ক্রিসমাস, বিচ, ব্রাইটন
May 27, 2020 | 4035
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই অক্সফোর্ড শহরটা আস্তে আস্তে খালি হয়ে যায়। এক সময় জনমানবহীন এই শহরে নিজেকে বড় একা বলে মনে হয়। তাই, ২০১৮ সালের ক্রিসমাস আসার আগেই কীভাবে অক্সফোর্ড থেকে পালানো যায় সেই ফন্দি করা শুরু করলাম। লন্ডনের অদূরে ব্রাইটন শহরে আমাদের বন্ধু সাকিব আর রাইসার বসবাস। তারা বেশ পশ্চিমা ঘরণার আয়োজনে আমাদের সবাইকে ব্রাইটনে ক্রিসমাস উদযাপনের দাওয়াত দিলো। বাঁধন, ম্যাক, অমিতা আর আমি হই হই করতে করতে সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত হলো— ক্রিসমাসে ইউরো ট্রিপ দেয়া হবে। ব্রাইটন থেকে শুরু করে সেই কাফেলা আমস্টারডাম হয়ে বেলজিয়াম যেয়ে থামবে। ক্রিসমাসে অক্সফোর্ডে থাকতে হবে না সেই চিন্তা করেই আমি মনে মনে স্বস্তি খুঁজে পেলাম।
অবশেষে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে সকাল সাত-টার সময় একটা ব্যাগপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে আমি অক্সফোর্ডের ব্রডস্ট্রীটে ম্যাকের বাসার নীচে যেয়ে দাঁড়ালাম। সেদিন অক্সফোর্ডের সবচেয়ে ব্যস্ত এই রাস্তায় একটা মানুষের দেখাও মিললো না। সব ছাত্র-ছাত্রীরা এই শহর ছেড়ে তাদের নিজ নিজ নীড়ে ফেরৎ গেছে। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই আমার একাকিত্বের সঙ্গী বাঁধন আর অমিতা সেখানে এসে উপস্থিত হলো। আমরা চারজন মিলে বাসে চড়ে লন্ডন অভিসারে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় দু’ঘন্টার পথ। আমি খানিকটা প্রোডাকটিভ হওয়ার চিন্তায় ল্যাপটপটা বের করে আমার প্রথম বই “হাইজেনবার্গের গল্প”-র শেষ অধ্যায়গুলো কয়েকবার পড়ে দেখলাম। বাসে একলা পেয়ে জোরপূর্বক অমিতাকেও বইটা পড়তে বাধ্য করলাম। এই সব কাজের মাঝেই হঠাৎ লন্ডনের গ্যাটউইক স্টেশনে গিয়ে বাস থামলো।
কাফেলা নিয়ে বাস থেকে নামার পর সবাই মিলে ব্রাইটনের ট্রেনে গিয়ে উঠলাম। মাত্র মিনিট ত্রিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পার্টি টাউন ব্রাইটনে। স্টেশনে নামা মাত্রই মনটা বেশ খুশি হয়ে গেলো। পুরো জায়গাটা ভিক্টোরিয়ান আমলের ডিজাইনে বানানো। ছাদটা বড় বড় লোহার বীমের উপর বসানো ঈষদচ্ছ আবরণ ঢাকা। তার মধ্য দিয়ে অফুরন্ত দিনের আলো প্রবেশ করছে। মাঝখানে ছাদ থেকে বেশ জমকালো ডিজাইনের একটা ঘড়ি ঝুলে আছে। সেই ঘড়ির শরীর জুড়ে ভিক্টোরিয়ান কারুকাজ আর গাম্ভীর্য। হেঁটে প্লাটফর্ম পার হতেই একটা গেটের উপর নজর গেলো। সেখানে বেশ রঙিন হরফে লেখা— “Welcome to Brighton”। লেখাটা পড়তেই ব্রাইটন ঘুরে দেখার উত্তেজনা বেড়ে গেলো।
ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বের হতেই ট্যাক্সির লম্বা লাইনে ফেঁসে গেলাম। কোনমতে একটা ট্যাক্সিতে উঠে মাত্র দশ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম আমাদের বাসায়। সেখানে রাইসা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমরা সবাই ওদের বাসার লিভিং রুমে পরজীবীর মতো গা এলিয়ে ছড়িয়ে পড়লাম। বাঁধন তার স্বভাবচেতা অভিজাত ভঙ্গিতে সোফায় বসে আর্ল-গ্রে চায়ে চুমুক দিলো। আমি আর ম্যাক কিছু একটা নিয়ে অযথা তর্ক করছিলাম। অমিতা এই সবকিছুকে দুই পয়সার দাম না দিয়ে কম্পিউটার থেকে গান ছাড়া শুরু করলো। আমি বুঝতে পারলাম, সবাইকে আরাম পেয়ে বসছে। এই রকম চলতে থাকলে ব্রাইটন আর ঘুরে দেখা হবে না।
