জিনিসগুলোর খুব বড় ভক্ত নই। তবুও বন্ধুদের সাথে স্যান্ডিম্যান সাহেবের ট্যুরে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। জীবনের অন্যতম ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো এটা।
বেলা দুটো নাগাদ আমাদের পরিচয় হলো ‘পল’ নামক এক স্কটিশ তরুনের সাথে। সে থিয়েটার আর্টসের ছাত্র; অবসর সময়ে বাড়তি কামাইয়ের জন্য ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করে। তবে এটা ফ্রি ট্যুর। তার মানে আমরা টাকা দেয়ার জন্য বাধ্য নই। পল আমাদেরকে তিন ঘন্টার জন্য আমস্টারডাম ঘুরে দেখাবে। সেই ট্যুর শেষে যদি আমরা খুশি হয়ে কিছু বকশিস দিতে চাই তাহলেই সে খুশি। কোন পয়সা না দিলেও সমস্যা নেই। ঝিরি ঝিরি আবহাওয়ায় ন্যাশনাল মনুমেন্ট স্কয়ারের পাশে উঁচু একটা জায়গায় এক কাপ কফি হাতে পল দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে সে বুঝিয়ে দিলো এটা কোন বোরিং ট্যুর না; বরং পুরো ট্যুরটাই একটা গেম শো। পল আমাদের ইতিহাস নিয়ে কুইজ জিজ্ঞাসা করবে; আমরা উত্তর দিবো। বিভিন্ন দেশের মানুষদের দলে ভাগ করা হলো। বাংলাদেশ আর আমেরিকার দলটা একটু ভারী।
আমার এখনো মনে আছে আমস্টারডামের পরিচয় দেয়ার জন্য পলের প্রথম লাইনটা—
Most people think Amsterdam is a city filled with drug, sex and prostitution. But, what people don’t realise is that it is also a city of great historic significance (long pause) filled with drug, sex and prostitution.
হাসির রোল পড়ে গেলো চারদিক জুড়ে।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করতে থাকলাম পলের গল্প। এটাকে ওয়াকিং ট্যুর না বলে থিয়েটার পার্ফর্মেন্স বললে অধিকতর যুক্তিযুক্ত হবে। ইতিহাসের ঘুম পাড়ানী বর্ণণাকে পল অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের কন্ঠ বদল করে করে আমাদের জন্য সুখময় করে তুললো। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সে যখন নেপোলিয়ন অথবা লুইর গল্প বর্ণণা করলো। ডাচরা হলো বিশ্বসেরা বণিক। নিজেদের জাহাজে করে তারা সেই বিখ্যাত স্পাইস রুটের সূচনা করেছিলো। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মসলা এনে ইউরোপের বাজারে তারা বিক্রি করতো। তবে মজার ব্যাপার হলো ডাচ খাবারে তেমন কোন মসলার ব্যবহার নেই। এই ব্যাপারে পলের উক্তি— “The Dutch never got high on their own supply.”
