Story of the Invisible Classroom
Jul 3, 2017 | 6996
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের কথা। তখন আমি সারা দিন-রাত মোটামুটি ১০ মিনিট স্কুলেই থাকতাম। বাসায় কিংবা মাস্টার্সের ক্লাসে আমাকে খুব একটা খুজেঁ পাওয়া যেতো না। কলাবাগানের এক চিপায় আমি-জিহান-শামস রোজকার বস্তাপচাঁ রসায়নের ভিডিও বানাতাম। দুপুরের দিকে ঘুম থেকে উঠে আমাদের CEO সাহেব আসতেন Well Food থেকে একগাদা খাবার নিয়ে। আয়মান আসার সাথে সাথেই সব কাজ পন্ড হয়ে যায়। তাই, আমাদের প্রতিদিনের প্ল্যান থাকতো ও আসার আগেই শ্যুট এগিয়ে রাখা।
একদিন আয়মান বেশ লাফাতে লাফাতে রুমে ঢুকে বললো:
আয়মান: দো-ও-ও-স্ত! ফেইসবুকের লাইভ অপশনটা দেখসোস?
আমি: হুম। বেশ বাজে হইসে। আগে মানুষের Pre-recorded ফাতরামি দেখতাম। এখন সেইটা লাইভে দেখতে হবে।
আয়মান: আরে!!! দো-ও-ও-স্ত, এই লাইভে গিয়ে চল আমরা ক্লাস নেয়া শুরু করি। Can you imagine the impact?
আমি: ফেইসবুকে মানুষকে পড়তে বলবি? মানুষ ফেইসবুক চালায় Cat pictures এবং Meme দেখার জন্য।
আয়মান: ভালো তো! এতোদিন মানুষ Cat-Meme দেখেছে। এখন থেকে তোর চাদঁ বদন দেখবে!
আমি: একটু চিন্তা করে দেখ, কারো হোমপেইজে পর পর দুইটা ভিডিও আছে। একটাতে বাংলাদেশের এক সুন্দরী মডেল লাইভে মোচড়া-মোচড়ি করতেসে। অন্যটাতে আমি কেমিস্ট্রি পড়াচ্ছি। মানুষ কোনটা দেখবে?
আয়মান: চল, সেটা ট্রায়াল রান দিয়েই দেখি। কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই এখন একটা লাইভ ক্লাস নিবো। তুই একটা কাগজের উপর DNA কী সেটা বোঝাবি। কতজন মানুষ লাইভে দেখলে তুই ক্লাস নিতে রাজি হবি?
আমি: যদি বিশ জন মানুষও দেখে তাইলে আমি তোকে Rice-n-Noodles এ ট্রীট দিবো।
আয়মান: Deal.
এমন অবস্থায় জিহান ও শামস বুঝতে পারলো আমাদের ওই দিনের শ্যুটের অকাল মৃত্যু হয়েছে। কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই একটা সাদা কাগজ আর মার্কার হাতে দাড়িঁয়ে গেলাম। আয়মান উপর থেকে ক্যামেরাটা ধরে রাখলো।
দুপর ২টা নাগাদ ক্লাস শুরু হলো। আমি বোঝাতে লাগলাম DNA কি? ক্লাস যখন প্রায় ৫ মিনিট হয়েছে তখন আয়মান আমার ঘাড়ে টোকা দিয়ে মোবাইলের স্ক্রীনে তাকাতে বললো। চরম বিরক্তি নিয়ে সেদিকে দেখতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেলো।
লাইভে তখন ৬৫২ জন মানুষ শুক্রবার দুপুর ২ টায় DNA কি সেটা বুঝতেসে। আমি চোখ বন্ধ করে একবার চিন্তা করলাম, আমি এমন একটা ক্লাসরুমের টিচার যেখানে প্রায় সাড়ে ৬০০ ছাত্র-ছাত্রী বসে আছে। On that moment, LIVE class had
me!