সুতরাং, আমি সাধারণত যা করি, তাই করলাম। সবাইকে বাসায় রেখে ব্রাইটনের রাস্তায় নেমে আসলাম বেলা দেড়টা নাগাদ। ব্রাইটনে আসলেই প্রথমে দুটো জিনিস বেশ চোখে পড়বে। প্রথমটা হলো উঁচু-নীচু রাস্তা; দ্বিতীয়টা হলো সীগাল। আমাদের বাসাটা শহরের উঁচু দিকটায় অবস্থিত। সেখান থেকে হেঁটে নিচে নামাটা অভিকর্ষের কারণে খুবই সহজ বলে মনে হয়। শহরের কেন্দ্রবিন্দুটা আসলে নীচের দিকেই। সেদিকে হাঁটতে হাঁটতেই দেখতে পেলাম দলবেঁধে সীগাল উড়ে বেড়াচ্ছে। এর মানে একটাই— আমি সমুদ্রের দিকে যাচ্ছি।
সমুদ্রের নাম শুনলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। ব্রাইটন ইংল্যান্ডের দক্ষিণ প্রান্তে ইংলিশ চ্যানেলের তীরবর্তী এক শহর। তাই এই শহরে পা রাখতেই সমুদ্রের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। মাত্র ১৫ মিনিট হাঁটবার পরই চোখের সামনে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে পেলাম। পুরো পাড়টার গাঁ ঘেঁষে একটা বিশাল লং ড্রাইভ দেবার রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তাটার অন্যদিকটায় কিছুক্ষণ পর পর একটা গলি ঢুকে গেছে শহরের ভেতরে। সেই গলির দুপাশে ব্রাইটনবাসীর রঙ-বেরঙের ঘর। তাই সমুদ্রে যাবার কোন একটা রাস্তা নেই। যেকোন রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে হাঁটা দিলেই সমুদ্র সুনিশ্চিত।
ব্রাইটনের কেন্দ্রে আছে বিশাল একটা শপিংমল — “চার্চিল স্কয়ার”। তার অন্য দিকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জুবিলী ক্লক টাওয়ার। কিছুক্ষণ সেই ঘড়িটার চারপাশে ঘুরে দেখলাম, ছবি তুললাম। তবে শপিংমলে ঘুরে বেড়ানোটা কোন দিক থেকেই আকর্ষণীয় মনে হলো না। তাই আমি অবশেষে হাঁটা ধরলাম সমুদ্রের দিকে। দুনিয়ার সব বড় বড় হোটেল চেইনগুলো এই সমুদ্র ঘেঁষা রাস্তার পাশে জটলা পাকিয়ে বসে আছে। সেই হোটেল বাণিজ্য পাড় হয়ে সামনে যেতেই চোখ পড়লো বিশাল এক টাওয়ারের উপর— i360। কিছু পাউন্ড খরচ করলেই এই টাওয়ারে উঠে পুরো ব্রাইটন শহরটাকে ৩৬০ ডিগ্রীতে ঘুরে দেখা যাবে। সেই ঘুরন্ত মঞ্চে রয়েছে একটি দর্শনীয় বার।
ততক্ষণে আমার হালকা মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। আমি তাই সেই টাওয়ারের নীচের কফিশপ থেকে এক কাপ কফি কিনে তাতে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্র বিলাসে মন দিলাম। ইংল্যান্ডের সমুদ্রের একটা ব্যাপার বেশ হতাশা জনক। আমাদের দেশের কক্সবাজারের মতো স্যান্ডি বীচ এদের খুব বেশী নেই। পুরো ব্রাইটনের পাড় জুড়ে নুড়ি পাথরে ভরা। সেখানে খালি পায়ে হেঁটে পায়ের-পাতা ভেজানোর প্রশান্তি পাওয়াটা একটু কঠিনই হবে। হঠাৎ মেসেজ আসলো— “সাকিব এসেছে।” সুতরাং, বাসায় যেতে হবে। অগত্যা ব্রাইটন ভ্রমণের একলা অধ্যায় অসমাপ্ত রেখেই ফেরত গেলাম রাইসা-সাকিব (সংক্ষেপে রাকিব)-দের বাসায়।