হাঁটার এক পর্যায়ে The atlas নামের একটা মূর্তির সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা বিল্ডিং-এর সদর দরজায় একজন মানুষের পিঠের উপর বড় একটা গ্লোব। সেই গ্লোবের ভাড়ে লোকটা নুয়ে পড়েছে। এই মূর্তির বেশ সুন্দর একটা মর্মার্থ আছে— “We dutch travel with the world on our back.” ব্যাপারটা চিন্তা করতেই বেশ শিহরে উঠছিলাম। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭’শ সালের দিকে বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছে। ব্যবসার নামে এরা অনেক দেশে গণহত্যার সাথেও জড়িত ছিলো। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ কলোনির অত্যাচারের গল্প বেশ হৃদয় বিদারক। এই সব ইতিহাসের গুরু তথ্য পল হাসির রোলে, গল্পের ছলে আমাদের মনে গেঁথে দিলো।
আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ডাচ লেখক এডওয়ার্ড ডুয়েস ডেকারের মূর্তির গল্পটা। ভদ্রলোক প্রথমে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। সেসময় ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের কাহিনী সে ‘মুলতাতুলি’ ছদ্মনামে তার বিখ্যাত উপন্যাস “ম্যাক্স হাভেলার”-এ তুলে ধরেন। তৎকালীন ডাচ সমাজে এর ফলে গনজাগরণের সূচনা হয় এবং অবশেষে কোম্পানি তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। মজার ব্যাপার হলো ‘মুলতাতুলি’ মানে হলে ‘আমি অনেক সহ্য করেছি’। পলের ভাষায় মুলতাতুলি ছিলো ১৭’শ সালের এডওয়ার্ড স্নোডেন।
মুলতাতুলির মূর্তির পাশেই আমস্টারডামের বিখ্যাত “গে প্রাইড স্কয়ার”। সেখানকার জেব্রা ক্রসিংগুলো রংধনু রঙের। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই মনটা ভালো হয়ে যায়।
পল এরপর আমাদের নিয়ে গেলো বিখ্যাত “অ্যান ফ্রাংক মিউজিয়াম” এর সামনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক ডাচ ইয়াহুদীরা এই শহরে বাস করতো। জার্মানী আমস্টারডাম আক্রমণ করার পর তাদের অনেকেই বছরের পর বছর ঘরের ভেতর লুকিয়ে ছিলো। এমন এক ইয়াহুদি পরিবারের কিশোরী মেয়ে ছিলো অ্যান ফ্রাংক। সে তার ডাইরীতে তার পরিবারের প্রতিদিনের যুদ্ধের গল্প লিখে রেখে গেছে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি অ্যান ফ্রাংকের। হিটলার বাহিনী অবশেষে তাদের ধরে ফেলে এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তাকে মেরে ফেলা হয়। তার সেই ডাইরী আজ সারা বিশ্বের অন্যতম বহুল পঠিত বই। আমার পাঠকদের প্রতি Anne Frank’s Diary পড়ার বিশেষ অনুরোধ রইলো।
কীভাবে তিন ঘন্টা পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। পলকে বিদেয় জানাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। আমরা সবাই এতো খুশি ছিলাম যে, পলকে ৫০ ইউরো বকশিস দিয়ে দিলাম। আমি এখন থেকে সবাইকে ইউরোপের যেকোন বড় শহরে গেলে এই স্যান্ডিম্যান্স ফ্রি ট্যুর নেয়ার জন্য অনুরোধ করি। এরা বেশ মজাদার ভঙ্গিতে শহরের ইতিহাসটা বর্ণণা করতে পারে।
