ভর্তি যুদ্ধের নীলনকশা
Education

ভর্তি যুদ্ধের নীলনকশা

May 27, 2020   |    3290



কিছুদিন পূর্বে শেষ হয়েছে উচ্চমাধ‍্যমিক পরীক্ষা। কলেজ পাশ শিক্ষার্থীদের জন‍্য সামনে অপেক্ষা করছে ভয়ানক এক ভর্তিযুদ্ধ। নিজের স্বপ্নের বিশ্ববিদ‍্যালয়ে পড়ার জন‍্য প্রায় লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে মেধা তালিকায় স্থান করে নিতে পারলেই যেন সবার মুখে ফুটবে সাফল‍্যের রঙিন হাসি। কিন্তু, সে জন‍্য আগামী দুই-তিন মাস তোমাদেরকে অবশ‍্যই পরিকল্পনা অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিতে হবে। ভর্তি যুদ্ধে সফলতা লাভের সেই নীলনকশা অঙ্কনে সহায়তা করতে আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে রইলো কয়েকটি টিপস:


. ঠিক করো তোমার লক্ষ‍্য

আমাদের দেশে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মেডিকেল অথবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ‍্যালয়ের দিকেই নিজের পছন্দের প্রথম তীরটি নিক্ষেপ করে থাকে। কিন্তু, বাস্তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই শেষ ঠিকানা হয় বিবিএ, আইন, সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত‍্য, ইতিহাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো আকর্ষণীয় বিষয়গুলোতে। তাই, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সামাজিক চাপের কাছে হার না মেনে বরং প্রথমেই ঠিক করে ফেলো তোমার পছন্দের বিষয়টি। তারপর খুজেঁ দেখো বাংলাদেশের কোন কোন বিশ্ববিদ‍্যালয়ে সে বিষয়টি পড়ার সুযোগ রয়েছে। তাহলেই তৈরি হয়ে যাবে তোমার স্বপ্নের তালিকা। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, পাশের বাসার আন্টির কথা শুনে নিজের জীবনের লক্ষ‍্য নির্ধারণ করা হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিশ্বাস রাখো নিজের পছন্দে।


. অত:পর প্রস্তুতি…

ভর্তিযুদ্ধের শুরুতেই অধিকাংশের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। অনেক পরীক্ষার্থীকেই দেখা যায় প্রথম অধ‍্যায়টা খুব মন দিয়ে পড়ছে; কিন্তু শেষের দিকের অংশটুকু রয়ে গেছে একেবারেই অধরা। তাই, কলেজ জীবনে যে অধ‍্যায়গুলো ভালো করে পড়া হয়নি এখন সেই অংশতেই দিতে হবে সবচেয়ে বেশী মনোযোগ। তোমার সময় অত‍্যন্ত সীমিত। তাই, একই জিনিস বারংবার পড়ার সুযোগ হয়তো হয়ে উঠবে না। এখন কোন অংশ বাদ পড়ে গেলে তা লাল কলমে চিহ্নিত করে রাখো। পরীক্ষার আগের দিনগুলোতে সেগুলো গুরুত্ব সহকারে পড়তে পারবে। ভর্তি পরীক্ষার জন‍্য তোমার বোর্ডের পাঠ‍্যবইগুলো হবে সবচেয়ে বড় সহায়ক। এক্ষেত্রে যেকোন লেখকের বই পড়লেই মূল তথ‍্যগুলো তোমরা পেয়ে যাবে। বাজারের সহস্র গাইডের বোঝায় নিজের কাধঁ ব‍্যথা না করাটাই শ্রেয়। 


দৌড়তে হবে সময়ের বিপরীতে

বাংলাদেশের অধিকাংশ ভর্তি পরীক্ষাই হয়ে থাকে বহুনির্বচনী প্রশ্নের আলোকে। সেক্ষেত্রে প্রতি প্রশ্ন উত্তরের জন‍্য সময় থাকে এক মিনিটেরও কম। তাই দুষ্ট ঘড়িটাকে বশে আনা শিখতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার জন‍্য প্রস্তুতির একটা বড় অংশ হলো বিগত বছরের প্রশ্ন অনুশীলন করা। এর জন‍্য পয়সা খরচ করে কোন গাইড কেনাটা এখন নিষ্প্রয়োজন। তোমার মুঠোফোন থেকে চলে যাও www.10minuteschool.com এর সাইটে। সেখানেই সম্পূর্ণ বিনামূল‍্যে পেয়ে যাবে সব বিশ্ববিদ‍্যালয়ের বিগত বছরের প্রশ্ন। একটা একাউন্ট খুলে একের পর এক পরীক্ষা দিতে থাকো। প্রতিটা কুইজের শেষে তোমাকে জানিয়ে দেয়া হবে প্রাপ্ত নম্বর এবং ব‍্যয়িত সময়; সাথে থাকবে ভুল হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর। কয়েক সপ্তাহ টানা পরীক্ষা দিতে থাকলে দেখতে পারবে, তোমার প্রাপ্ত নম্বরটা দিন দিন বাড়ছে; আর ব‍্যয়িত সময়টা যাচ্ছে কমে। এতে তোমার মনে জমা হবে প্রবল আত্মবিশ্বাস- “আমিও পারবো আর এই আত্মবিশ্বাসটাই ভর্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। 


