টাইটানিক, গেম অফ থ্রোন্স, বেলফাস্ট
May 27, 2020 | 5123
এপ্রিল, ২০১৯। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে স্টুটগার্ট থেকে ফেরৎ আসার পর পরই ল্যাবের কাজ শুরু হয়েছে। এক টানা প্রায় ৪৫ দিন ধরে ডাটা উৎপাদন করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এক স্কাইপ মিটিং-এ সাউথ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড আর অক্সফোর্ডের গ্রুপ একসাথে হলো। আমি আমার আবিষ্কারগুলো উপস্থাপন করলাম। সবাই শকুনের চোখ দিয়ে খুটে খুটে তা যাচাই করে দেখলো। মিটিং শেষে আমার বস সাজিয়া এসে বললো, “Shamir, why don’t you take a week off?”
ব্যস! আমার খুশি আর কে ঠেকায়?
এক সপ্তাহের বদলে আমি মাত্র একটা শুক্রবার বন্ধ নিলাম। এবার আমার খপ্পড়ে পড়ে ইফতি টিকেট কাটতে বাধ্য হলো। বেচারার ল্যাবের প্রচন্ড প্রেশার চলছিলো। কিন্তু, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ বলে কথা।
২৬ এপ্রিল শুক্রবার সকাল নয়টায় লন্ডন থেকে হালকা চিলের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম। বেলা সাড়ে দশটায় নর্দান আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্টে এসে হাজির হলাম। যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরের মতো বেলফাস্টেও সারাদিন ঝির ঝির বৃষ্টি হয়; আকাশটা কালো হয়ে থাকে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে শহরের দিকে যাবার জন্য বাসে উঠলাম। হতাশার ব্যাপার হলো, এরা কার্ড পেমেন্ট নেয় না। মনে মনে গালি দিয়ে নিরুপায় আমি তখন এটিএম বুথ খুঁজছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে এক ইটালিয়ান ছেলে এসে কথা বলা শুরু করলো। সুদর্শন এই ভদ্রলোকের নাম ইমানুয়েল; পেশায় সে ইজিজেটের স্পাই!
ইমানুয়েল আর আমি একই প্লেনে চড়ে এসেছি। ইমানুয়েলের কাজ হলো যাত্রী সেজে ফ্লাইটে ঘুরে বেড়ানো আর প্রতিটা এয়ার হোস্ট্রেসের কাজের রেটিং দেয়া। সকালের ফ্লাইটে সে বেলফাস্ট এসেছে; সন্ধ্যার ফ্লাইটে লন্ডন ফেরত যাবে। মাঝখানের সময়টায় সে এই নতুন শহরটা ঘুরে দেখবে। কি মজার চাকরী!
দুজনে মিলে বাসে বসে গল্প করতে শুরু করলাম। বেলা বারোটা নাগাদ কুইন্স স্কয়ার স্টপে এসে আমি নেমে গেলাম। ইমানুয়েল বললো, “চলো আমরা এক সাথে বেলফাস্ট ঘুরে দেখি!” আমি বললাম, “ব্যাগটা রেখে আমি চলে আসবো। তোমার নাম্বারটা দাও।”
