অক্সফোর্ড পিএইচডির প্রথম সপ্তাহ
Oct 4, 2018 | 17675
গবেষণা জিনিসটা অনেকটা সমুদ্রে সাতাঁর কাটার মতো। আপনি যতই চেষ্টা করেন না কেন সহসা তার তীর খুজেঁ মেলাটা কঠিন হবে। তাই যেকোন ধরণের দিক নির্দেশনা গবেষণার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গত ২ অক্টোবর অক্সফোর্ডের র্যাডক্লিফ ডিপার্টমেন্ট অফ মেডিসিনের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে ড.ওয়াটসন স্বাগত জানাতে গিয়ে বললেন, “অক্সফোর্ড আর হার্ভার্ডের একটা বড় পার্থক্য হলো: যে কাজে হার্ভার্ড তিনজন পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক নিয়োগ দেয় অক্সফোর্ড সেই কাজটাই পাচঁ-ছয়জন ডক্টরাল গবেষককে করতে দেয়। অতীতে আমাদের পিএইচডি স্টুডেন্টরা সত্যিকার অর্থেই দুনিয়া বদলে দেয়া আবিষ্কার করে এসেছে। ২৩৫টা আবেদন থেকে মাত্র ১৫ জনকে আমরা এবছর এই প্রোগ্রামে নিয়েছি। Doctor of Philosophy in Medical Sciences পড়তে আজকে এখানে উপস্থিত হয়েছো বেশ কয়েকজন ডাক্তার, জেনেটিসিস্ট, প্রোগ্রামার, গণিতবিদ এমনকি একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এক বিভাগে এতো বৈচিত্র্য শুধু অক্সফোর্ডেই খুজেঁ পাবে।”
বৈচিত্র্য! কী অসাধারণ একটা জিনিস। আপনি জীবনে যতটা বিচিত্রতা উপভোগ করবেন ততই দিন দিন উদার এবং বড় মনের মানুষ হতে পারবেন। যে সারাটা জীবন নিজের ঘরের কোণায় বাস করে তার মনটাও তার ঘরের মতোই ছোট হয়। সেই কথা চিন্তা করতে গেলে অক্সফোর্ডের মানুষজন বেশ প্রগ্রেসিভ। তারা বাস করে বিশ্বের সবচেয়ে বিচিত্র পরিবেশে। সব জাতির, সব ধর্মের, সব লিঙ্গের, সব যৌনতার মানুষ এসে একত্রিত হয়েছে ইংল্যান্ডের ছোট্ট এই শহরে। প্রায় নয়’শ বছর ধরে চলে আসছে এই সিলসিলাহ। প্রতি সমাজের সবচেয়ে বেমিল, একটু আলদা, খানিকটা সামাজিকভাবে বিব্রত কিন্তু অসাধারণ মেধাবী মানুষগুলো অক্সফোর্ডে এসে যেন নিজেকে নতুন করে খুজেঁ পায়। কারণ, এখানে নির্ভয়ে সবকিছুই বলা যায়; সবকিছু করা যায়।
কিন্তু, দেড়শ জাতির মানুষ যখন এক ছাদের নীচে এসে দাড়াঁয় তখন স্বভাবতই সেখানে কিছুটা ভেদাভেদ তৈরি হতে পারে। সেটা বন্ধ করতে অক্সফোর্ডের রয়েছে অসাধারণ এক প্রক্রিয়া- “ফ্রেশার্স উইক”। আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের নবীন বরণে সাধারণত এক দিনের একটা অনুষ্ঠান হয়। আর অক্সফোর্ডে সেই কাজটাই হয় এক সপ্তাহ জুড়ে। প্রতি ধাপে ধাপে আমাদেরকে অক্সফোর্ডের সমাজের সাথে ধরে ধরে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। অক্সফোর্ডের প্রতিটা শিক্ষার্থীর তিনটা পরিচয় রয়েছে- আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আমার পড়াশোনা হয় রেডক্লিফ ডিপার্টমেন্ট অফ মেডিসিনে এবং আমার সামাজিক জীবনটা কাটে ব্যালিয়ল কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপার্টমেন্ট আর কলেজ— তিনজনই আমার জন্য নবীন বরণের আয়োজন করেছে।
অক্সফোর্ড নবীনবরণ
গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণ অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি তার বক্তব্যে আমাকে বেশ চমকে দিলেন। ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের (ব্রেক্সিট) প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছিলেন, “A citizen of everywhere is a citizen of nowhere.” প্রো-ভিসি বেশ বলিষ্ঠ কন্ঠে বললেন, “অক্সফোর্ড থেরেসা মে’র এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণরূপে বিরোধিতা করে। আমরা মনে করি, জ্ঞানের চর্চার জন্য দুনিয়ার সব দেশের মানুষের একসাথে হতে হবে। যেটা আমরা প্রায় হাজার বছর ধরে অক্সফোর্ডে করে আসছি।” আমি বাংলাদেশের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যে সরকারের সরাসরি বিরোধিতা করতে পারে সেটা আমি স্বপ্নেও কখনো চিন্তা করতে পারি না। কিন্তু, অক্সফোর্ডে সবই সম্ভব। বিশ্বের অনন্ত ৬০ জন প্রধানমন্ত্রী অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন; তাদের ঝুলিতে আছে প্রায় পঞ্চাশটা নোবেল পুরস্কারও। সবচেয়ে কনিষ্ঠ নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফিজাইও অক্সফোর্ডের ছাত্রী। তাই, অক্সফোর্ড নিজেকে মেধার ফ্যাক্টরী বলে মনে করে। আর, সেই মেধার জোরেই আমাদের প্রো-ভিসি সাহবে এতোটা বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে পারেন; যদিও সেটা প্রধানমন্ত্রী বিপক্ষে যায়।
বিভাগীয় নবীনবরণ
দ্বিতীয় নবীন বরণটা আসে নিজের বিভাগ থেকে। এই প্রবন্ধের শুরুতেই সেই অনুষ্ঠানের কথা বলছিলাম। প্রতিটা বিভাগে পড়তে হলে কী কী জিনিস জানতে হয় তা প্রায় গাইড বইয়ের মতো করে হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। পিএইচডি গবেষণার একটা বড় অংশ নির্ভর করে আমার সুপারভাইজারের উপর। তার সাথে কীভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে সেটা বোঝাতে “how to manage your supervisor” নামের একটা ক্লাস নেয়া হলো। অধ্যাপক ম্যারেলা ডি ব্রন এই ক্লাসটা নেয়ার জন্য বিখ্যাত। উনি দিনশেষে সব ছাত্রকে একটা বই উপহার দেন। বইটার নাম- “How to have a difficult conversation”। জীবনে এই জিনিটা জানা অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ম্যারেলা বলছিলেন, “গবেষণায় ব্যর্থ হলে কিংবা পার্টনারের সাথে ব্রেকআপ করতে গেলে এই বইটা বেশ কাজে দিবে!” হলভর্তি তখন হাসির রোল পড়ে গেলো।
কলেজ ফ্রেশার্স উইক
ফ্রেশার্স উইকে আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশটা হলো কলেজ নবীনবরণ। কলেজের কাজ হলো প্রতিটা ডক্টরাল স্টুডেন্টের সামাজিক জীবন নিশ্চিত করা। আমার বাস অক্সফোর্ডের সবচেয়ে পুরাতন কলেজগুলোর মধ্যে অন্যতম- ব্যালিয়ল কলেজে। শহরের ঠিক কেন্দ্রবিন্দু এর অবস্থান। সেদিক থেকে আমরা বেশ ভাগ্যবান। সকল সুযোগ সুবিধা আমাদের হাতের নাগালে। অক্সফোর্ডে আসার আগেই কলেজ আমাকে ফ্রেশার্স উইকের বিশাল এক লিস্ট পাঠিয়ে দিলো। তার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি:
Getting to Know Each Other: যারা একটু আগেই অক্সফোর্ডে চলে আসে তারা প্রতিদিন রাত ৮ টায় কলেজের মিডেল কমন রুম (MCR)-এ ভীড় জমায়। একে অন্যের সম্পর্কে এক-আধটু জেনে নেয়। অন্তত কিছু চেহারা চেনা চেনা বলে মনে হতে শুরু করে। সবাই নিজেদের ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে অন্যকে শহরে সেটেল হতে সাহায্য করে। এই সময়টা খুবই নিষ্পাপ। সবাই সবার খুব ভালো বন্ধু।