. মচকাবো, কিন্তু ভাঙ্গবো না

জীবনের অন‍্যান‍্য অংশের মতো ভর্তি পরীক্ষাতেও থাকবে জয়-পরাজয়। তুমি সর্বাত্মক চেষ্টা করে পরীক্ষা দিয়েও ব‍্যর্থ হতে পারো। কিন্তু মনে রাখবে, পরাজয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পুনরায় চেষ্টা করার মাঝেই সফলতার মূলমন্ত্র নিহিত। কোন কারণে নিজের প্রথম পছন্দের বিশ্ববিদ‍্যালয়ে চান্স না পেলে সময় নষ্ট না করেই দ্বিতীয় পছন্দকে পাবার জন‍্য লেগে পড়তে হবে। হাল ছেড়ে দেয়াটা চলবে না। অনেকেই অন‍্যান‍্য বন্ধুর ভালো প্রস্তুতি এবং সাফল‍্য দেখে হতাশ হয়ে নিজের আত্মবিশ্বাসের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তাই, জেনে রেখো, বিফল হয়তো তুমি হবে। কিন্তু খোড়া পা নিয়েও যে যোদ্ধা লড়াই করতে জানে, বিজয়টা হয়তো তার জন‍্যই লেখা থাকবে। 


. স্বাস্থ‍্যই সকল সুখের মূল

অনেক ভালো ছাত্রকেই ভর্তি পরীক্ষার সময় ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখেছি। ফলশ্রুতিতে তারা নিজের পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না। তাই, সুস্থ থাকার জন‍্য আলাদা নজর দিতে হবে। এখন গ্রীষ্মকালে ভাইরাসজনিত অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে খাবার পানির ব‍্যাপারে সতর্ক থাকবে। দৈনিক আটঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম তোমার ভর্তিযুদ্ধের জন‍্য খুবই দরকার। 


. সাজেশনের মায়াজাল

আমাদের বোর্ড পরীক্ষাগুলোর আগে শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের একটা সাজেশন পড়ে পাস করে যায়। কিন্তু, ভর্তি পরীক্ষার সবচেয়ে বড় তফাত হলো- “কোন সাজেশন নেই সিলেবাসের সবই আসতে পারে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে। তাই, পাঠ‍্যবইটি হাতে নিয়ে তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন প‍্যারা বাদ না দিয়ে পড়ে যাও। কঠিন বিষয়গুলোকে পড়ার সময় তালিকা আকারে একটা সাদা কাগজে নোট করে রাখতে পারো। ফেইসবুকে 10 Minute School LIVE নামক গ্রুপটিতে তোমার হাজারো বন্ধু প্রতিদিন তাদের তৈরি করা নোটগুলো শেয়ার করছে। চাইলে সেগুলো থেকেও তুমি সাহায‍্য নিতে পারো। সাজেশন দেখে পড়ার সময় এখন শেষ।


. তথ‍্যই শক্তি

অনেক কষ্ট করে তুমি হয়তো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে। কিন্তু, পরীক্ষার হলে ক‍্যালকুলেটর ব‍্যবহার, প্রশ্নের মানবন্টন, উত্তরপত্রে সেটকোড লেখার মতো বিষয়গুলোতে ভুল করে তোমার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যেতে পারে। তাই, পরীক্ষা প্রক্রিয়ার আদ‍্যোপান্ত তোমাদেরকে জানতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ‍্যালয়ের মানবন্টন, সময়, নিয়ম-কানুন কিছুটা ভিন্ন। তাই, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সেই তথ‍্যগুলো এখনই সংগ্রহ করে রাখো। অতিপরিচিত বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোর তথ‍্য আমাদের ১০ মিনিট স্কুলের সাইটেও ছবির মাধ‍্যমে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সুতরাং, প্রযুক্তির এই যুগে ভর্তি সংক্রান্ত তথ‍্যের ব‍্যাপারে নিজেকে সবসময় অবগত রাখবে।