কুইন্স স্কয়ারে নেমেই যে জিনিসটা প্রথমে চোখে পড়বে তা হলো আলবার্ট মেমোরিয়াল ক্লক। বেলফাস্টের যে কোন ক্লাসিক ছবিতে এই ক্লক টাওয়ারটা থাকবেই। স্কয়ারটার আশে পাশে অনেক গুলো পানির ফোয়ারা; সেগুলো বেশ ছন্দ মিলিয়ে একটু পর পর মাটি থেকে পানি ছুড়ে মারছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো শুক্রবার দুপুর বারোটার মাঝেই রাস্তায় আইরিশ মাতালদের পড়ে থাকতে দেখলাম। বোঝা গেলো, আমি আয়ারল্যান্ডে চলে এসেছি।
একটা উবার ডেকে কুইন্স স্কয়ার থেকে চলে গেলাম এয়ার বিএনবির ভাড়া করা বাসায়। পথিমধ্যে উবার ড্রাইভার জন আমাকে বেলফাস্টের বিখ্যাত টেরোরিস্ট পেইন্টিং দেখাতে থাকলো। নর্দান আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসটা বেল কালো; সেখানে এখনো ক্যাথলিক-প্রোটেস্টানদের মধ্যবর্তী বিবাদ বিরাজমান। আয়ারল্যান্ড রিপাবলিকান আর্মি (IRA) রাস্তায় রাস্তায় বন্দুকের যোগান বাড়ানোর দাবীতে স্লোগান লিখে রেখে গেছে। ভাবতেই অবাক লাগে, এই যুগেও পশ্চিমা বিশ্বে এই রকম ভয়ানক অবস্থা বিরাজমান।
আমার হোস্টের নাম ড্যানিয়েল; পেশায় ফ্যাশন ম্যাগাজিনের এডিটর। প্রচন্ড সুদর্শন এই ছেলেটা ক্ল্যাসিক ইউরোপিয়ান লাইফ উপভোগ করছে। তার তিন বেড রুমের আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। নিজে বড় বেডরুমে থাকে; বাকী দুটো রুম এয়ার বিএনবি-তে ভাড়া দেয়। আমাকে বাড়ির খুটিনাটি বুঝিয়ে দিয়ে ড্যান কাজে ফেরত গেলো। তার সুপারিশ মতে আমি Kelly’s Cellars নামক পাবে লাঞ্চের জন্য যেতে মনস্থির করলাম। ওয়াটসঅ্যাপে ইমানুয়েলকেও লোকেশন পাঠিয়ে দিলাম।
বেলা আড়াইটা নাগাদ KC-এর সামনে যেয়ে দেখি ইমানুয়েল পরম শান্তিতে বিড়ি ফুঁকছে। আমি পাবের ভিতরে ঢুকে আয়ারল্যান্ডের দুই বিখ্যাত জিনিস অর্ডার করলাম— আইরশ স্টু আর গিনেস বিয়ার।
স্টু হলো আলু আর গরুর মাংসের একটা গাঢ় ঝোল; তেমন কোন মশলা এতে নেই বললেই চলে। এক টুকরা রুটির সাথে গরম গরম স্টু খেতে খেতে এক পাইন্ট ঠান্ডা গিনেসে চুমুক দিলাম। আহ! মনটা শান্ত হয়ে গেলো। ইমানুয়েলের সাথে এবার শুরু হলো আমার ইয়ার-দোস্তি। ছেলেটা এককালে বারটেন্ডার হিসেবে কাজ করতো; এখন এয়ার লাইনে জব করছে। অক্সফোর্ডের বারের সস্তা মদের কথা শুনে সে সাথে সাথেই বলে ফেললো, “Shamir, when are you inviting me to Balliol bar?”
গিনেস আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত বিয়ার। গাঢ় কালো বর্ণের এই এলের দ্রবণ গ্লাসের নিচ থেকে উপরের দিকে ঘনমাত্রার এক ম্রিয়মান বর্ণালী তৈরী করে। ক্যানে বিক্রি করা গিনেসে কখনোই এই স্বাদ আর ঘনত্ব পাওয়া সম্ভব নয়। গিনেসের ক্যালোরী এতোটাই বেশী যে, আয়রিশ লোকগাথায় বলা হয়, “শুধু গিনেস আর কমলা খেলেই শরীরের সব পুষ্টি পাওয়া সম্ভব!”