সাকিব বেশ ঝাঁনু রাধুনি। আমাদেরকে তোষামোদ করতে সে পুরো ব্রাইটনের বাজারটা তুলে বাসায় নিয়ে এসেছে। বিকাল নাগাদ আমরা সবাই ধীরে ধীরে সাকিবের রান্নাঘরের সুঘ্রাণ পেতে শুরু করলাম। গর্ডন রামসের রেসিপি দেখে সাকিব এমন কিছু ডিস বানিয়েছে যার নাম এই বাঙ্গালের মুখে উচ্চারণ করা খুবই কঠিন। তবে প্রত্যেকটা খাবারই চামচ-চেটে খাওয়ার মতো! সন্ধ্যার হালকা খাবার শেষে আমরা সবাই মিলে পোকার খেলা শুরু করলাম। প্রথম রাতে আমি আর রাইসা অনেকক্ষণ ধরে টেবিলে রাজত্ব করে বেড়ালাম। অন্যদিকে সাকিব শুরু করলো তার কারসাজি! এবার ভদ্রলোক পিজ্জা বানাবেন।
সেই দুপুর বেলা পিজ্জার খামির (চাবানো ইংরেজিতে যাকে ‘ডোহ্’ বলে) বানিয়ে রেখেছিলো। রাত নাগাদ সেটা ফুলে তুল তুলে একটা আকার ধারণ করেছে। সুন্দর একটা কাঠের তক্তার ওপর পরম যত্নে সেই খামির ছড়িয়ে তাতে একের পর এক বিভিন্ন স্বাদের চীজ, মাংস, ডিমের টপিং দিয়ে প্রায় ছয় রকমের পিজ্জা তৈরি করা হলো। সেটা খেতে গিয়ে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়লেও এই নরাধমের কৃষ্ণ গহবরের সমান পেটে একের পর এক পিজ্জার টুকরা ঢুকতে থাকলো। সেই ভোজন সভার শেষে রাত্র প্রায় তিনটার দিকে সবাই লিভিং রুমের এদিক সেদিক গা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন যথারীতি সবার আগে সকাল নয়’টায় আমি ঘুম থেকে ওঠে তৈরি। বাকিরা সবাই তখনো পরম নিদ্রায় শায়িত। অগত্যা আমি আবার ব্রাইটন ভ্রমণের একলা অধ্যায়টা খুলে বসলাম। এবার হাঁটা দিলাম ক্লক টাওয়ার বাম দিকের রাস্তায়। এক সময় চোখের সমানে এসে পড়লো রয়াল প্যাভিলিয়ন গার্ডেন। সেই বাগানের মাঝে ঢুকে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম। জায়গাটার এক কোণায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হওয়া ভারতীয় সৈন্যদের নামের একটা ফলক দেখা গেলো। কলনিয়াল ব্রিটিশ যুগের চিহ্ন এখনো দেখতে পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে।
বাগানের অন্যদিক দিয়ে যখন পুনরায় রাস্তায় নেমে আসলাম ততক্ষণে পেটে প্রচন্ড খিদে। সামনেই একটা সাবশপ দেখতে পেয়ে সেখানে ঢুকে পটেটো ওয়েজেস মুখে পুড়া শুরু করলাম। পাকস্থলির আওয়াজ খানিকটা কমে আসার পর আবার রাস্তায় নামতেই দেখলাম দূরে বড় করে লেখা— Brighton Palace Pier. জায়গাটা দেখতেই মনে হলো বেশ জমকালো একটা মেলা। কিন্তু, অবশ্যই এতো সকাল বেলা এখনো কিছুই খোলেনি। অগত্যা আমি আবার বাসায় ফেরত গেলাম।
লিভিং রুমে ঢুকতেই দেখি সাকিব আবার তার কারিশমার ছড়ি নাড়তে শুরু করেছে। এবার সে বানিয়েছে সনাতনী ব্রিটিশ নাস্তা। সজেস, বেকন, বীন, হ্যাশ ব্রাউন, বেকড টমেটো আর চীজ। খাবারের চেহারা দেখেই মন ভরে গেলো। সবসময় এই রকম ঝানু রাধুনীর সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত। এরা সকাল বিকাল মানুষকে খাওয়াতে বেশ ভালোবাসে। আমরা সবাই সাকিবের ভূয়সী প্রশংসা করতে করতে নাস্তার প্লেট মুহুর্তেই সাবাড় করে দিলাম। ম্যাক এবার সবার জন্য কফি বানাতে শুরু করলো। অন্যদিকে আমি সবাইকে নিয়ে বাসার বাহিরে বের হবার জন্য জোরাজুরি শুরু করলাম।