. নিজের পড়া, সেরা পড়া

আমাদের দেশে ভর্তি প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হিসেবে আমরা নানা রকম বাণিজ‍্যিক প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার টাকার খরচ করে আসি। এই শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই মাস না ঘুরতেই হতাশ হয়ে বাসায় বসে থাকে। কারণ জ‍্যাম ঠেলে গরমের মাঝে রাস্তা ঘাটে দৌড়াতে গিয়ে নিজের পড়ার সময়টুকু একেবারেই হয়ে উঠে না। মনে রাখবে, তুমি নিজের পড়ার টেবিলে বসে যেই প্রস্তুতিটা নিবে সেটাই সবচেয়ে বেশী কাজে দিবে। পড়াটা কেউ তোমাকে চামচ দিয়ে মুখে তুলে দিলে তা খুব বেশী কাজে আসবে না। কষ্ট করে একা একা পড়তে শেখো। বিশ্ববিদ‍্যালয়ে পড়ার অন‍্যতম একটা বৈশিষ্ট‍্য হলো জ্ঞানের দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হতে শেখা। বাহিরের দৌড় কমাও, ভালোবাসতে শেখো নিজের ঘরের টেবিলটাকে।


. স্নায়ুর সাথে বোঝাপড়া

মাত্র এক ঘন্টার একটা পরীক্ষায় আমাদের জীবনের লক্ষ‍্য নির্ধারিত হয়ে যায়। সুতরাং, স্নায়ুর চাপ বাড়াটা খুবই স্বাভাবিক। অনেক ভালো ছাত্রই পরীক্ষার হলে গিয়ে হার মানে এই স্নায়ুর কাছে। তাই, নিজের স্নায়বিক বোঝাপড়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রস্তুতি। কথায় আছে, অনুশীলনই সৃষ্টি করে আত্মবিশ্বাস। পরীক্ষার অনুরূপ প্রশ্নপত্রে নিয়মিত বাসায় বসে পরীক্ষা দিতে থাকলে পরীক্ষার হল সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা তৈরি হয়ে যায়। তখন ভয়টা অনেকাংশে কমে আসে। এছাড়া নিয়মিত মেডিটেশন এবং প্রার্থণার মাধ‍্যমেও নিজের স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব।


১০. আব্বু-আম্মু

জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে একজন শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বড় মনোবল জোগাতে পারে তার বাবা-মা। তাই, এই অংশটায় আমরা অভিভাবকদের উদ্দেশ‍্য করে বলছি: আপনার সন্তানদের সময়ে সবচেয়ে বেশী দরকার মানসিক সাহায‍্য। আপনার সন্তান প্রকৌশলী হতে চাইলে তাকে জোর করে চিকিৎসক বানানো হয়তো ঠিক হবে না। তাদের ইচ্ছাকে প্রাধান‍্য দিলে তাদের প্রস্তুতি আরো বেগবান হবে। কারণ, নিজের নির্ধারিত লক্ষ‍্য অর্জনের জন‍্য মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রম করে। দ্বিতীয়ত, কোন একটা পরীক্ষায় খারাপ করলে দয়া করে তাদেরকে দোষারোপ করবেন না। বরং সামনের পরীক্ষার জন‍্য প্রস্তুতি নিতে তাকে উৎসাহিত করুন।কেন কম নম্বর পেলে?”— এই প্রশ্ন করে কারো নম্বর বৃদ্ধি পাবে না। বরং, আপনার ভালোবাসা পেলে তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। আর বিজয়টা কিন্তু আসবে সেই আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়াতেই। সবশেষে, একটু লক্ষ‍্য রাখবেন যাতে আপনার সন্তান প্রতিদিন কিছুটা সময় হলেও একা একা পড়াশোনা করতে সক্ষম হয়। আর আগামী দুই-তিন মাস বাসাটাকে আপনার সন্তানের জন‍্য একটু ভেজালমুক্ত রাখুন। হয়তো মাঝেমধ‍্যে বাসায় ভালো রান্না-বান্না হলেও আপনার বাচ্চাটা পড়াশোনায় বেশ উৎসাহ পাবে। 


ভর্তি পরীক্ষা একটু প্রতিযোগিতামূলক, তবে এটা অসম্ভব কিছু নয়। নিয়মিত সামনের সময়টুকু কাজে লাগিয়ে প্রস্তুতি নিলে কোন একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে চান্স অবশ‍্যই পাওয়া যাবে। জীবনের এই ক্রান্তিকালে তোমাদের প্রতি রইলো অনেক অনেক ভালোবাসা। এগিয়ে যাও বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে.. 




Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.