360 ডিগ্রীর গল্প
Education

360 ডিগ্রীর গল্প

Sep 22, 2017   |    7309


প্রায় মাস খানেক আগের কথা। রাত বাজে তখন একটা। ফেইসবুকে বসে নিউজ ফিড স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো শাফী আহমেদ নামক এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিৎসকের গল্প। একটি বিদেশী পত্রিকা তাকে নিয়ে বিশাল এক ফিচার করেছেThe Virtual Surgeon”. প্রথম দর্শনে ভাবলাম, হয়তো উনি কোন নতুন সার্জারীর উপায় আবিষ্কার করেছেন। বাঙালীদের এমন সাফল্য তো প্রায়ই আমরা শুনতে পাই। আর নতুন কি?

 

কিন্তু, ফিচারটা পড়ে আমার ধারণা পুরোটিই উল্টে গেলো। এই লোকটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের পড়াশোনাটাকে সহজতর করার জন্য পুরো সার্জারীর কোর্সটাকেই অনলাইনে নিয়ে এসেছেন। অনলাইনে শেখাটাও বা আর নতুন কি? বাংলাদেশের মতো গরীব দেশেও তো মানুষ 10 Minute School, অন্যরকম পাঠশালা থেকে ভিডিও দেখে শিখে।

 

আমি প্রথমে একটু সন্দিহান হলাম। সার্জারীতো হাতে কলমে শেখার বিষয়। এইটা ভিডিও দেখে শিখলে কতটুকু বোধগম্য হবে?

 

কিছুক্ষণের মধ্যই আমার ধারণা আবার ঘুরে গেলো। শাফী আহমেদের ফেইসবুক প্রোফাইলটা ঘেটেঁ দেখলাম। প্রোফাইল পিকচারটা দেখেই চমকে উঠলাম। একটা অপারেশন থিয়েটারে রোগী শুয়ে আছে। সার্জনের ব্লেড হাতে শাফী আহমেদ দাড়ানো। আর চারপাশে তাকে ঘিরে আছে ৪০-৫০ টা ্যামেরা।

 

আমার আগ্রহ তখন আরেকটু তুঙ্গে। তার টাইমলাইন ঘেটেঁ আমি আসল ঘটনা বুঝতে পারলাম। উনি নরমাল ভিডিওতে সার্জারী শেখান না। ৩৬০ ডিগ্রী প্রযুক্তির ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কাজে লাগিয়ে অপারেশন থিয়েটারের পুরো অভিজ্ঞতাটাই তারা তৈরি করেন একজন শিক্ষার্থীর বেডরুমে! তার এই সকল ভিডিওর ১০ সেকেন্ডের স্ন্যাপ পাওয়া যায় Snap Chat এর স্টোরিতেও!

 

নরমাল ভিডিও আর ৩৬০ ডিগ্রী ভিডিও মূল পার্থক্য কি?

 

সাধারণ ইউটিউব ভিডিওতে আপনি শুধু ্যামেরার সামনে কি হচ্ছে তা দেখতে পান। কিন্তু, ্যামেরার উপরে-নীচে, পেছনের জগতটা আপনার কাছে থাকে অজানা। অন্যদিকে, ৩৬০ ডিগ্রী ভিডিওতে আপনি চাইলেই শিক্ষকের উপর থেকে চোখ সরিয়ে ডানে-বামে তাকাতে পারবেন। বাস্তব জীবনের সাথে এর মিল অনেক বেশি। কারণ, মানুষ বেশিক্ষণ একই দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করে না।

 

সবচেয়ে বড় কথা হলো এখন প্রায় ৪০০ টাকায় একটা VR Headset কিনতে পাওয়া যায়। সেটা ্যবহার করে একজন ছাত্র ঠিক একটা ক্লাসরুমে মধ্যে বসে থাকার অনুভূতিটাও উপভোগ করতে পারবে। প্রযুক্তি আপনাকে যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!

 

এই সবকিছু পড়তে পড়তে রাত তখন আড়াইটা বাজে। চিন্তা করতে লাগলাম, ১০ মিনিট স্কুলে ইতোমধ্যে প্রায় ৪০০র মতো ভিডিও বানিয়েছি। এখন ্যুট করতে গেলে কিছুটা বোরিং- লাগে। Why not spicing things up a bit?

