হাসি-আনন্দ-কান্নার ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়
Personal Life

হাসি-আনন্দ-কান্নার ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়

Jul 1, 2017   |    11685


কার্জন হলের দোতলাটা অসাধারণ এক জায়গা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে করিডোর পেরিয়ে ঠিক মাঝখানটাতে আবার তিন তলায় উঠার সিঁড়ি। সেই সিঁড়িটা প্রায় সবসময়ই তালাবদ্ধ থাকে। শুধুমাত্র তার নীচের তিনটা পাটাতনে বসে থাকা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো এই সিঁড়িটা। এখানে বসলে আপনি পুরো কার্জন হলের সুন্দর একটা চিত্র দেখতে পাবেন। পহেলা ফাল্গুনে সেখান থেকে দাড়িয়ে অপরূপ এক দৃশ্য চোখে পড়ে। অসামান্য রূপবতী মেয়েরা হলুদ শাড়ি পড়ে কার্জনের আঙ্গিনায় ভীড় জমায়। তাদের আভা বসন্তের ফুলগুলোর সৌন্দর্যকেও হার মানায়। 
 
শিশু একাডেমীর সামনের রাস্তা থেকে দাঁড়িয়ে আপনি যদি কার্জন হলের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাহলে দোতলার ঠিক মাঝখানে যে একটুকরো অন্ধকার স্থানের দেখা মিলবে সেখানেই সিঁড়িটার অবস্থান। বাহির হতে সেখানে কিছু আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু, সে জায়গাটা থেকে দাড়িয়ে সমগ্র দুনিয়াটাকে খুবই উজ্জ্বল মনে হয়। 
 
সিড়িটার আরেক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোএটি একটি ব্লাইন্ড স্পট সেখানে দাড়িয়ে থাকলে আপনি সবাইকে দেখতে পাবেন। অথচ করিডোর দিয়ে যে আসবে সে আপনাকে দেখতে পারবে না। যখন মনটা অনেক কষ্টে ভরে উঠবে, তখন সেখানে যেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে আসবেন। কেউ জানতেও পারবে না। চোখের পানি অথবা হাসির রোলগুলো সেই সিঁড়ির পাটাতনে মিশে মিশে দিনকে দিন আরো কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। অসাধারণ উজ্জ্বল সেই বর্ণ। 
 
আমার প্রতিবছর ফাইনাল পরীক্ষার সীট পড়ে কার্জনে। তৃতীয় বর্ষে রোল ছিল- কার্জন-৩০৭। প্রতিদিন সকালে পরীক্ষা দিতে ঘন্টা আগেই চলে যেতাম। সবাই জটলা পাকিয়ে বসে বসে পড়তো। আর আমি সবজান্তা ভাব নিয়ে কার্জনের করিডোরে হাঁটতাম। অসামান‍্য বিস্ময়ে লক্ষ‍্য করতাম, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের এসির ফাঁকে বাসা বাঁধা জালালি কবুতর তার ইলেকট্রনিক্স অ্যাডাপটেশনে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছে! 

 
আর যখন পরীক্ষাটা শেষ হয়, তখন আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকি উপরের দিকে। কারুকাজ করা কার্ণিশ, অসামান্য সেই ডিজাইন। ভাবতেই ভালো লাগে আমি এখানে পড়ি। না! বলা উচিত আমি এস্থানের একজন অধিকারী। অধিকার খাটাতে সবারই ভালো লাগে। কার্জনের উপর আমার অনেক স্মৃতির অধিকার, অনেক হাসির অধিকার, অনেক দু:খের অধিকার 
 
আমার ক্লাস হতো সায়েন্স কমপ্লেক্স বিল্ডিং-এর ৬ষ্ঠ তলায়। এর উপরেই ছিলো ছাদ। প্রায়ই ক্লাসের ফাঁকে সেই ছাদে উঠে বসে থাকতাম। ঢাকা শহরে এর থেকে সুন্দর সবুজ দৃশ‍্য হয়তো অন‍্য কোথাও দেখতে পাবেন না। এক দিকে সৌহরাওয়ার্দী উদ‍্যানের ঘন সবুজ বরণ, অন‍্যদিকে গাছের আচ্ছাদনে আবৃত ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের রাস্তা। বৃষ্টির দিনে এই জায়গাটা আমার সবচেয়ে পছন্দের। ছাদের কোণ থেকে পা ঝুলিয়ে বসে বৃষ্টিতে ভেজা আমার ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি গুলোর একটি। 
 
