১০ মিনিটের গল্প
May 2, 2017 | 11484
সেটা
2014 সালের কথা। সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পা দিয়েছি। জানুয়ারি
মাসের দিকে নিলয় ফোন
দিয়ে বললো-
“দোস্ত,
একটা ছেলের সাথে তোর পরিচয়
করিয়ে দিতে চাই। তোর
সাথে ওর আইডিয়া ভালো
জমবে।”
শুনে
প্রথমে তেমন পাত্তা দিলাম
না। নিলয়ের সব কথা ফুলিয়ে
ফাপিয়ে বলার একটা অভ্যাস আছে। যাই
হোক, কিছুদিন পর হঠাৎ আবার
ফোন আসলো। অগত্যা একদিন
সকালে সেই ছেলের সাথে
দেখা করতে গেলাম ঢাবির
সায়েন্স লাইব্রেরির পাশের টং দোকানে। ছেলেটার
নাম আয়মান সাদিক।
আয়মান
সাদিকের আচার ব্যবহার
অমায়িক। প্রচন্ড ধার্মিক এবং ভদ্র স্বভাবের।
একটা ল্যাপটপ বের
করে সে পাওয়ার পয়েন্টে
প্রেজেন্টেশন শুরু করে দিলো।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কেবল পাওয়ার পয়েন্ট
ব্যবহার করে ছেলেটা শিক্ষামূলক
একটা ওয়েবসাইটের আইডিয়া পুরো জীবন্ত করে
তুলেছে। আমাকে বললো তার সাথে
কাজ করতে। আমিও কিছুটা ইতস্তত
করা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলাম।
পরদিন
দেখি আয়মান একটা গ্রাফিক্স ট্যাব নিয়ে আমার
ডিপার্টমেন্টে হাজির! কী মুসিবত! এই
ছেলে দেখি পিছু ছাড়বে
না! আমি আমতা আমতা
করে ট্যাবটা হাতে
নিলাম। বাসায় গিয়ে কম্পিউটারে বসে বসে বানালাম
আমার জীবনের প্রথম অনলাইন ভিডিও। সেটা ইউটিউবে দিয়ে
আয়মানকে দেখলাম। ছেলেটা প্রশংসা করে ভাসায়া দিলো।
(মূলত কেউ যদি কাশিও
দেয় তাও আয়মান তার
কাশি দেয়ার স্টাইলটার একটা ভূয়সী প্রশংসা
করে বসবে।)
বেশ
কিছুদিন ধরে চললো বাসায়
বসে বসে ভিডিও বানানোর
সেই কাজ। কিন্তু, সেই
ভিডিওগুলো মনমতো হচ্ছিলো না করোরই! হঠাৎ
2015 এর মাঝামাঝি সময়ে শুনলাম, আয়মান তার ওয়েবসাইট বানানোর
কাজ শেষ করে ফেলেছে।
রাঈদ নামের একটা অসাধারণ কোডার
প্রায় 1বছর দিন-রাত
কাজ করে সাইটটা তৈরি
করেছে। তখনো সাইটটি পাবলিশ
করা হয়নি। আমি জীবনে প্রথমবারের
মতো ঢুকলাম
www.10minuteschool.com এ!
নিমেষেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আয়মান
প্রায় 1বছর খেটে খুটে
টিউশনির টাকা খরচ করে
দাড়ঁ করিয়েছে এই সাইট। কিনে
ফেলেছে একটা ক্যামেরা
এবং লাইট। ব্যাস! শুরু
হয়ে গেল 10 minute school এর প্রথম স্টুডিও!