 

গুগল বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, VR ্যামেরার দাম কত? উনি জানালেন, মডেল ভেদে ২২ হাজার থেকে লাখটাকারও উপরে। মেসেঞ্জারে দেখলাম আমাদের সিইও আয়মান এখনো অনলাইন। ওকে আইডিয়াটা বললাম: “দোস্ত, ৩৬০ ডিগ্রী ভিডিও বানাবো। ্যামেরা লাগবে। আমার কাছে কিছু টাকা আছে। কিনে ফেলি?

 

যথারীতি আমার সকল আবদারের মতো এই আবদারটাও আয়মান হাসিমুখে মেনে নিলো। শাফী আহমেদ সাহেবকে আরো কিছুক্ষণ stalk করে রাত চারটা নাগাদ ঘুমাতে গেলাম।

 

শুক্রবার সকাল টায় ঘুম থেকে উঠেই বসুন্ধরা সিটিতে দৌড় লাগালাম। পুরো মার্কেট ঘেটেঁ মাত্র একটা VR Camera পেলাম। দাম প্রায় ২৬ হাজার টাকা। কথায় আছে, শখের তোলা আশি টাকা। দ্বিতীয় চিন্তা না করেই আমি আর আয়মান ্যামেরাখানা বগল দাবা করে অফিসে ফিরলাম।

 

্যামেরা তো হলো। এখন তো ভিডিও বানাতে আইডিয়া লাগবে। কি করা যায়? আমাদের প্রোডাকশন হেড জিয়াউস শামস (মতান্তরে জিসাস ্যাম) বললো, “শামীর ভাই, এই ভিডিওতে অনেক হাতে-কলমে কাজ করে দেখাতে হবে। নাইলে এই ৩৬০ ডিগ্রীর মজাটা আসবে না।

 

প্রায় মাস দুয়েক আগে মামুন ভাই (GRE Center এর প্রতিষ্ঠাতা) আমাদের অফিসে ঘুরতে এসেছিলেন। তখন আমি অফিসের মধ্যে ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি একটা সুন্দর মানুষ আমার দিকে হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমার দৃষ্টি তার ফোকাসতল খুজেঁ পাওয়ার আগেই উনি বললেন, “আমি কিন্তু আপনার ভিডিওর অনেক বড় ্যান।মামুন ভাইয়ার সাথে অনেকক্ষণ কথা হলো। আমি কেমিস্ট্রি পড়াই এটা জানার পর উনি আমাকে ্যামাজন থেকে কিনে আনা অণু-পরমাণুর একটা সেট গিফট করে গেলেন। কিছু কিছু মানুষের প্রতি ভালো লাগাটা তাই মন থেকেই আসে।

শুক্রবার অফিস শেষ। সন্ধ্যা টা নাগাদ আমাদের সাধারণ জ্ঞান শিক্ষক সাকিব বিন রশীদ (ওরফে শুভ) কে ফোন দিয়ে অফিসে আনা হলো। অণু-পরমাণুর সেট দিয়ে গ্লুকোজ অণুর গঠন বোঝানো হবে। তাই, পুরো স্টুডিওটা আমি আর শামস মিলে সাজাতে শুরু করলাম। শুভ আমাদের এয়ার ্যাটট্রেসে বেশ সুন্দর একটা নাক-ডাকা ঘুম দিলো। রাত একটা নাগাদ আমাদের প্রস্তুতি শেষ হলো।

 

শুভকে মোটামুটি লাথি মেরে ঘুম থেকে উঠিয়ে জীবনে প্রথম বারের মতো ওকে কেমিস্ট্রি পড়াতে লাগলাম। এরপর শুরু হবে ্যুট। কিন্তু, এখন এক নতুন ঝামেলা। নরমাল ভিডিতে ্যামেরার অন্তরালের মানুষগুলোকে দেখা যায় না। এই মানুষগুলোর ্যামেরাতে মুখ দেখানোর ্যাপারে এক ধরণের অনীহাও কাজ করে। আমাদের ডিরেক্টর জিয়াউস শামসও সেই গোত্রের মানুষ।