Mentor/Mentee Picnic: ব্যালিয়ল কলেজ প্রতিটা শিক্ষার্থীর জন্য একজন বড়ভাই/আপু নিয়োগ দেয় যারা আমাদের মেন্টর হিসেবে কাজ করে। আমার মেন্টরের নাম কেইটলিন। জার্মান এই মেয়ে সেল বায়োলজিতে পিএইচডি করছে। প্রথম দিন কেইটলিন আমাদের নিয়ে গেলো অক্সফোর্ডের পার্কে। রোদ ঝলমলে পরিবেশে আমরা হালকা খাবার খেতে খেতে অক্সফোর্ডের জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ একজনের পরামর্শ লাভ করলাম। কেইটলিন আমাদের শত প্রশ্নের উত্তর দিলো অসম্ভব ধৈর্য্য ধরে। অনেকেই প্রফেসরের সাথে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করে। তাই, একজন বর্তমান ছাত্রকে এইভাগে নিয়োগ দেয়ায় আমাদের জন্য যোগাযোগ করাটা অনেক সহজ হয়ে গেল।
Meet Your Floor Dinner: কলেজের সবাই বাস করে এখানকার গ্র্যাজুয়েট হলগুলোতে। স্বভাবতই তারা নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। তাই, একই তলার বাসিন্দাদেরও অনেক সময় দেখা-সাক্ষাত হয় না। কিন্তু, এই ট্র্যাডিশন ভাঙ্গতে ব্যালিয়ল বানিয়েছে সুন্দর একটা পরিকল্পনা। প্রতিটা শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে একটা করে মাইক্রোওয়েভ পিজ্জা দেয়া হলো। আমার তলায় মোট ছয়জনের বসবাস। ছয়টা ঠান্ডা পিজ্জাকে ওভেনে গরম করতে গিয়ে প্রথম বারের মতো সবার সাথে বেশ হার্ট-টু-হার্ট কথাবার্তা হলো। একজন অন্যজনের বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। আমার তলায় কেবল আমারই রান্নার সরঞ্জান আছে। তাই, বাংলাদেশের মতো অক্সফোর্ডেও রান্নার ভারটা আমার কাথেই বর্তালো। সবাই অবশ্য যাওয়ার সময় বেশ প্রশংসা করে গেলো।
Garden Tour: ব্যালিয়ল কলেজ তার বাগানের জন্য খুব বিখ্যাত। আমাদের মোট দুইটা বাগান আছে। দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্র এসে আামাদেরকে সেই বাগানের আনাচে-কানাচে ঘুরিয়ে দেখালো। বাগানটার মাঝখানে একটা অংশ একটু নিচু। এর নাম- sunken garden. চাইলে একদল শিক্ষার্থী এই জায়গায় নাটক-গানের আয়োজন করতে পারে। পাশেই রয়েছে একটা বারবিকিউ চুলা। বুকিং দেয়ার মাধ্যমে সেটা যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে। হলের বড়ভাইদের কোন দৌরাত্ম্য নেই। সবই আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। আর, বাগানটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলে বেঞ্চগুলো। বেশ ঝোপঝাড়ে ঘেরা পরিবেশে একটা দুইটা কাঠের অথবা নেটের চেয়ার। সেখায় গরমের সময় মানুষজন বসে বই পড়ে। কেউ কেউ তার পার্টনারের সাথে কাটায় অন্তরঙ্গ সময়।