সেই দিন থেকে আমার আর আয়মানের রাতের ঘুম প্রায় হারাম। কীভাবে লাইভ ক্লাসটাকে সবার কাছে নিয়ে যাওয়া যায়? একদিন জিহানের বাসায় বসে গল্প করতে করতে মাথায় আসলো, সামনেই তো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। গ্রামগঞ্জ থেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে মানুষ ঢাকার ফার্মগেটে এসে কোচিং করে। আর, যাদের আর্থিক সামর্থ্য কম তাদের জন্য ভর্তি পরীক্ষা খালি একটা স্বপ্নই।
ঠিক করলাম, এই বছর থেকে আমরা লাইভে পুরোদস্তুর ফ্রি ভর্তি কোচিং করাবো। রাত জেগে আমরা দুইজনে মিলে দাড়া করলাম ১৬০ ক্লাসের একটা প্ল্যান। কিন্তু, এতো ক্লাস নেয়ার মতো টিচার পাবো কই?
আমার পরিচিত বন্ধু-জুনিয়র-বড়ভাইরা এগিয়ে এলেন। দুইটা Make Shift Studio বানাতে হবে— একটা গ্রিনরোডে জিহানের বাসায়, অন্যটা খিলগাঁওতে আমার বাসায়। প্রতি স্টুডিওতে লাগবে একজোড়া লাইট, একটা প্রিন্টার আর কিছু জিনিসপত্র। একদিন ক্লাসশেষে আমি আর আয়মান নীলক্ষেত-এলিফ্যান্টরোড-পুরানা পল্টন সফরে গেলাম।
মাল্টিপ্ল্যান থেকে একটা UPS ও দুইটা Printer কেনা হলো। বেশ বড়-সড় এই তিনটা বাক্স নিয়ে কীভাবে বাসা পর্যন্ত যাবো তা দুইজন বের করতে পারছিলাম না। অবশেষে অবু-দশ-বিশ গুনে আয়মানের ভাগ্যে পড়লো UPS, আমি কোলে নিলাম Printer দুইটা। দুইজনের গা বেয়ে তখন দর-দর করে ঘাম ঝড়ছে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে আয়মান বললো, “দোস্ত, মানুষকে বিনামূল্যে ফেইসবুকে পড়াতে গিয়ে আমাদের কি হাল হচ্ছে এইটার একটা ছবি তুলে রাখা দরকার।” একটা UPS টানার কষ্ট সহ্য করতে না পারা ছেলেটার দিকে বেশ বিরক্তির দৃষ্টিতে আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম আর মনে মনে বললাম: “হায়রে! Rich kid of Dhaka City”
জুন মাস থেকে রুটিন করে শুরু হলো লাইভ ক্লাস। প্রথম দিনই রাতুল ভাইয়া আমার রেকর্ডের বারোটা বাজিয়ে নিজের লাইভ দর্শক সংখ্যা হাজার পার করলেন। ক্লাস শেষে লক্ষ করলাম, রাতুল ভাইয়া ঘেমে গোসল করে ফেলেছেন। কারণ, আমার রুমে এসি নেই। ক্লাসে নয়েজ কমাতে ফ্যান বন্ধ করে রাখতে হয়। অগত্যা নিজের তিন মাসের টিউশনির টাকা জমিয়ে একটা এসি লাগিয়ে ফেললাম। আমার ওরিয়েন্টেশন ক্লাসটাতে প্রায় ৫ হাজার মানুষ এসেছিলো। সেই ক্লাসটা নিতে গিয়ে আমি অত্যন্ত নার্ভাস ছিলাম। বার বার মনে হচ্ছিল এখনই বুঝি ইন্টারনেট কানেকশনটা যাবে। সেই ক্লাসের ভিডিওটা এখানে দেয়া হলো:
জিহান ছেলেটা ক্লাস গুলো আয়োজন করতে তার ২০০ পারসেন্ট ঢেলে দিতো । টিচারদের খাবার দাবার থেকে শুরু করে কখন হাসতে হবে, কখন কমেন্ট পড়তে হবে সব মনে করিয়ে দিতো। ক্লাসের মজাটা আরো জমে উঠলো যখন শুভ, নাহিয়ান, আকাশ আর ফাবলিহা ক্লাস নেয়া শুরু করে। মোটামুটি সায়েন্স, কমার্স, আর্টস- সবার জন্যই লাইভ ক্লাস শুরু হয়।