ইমানুয়েলের কাছ থেকে জানতে পারলাম, বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজটা বানানো হয়েছিলো বেলফাস্টের শিপইয়ার্ডে। ঠিক সেই জায়গাটায় এখন টাইটানিক মিউজিয়াম অবস্থিত। খাবার শেষ করে আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম হারল্যান্ড অ্যান্ড উল্ফ শিপইয়ার্ডে। তবে মিউজিয়ামে ঢুকতে খানিকটা টাকা লাগবে ভেবে আমরা দুজনেই বাহির থেকে বিল্ডিংটা দেখে চলে আসলাম। শিপইয়ার্ডের ঠিক পাশেই একটা সাইনবোর্ডে লেখা “The Dock Cafe”. যথারীতি ইমানুয়েল আর আমি কফির গন্ধ শুকে ভেতরে গিয়ে বসলাম।
আমার জীবনে আমি অসংখ্য কফি শপে গিয়েছি। বিশ্বের অন্তত বিশটি শহরে কফি খেয়েছি। তবে দ্য ডক কাফেই আমার দেখা প্রথম জায়গা যেখানে কফির জন্য টাকা দিতে হয় না। দুই আইরিশ কাপল এই দোকানটা চালায়। আলিশান সোফার মাঝে অবস্থিত টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সুলতানা স্কোন, সিনামান বান আর ফিল্টার কফি। আপনি চাইলে যত খুশি খেতে পারবেন। বদলে নিজের ইচ্ছেমতো একটু দান করলেই হবে। তবে তা বাধ্যতামূলক নয়।
ইমানুয়েল আর আমি বেশ হতবাক! এ কী কান্ড! আমরা খুশিতে দশ পাউন্ড দান করে দুই কাপ কফি আর দুটো স্কোনের উপর গল্পের ঝড় তুলে দিলাম। বেলা সাড়ে পাঁচটার দিকে ইমানুয়েলের বিদায় ঘন্টা বাজলো। ইজিজেটের পরবর্তী ফ্লাইটের স্পাই আমাকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠে গেলো। তার শেষ লাইনটা ছিলো, “Shamir, hope to run in to you again.”
আমি বললাম, “ the world is round. Hence we will meet.”
ইমানুয়েল পর্ব শেষে এবার ‘সোলো হাইজেনবার্গ’ মুডে ঢুকে গেলাম। আমার কাছে ভ্রমণের অন্যতম প্রিয় অংশ হলো একা একা একটা শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো। প্রথমে চলে গেলাম ডোনেগাল স্কয়ারে; সেখানে বেলফাস্টের আলিশান টাউন হল অবস্থিত। ঠিক একই ডিজাইনের একটা টাউন হল নাকি সাউথ আফ্রিকাতেও আছে। এই তথ্য জেনে একটু অবাকই হলাম! পাশাপাশি, সাউথ আফ্রিকা-আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার ভালো সম্পর্কেরও খানিকটা আন্দাজ পাওয়া গেলো।
পাঠক, এবার আপনাকে বিরক্ত করতে আমি আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস খুবই সংক্ষেপে বলা শুরু করবো। কারণ, সেই ইতিহাস না জানলে এই শহরের চলমান অরাজকতার কথা আন্দাজ করা অসম্ভব।
বর্তমানে আয়ারল্যান্ড দুটো দেশে বিভক্ত— রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ড আর নর্দান আয়ারল্যান্ড। প্রথম দেশটার মানুষ প্রধানত ক্যাথলিক এবং জাতীয়তাবাদী; অন্যটার মানুষগুলো ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত এবং প্রটেস্টান। প্রথম দল চাইতো, পুরোটা আয়ারল্যান্ড একসাথে থাকবে। দ্বিতীয় দল চায় তারা যুক্তরাজ্যের অংশ হয়ে থাকবে। এই রেষারেষি চলছে প্রায় একশো বছর ধরে। অবশেষে ১৯৯৮ সালে Good Friday Agreement এর মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের একটা আংশিক সমঝোতা করা হয়। রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ডে চলে যায় সব ক্যাথলিকরা; তাদের রাজধানী শহর হয় ডাবলিন। অন্যদিকে প্রটেস্টানরা নর্দান আয়ারল্যান্ড হয়ে যোগ দেয় যুক্তরাজ্যে। মনে রাখতে হবে, এরা যুক্তরাজ্যের অংশ হলেও ব্রিটিশ নয়।
দু্ই আয়ারল্যান্ডের মাঝে আজো কোনো সীমানা নেই। কারণ, কোন চেকপোস্ট বসানো হলেই আইরিশরা সেটা গুলি করে উড়িয়ে দেয়। আপনি চাইলে বেলফাস্ট থেকে হেঁটে ডাবলিনে ঢুকে যেতে পারবেন। কোন ইমিগ্রেশন চেক হবে না!
তবে সবসময় তাদের মাঝে এরকম সমঝোতার অবস্থা ছিলো না। এককালে বিশাল বড় দেয়াল দিয়ে ক্যাথলিক-প্রটেস্টান সংঘর্ষ ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেই দেয়ালটা আজকের আয়ারল্যান্ডে The Peace Wall নামে পরিচিত। আমি বিকেল বেলা বাসে উঠে চলে গেলাম সেই দেয়াল দেখতে। বিভেদের প্রতীক এই ইটের ইমারতকে কেন এখন শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয় তা প্রথম দর্শনেই বোঝা যায়। এক মাইল লম্বা এই দেয়ালের গায়ে সারা বিশ্বের মানুষ শান্তির বার্তা লিখে গেছে। সে দেয়াল থেকে আমার পছন্দের কয়েকটি লাইন—
Love each other.