Manorlympics: ফ্রেশার্স উইকে আমার অন্যতম পছন্দের ইভেন্ট। ব্যালিয়লের বেশ বড়সড় একটা ক্রিকেট মাঠ আছে। সেই মাঠের সবুজ ঘাস দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আমার ডাইনিং টেবিলের জানালা দিয়ে মাঠটা প্রতিদিন দেখি আর সকালের নাস্তা করি। একদিন বিকেল বেলা সব ফ্রেশার্সদের সেই মাঠে জড়ো করা হলো। চারজন করে মোট আটটা দলে ভাগ করে দেয়া হলো আমাদেরকে। প্রথমে সুমো রেসলিং খেলা হলো। এরপর চামচের উপর বল হাতে নিয়ে মিতালী দৌড় দেয়া হলো। মাঠের মাঝখানে বেশ বড় একটা বেলুন ফুলিয়ে তার উপর দুই জনকে বালিশ দিয়ে মাড়ামাড়ি করতে দেয়া হলো। এই খেলার নাম গ্ল্যাডিয়েটর। আর সবকিছুর শেষে থাকলো ফ্রি স্টাইল ফুটবল। যেই অচেনা মানুষগুলো একজন অন্যজনের সাথে আগে কথা বলতে ভয় পেতো, তারাই খেলতে খেলতে মুহুর্তেই বেশ বন্ধু বনে গেলো। বার্বিডল টাইপ সোনালি চুলের মেয়েদের সাথে কথা বলতে আমি কিছুটা ইতস্তত বোধ করি। কারণটা আমার জানা নেই। কিন্তু, আমার দলে স্ট্রাইকার পজিশনে এল নামের এক সোনালিচুলওয়ালী খেললো। আমি যতবারই বল ফরোয়ার্ড করি ততবারই এলের কাছে যায়। এইভাবেই দেখলাম তার সাথে কথা বলার জড়তাটা কেটে গেলো। একসময় এল এসে বললো চলো টেনিস বল দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ খেলি। জড়তা কাটিয়ে উঠাটা অক্সফোর্ডে খুবই দরকার। আমার কলেজ সেই কাজটা খুব সহজেই করে দিলো।
BBQ Party: বুঝতেই পারছেন ব্যালিয়লের বাগানটাকে কাজে লাগানো হয়েছে। সব ফ্রেশার্সদের জন্য নানা পদের মাংশ পুড়িয়ে দেয়া হলো। ভেজিটেরিয়ানদের জন্য থাকলো ফল আর সবজি। শেষে আসলো কেক-মাফিন। ফ্রি খেতে খেতে এক পর্যায়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলাম।
Mentor/Mentee Normal Hall: অক্সফোর্ডের বিশেষ ঐতিহ্য হলো এর হল ডিনারগুলো। ব্যালিয়লের হল দেখলে আপনি ভীষণ ইর্ষান্বিত হবেন। হ্যারি পটারের হগওয়ার্টসের হলের কথা মনে পড়ে যাবে। এই হলের ছবি দেখেই আমি ৩৮টি কলেজের মধ্যে ব্যালিয়লকে নিজের বাড়ি হিসেবে ঠিক করেছিলাম। ব্রিটিশদের হল ডিনারে অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। অন্যদেশের মানুষদেরকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই কেইটলিন আমাদেরকে প্রথম হলে তার সাথে করে নিয়ে গেলো। কলেজের ওয়েবসাইটে নিজের ব্যাংক একাউন্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডে টাকা আগে থেকেই লোড করে নিতে হয়। সেই আইডি কার্ডই তখন ডেবিট কার্ডের কাজটা করে। দুই কোর্স ডিনার ইচ্ছামতো নিয়ে কাউন্টারে কার্ডের বারকোড স্ক্যান করলেই আমার অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা কেটে রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডের ব্যবহার যে কত সুন্দর হতে পারে তা অক্সফোর্ডে না আসলে আমি জানতেই পারতাম না। ডাইনিং হলে পরিচয় হলো আরে কিছু নতুন মুখের সাথে। এপর্যায়ে একজন আরেকজনের নাম ধরেও ডাকতে পারতাম।
Pub Quiz: ডিনার শেষে সবাই ফেরত গেলাম আমাদের ইনডোর গেইম রুমে। সেখানে আছে পুল বোর্ড, জিম, টেবিল টেনিস, প্লে স্টেশন, টিভি। আমাদের সবাইকে ৮ জনের ছয়টা দলে ভাগ করা হলো। এরপর শুরু হলো সাধারণ জ্ঞানের উপর কুইজ প্রতিযোগিতা। এক সায়েন্স রাউন্ড বাদে বাকী মোটামুটি সব রাউন্ডেই আমাদের দল সফলতার সাথে শেষ স্থান দখল করলো। এপর্যায়ে নিজেদের জ্ঞানের সংকীর্ণতা নিয়ে হাসি তামাশা করতে করতেই আমরা আরো ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। সবাই যেন দীর্ঘদিন থেকে একজন আরেকজনকে চিনি।
