মুক্তিযুদ্ধের গল্প
May 27, 2020 | 2970
এক.
মাগুড়ার এক গ্রামের মক্তবের শিক্ষক ছিলেন ফরাসউদ্দিন মাওলানা। ১৯৭১ সালে পাকিস্থানী বাহিনী যখন তার গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো, তখনো এশার নামাজের ইমামতী করছিলেন তিনি। রাত্র দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখলেন তার নিজের বলে আর কিছুই নেই। ভিটে-বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে; দশ বছরের ছেলেটার বেয়নেটে-খোঁচা দেহ উঠানের এক কোণে পড়ে আছে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানতে পারলেন তার তিন মাসের অন্ত:সত্ত্বা মেয়েটাকে হানাদার বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেছে। হত-বিহবল এই মাওলানা আর ধর্মের দোহাই দিয়ে টিকিয়ে রাখা “পাক”স্থানে থাকতে চাইলেন না। ফজরের নামাজের ইমামতী করে যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীতে। মাগুড়ার বেশ কিছু বড় গেরিলা যুদ্ধে মেহেদী-পাকা দাঁড়িওয়ালা এই ভদ্রলোককে দেখা যেতো। পড়নে থাকতো লুঙ্গি; হাতে একটা স্টেনগান। শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিলো ৯ নভেম্বর। বাদ আছর পাকিস্তান বাহিনীর একটা বিশাল গাড়িবহরের সামনে তার ৭ জনের দল নিয়ে সম্মুক্ষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতি দশজন হানাদারের বিপরীতে একজন মুক্তি। কিন্তু, ফরাসউদ্দীন মাওলানার তো হারাবার কিছু নেই। জুম্মার নামাজের ইমামতী করা লোকটা সেই আত্মঘাতী মিশনেরও ইমামতী করতে করতে শহীদ হলেন। ১৭ নম্বর গুলিটা তার মস্তিষ্কের আঘাত করার আগ পর্যন্ত তার হাতে মারা পড়ে পঞ্চাশের অধিক হানাদার। ফরাসউদ্দীন মাওলানার জানাজা পড়া হয়েছে নদীর পাড়ে; ঠিক যেখানটায় তিনি নিজের ছেলের জানাজার নামাজের ইমামতী করেছিলেন।
দুই.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শিবলী। লেখাপড়ার বাইরে খুব বেশী জিনিসে শিবলীর মন নেই। খুবই শান্ত-শিষ্ট ভদ্র স্বভাবের মিতভাষী একটা ছেলে। ২৫ মার্চের কালোরাতের পর সে কোনমতে বিক্রমপুরে তার গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যায়; জুন মাসের শেষ দিকে ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। আঁতেল স্বভাবের এই ছেলেকে দিয়ে গোলাগুলি করাবার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ খুব সহজ একটা কাজ শিবলীকে দেয়া হয়। গুলি করতে হবে না; গ্রেনেডও মারতে হবে না। বুকের মাঝখানে বাংলাদেশের নাম আর বড় একটা বোমা বেঁধে শুয়ে পড়তে হবে পাকিস্তানী ট্যাংকের সামনে। সারা জীবন অম্ল-ক্ষারের বিক্রিয়ায় লিখে অভ্যস্ত এই ছেলেটা তার জীবনের শেষ পরীক্ষাতেও একটা সুন্দর রসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটালো। শিবলীর আক্রমনে সেদিন মারা পড়ে ৯ জন পাকিস্তানী হানাদার আর তাদের বিশাল এক ট্যাংক। জানাজা পড়বার মতো শিবলীর পর্যাপ্ত মাংস টুকরো জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
তিন.
রাজশাহী সদরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে শিউলী। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিলো মাত্র ১৯ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর শিউলী আর তার মা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করে বিতরণ করতো। জুন মাসের ৭ তারিখ তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল। শিউলী আর তার মা মিলে চারটা মুরগী জবাই করে রান্না শুরু করে। ইতোমধ্যে নিকটবর্তী হানাদার ক্যাম্পে খবর চলে যায়। ঘন্টাখানেক পর বাড়ির দরজায় খট খট আওয়াজ। বাহির থেকে একজন পাকিস্তানী সেনা বলে উঠে, “মুক্তি বাহার আও”। প্রায় পাঁচ মিনিট পর দরজারটা খুলে যায়। ১৯ বছর বয়সী লাস্যময়ী এক বঙ্গ নারী হানাদার বাহিনীকে বেশ সুন্দর করে ঘরের ভেতরে আসতে আমন্ত্রণ জানায়। আকার-ইঙ্গিতে কমান্ডার বুঝতে পারে এই মেয়ে তাকে শোবার ঘরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। নিজের বন্দুক আর হেলমেটটা খুলে রেখে শিউলীর সাথে ভেতরের ঘরে ঢুকবার মিনিট দশকের মাঝেই বেশ জোরে এক পাকিস্তানীর আর্তনাদ শোনা যায়। সেদিন চারটা মুরগীর পাশাপাশি একটা পাকিস্তানীও সেই বাড়িতে জবাই হয়েছিলো। পেছন থেকে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর গুলির শব্দ। টোপ ফেলে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে এনে হানাদার বাহিনী দমন করেছিলো ১৯ বছরের সেই মেয়ে।
চার.
ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপারে দোহার উপজেলার চরকুশাই গ্রাম। সেই গ্রামের মোল্লা বাড়ির তৃতীয় ছেলে আব্দুল হাই। বয়স মাত্র ১৬ বছর। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের এক ভোর রাতে মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখে রেখে হাই চলে যায় ২ নং সেক্টরের ক্যাম্পে যুদ্ধ করতে। স্কুল-বয়সী এই কিশোর ছেলেটা বীজগণিতের বই রেখে হাতে তুলে নেয় বন্দুক আর গ্রেনেড। আট মাস পরিবারের মানুষের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। সবাই ভেবেই নিয়েছিলো সে আর ফেরত আসবে না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বন্দুকের কোণায় সদ্যস্বাধীন দেশের পতাকাটা ঝুলিয়ে সে ফিরে এসেছিলো তার মায়ের বুকে। ভাগ্যিস আব্দুল হাই ফেরত এসেছিলো! নয়তো ঠিক ৪৮ বছর পর অক্সফোর্ডের এক ল্যাবে বসে তার ছেলে আজকে মুক্তিযুদ্ধের এই গল্পগুলো শোনাতে পারতো না।
ফরাসউদ্দীন, শিবলীর মতো নাম-না-জানা লাখো শহীদ এবং শিউলী, আব্দুল হাইদের মতো গাজীদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
১৬ ডিসেম্বর ২০১৯