ততক্ষণে সন্ধ্যা সাত-টা বেজে গেছে। আমরা সবাই দাড়িঁয়ে আছি জর্ডান নামক এক এলাকায়। ইউরোপিয়ান ক্ল্যাসিক মুভিগুলোতে আমস্টারডামের যে ছবি দেখানো হয় তা নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। গোধূলির আলোর সাথে রাস্তার সোডিয়াম বাতি মিলে মিশে বেশ সুন্দর একটা আবহাওয়া তৈরি করেছে। ফুটপাতের উপর একটু পর পর একটা ল্যাম্পপোস্ট; সেই পোস্ট থেকে একটা সুন্দর ফুলের টব ঝুলে আছে। ক্রিসমাস উপলক্ষে রাস্তায় মিট মিট করে মরিচা বাতি জ্বলছে। প্রিয়জনের সাথে এই রোমান্টিক সন্ধ্যায় হাত ধরে হেঁটে বেড়াতে পারলে এক্কেবারে মন্দ হতো না। যার জীবনে অনেক কিছু আছে সে একটা সাময়িক হাহাকার সৃষ্টি করে এক ধরণের মানসিক প্রশান্তি লাভ করে।
সেদিন বাকি রাত্র পার করলাম আমস্টারডামের রাস্তায় খাবারের দোকান খুঁজে। ইন্দোনেশিয়ান অঞ্চলের খাবারের পসরাটা এই শহরে বেশ ভালো। আমরা একটা ভিয়েতনামিজ রেঁস্তোরায় ঢুকে তাদের বিখ্যাত খাবার “ফা” অর্ডার করলাম। ফা (অথবা ফো) এক ধরণের নুডুলস স্যুপের মতো। জাপানিজ রামেনের তুলনায় এর ঝোলটা বেশ পাতলা; নুডুলসটা বেশ নরম। বিশাল বড় এক বাটিতে নুডুলসের ঝোলের উপর কয়েক টুকরা মাংস সাজানো থাকে। চপস্টিক দিয়ে ঠিক রামেনের মতো করেই খেতে হয়। আমার কাছে ঝালের আধিক্য খাবারের স্বাদের সমানুপাতিক। তাই, বেশ ঝাল দেয়া লালচে রঙের ফা দেখলে জিভে জল চলে আসেই।
খাবার শেষ করে ডিসেম্বরের শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা সবাই নিউ মার্কেটের কাছে চলে গেলাম। সেখানে একটা ঠেলাগাড়িতে করে ডাচদের বিখ্যাত খাবার “আলোওয়ালিয়ো” বিক্রি করা হচ্ছে। খুব সহজ ভাষায় বললে এটা আমাদের দেশের “তেলের পিঠা”। এক দলা আটা ডুবো তেলে ভেজে তার উপরে খানিকটা চিনি অথবা চকলেট সস ছড়িয়ে খাওয়া হয়। ক্রিসমাসের সময় এই বস্তুর কদর বেশ বেড়ে যায়। এর একটা বড় কারণ হলো ছুটির দিনে ডাচরা বেশ মদ্যপান করে। তৈলাক্ত খাবার খেলে সেই মাতলামিটা সহজে কাটানো যায়।
ডাচ তেলের পিঠা ভক্ষণের পর আমরা সবাই বুঝতে পারলাম শরীর বেশ ক্লান্ত হয়ে আসছে। আগামীকাল ৩১ ডিসেম্বর। আমস্টারডামে আমাদের শেষদিন। বছরের সায়াহ্ন লগ্নটা উপভোগ করার জন্য আজ ভালো করে ঘুম দরকার। তাই সবাই ভদ্র বাচ্চার মতো বাসায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন যথারীতি আমার ঘুম ভাঙলো সকাল ৯-টায়। ঘুম থেকে উঠে বাসার নিচের বেকারী থেকে একটা ক্রঁসো আর কফি খেয়ে চলে গেলাম ওপেরা হাউজের দিকে। সেখানে একটা সুন্দর কফিশপে বসে আমার প্রথম বইটার শেষ অধ্যায়টুকু লেখা আরম্ভ করলাম। বেলা সাড়ে এগারোটায় ঠিক যে মুহুর্তে শেষ লাইনটা লিখে ফেললাম, মনে হলো জীবনে নতুন কিছু একটা অর্জন করে ফেলেছি। দেরী না করে আমার প্রকাশককে বইয়ের পান্ডুলিপিটা পাঠিয়ে পুরাতন বছরের জমে থাকা কাজের তালিকটা দায়মুক্ত করলমা। আহ! কী সে আনন্দ! বছরের শেষ দিন আমি সাধারণত প্রত্যেকটা বছরকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লিখি। ফেসবুকের মেমোরিতে সেটা আমাকে প্রতিনিয়ত নিজের জীবনের উপর স্বীয় উপলব্ধিকে মনে করিয়ে দিতে থাকে। বেলা বারোটা নাগাদ আমি ২০১৮ সালকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিটা পোস্ট করে ফেললাম। একটা বছরে মোট ১৭টা ভিন্ন শহরে ঘুরেছি! ২০১৮ সাল নি:সন্দেহে আমার জীবনের অন্যতম রোমাঞ্চকর অধ্যায়।