অবশেষে বাঁধন রাজি হলো। আমি আর বাধঁন নেমে আসলাম ব্রাইটনের রাস্তায়। ২৪ ডিসেম্বরের সকালটা ছিলো বেশ রোদেলা। আমরা দুজনে গিয়ে হাজির হলাম গার্ডেনার্স রোডে। রাস্তাটা খুব সাধারণ ইউরোপিয়ান ট্যুরিস্ট স্পটের মতো। পুরো রাস্তার দুধারে অনেক খাবারের দোকান। প্রতিটা দোকানের বাহিরে বেশকিছু চেয়ার-টেবিল রাখা। সেখানে বসে অনেকেই তাদের সকালের নাস্তা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। দু-চারজন ভ্রমণপিপাসুকে দেখা গেলো একলা বসে বই পড়তে পড়তে কফির কাপে খানিকটা চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। বাম দিকে একটা টার্কিশ দোকানে বেশ কিছু অ্যান্টিকস সাজানো। তার সামনের ফুটপাতে বসে পিটার নামক এক ভদ্রলোক গিটার বাজিয়ে সুন্দর একটা টোনে গান গেয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে তার মুখের সামনে লাগানো হার্মোনিকাটাও বাজিয়ে সুরের একটা সুন্দর প্রবাহ নিশ্চিত করেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে পিটারের গান শুনলাম আর ছবি তুললাম। কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সেই ছবিটা আজও মাঝে মাঝে দেখি। সুন্দর সেই সকালের পরিবেশটা চিন্তা করতেই মনটা ভালো হয়ে ওঠে।
বাঁধন সেই রাস্তায় একটা চায়ের দোকান আবিষ্কার করলো। সেখানে ঢুকে চায়ের বাহারী নাম দেখে আমাদের দুজনের চোখই ঝলসে গেলো। সে অবশেষে “হট মামা জামা” নামক এক জ্যামাইকান চায়ের ব্লেন্ড কিনে বের হয়ে আসলো। আমরা এরপর চলে গেলাম চার্চিল স্কয়ার মার্কেটের সামনে। সেখানে ম্যাক-অমিতা-রাইসা-সাকিব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
পুরো গ্যাং পুনর্মিলনী শেষে আমরা সবাই মিলে ব্রাইটনের বীচের দিকে হাঁটা দিলাম। একসময় সবাই পৌঁছে গেলাম সেই সকাল বেলার Brighton Palace Pier-এ। পুরো জায়গাটাই হলো আনন্দের বাজার। সমুদ্রের ঠিক উপরে একটা কাঠের পাটাতনের উপর সুবিশাল এই মেলা বসেছে। সেখানে মেরী-গো-রাউন্ড, রোলার কোস্টার রাইড থেকে শুরু করে আর্কেড গেমস— সবই আছে। একটা কোণায় চুরোস নামক কুড়মুড়ে এক পিঠা বিক্রি হচ্ছে। সেটাকে তরল চকলেটে ডুবিয়ে খেতে বেশ মজা লাগে। বেলা বেড়ে যখন সন্ধ্যা নামছে ঠিক তখনই লক্ষ্য করলাম এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য।
একটা ছোট বাচ্চা এক প্যাকেট চুরোস কিনে পিয়ারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওপর থেকে এক ঝাঁক সীগাল তাকে অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করছে। হঠাৎ একটা সীগাল এসে পিচ্চির হাতের উপর আক্রমণ করে তাকে ভড়কে দিলো। আতংকিত সেই ছেলের হাত থেকে চুরোসের পোটলাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সে সুযোগে মুহুর্তে দশটা সীগাল এসে একটা একটা করে চুরোস নিয়ে পালিয়ে গেলো। এক্কেবারে গ্যাংস্টার লেভেলের ডাকাতি!