Remember, we are one.
Fuck Trump.
Fuck Cancer.
Use love as a weapon.
An eye for an eye will only make this world blind.
We were born different to co-exist in peace.
There is strength in struggle.
এবং বিটেলসের সেই বিখ্যাত লাইন, “All you need is love.”
আমিও সে দেয়ালে বড় বড় করে বাংলায় “শান্তি” শব্দটা লিখে আসলাম। হয়তো এই বইয়ের কোন পাঠক ভবিষ্যতে সেটা খুঁজে বের করবে।
বেলা সাত-টার দিকে আমি সিটি সেন্টারের নিকটবর্তী একটা পাবে ঢুকে বসলাম। সেখানে লাইভ মিউজিক হচ্ছে; কয়েকটি আইরিশ পরিবার একসাথে একটা টেবিলে বসে আছে। তাদের সংস্কৃতি কিছুটা সনাতনী ধাঁচের। অক্সফোর্ডের পাবের মতো চাইলেই কোন সুন্দরী মেয়ের কাছে যেয়ে গল্প করা সম্ভব না। কারণ, সেই মেয়ের বাবা-মাও আশে পাশে বসে আছে।
আমি বারের সামনের টুলে বসে গান শুনছি। আমার পাশে এক বয়স্ক মহিলা বসে আছেন; তার নাম জেন। হঠাৎ করেই জেন আমার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। তার স্বামী ফিলিপও পাশেই বসে আছে। জেন-ফিলিপ দম্পতির একমাত্র সন্তান ক্যাম্ব্রীজে পড়ছে। আমি অক্সফোর্ডের ছাত্র বুঝতে পেরে তারা খুশিতে আমাকে একের পর এক গিনেসের পাইন্ট কিনে দিতে থাকলো। আমিও জেন-ফিলিপের সাথে গল্পে গল্পে আইরিশ ইতিহাস জেনে নেয়ার প্রচেষ্টায় লেগে গেলাম। প্রায় তিন ঘন্টা গল্পের পর ফিলিপ বললো, “শামীর, তোমাকে আমি আমার প্রিয় পাবে নিয়ে আরেকটা গিনেস খাওয়াতে চাই।” আমি সম্মতিতে মাথা ঝাঁকালাম।
১৫ মিনিটের মাথায় আমরা সবাই আবার সেই কেলী’স সেলারে হাজির। তবে এই সময় পাবটা বেশ জমে উঠেছে। ফ্রাইডে নাইটে সবাই এখানে এসে গায়ে গা লাগিয়ে আগুনের সামনে বসে থাকে। বিয়ার খায়; গান শুনে। জন-ফিলিপ-শামীরও সেই জটলায় মিশে গেলো।
পাঠক, এই পর্যায়ে আপনি হতো ভাবছেন, ইফতি কই?
ইফতি আসলে শুক্রবার ছুটি পায় নি। তাই সে ল্যাব শেষ করে সন্ধ্যার ফ্লাইটে বেলফাস্ট আসছে। রাত্রি ১১-টার দিকে আমার আইমেসেজে বার্তা আসলো, “I am outside. Come and get me.”