লেখক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে এরপর আমি পেটপূজোর উদ্দেশ্যে ছুটলাম মিউসিয়ামপ্লিন নামক এলাকায়। সেখানে একটা ক্রিসমাস মার্কেট বসেছে; যথারীতি পাওয়া যাচ্ছে রকমারী খাবার। ফুড ক্রিবের স্টল থেকে বেশ বড়সড় একটা হ্যামবার্গার খেয়ে নিজের ক্ষুধার্ত পেটের আন্দোলন দমিয়ে আনলাম। মার্কেটের পাশেই বেশ বড়সড় একটা সবুজ মাঠ। তার ঠিক অন্যপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে— “ভ্যান গহ মিউজিয়াম”। ভিনসেন্ট ভ্যান গহের নাম শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্টারি নাইট নামক বিখ্যাত সেই ছবির এই জাদুকরের চিত্রকর্ম আর জীবনের উপর গড়ে উঠেছে এই সুবিশাল মিউজিয়াম। নেহায়েত সময়ের অভাবে সেটা ঘুরে দেখাতে পারলাম না। তবে ভবিষ্যৎ আমস্টারডাম ট্রিপের জন্য একে তালিকাবদ্ধ করে রাখলাম।
মিউজিয়াম এলাকা হতে একটা ট্রামে চড়ে ফেরত গেলাম সেন্ট্রাল স্টেশনে। তবে এবার কোন ট্রেন/মেট্রোতে না চেপে বরং চলে গেলাম ফেরী ঘাঁটের দিকে। সেখানে বন্ধুদের সাথে আমার পুনর্মিলন ঘটলো। বিনামূল্যে এই ফেরীতে চড়ে নদীর ওপারের উত্তর হল্যান্ডে চলে যাওয়া যায় যাকে “আমস্টারডাম নুর্ড” বলা হয়ে থাকে। প্রায় মিনিট দশেকের এই নদীপথ ভ্রমণে আমরা দুপাশের ব্যস্ত নগরীর আলোকিত শোভায় নয়ন জুড়িয়ে নিলাম। নুর্ড একটু গ্রাম্য এলাকা; এখানে ঘর-বাড়ি কম। তবে একটু পর পর বেশ সুন্দর সুন্দর পাব রয়েছে। সন্ধ্যা নাগাদ সেখানে ভীড় জমিয়েছে হল্যান্ডবাসীরা।
আমরা চলে গেলাম নুর্ডের সবচেয়ে আইকনিক ভবন— “আইফিল্ম মিউজিয়াম”। বিল্ডিংটা বেশ অভিজাত কিসিমের একটা সিনেমা হল। তবে সেখানে আলোকচিত্র এবং ক্যামেরার বিবর্তনের একটা সুন্দর মিউজিয়ামও রয়েছে। নীচ তলাটা ফাইন ডাইনিং এবং কফি পানের স্থান। আমরা সবাই মিলে সেখানে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিজেদের পুরোনো বছরের হালখাতাটা চুকিয়ে নিলাম। দেনা-পাওনার হিসেবে সবাই খুবই খুশি। এখন সবাই মিলে একটা সুন্দর জায়গা খুঁজে বের করে আতশবাজি দেখার পালা। নতুন বছরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তো সেটাই!
কিছুক্ষণ গুগল বন্দনার পর বুঝতে পারলাম, জাভা আইল্যান্ড নামক জায়গাটা আতশবাজি দেখার জন্য সবচেয়ে সুন্দর। সবাই মিলে তাই হুমড়ি খেয়ে বাসে উঠে পঞ্চাশ মিনিট লাগিয়ে জাভা আইল্যান্ডে গিয়ে নামলাম। আমরা আশা করছিলাম অসম্ভব আলোকিত কোন পার্টি টাউনে যাচ্ছি। কিন্তু, প্রথম দর্শনেই জাভা আইল্যান্ড সে উন্মাদনা কেড়ে নিলো। এলাকাটা বেশ নির্জন এবং নীরব। অনেকক্ষণ পর পর একটা দুইটা গাড়ির দেখা মেলে। এখানে কেন আসলাম তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক সেই মুহুর্তে আমার মূত্র বিসর্জনের তীব্র উপদ্রপ হলো। আশে পাশে কোন পাব/রেঁস্তোরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। প্রায় ১৫ মিনিট হাঁটার পর চোখে পড়লো একটা পানশালা। সেখানে প্রবেশ করতেই একটু হচকে গেলাম।