পক্ষী রাজ্যের ক্রিমিনাল মাস্টার মাইন্ডদের কারসাজি দেখা শেষ করে আমরা অনেকক্ষণ পিয়ারের কোণায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই পড়ন্ত বিকালটার কথা মনে হলে এখনো মনটা ভরে যায়। সাগরের পাড় ঘেঁষে ব্রাইটন শহরের স্কাইলাইন দেখা যাচ্ছে। সামনেই টলটলা নীল সমুদ্র। সেই দরিয়ার ওপাড়ে সূর্যটা লাল হয়ে তখন ঢলতে শুরু করেছে। জীবনে অনেক দু:খ থাকলেও সেই সময়টায় কেবল সুখের মুহুর্তগুলোই মনে পড়ছিলো। সেই বঙ্গোপোসাগর থেকে শুরু করে উত্তর সাগর, আন্দামান আর প্রশান্ত মহাসাগর পাড় করে এবার দাঁড়িয়ে আছি ইংলিশ চ্যানেলের উপর। পৃথিবীটা যতই দেখী ততই অবাক হই।
সূর্য অবশেষে অস্ত গেলো। আমরা সবাই ব্রাইটনের সন্ধ্যাবিলাসে ব্যস্ত। তাদের মেরিন ড্রাইভের রাস্তাটায় বড় বড় করে লেখা WISH, PEACE, HAPPY। ব্রাইটন শহরটার ভাবটাই অনেক পজিটিভ। একে কেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সুখী শহর বলা হয় তা হারে হারে টের পাচ্ছিলাম।
একসময় আমরা সবাই মিলে ক্যাফে নেরোতে প্রবেশ করলাম। দোকানটা অমিতার খুব পছন্দের। সবাই মিলে কফির চুমুকে শরীর চাঙ্গা করে নিতে নিতে আবার একটা গল্প জুড়ে দিলাম। সেই গল্প শেষ হতে হতে রাত ৯-টা বাজলো। শেষমেশ সবাই কিছু মুদির বাজার করে বাসায় ফিরে গেলাম। আগামীকাল ক্রিসমাস। সেটা পালন করার জন্য আমাদের বেশ কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।
রাইসা বাসার মাঝখানে একটা ছোট ক্রিসমাস ট্রী রেখে দিয়েছে। সেই গাছের সামনে সবাই সিক্রেট সান্তার উপহারগুলো রেখে দিলো। ব্যাপারটা আমরা অনেকদিন আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। একটা অ্যাপের মাধ্যমে দৈবচয়নে সবাইকে কোন একজনের জন্য উপহার কিনতে হবে। তারপর ক্রিসমাসের দিন সেই উপহারগুলো খুলে দেখা হবে। আমি রাইসার সিক্রেট সান্তা নির্বাচিত হয়েছিলাম। ওর জন্য আমি একটা সান্তা ক্লসের জ্যাকেট কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা পড়ে মেয়েটা সবাইকে তাদের উপহার দিয়ে গেলো। অমিতা কোন এক কারণে অতিদরদী হয়ে আমাদের সবার জন্যই কিছু কিনে এনেছে। আমি The Idiot Brain নামক একটা অসাধারণ বই পেলাম। ডিন ব্রানেট নামক এক নিউরো গবেষকের লেখা এই বইয়ের পাতায় পাতায় বেশ হাসির খোরাক আর মস্তিষ্ক বিষয়ক জ্ঞানের ছড়াছড়ি।
আমি সবার জন্য একটা করে কার্ড নিয়ে গিয়েছিলাম। এই যুগেও আমি হাতে লেখা কার্ড বেশ পছন্দ করি। সবাই আয়োজন করে আমার লেখা কার্ড পড়ে শোনালো। উপহারের বৈঠকটা তখন বেশ আহলাদে গদগদ করছে। ঠিক সে মুহুর্তে সবাই মিলে শেরেডস খেলার সিদ্ধান্ত নিলো। একটা সিনেমার নাম অভিনয় করে বোঝাতে হবে। যে দল আগে বুঝতে পারবে সে জয়ী। যথারীতি বন্ধুত্বের আসর মুহুর্তেই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলো। সেই শেরেডস চললো রাত চার-টা পর্যন্ত। ক্লান্ত হয়ে সবাই অবশেষে ঘুম দিলাম। পরদিন ক্রিসমাস। সেই কথা চিন্তা করতেই বেশ ভালো লাগছিলো।