আমি বাহিরে এসে দেখলাম বৃষ্টি জর্জরিত এক রকেট সায়েন্টিস্ট দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভেতরে নিয়ে গিনেসের গ্লাস ধরিয়ে দিলাম। এবার ইফতি-জেন-ফিলিপ গল্প জুড়ে দিলো। আমি বারের সামনে বসে থাকা বান্ধবীদের সাথে “ছোট কথা” বা “স্মল টক” শুরু করলাম। তাদের একজন আমার ফোন নিয়ে একের পর এক বেলফাস্টের দর্শনীয় জায়গাগুলোর নাম লিখে দিলো। আর কানে ফিস ফিস করে বললো, “I have saved my number in your phone. Call me if you can remember my name tomorrow.” দু:খের বিষয় হলো, সেই বান্ধবীর নাম আমি আজো মনে করতে পারিনি।
রাত সাড়ে বারোটায় ইফতি একটা উবার ডেকে আমাকে জোর করে গাড়িতে তুললো। রাস্তায় কিছু আইরিশ কেন জানি আমাদের দেখে “পাকি পাকি” বলে গালি দিচ্ছিলো। কিন্তু, ইফতি আমাকে বলপূর্বক সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য করলো। পথিমধ্যে ম্যাক ডোনাল্ড’স থেকে বেচারা তার রাতের ডিনার প্যাক করে নিলো। বাসায় ফিরে আমরা খেয়ে দেয়ে সোজা বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আমার ঘুম ভাঙলো। নিচ তলার কিচেনে গিয়ে আমি ব্রেকফাস্ট বানাতে শুরু করলাম। আটটার মধ্যেই ইফতি এসে যোগ দিলো আমার সাথে। সাড়ে আটটায় আমরা আবার সিটি সেন্টারে হাজির। আজকের প্রধান উদ্দেশ্য— গেম অফ থ্রোন্স ট্যুর!
হ্যাঁ! ঠিকই ধরতে পেরেছেন। বিখ্যাত এই টিভি সিরিজের বেশ বড় একটা অংশের শ্যুটিং হয়েছে নর্দান আয়ারল্যান্ডে। ট্যুর গাইড কোম্পানিগুলো আপনাকে বাসে করে সেই লোকেশনে নিয়ে যাবে এবং ঘুরিয়ে দেখাবে। জনপ্রতি খরচ পড়বে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আমি ট্রিপ অ্যাডভাইজারের মাধ্যমে আগে থেকেই আমাদের দুজনের ট্যুর বুকিং দিয়ে রেখে ছিলাম।
বাস ছাড়বে সকাল সাড়ে নয়টায়; বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমরা দুজনে পাশের একটা স্টারবাকসে গিয়ে ঢুকলাম। আধা ঘন্টা হাতে আছে দেখে দুজনে দুকাপ কফি নিয়ে আলিশান আড্ডা জুড়ে দিলাম। সাড়ে নয়টায় বাহিরে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমাদের গেম অফ থ্রোন্সের বাস চলে গেছে। এখন সাধারণ একটা বেলফাস্ট ট্রিপের বাস ছাড়বে। তারা দয়া পরবশ হয়ে আমাদেরকে সেই বাসে তুলে নিলো।
আমার মেজাজটা হাল্কা খারাপ হলো। কিন্তু, বাস ছাড়ার পর যখন আমাদের আইরিশ ট্যুর গাইড কথা বলা শুরু করলো, আমি আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না। আইরিশ অ্যাকসেন্ট ব্রিটিশদের তুলনায় বেশ ভিন্ন রকমের। ইফতির ভাষ্যমতে, “অক্সফোর্ডের ছাত্রদের উচিত আয়ারল্যান্ডে এসে ইংলিশ কোচিং সেন্টার খোলা।”
অসম্ভব বাজে রকমের বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু, আমি সবসময় একটা কথা বলি— “The destination doesn’t matter. What matters is the journey.”
সঙ্গী ভালো হলে যেকোন ট্রিপ মজার হয়ে যায়। আমি আর ইফতি মিলে আইরিশ ইংলিশের কোড ব্রেক করে তার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। বেলফাস্ট হলিউডের বিখ্যাত শ্যুটিং স্পট। The Shaw Shank Redemption ছবির খানিকটা শ্যুটিংও এখানে হয়েছে। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরকে হাতের ডান দিকে রেখে পাহাড় কেটে বানানো রাস্তা দিয়ে আমাদের বাস ছুটে চলছে। আটলান্টিকের বড় বড় ঢেউ পাড়ে এসে ঝুম ঝুম বৃষ্টির সাথে মধুর মিলন ঘটাচ্ছে। প্রায় এক ঘন্টা পর বাস থামলো ক্যারিকফারগাস ক্যালেসের সামনে। সাধারণ দিনে এই জায়গাটায় অনেক পর্যটক ভীড় জমায়। কিন্তু, বৃষ্টি দেখে কেউ বাস থেকে নামছে না। আমি আর ইফতি মিনিট দশেকের জন্য নেমে বাতাসের দাপটে দেখে অবশেষে ফিরে যেতে বাধ্য হলাম।
আবার ছুটলো বাস। এবার গিয়ে থামলো ক্যারিক-আ-রিড রোপ ব্রীজে। এই জায়গাটা আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মাঝে অন্যতম। এখানে দড়ির তৈরি একটা ব্রীজ রয়েছে। আট পাউন্ডের টিকেট কেটে সেই ব্রীজ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। গেম অফ থ্রোন্সের গ্রেজয় বংশের দুই ভাই— ব্যালন আর ইউরন গ্রেজয় এই ব্রীজের উপর তাদের সেই বিখ্যাত ডুয়াল যুদ্ধ করেছিলো। তবে, দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, বিরূপ আবহাওয়ায় এই ব্রীজে কাউকে উঠতে দেয়া হয় না। ট্যুর গাইড আমাদেরকে সান্ত্বনা দিতে বললো, “At least none of you will be losing your phone on the bridge today.”