পুরো পাবের সবগুলো টেবিল একসাথে জড়ো করে প্রায় ৩০ জন মিলে ডিনার করছে। আমার মতো একজন বাংলাদেশী আগুন্তকের দেখা পেয়ে পাবের মালিক এগিয়ে এলো। আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললো যে, এখানে শুধু পরিচিত মানুষজন থাকতে পারবে। তাই আমি যাতে টয়লেটের কাজ সেরে সোজা রাস্তায় চলে যাই।
যেই কথা, সেই কাজ। আমি ঢুকলাম ওয়াশরুমে। বের হয়ে দেখি আমার বন্ধুবান্ধব কাহিনী ঘটিয়ে ফেলেছে। সাকিব ইতোমধ্যে পাবের কয়েকজন বুড়ো কাপলদের সাথে কথাবার্তা বলে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। এক ডাচ ভদ্রলোক তো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে, বাংলাদেশের ৫ জন ছেলে-মেয়ে অক্সফোর্ডে পড়ছে। সে আমাদের সবাইকে অন-দ্য-হাউসে ড্রিংকস দিয়ে যেতে বললো। উনি আমাদেরকে পাবের মালিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ভদ্রলোকও লন্ডনে পড়াশোনা করেছে। এক অক্সফোর্ড লোগোর কারণে পাব থেকে বের করে দেয়ার বদলে আমাদেরকে জামাই আদর করা শুরু করা হলো। এক গ্লাস শেষ না হতে পরবর্তী গ্লাস ড্রিংকস এসে হাজির হচ্ছে; প্লেটের পর প্লেট আলোওয়ালিয়ো আসছে একটু পর পর। বাহ! আর কি লাগে। বছরের শেষটা আমাদের বেশ জমতে শুরু করেছে।
ন্যাশ নামক ষাটোর্ধ এক ভদ্রলোকের সাথে আমি অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলাম। পেশায় তিনি গণিতবিদ; কাজ করেন এক ব্যাংকে। টাকার হিসেব মেলাতে পটু এই পুরুষ বছরের শেষ সন্ধ্যায় আমার সাথে বসে জীবনের হিসেব মিলাতে শুরু করলেন। আমাকে বার বার করে বললেন, জীবনে একবার ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পেলে তাকে কখনো যেতে দিয়ো না। আমি হালকা হেসে বললাম, “You are too late.”
ঘড়িতে ১১.৫০ বাজে। আমরা সবাই আতশবাজি দেখতে বাহিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ পাবের মালিক এসে আমাদের হাতে এক গ্লাস করে শ্যাম্পেইন ধরিয়ে দিয়ে গেলো আর মুচকি হেসে বললো, “Have a wonderful new year, guys.” আমরা তাকে বিদায় জানিয়ে ঠিক নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের দুদিকেই আমস্টারডাম শহর। মাঝখানের এক দ্বীপের উপর আমরা ছয়জন দাঁড়িয়ে। রাত ঠিক বারোটা বাজতেই আকাশ কাঁপিয়ে, চোখ ধাঁধিয়ে একের পর এক আতশবাজি ফুটতে লাগলো। সেই দৃশ্য বর্ণণা করার মতো দক্ষতা এই অধমের নেই। প্রতিটা বাজি আকাশে ফুটতেই আমস্টেল নদীর উপর সুন্দর একটা আভা ভর করে; কয়েক মুহুর্ত পরেই সেটা মিলিয়ে যায়। তীরের দিকে ধেয়ে আসা ছোট ঢেউগুলোকে আতশবাজির আলোয় বেশ মোহময় লাগছিলো। সেই মোহ যেন কাটবার নয়!
রাত প্রায় ১-টার দিকে আতশবাজিগুলো ঘুমিয়ে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আমস্টেল নদীর তীরে। হঠাৎ দেখতে পেলাম নতুন এক বন্ধু এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তার নাম ২০১৯। রোমাঞ্চে আমার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। নতুন বছরের উচ্ছ্বাসে জাভা আইল্যান্ডের কোণায় নিজের জীবনের আরো একটা বছরের ডাইরী শেষ করলাম।
I am sterdam.