এতো বিশাল ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা বেশ কঠিন একটা কাজ। এই কাজটা সহজ করতে 10 Minute School LIVE নামে একটা গ্রুপ খোলা হলো। এখন তাতে প্রায় চার লক্ষ সদস্য। সাতক্ষীরার একটা মেয়ে হয়তো কোন ম্যাথ প্রবলেম মেলাতে পারছে না। সে একটা ছবি তুলে গ্রুপে পোস্ট করে দিলো। সাথে সাথেই বরিশাল থেকে কেউ একজন তার উত্তর দিয়ে দিলো। বাহ! জিনিসটা চোখের সামনে দেখতেই ভালো লাগছিলো।
গতবছর ঢাবি ঘ-ইউনিট পরীক্ষার আগের রাত্র আমরা ৬ ঘন্টা ব্যাপী একটা ম্যারাথন লাইভ ক্লাসের আয়োজন করি। বৃষ্টিতে ভিজে আমার বাসায় আসার পর সাধারণ জ্ঞান শিক্ষক শুভর জ্বর আসে। এক কাপ চা খেয়ে জ্বর নিয়ে ছেলেটা দুই ঘন্টা টানা ক্লাস নিয়ে গেলো। ক্লাস শেষে বললো, ভালো কাজ করার ইচ্ছাটাই মানুষের রোগ-ব্যধি তাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এই লাইভ ক্লাসের সময় থেকেই ১০ মিনিটের মানুষগুলোর সাথে রাত্রিযাপন শুরু হয়। এখন কোন শুক্রবার একটা Night-stay না হলে সেটাকে weekend মনে হয় না।
লাইভ ক্লাসের ভিডিওগলো আমরা পরে ফেইসবুক থেকে ডাউনলোড করে 10 Minute School LIVE নামক একটি YouTube Channel এ আপলোড করা শুরু করি।
এখন পর্যন্ত ৩১৭ টি ক্লাসের ভিডিও দেখা হয়েছে প্রায় ৫২ লক্ষ বার! সবাই মিলে প্রায় ২ কোটি ৩৪ লক্ষ মিনিট ফেইসবুকে নেয়া ক্লাসের ভিডিও দেখেছে। (এইটা শুধু ইউটিউবের ভিউ, ফেইসবুকেরটা যোগ হলে এই সংখ্যাটা ৪ কোটি মিনিট ছাড়াবে)।
আয়মান ছেলেটার নামে আমি অনেক বিচিং করি। ছেলেটা Chocolate Boy, কষ্ট করতে চায় না — ইত্যাদি নিয়ে অনেক জোক করি। তবে, ছেলেটাকে একটা বড় ধন্যবাদ দিতে হয়। ওই দিন দুপুরবেলা আমার সাথে বাজি ধরে ফেইসবুকে ক্লাস নেয়ার যে আইডিয়াটা ও শুরু করে তা আজো চলছে। এখন শুধু আমরা একা নই, বাকিরাও এই সুন্দর উদ্যোগ শুরু করেছে। মার্ক জাকার্গবার্গও হয়তো ভাবতে পারে নাই যে, বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েটা ছেলে-মেয়ে ২ কোটি ৩৪ লক্ষ মিনিট মানুষকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখবে।
নি:সন্দেহে ১০ মিনিট স্কুল এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্লাসরুম। আমাদের একটি লাইভ ক্লাসে আপনি আসলেই সেটা বুঝতে পারবেন। চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করবেন আপনার সাথে বসে হাজার হাজার সহপাঠী ক্লাস করছে। প্রতিনিয়ত তারা কমেন্টে প্রশ্ন করে, উত্তর দেয়। মাস শেষে বেতনের খাতায় এক গাদা ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়ে যায়। আমার Filtered and Other Messages গুলো পড়তে গেলেই চোখ ভিজে আসে। ঢাকা মেডিকেলে সড়ক দূ্র্ঘটনায় আহত বাবার বিছানার পাশে বসে একটা ছেলে তার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে শুধুমাত্র আমাদের ক্লাস দেখে। বাবাকে বাচাঁতে না পারলেও ছেলেটা বাবার স্বপ্নটা পূরণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে।
জীবনে যখন নিজেকে useless মনে হয় তখন নিজের Filtered and Other Messages গুলো পড়ে দেখি।
ভালোবাসার কোন কমতি হয়না সেখানে…