এই ব্রীজের অবস্থান আয়ারল্যান্ডের একদম শেষ প্রান্তে। সেই জায়গার আটলান্টিকের সৌন্দর্যটা ভীষণ রকমের নেশার উদ্রেক ঘটায়। ইফতি আর আমি কোন ভাবেই বাসে ফেরত যেতে চাইছিলাম না। মনে হচ্ছিলো, মাটি থেকে খানিকটা স্বর্গ আলাদা হয়ে আটলান্টিকের মাঝে ভেসে আছে। পানিটা সেখানে অদ্ভূদ নীল; দ্বীপটা মোহময় সবুজ।
অবশেষে সৌন্দর্য দর্শনে ব্যঘাত ঘটালো আমাদের পাকস্থলী। খিদে লেগেছে প্রচন্ড। আমাদের বাসের পরবর্তী স্টপ একটা গ্রামের রেঁস্তোরায়। সেখানে আমি অর্ডার করলাম সী-ফুড চাউডার; আর ইফতির জন্য আমেরিকান বার্গার। গিনেস আসলো গ্লাসে গ্লাসে। চিংড়ি, অক্টোপাস, স্কুইডে ভরপুর সেই স্যুপের গরম ভাবটা এখনো আমি অনুভব করতে পারি। সাদা বর্ণের অসাধারণ সেই সামুদ্রিক প্রাণীর ঝোলটা অনেক শহরেই পরে খুঁজেছি; কোনটাই আইরিশদের হার মানাতে পারেনি। নিজেকে এখন এই বলে আশ্বাস দেই যে, “সেদিনের স্যুপটা এতো মজার ছিলো না; খিদের চোটে সবই স্বর্গীয় লেগেছে!”
বিকেল তিনটে নাগাদ বাস দিয়ে যেতে যেতে আমাদের নাকে হঠাৎ করে বার্লির সুন্দর গন্ধ একে লাগলো। বুঝতে বাকি রইলো না, আমরা পৌঁছে গেছি বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো হুইস্কির কারখানায়—“The old bushmill whiskey distillary”. তাদের প্রবেশ দরজায় বড় বড় করে লেখা- “Come and see how we turn water into gold.”