২৫ ডিসেম্বর ২০১৮; বড়দিন। বেলা দশটার সময় ঘুম ভাঙলো আমাদের। ক্রিসমাস ডিনার পশ্চিমা বিশ্বে বেশ ঘটা করে আয়োজন করা হয়। সাকিব গর্ডন রামসের ভিডিও দেখে টার্কি রোস্ট করার রেসিপি আয়ত্ত করেছে। আজকে সেই টার্কি বানানো হবে। প্রথম ধাপ হলো, টার্কির চামড়ার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বাটার লাগানো। মাখন মাখানোর এই গুরু দায়িত্ব চাপানো হলো আমার ওপর। প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে একটা ৩০০ গ্রামের বাটার ৮ কেজি ওজনের টার্কি মহোদয়ের উপর ঘষা হলো। সেই টার্কির সুঘ্রাণ থেকে পরিত্রাণ পেতে অবশেষে বাসার সকল সাবান আর শ্যাম্পু আমার হাত ধোয়ায় ঢেলে দিলাম। টার্কি প্রস্তুতি শেষে সাকিব সকালের নাস্তা সার্ভ করলো। ডিম পোচ করার জন্য সে ফুটন্ত পানিতে থার্মোমিটার ডুবিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডিমের এক বিশেষ আকৃতি নিয়ে আসলো। সেটা দেখে আমি আমার ল্যাবরেটরী জীবনের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। অন্যদিকে বাঁধন সেই পোচ ডিমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ম্যাক যথারীতি নিজের কালো কফিতে মুগ্ধ। ক্রিসমাসের দিন সাধারণত কেউ বাহিরে বের হয় না। সবাই বাসায় বসে থাকে আর প্রচুর পরিমাণে খাবার খায়। বোঝা গেল, আমার বন্ধুদেরও চিন্তা একই রকম। সমস্যা হলো, আমি বেশীক্ষণ এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারি না। অবশেষে অমিতা আর বাঁধনকে জোর করে টেনে নিয়ে ব্রাইটনের বীচে চলে গেলাম।
বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। ব্রাইটনের বীচে অনেক গুলো রঙ-বেরঙের ছোট ছোট ঘর আছে। অনেকেই গ্রীষ্মকালে এই ঘর গুলো ভাড়া নিয়ে তাতে মালপত্র রেখে বীচের কাছে এক-দুই দিন কাটিয়ে দেয়। সেই রঙিন কুড়ে ঘর মার্কা কুটির গুলো দেখে কিছুটা বাংলাদেশের গ্রামের কথা মনে পড়লো। অমিতা আর বাঁধনকে সাথে নিয়ে এবার আমরা বীচের সাইড ধরে প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটতে থাকলাম। ব্রাইটন বীচের পুরোটা ঘাঁটই বাঁধানো। একটু পর পর কয়েকটা বেঞ্চ রাখা। এরকম বেঞ্চ দেখলে বেশ রোমাঞ্চিত লাগে। একবার চিন্তা করে দেখুন। সমুদ্রের পাড়ে একটা বেঞ্চে বসে আছেন। পাশে বসে আছে আপনার পছন্দের কেউ। দুজনে সমুদ্র দেখতে দেখতে ক্রিসমাসের দিন এক আলসে সকালে জীবন নিয়ে দু-চারটা ফিলোসফিকাল কথা বলছেন। একে অপরের অযাচিত পাকনামিতে পরক্ষণেই ফিক করে হেসে ফেলছেন।
কি? ভাবতেই ভালো লাগছে না?