কলাবাগানের
এক গলির চিপায় প্রতি
শুক্রবার আমাদের শুটিং হতো। দিনভর চলতো
আড্ডা-খাওয়া-দাওয়া। সেখানে ক্যামেরা এবং
সাউন্ডের কাজ করতো শামস
এবং জিহান। দুজনেই তখন আইবিএর প্রথম
বর্ষে পড়তো। আমরা চারজন মিলে
প্রতি সপ্তাহে ভিডিও প্রসব করতে লাগলাম। সেই
ভিডিও আপলোড হলো 10 Minute School এর সাইটে। মানুষজনের
কমেন্ট দেখে উৎসাহ 100গুন
বেড়ে গেলো। কিন্তু, সমস্যা হয়ে
দাড়ালো তখন ভিডিও এডিটিং
এর কাজ করা। তখন,
রক্ষাকর্তা হয়ে আমাদের দলে
যোগ দিলো রামিম নামের
অত্যন্ত সুন্দর দেখতে একটা ছেলে।
রামিমকে
বলা হয় গ্রামার নাজ্জি। কেউ এক লাইন
ইংরেজি বললে সে 10টা
ভুল বের করে ফেলবে।
ছেলেটা ভিডিও এডিটিং করার জন্য
কিছুদিন আগে 64হাজার টাকা দিয়ে একটা
গ্রাফিক্স কার্ডও কিনে ফেলে! পিকশনারি
খেলায় রামিমকে হারানো অসম্ভব! বর্তমানে সে সদ্য
সিংগেল হওয়া জীবন উপভোগে ব্যস্ত।
শামস
আমাদের অসাধারণ ট্যালেন্ট! কম্পিউটারের যত বিদঘুটে কঠিন
সফটওয়ার আছে তার প্রায়
সবই তার নখদর্পনে। আমাদের
অধিকাংশ ভিডিও এডিটিংই হয় এই রামিম
ও শামসের হাতে। (ভিডিও আপলোড হতে দেরি হলে
কারা দায়ী সবাই হয়তো বুঝে
গেছেন!)
শামসের
একটা মজার ঘটনা বলতেই
হয়। ওর ছোটভাই গেইম
অফ থ্রোন্সের ভক্ত। কিন্তু, টিভি সিরিজটার খোলামেলা
দৃশ্য এবং হিংস্রতা
ওই ছোট বাচ্চার জন্য অনুপোযোগী। তাই
প্রতিটি এপিসোড বের হলে শামস
সেটা এডিট করে ছোট
ভাইয়ের দেখার উপযোগী করে তোলা। কিন্তু,
সে কখনোই কাহিনী পরিবর্তন করে না। ধরুন,
গুরুত্বপূর্ণ একটা দৃশ্যে
খালিসী সম্পূর্ণ উলঙ্গ। শামস সেই সিনটা
জুম করে গলা পর্যন্ত
রেখে বাকিটা কেটে দিবে। অবসর
সময়ে শামস তার প্রিয়
কুকুর Shadowকে নিয়ে খেলা
করে। Shadow এর প্রতি তার
ভীষণ টান। Shadow অসুস্থ হওয়ায় প্রায় 1মাস 10Minute School এর ভিডিও এডিটিং
বন্ধ ছিলো!
জিহান-
অসম্ভব মাত্রায় ফাকিঁবাজ একটা ছেলে। ধরুন, তাকে বলা হলো
5 প্যাকেট কাচ্চি নিয়ে আসতে। সে টাকা নিয়ে
বাসায় খেতে চলে যাবে।
তার আর আসার নাম
থাকবে না। শুটিং এর
জন্য 10টায় আসতে
বলে নিজে ঘুম থেকে
উঠবে 11টায়। তার অন্যতম
দায়িত্ব সাউন্ড এডিটিং করা। আমাদের ফাটা
বাশেঁর মতো গলাকে সে
এডিট মেরে অসাধারণ বানিয়ে
দেয়। ছেলেটাকে আমরা অনেক গালাগালি
করি। কিন্তু, যত যাই হোক
না কেন, জিহানকে ছাড়া
আমাদের চলে না।
আমাদের
আরেকটা সম্পদের নাম সাদমান সাদিক।
যেকোন মোবাইল app এর পরের ভার্সন
যেমন আগেরটার থেকে ভালো হয়;
সাদিক পরিবারেও সেই ঘটনা ঘটেছে।
সাদমান সাদিক তার বড় ভাই
আয়মান সাদিককে মোটামুটি সবকিছুতেই হার মানায়। তার
পাওয়ার পয়েন্টের কিছু কিছু টিউটরিয়াল
বিদেশেও ভাইরাল হয়েছে! আমি নিজে graduation শেষ
করে সাদমানের ভিডিও দেখে সিভি বানিয়েছি।
এই ছেলে মোটামুটি আমার
সফটওয়ার শিক্ষক!