Medical Registration: ব্রিটেনের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ ফ্রি। সেই NHS সেবা কীভাবে গ্রহণ করতে হয় তা বোঝাতেই আমাদের কলেজের ডাক্তার আর নার্সরা এসে আমাদের নির্দেশনা দিয়ে গেলো। আমি সাথে সাথেই রেজিস্ট্রেশন করে নিলাম। সেখান থেকে চাইলে বিনামূল্যে টিকাগ্রহণও করা যায়।
LGBTQ+ Lunch: ব্যালিয়লে এবছর ফ্রেশার্সদের প্রায় অর্ধেকেই সমকামী। গতবছর থেকে অক্সফোর্ডে গে-প্রাইড-প্যারেড শুরু হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্বের অন্যতম সমকামী বান্ধব শহর। আমার অক্সফোর্ড আইডি কার্ডের ফিতাটা রেইনবো প্রিন্টের। সবাই আমার আইডিটা দেখে বেশ ঈর্ষান্বিত হয়। নাতাশা নামের একটা মেয়ে এসে আমাকে বললো, “Can you get me one of these? I want to be gay too!” ব্যালিয়লের সমকামী দলের নাম দেয়া হয়েছে “গেলিয়ল”। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম সমকামিতা ব্যাপারটাকে আমি বেশ সহজেই মেনে নিতে পারি। অক্সফোর্ডে আমার প্রথম ৯ জন বন্ধুর ৭ জনই সমকামী। এক ডিনারে তাই হাসতে হাসতে একজন বলে ফেললো, শামীর হলো এখানকার গে-কমিউনিটির সবচেয়ে বড় বন্ধু। নিজে স্ট্রেইট হলেও শামীরের স্ট্রেইট বন্ধু নেই বললেই চলে। LGBTQ+ লাঞ্চে সব সমকামী এবং তাদের বন্ধুদের জন্য ফ্রি খাবার দেয়া হলো। সেখানে প্রচুর গে-জোকস হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, সমকামীরা বেশ মজার মানুষ হয়। তাদের সাথে বেশ ভালো সময় কাটানো যায়।
Sexual Consent Workshop: ফ্রেশার্স উইকের এই ইভেন্টে অংশগ্রহণটা বাধ্যতামূলক। পরিণত বয়সের অধিকাংশ অক্সফোর্ড স্টুডেন্টই যৌনজীবনে সক্রিয়। তাই, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং কনসেন্ট জিনিসটা পরিষ্কারভাবে সবাইকে বোঝাতে ৬ জনের দলে ভাগে করে চারটা কেইস দেয়া হলো। প্রতিটা ক্ষেত্রে আলোচনা করা হলো এই ঘটনায় কনসেন্টের অভাব আছে কিনা; এটা কি রেপ হয়েছে কিনা ইত্যাদি। এই ওয়ার্কশপের বইগুলো আমি তাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। সময় পেলে কনসেন্টের উপর একটা ব্লগ লিখবো।
Pub Crawl: এটা ব্রিটিশদের বিশেষ একটা ট্রেডিশন। রাত আট-টা থেকে শুরু করে সবাই মিলে একটা করে পাবে ঢুকে একগ্লাস বিয়ার খাবে। তারপর দৌড় দিবে পরবর্তী ক্লাবে। বিয়ার জিনিসটা আমার খুব একটা পছন্দ না। তাই কোকের উপর দিয়েই আমার পাব ক্রল হলো। একপর্যায় আমরা প্রায় অক্সফোর্ডের সবগুলো পাবেই ঘুরে ফেললাম। সামাজিক জীবনে মাত্র এক সপ্তাহেই কীভাবে মিশিয়ে দিতে হয় তা অক্সফোর্ড সুন্দর করেই জানে।
Freshers’ Formal Dinner: অক্সফোর্ডের আরেক বিশেষ রীতি। প্রতি সপ্তাহে একজন অক্সফোর্ডের বিশেষ গাউন পড়ে, স্যুুট-টাই লাগিয়ে ডিনারে যেতে হয়। দুই কোর্সের বদলে সেখানে থাকে তিন কোর্স খাবার। এই রীতিগুলো অক্সফোর্ডের ছাত্রদের বেশ স্মার্ট বানায়। তাদের কাপড়-চোপড় আর ডাইনিং এটিকেট দেখলে আপনি বেশ মুগ্ধ হয়ে যাবেন। আমার সুপারভাইজার যতবার আমাকে স্যুুট পড়া অবস্থায় দেখেছে ততবারই রসিকভঙ্গিতে বলে, “শামীর, তুমি বেশ স্পয়েল্ট হয়ে যাচ্ছো!”