আমি কেমিস্ট্রির অনেক বড় ভক্ত। একদিন অনিন্দ‍্য-সুন্দর নয়নাভিরাম বৃষ্টির দিনে আমার সবচেয়ে প্রিয় রফিক স‍্যারের কেমিস্ট্রি ক্লাস ছিলো। হঠাৎ এক বান্ধবী ফোন দিয়ে বললো, চলো বৃষ্টিতে ভিজি। সেইদিন আমি বুঝতে পারলাম আমি কেমিস্ট্রি অপেক্ষা বৃষ্টিকে একটু বেশি ভালোবাসি। আমার অনেক ক্লাসের অ‍্যাটেনডেন্সটাও বৃষ্টির কারণে কাটা গেছে। যেহেতু এই উপস্থিতির উপর পরীক্ষার নাম্বারও নির্ভর করে, সেহেতু এর ফলাফলও আমি হারে হারে টের পেয়েছি। জীবনে যে কয়েকটি কোর্সে A+ মিস করেছি তার সবগুলোতেই বৃষ্টির বেশ সরাসরি হাত ছিলো। ঢাকা  বিশ্ববিদ‍্যালয় ছাড়া বৃষ্টি উপভোগ করা আমার জন‍্য প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। 
 
শহীদ মিনারের উল্টোদিকে মোতাহের ভবন। এর সামনের আঙ্গিনায় একটা সোনালু গাছ আছে। চরম ভাপসা গরমের দিনে গাছটা ফুলে ফুলে হলুদ হয়ে যায়। নিজের আভিজ‍াত‍্যের খানিকটা রঙ পরম যতনে সে ছড়িয়ে দেয় সবুজ ঘাসের উপর। ফুলের হলুদ আর ঘাসের সবুজ রংটা মিশে এক মায়াবী সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। তার উপরে কোন একটা মেয়ে তার শাড়ির আচঁল ছড়িয়ে বসে আছে, এটা ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। 
 
সবার যখন গ্রীষ্মের তাপদাহে জীবনটা যায় যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের মানুষগুলোর জন‍্য তখন অপেক্ষা করে আরেকটি অযাচিত সৌন্দর্যকৃষ্ণচূড়া! টিএসটি থেকে কলা ভবনের দিকে রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় হাতের ডানদিকে তাকিয়ে থাকলেই দেখা যাবে লালের এক ভাসমান গালিচা। তারমধ‍্যে সবচেয়ে সুন্দর গাছটা দেখতে পাবেন আইবিএর সামনে ডাকসুর ঠিক পাশে। এই গাছটার আমি মনে মনে নাম দিয়েছিকৃষ্ণরাণী এর থেকে বেশি ফুল আমি আর কোথাও ধরতে দেখিনি।

মানুষ  বিশ্ববিদ‍্যালয়ে পড়তে যায় ডিগ্রী অর্জনের জন‍্য, ভবিষ‍্যতে ভালো চাকুরী পাবার জন্য। আর আমি ঢাকা  বিশ্ববিদ‍্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছিলাম টিএসসি-চারুকলায় আড্ডা দেয়া, শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় বৃষ্টিতে ভেজার জন‍্য জীবনের পাচঁটা বছর দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেলো ঢাকা  বিশ্ববিদ‍্যালয়কে নিজের বলতে পারার অহংকারটা আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে। এখন আমার নামটা ছাত্র থেকে অ‍্যালামনাই তালিকায় চলে যাবে। সত‍্যিই, “অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই 
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম আক্রমণগুলোর একটা ছিলো ঢাবির সূর্যসেন স্কোয়াডের। এই দলের অনেকেই ছিলো শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র। ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন সবাই দিশেহারা, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-না-মানা বেদায়প ছেলেগুলো তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করলো। কখনো সময় হলে একবার মধুর ক‍্যান্টিনে যাবেন। খাবার খুবই খারাপ। তারপরও যাবেন। একবার ছাদের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন, মধুর ক‍্যান্টিনের পুরোটা জুড়ে একটা বাংলাদেশের পতাকা আকাঁ। পাশের দেয়ালেই মধু-দার একটা ছবি। সেই ছবিটার নিচে লিখা:
 
আমরা তো ভাই অসভ‍্য বুনো, বৃথা রক্তের শোধ নেবো দুনো।
 
আজ জুলাই, ২০২০। ঢাকা  বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ১০০ তম জন্মদিন।
 
ভালোবাসি তোমায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুভ জন্মদিন।
 



Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.