জাহাঙ্গীর
নগরের একটা জিনিয়াস আছে
আমাদের সাথে। নাম তার মেহিদী।
মেহিদী একটা সুপার হিরো। Animation হচ্ছে তার সুপার পাওয়ার।
আমরা যা 1ঘন্টা ধরে
বোঝানোর চেষ্টা করবো সেটা মেহিদীর
বানানো 1মিনিটের একটা animation বুঝিয়ে দিতে পারে। এই
ছেলেটা ক্লাস শেষ করে বাসায়
ফিরেই সারারাত জেগে আমাদের স্বপ্নের
স্কুলটার জন্য animation বানায়।
সুপার হিরোর মতই তার ডুয়াল
লাইফ। দিনে সে ছাত্র,
রাতে Animator. ছেলেটা একদিন অনেক বড় হবে।
হয়তো বাংলা animation মুভিটুভিও বানিয়ে ফেলতে পারে।
এইভাবে,
পাগল ছাগল কিছু ছেলে
বানাতে থাকে তাদের স্বপ্নের
10 মিনিটের ইশকুল। সেই ইশকুলে পরবর্তীতে
যোগ দেয় রাতুল ভাই,
শুভ, ইরফান, আকাশ, সালমান নামের নতুন কিছু পাগল।
পর্দার পেছনে আছে আরো 50-60 জন
পাগল!
পাগল
কেন বলছি?
শুক্র-শনিবার বন্ধের দিনে সকাল বেলার
ঘুম হারাম করে ইশকুলের বাচ্চাদের
জন্য ‘’মজায় মজায়
শেখার ভিডিও” বানাতে কয়জন রাজি হবে? তাও
আবার সেটা বিনাবেতনে!
প্রথম
প্রথম আমরা সবাই টাকা
পয়সা নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম।
এতো বড়ো ওয়েব সাইট
দেখাশোনা করা মেলা টাকার
খেলা। সেই সমস্যার
সমাধান হলো মুঠোফোন কম্পানি
রবির হাত ধরে। রবি
এসে আমাদেরকে জ্বালিয়ে দিতে থাকলে আরো
বেশি আপন শক্তিতে!
আস্তে
আস্তে আমাদের স্বপ্নটা বাস্তব হতে থাকলো। এখন
আমরা আরো বড় স্বপ্ন
দেখি। একদিন শুধুমাত্র 10 মিনিটের স্কুলে বসেই বাংলাদেশের সবাই
পড়াশোনা করবে। প্রয়োজন হবে না কোন
কোচিং সেন্টারের। দেশের আনাচে-কানাচের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাসে দেখানো হবে আমাদের ভিডিও।
সরকার এসে আমাদের সাহায্য করবে এই
দেশটাকে বদলে দিতে।
এখন
প্রায়ই মনে হয় 2014 সালের
সেই সকালটার কথা। টং এর
দোকানে চা খেতে খেতে
আসাধারণ একটা কিছুতে লেগে
গিয়েছিলাম। এখন সেটা সবচেয়ে
বড় নেশাতে পরিণত হয়েছে।
যাই
হোক, অনেক কথা বলা
হয়েছে। আজকে তাড়াতাড়ি শুতে
যেতে হবে। কাল শনিবার।
সকাল 9.00টায় 10 মিনিট স্কুলের শুটিং আছে। সকাল সকাল
উঠতে না পারলে 20 হাজার
ছাত্র-ছাত্রীর জৈব যৌগ চ্যাপ্টারটা পড়তে দেরী হয়ে যাবে!
সেইটা কি আর হাইজেনবার্গ
হয়ে মেনে নেয়া যায়?
শামীর
মোন্তাজিদ
হাইজেনবার্গ,
10 মিনিট স্কুল