ঠিক এমনটাই ছিল আমাদের ২০১৮ সালের ক্রিসমাসের সকাল বেলাটা। অমিতা আর বাঁধনকে সাথে নিয়ে বেশ অসাধারণ কিছু মুহুর্ত কাটিয়েছি আমি।
সন্ধ্যা ছয়টা। অবশেষে সময় এসেছে সেই বহুল আকাঙ্খিত ক্রিসমাস ডিনারের। আমাদের বহু সাধের টার্কি ততক্ষণে তৈরি। প্রায় তিন ঘন্টা রোস্ট করার পর একে পাচঁ ঘন্টা ঘামতে দিতে হয়। আস্তে আস্তে ঠান্ডা করার পর সাকিব বিশাল এক ছুড়ি দিয়ে টার্কিটা পিস পিস করে আমাদের প্লেটে তুলে দিলো। সাথে সার্ভ করা হলো নানান পদের সিদ্ধ সবজি। অন্যান্য মাংসের তুলনায় টার্কি কিছুটা শুকনো; তবে খেতে অনেকটা মুরগীর মতোই। একটা গ্রেভী ঢেলে টার্কির তরলতা বাড়িয়ে খেতে মন্দ লাগে না। চর্বির পরিমাণ অনেক কম হওয়ায় টার্কি বেশ স্বাস্থ্যসম্মত খাবারও বটে। যথারীতি বেচেঁ যাওয়া টার্কির প্রায় অর্ধেকটাই আমাকে খেতে হলো। বাকি অর্ধেকটা পরদিন সকালের নাস্তার জন্য তুলে রাখা হলো। প্রায় কেজি দুয়েক ওজন বাড়িয়ে খানিকটা ঘাম ঝরিয়ে আমরা সবাই তখন কোনমতে সোফার ওপর বসে আছি। নাক পর্যন্ত খাবার দিয়ে ভরে গেছে। কথা বলার শক্তিও নেই কারো মাঝে। অগত্যা সবাই নেটফ্লিক্স ভিনসেন্ট ভ্যান গহের জীবনের ওপর নির্মিত একটি সিনেমা দেখতে বসলাম। সেটা দেখতে দেখতেই আমি ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
পরদিন সকাল ছয়টায় সবাই ঘুম থেকে উঠে রেডি। আমি চোখ কচলাতে কচলাতে দেখলাম অমিতা বেঁচে যাওয়া টার্কির মাংস দিয়ে স্যান্ডউইচ বানাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে সবাই ব্যাগ ঘুছিয়ে আবার লন্ডন গ্যাটউইক এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা দিলাম। আজ ২৬ ডিসেম্বর, বক্সিং ডে। আমাদের ইউরো ট্রিপের শুরু। বেলা সাড়ে এগারোটার প্লেনে চড়ে সবাই মিলে আমস্টারডাম শহরের দিকে উড়াল দিলাম। পেছনে রেখে গেলাম ব্রাইটন, ক্রিসমাস, টার্কি, বীচ, পিটার, গার্ডেনার্স রোড আর অসাধারণ কিছু মুহুর্ত।
Sometimes in the future, I will come back to Brighton beach and sit on the same bench just to contemplate how life has unfolded since then.