হুইস্কি আইরিশদের খুব পছন্দের অ্যালকোহল। এই বস্তু যত পুরোনো হয় তত তার কদর বাড়ে। কমদামী হুইস্কিগুলো সাধারণত ১০ বছর পুরোনো হয়ে থাকে। তবে বিশ বছরের চেয়ে বেশী পুরনো হুইস্কির স্বাদ নিতে হলে প্রতি শটের (২৫ মিলি) জন্য গুনতে হবে প্রায় দুই হাজার টাকা। ডিসটিলারির ভেতরটা যেন এক হুইস্কির মিউজিয়াম। গর্ব করে তারা তাদের শত বছর পুরোনো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম প্রদর্শন করেছে। সেখানে জ্যাক নামক এক আমেরিকান ভদ্রলোক এসে আমাদের সাথে গল্প জুড়ে দিলো। জ্যাক ১৪ পাউন্ড খরচ করে ২১ বছর পুরনো এক শট হুইস্কি চেখে দেখলো। তার চেহারায় তখন হাসির ঝলক।
হুইস্কি পর্ব শেষ করে বিকেল পাঁচটার দিকে আমরা পৌঁছলাম আজকের দিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ— “দ্য জায়ান্টস কসওয়ে” প্রাঙ্গনে। আইরিশ রূপকথার এক দৈত্য লাফালাফি করে নাকি এই পাহাড়ের পাথরকে এবড়ো-থেবড়ো করে ফেলেছিলো। অক্সফোর্ডের দুই সায়েন্সের ছাত্র সেই রূপকথার বৈজ্ঞানিক সত্যতা নিয়ে হালকা হাসি তামাশা করতে করতে প্রচন্ড সবুজ সেই ইউনেস্কো হেরিজেট সাইটে প্রবেশ করলো। কসওয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় যেতে ৫০ মিনিট হাঁটা লাগবে। এই আবহাওয়াতে বাসের কেউ সেটা করতে রাজি নয়। তবে আমরা দুই পাগল হই হই করতে করতে বাস থেকে নেমে গেলাম। অবশেষে বাসের বাকি যাত্রীরাও আমাদের পিছু নিলো।
আললান্টিকের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিশাল বড় এক পাথরের পর্বত। পানির ঠিক কাছে এসে সেটা সোজা খাড়া হয়ে নীচে নেমে গেছে। সাধারণত পাহাড়ের একটা সুন্দর ঠাল থাকে। তবে কসওয়ের ভৌগলিক ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। হয়তো বহুকাল আগে এখানে বড় রকমের টেকটোনিক শিফট ঘটেছিলো। সেটা ভূগোলের ছাত্র হলো হয়তো আরেকটু বেশী ব্যাখ্যা করতে পারতাম।
একটা কথা না বললেই নয়, কসওয়ের চূড়ায় যেয়ে যখন সবুজের মাঝে নীল সমুদ্রের বিশাল ঢেউগুলোর সামনে মুখোমুখি দাঁড়াবেন; তখন নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র বলে মন হতে থাকবে। পাহাড় আর সমুদ্রের সম্মিলনস্থলগুলো তাই সবসময়ই আমার খুব পছন্দের জায়গা। সেই চূড়ায় ইচ্ছে করছিলো কয়েক ঘন্টা বসে থাকি। কিন্তু, বাসের বেঁধে দেয়া সময়ে বাধ্য হয়ে ফেরত যেতে হলো। অবশেষে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা ডে-ট্রিপ শেষ করে ফেরত আসলাম বেলফাস্ট সিটি সেন্টারে। এপ্রিলের শেষ দিকটায় উত্তর মেরুর নিকটবর্তী এই জায়গায় রাত হয় প্রায় এগারোটায়। সন্ধ্যা আট-টায় মাথার উপর ভালো রকমের সূর্য!
ইফতির তখন কফির উদ্রেক হলো। চোখের সামনে দেখতে পেলাম কানাডার বিখ্যাত কফি চেইন— “Tim Horton”. বন্ধু যখন ‘আমেরিকানো’র লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন আমি এক মেক্সিকান বান্ধবী জুটিয়ে ফেললাম। ইউরসা বেলফাস্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ করে; তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া চলছে। তাই শনিবার রাতে গার্লস নাইট আউটে বের হয়েছে। আমাদের সাথে কফি খেতে খেতে তাদের সাথে পার্টিতে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলো। এভাবে বনে-বাদাড়ে, কফিশপে কত মানুষকে যে ফেসবুক-ইন্সাগ্রামে অ্যাড করার পর ভুলে গেছি তা কে জানে!