 

অন্তত লাজুক প্রকৃতির ছেলে শামস। হঠাৎ করে নতুন প্রযুক্তির এই ্যবহারে সেও েশ উত্তেজিত। দেশের প্রথম শিক্ষামূলক ৩৬০ ডিগ্রী ভিডিও বানানো হবে। সেই ভিডিওতে থাকার লোভটা শামসও সামলাতে পারলো না। ছেলেটা এসে বললো, “শামীর ভাই, আমাকেও একটা ছোট অংশে রাখেন

 

কিন্তু, ওকে কই রাখবো? আমাদের ্যামেরাতে রুমের প্রতিটা কোণা পর্যন্ত দেখা যাবে। শেষমেষ ছেলেটার জায়গা হলো ্যামেরার স্ট্যান্ডের নিচে। ভিডিওটির শেষ পর্যন্ত যদি দেখেন তাহলে শেষ মিনিটে শামসের অত্যন্ত হাস্যকর ঐতিহাসিক এক Entry দেখা যাবে।

 

সারা-রাত ধরে মাত্র একটা ভিডিওর ্যুট হলো। গ্লুকোজ অণুর গঠন সম্পর্কে আমি যা জানতাম তার পুরোটাই ঢেলে দিলাম। ১০ মিনিটের স্কুলের এই ভিডিওটা হলো প্রায় ১৬ মিনিটের মতো। আয়মান একটু মন খারাপ করলো। কিন্তু, আমি-শামস অনেক খুশি।

 

পরের এক সপ্তাহ আমরা সবাই অনেক ্যস্ত নিজেদের জীবন নিয়ে। শামস তার জীবনের প্রথম ৩৬০ ডিগ্রী ভিডিও এডিট করবে। পুরো কাজটা সে ইউটিউব দেখে শিখলো। দুই দিন ধরে একটা মাত্র ভিডিও এডিট করা হলো। উল্লেখ্য, ১০ মিনিট স্কুলে দিনে প্রায় ৪০ টার মতো ভিডিও এডিট হয়!

 

কিন্তু, এই ভিডিওটা ছিলো খুবই স্পেশাল আয়মান ছেলেটার কিছুদিন আগে জন্মদিন ছিলো। ধর্মীয় কারণে জন্মদিন উদযাপন পছন্দ করে না। তাই, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এই ভিডিওটা হবে ওর জন্মদিনের গিফট।

 

অবশেষে গত শুক্রবার রাতে আপলোড হলো ১০ মিনিট স্কুলের ইতিহাসের প্রথম ৩৬০ ডিগ্রী ভিডিও। আমি অনেক ভয়ে ভয়ে ছিলাম মানুষ কি বলবে তা চিন্তা করে। এই ভিডিওটা অনেক ভারী। তাই অনেক দ্রুত গতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ ছাড়া না দেখলে সবই ঘোলা দেখাবে।




আস্তে আস্তে কমেন্ট আসতে শুরু করলো। কিছু ভালো, কিছু মন্থর ইন্টারনেটের ভুক্তভোগী। অবশেষে একটা ছেলের কমেন্ট পড়ে মনে শান্তি আসলো— “ভাইয়া আমার মোবাইলে সব কিছুই ঘোলা আসছে। তবুও নতুন এই ভিডিও দেখতেই ভালো লাগছিলো। কমার্সের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও পুরো ভিডিওটা দেখলাম।

 

সবকিছু শেষ। পরদিন সকালে বাসায় আসার সময় একটা VR হেডসেট নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। আম্মু বাসায় বসেছিলো। তাকে ঘরে এনে মাথায় হেডসেটটা পড়িয়ে দিয়ে ভিডিওটা চালু করলাম। মা আমার তার মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমের চারদিকে কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টায় ্যস্ত। ভিডিও শেষে তার একটাই মন্ত্য: “মনে হলো আমি একদম তোমাদের স্টুডিওতে বসেই ক্লাসটা করছি। জিনিসটা কোনভাবেই অনলাইন মনে হয় না।

 

আমি আম্মুর মাথার হেডসেটটা খুলতে খুলতে বললাম:

 

মা, Welcome to the future of Education!



Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.