প্রথম ফর্মাল ডিনারটা একটু বেশীই জাঁকজমকপূর্ণ। প্রথমে সবাইকে ডাইনিং হলের পাশে সিনিয়র কমন রুমে একত্রিত হতে বলা হলো। সাধারণত এইটা ফেলোদের চিল প্যালেস; আমাদের মতো ছাত্রদের এখানে জায়গা নেই। শুধু এই প্রথম ফর্মালে আমরা ফেলোদের রুমে ঢুকে তাদের সাথে কথা বলে পরিচিত হলাম। চারপাশ থেকে ওয়েটারবৃন্দ দামী মদের প্রবাহ বহিয়ে দিচ্ছে; আমার মতো কয়েকজন অরেঞ্জ জুসে তাদের চেষ্টা মেটালো। জাপানী এক মেয়ে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি পড়তে এখানে এসেছে। তার নাম এন। আমি আর এন আমাদের ফেলোকে খুজেঁ বের করার ব্যর্থ প্রয়াস চালালাম। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর একজন ওয়েটার বিশাল এক ঘন্টা বাজিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দিল। মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, “Ladies and Gentlemen, the dinner is ready!”
ফর্মালের জন্য সবাই তাদের সেরা, স্যুট, টাই পড়ে এসেছে। আমি অক্সফোর্ডের রীতি মানতে সাদা বো-টাই লাগিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকেই সেটার ভূয়সী প্রশংসা করলো। এতো সুন্দর করে সজ্জিত একদল তরুণ-তরুণী যখন হলে প্রবেশ করলো তখন হ্যারি পটার মুভির সেই ডাইনিং হলের কথা মনে পড়ে গেলো। বিশাল লম্বা লম্বা টেবিল। তার উপর মৃদু আলোর বাতি। প্রতিটা স্থানে তিন কোর্স খাবারের চামচ, প্লেট, রুটি, রুমাল রাখা; তার সামনে ব্যালিয়লের লোগো সজ্জিত একটা সাদা কার্ড। সেই কার্ডের উপর লেখা আমাদের নাম। Shamir Montazid লেখা সীটে বসতেই চারপাশের মানুষের সাথে গল্প জমিয়ে দিলাম। আমার পাশের ছেলেটা একজন ডাচ ডাক্তার; নাম তার এডিয়েন। তার গার্লফ্রেন্ড অক্সফোর্ডে আসতেসে; তার আধা ঘন্টার মধ্যে ট্রেন ধরতে দৌড় দিতে হবে। কি আর করার! সে আমাকে বললো, “আমার ডেজার্টটা তুমি খেয়ে ফেলো।”
প্রথমে আসলে স্টার্টার। খুব বিশাল বাটির মধ্যখানে অল্প একটু স্যুপ আর একটা রুটি। সেটার পর থাকলো ভেড়ার মাংসের রোস্ট আর ভাত। মিষ্টান্নে আসলো চিজ কেক, পানা কোটা, আইসক্রীম। আর পুরো খাবার জুড়ে রেড আর হোয়াইট ওয়াইনের গ্লাস কারো খালি হলো না। এবার অরেঞ্জ জুস না মেলায় শুধু পানিতেই আমার কাজ চালাতে হলো।