রাত এগারোটায় আমি আর ইফতি গেলাম আইরিশ নাইট লাইফের মন্ত্র উদঘাটন করতে। নর্থ স্ট্রীটের পার্শ্ববর্তী একটা ক্লাবের ডিজে তখন এলাকা মাতিয়ে তুলেছে। আমি আর ইফতি এদের দেখে বেশ হতাশ! সবাই তাদের ড্রিংকস হাতে দাঁড়িয়ে আছে; কিন্তু কেউ নাচছে না! ইফতি বললো, “এদেরকে অক্সফোর্ডে এনে বপ (এক ধরণের ডিজে পার্টি) করানো দরকার।”
অবশেষে ক্লাবের একমাত্র অসাদা দুটো ছেলে ডিজের সামনে নাচতে শুরু করলো। আমাদের দেখে একে একে অন্যরাও যোগ দিলো। সারাদিনের বাস ভ্রমণে হাঁটুর উপর জমে যাওয়া মরিচা কয়েক ঘন্টার ডান্সে দূরে করে ফেললাম। ইফতি তখন ক্লাব হপিং ব্যাপারটা জমিয়ে তুললো। আমার মতের কোন দাম নেই; ইফতি যা বলবে তাই শুনতে হবে। আমি ওর সাথে একের পর এক ক্লাবে ঢুকছি; দশ মিনিট নেচে আবার বের হয়ে যাচ্ছি। একটা ক্লাবের কিছু ছেলে মনে হয় জীবনে প্রথমবারের মতো কোন বাংলাদেশীকে নাচতে দেখছে। সে বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে এসে ছবি তুলে গেলো। ক্লাবিং শেষ করে বাহিরে এসে নতুন দুই আইরিশ বান্ধবীর সাথে পরিচয় হলো। সারাহ নামের মেয়েটা হঠাৎ করে আমার পিঠে উঠে গেলো। আমি, সারাহ, ইফতি আর সান্দ্রা (ছদ্মনাম) বেলফাস্টের রাস্তায় মাঝ রাতে ম্যাকডোনাল্ড’স খুঁজে বেড়াচ্ছি; আমার কাঁধে ব্যাগপ্যাকের বদলে সারাহ ঝুলে আছে। এরপর যতদূর মনে পরে আমরা রাস্তার পাশের একটা বার্গারের দোকানে ঢুকে কোন রকমে পাকস্থলিতে পানি ঢেলেছি। সেখানে ইফতি লক্ষ্য করলো, পুরো বেলফাস্টে একমাত্র আমরাই সাদা চামড়াবিহীন মানুষ। আমি এই সমসত্ত্ব সমাজে থাকতে অস্বীকার জানালাম। ইফতি উবার ডেকে আবার আমাকে টেনে বাসায় নিয়ে গেলো।
পরদিন ঘুম ভাঙলো দুপুর একটায়। ইফতি ফোন খুলে দেখালো সেই বিখ্যাত ছবি— শামীরের পিঠে সারাহ! আমি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম। ভালোমতে একটা গোসল করে ব্যাগ গুছিয়ে দুই বন্ধু এরপর সিটি সেন্টারে ফেরৎ গেলাম। আজকের প্রথম গন্তব্য সেন্ট জর্জেস মার্কেট। এটা বেলফাস্টের একমাত্র ভিক্টোরিয়ান মার্কেট। এক ছাদের নীচে অনেকগুলো ছোট ছোট দোকান। একটা থেকে অন্যটায় হেঁটে হেঁটে খানিকটা কফি, একটু মাসেল, একটু সসেজ চেখে দেখলাম। সেই মার্কেটের একটা ছোট পেইন্টিং শপে খুব সুন্দর একটা লাইন লেখা ছিলো- “If you are lucky enough to be Irish, you are lucky enough.” সেন্ট জর্জেস থেকে বের হয়ে আমরা ওয়েদারস্পুন্স নামক একটা চেইন রেঁস্তোরায় ঢুকে ত্রিশটা চিকেন উইংস আর তিনটা স্টেক অর্ডার করলাম; সাথে থাকলো দুই পাইন্ট গিনেস! দুজনে মিলে এই মাংসের রাজত্বে পরবর্তী দুই ঘন্টা মজে রইলাম। খাবার শেষে একটা শান্তির ঢেকুড় তুলে নিজেদের আইরিশ ট্রিপের বিশেষ অংশগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকলাম।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ ফিরে গেলাম বেলফাস্ট এয়ারপোর্টে। প্লেনে চড়ে রাত্র নয়টায় এসে নামলাম লন্ডনে। শুভ সমাপ্তি ঘটলো শামীর-ইফতির আরো একটি উইকেন্ড-হপের। দুজনেই আগামীকাল থেকে ল্যাবে ঢুকবো; রাতে ঘুমাবো না একটুও। কাজ হবে মাসের পর মাস। তারপর আবার লাফ দিয়ে চলে যাবো কোন এক ইউরোপিয়ান শহরে; সেখানে কোন এক সারাহ এসে হয়তো মাঝরাতে পিগি-ব্যাগিং করতে চাবে।
You don’t need to travel with friends. You can make a lot of friends while traveling.