প্রতিটা কোর্সের প্রায় বিশ মিনিট পর পরের কোর্স আসবে। মাঝখানের সময়টায় আমরা ভীষণ গল্পে মাতলাম। আমার সামনের ছেলেটা ব্রাজিলের ডাক্তার- পেড্রো। সে ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিচ্ছে। তার পাশেই আরেক অষ্ট্রেলীয় ডাক্তার হেনরি। সে বাংলাদেশের ক্রিকেট টীমের ফ্যান। নানা ডাইমেনশনে চললো সেই আলোচনা। কখনো ধর্ম, কখনো রাজনীতি, কখনো বিজ্ঞান— অক্সফোর্ডে আছি তো! কি আর করার! খাবারের শেষ দিকে কলেজের মাস্টার সবাইকে চুপ করিয়ে ভাষণ দিলেন। ব্যালিয়ল কলেজের বিশাল ইতিহাস এবং ঐতিহ্য তুলে ধরা হলো। নোবেল লরিয়েট থেকে প্রাইম মিনিস্টার— সবাই এখানে পড়েছে। এই কলেজের শুরুট হয়েছিলো মধ্যবিত্ত সমাজের উচ্চশিক্ষার কথা মাথায় রেখে।
ভাষণের পর আমরা গেলাম মিডেল কমন রুমে। সেখান বিশ রকমের চকলেট আর পোর্ট ওয়াইন দেয়া হয়েছে। ডজনখানেক চকলেট মুখে পুড়ে বাড়ি ফিরে আসলাম। আহ! এই ডিনারের কথা আজীবন মনে থাকবে। নিজের নাম লেখা কার্ডটা অবশ্য স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এসেছি!
Freshers’ BOP: সারা সপ্তাহের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বপ হলো নাচার অনুষ্ঠান। এইবারের বপের থিম হলো “সুপার হিরো- সুপার ভিলেন”। সবাই সেই অনুসারে সেজেগুজে নাচতে আসবে। ব্যালিয়লের বারের সবগুলো দরজা সে রাতে খুলে দেয়া হয়। ককটেইলের পর ককটেইল; সবার জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি। তবে কেউ চাইলে শুধু কোক-লেমোনেড খেয়েও রাত কাটাতে পারে। তাতে কেউ মাইন্ড করবে না।
Matriculation: এর মাধ্যমে অক্সফোর্ডের নবীন বরণ শেষ হয়। শেলডোনিয়ান থিয়েটারে "সাব ফাস্ক" ড্রেস পড়ে সবাই একত্রিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অক্সফোর্ডের ব্রত গ্রহণ করে। এরপর গ্রুপ ফটোসেশন হয়।
আমি শুধু অক্সফোর্ডের বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোর কথাই এখানে বলার চেষ্টা করলাম। অন্যান্য কমন ভাষণ, চা-কফির আড্ডাগুলো বাদই দিলাম। ফ্রেশার্স উইক করতে করতে সবাই বেশ ক্লান্ত। পড়াশোনা কিংবা গবেষণা— কোনটাই এখনো শুরু হয়নি। আমি অবশ্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন সেট জীবনটা শুরু হবে। ইতোমধ্যেই সময় পেলে ল্যাবে চলে যাই। ল্যারি নামের একটা আর্ডারগ্র্যাডকে আমি এখন সুপারভাইজ করি। ওকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শেখাচ্ছি; যদিও নিজে খুব একটা ভালো পারি না। না জানাটা এখানে কোন সমস্যা নয়; শেখার আগ্রহ থাকটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আমার আর ল্যারির সেই আগ্রহ বেশ প্রখর। হয়তো আগামী কয়েক'শ এক্সপেরিমেন্ট ফেইল করার পর সফলতা পাবো। সেই জীবনটা শুরু হওয়ার আগে এই ফ্রেশার্স উইকটা বেশ স্মৃতিরোমন্থনযোগ্য একটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলো।
Thank you, Oxford. You are the best.