বাবা দিবসের হাহাকার
May 4, 2017 | 10400
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। আমার জন্মের ঠিক 1 মাস 5 দিন আগে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা যান। আমি বড় হয়ে উঠি মাতৃতান্ত্রিক এক পরিবারে। যে জীবনে কোনদিন হীরা দেখেনি তাকে যেমন হীরার সৌন্দর্য বোঝানো কঠিন; একইরকমভাবে আমার মত যারা কখনো বাবা দেখেনি তাদের বাবার গুরুত্ব বোঝানোটাও অনেক কঠিন।
লোকমুখে শুনেছি, বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র 16 বছর বয়সে গভীর রাতে দাদীর কাছে চিঠি লিখে রেখে চলে গিয়েছিলেন দেশ স্বাধীন করতে। হয়তো সেই রক্ত গায়ে প্রবাহিত হয় বলেই আমার এতো উত্তেজনা। নানু বলতো, ছোট্ট বেলায় বাবা মুখে মুখে ভাইয়াকে অনেক ছড়া মুখস্ত করাতো। সেটা শুনে আমার সবসময়ই একটু একটু মন খারাপ হতো। আমাকে তো কেউ মুখে মুখে ছড়া শেখায় না! বাবা নাকি ভাইয়াকে করলার জুস বানিয়ে খাওয়াতো। ধ্যাত!
আমার করলার জুস কেন আমি পাই না?
এই রকম অসংখ্য অযৌক্তিক আবদারে ভরা ছিলো আমার শৈশবের প্রথম কয়েকটি বছর। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমার মা-ই আমার বাবা। মা’মনি বেশ কঠিন চীজ। একহাতে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সরকারি চাকুরি করেন। প্রতিদিন সকালে সোনারগাঁ যান, রাতে বাসায় ফিরে আসেন। দৈনিক 6 ঘন্টা যাত্রাবাড়ির জ্যাম ঠেলে তিনি আমাদের টানা-পোড়েনের সংসার রক্ষা করেন। সবসময়ই চেষ্টা করেন বাবা না-থাকার কষ্টটা যাতে আমাদের স্পর্শ না করে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, ভালোই হয়েছে বাবা নেই। ছোটবেলায় মামাতো ভাইদের দেখতাম তিন গোয়েন্দার বই হাতে ধরা পড়ার পর বাবার (আমার মামা) হাতে প্রচুর মাইর খেতে। তখন মনে হতো, বাবা একটা টরচার সেল। বাবারা খালি মারে, আর বকা দেয়। কিন্তু, মাঝে মাঝেই আবার মনে হতো বাবা একটা ছায়া। বাবা না থাকায় আমার মাথার উপর রোদটা অনেক বেশিই লাগে। আমার সারাটা স্কুল জীবন পার হয়েছে নানার হাতের আঙ্গুলটা ধরে স্কুলে যেয়ে। বাবা তার বাইকে বসিয়ে কখনো স্কুলে দিয়ে আসতো না। স্কুল ছুটির পর বের হয়ে কোন বাবাকে দেখা যেতো না। একটা জোরে দৌড় লাগিয়ে নিজেই বাসায় চলে আসতাম। হয়তো, সেই কারণেই এত্তো ছোট্ট বয়সেই এত্তো বুড়ো হয়ে গিয়েছি! কারণ, বাবা না থাকলে শৈশবটা অনেক আগেই ফুরিয়ে যায়। অনেক তাড়াতাড়ি ম্যাচিউরড হতে হয়। বাস্তবতাকে ফেইস করতে হয়। তোমাদের যাদের বাবা আছে তাই তোমাদের দেখে অনেক হিংসে হয়। তোমরা কত্তো দুশ্চিন্তবিহীন একটা ছেলেবেলা কাটিয়ে এসেছো!
বাবা মারা যাবার পর তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। ভাইয়ার বয়স তখন মাত্র 4 বছর। এত্তোটুকুন পিচ্চি ছেলের এত্তোবড় বাস্তবতা মেনে নেয়ার মানসিকতা তখনো গড়ে উঠেনি। তাই, সবাই যখন কবর দিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখনো ভাইয়া বলছিলো:
“আমার বাবাকে রেখে কেন চলে যাচ্ছো? বাবাকে রেখে আমি যাবো না!”
কখনো কখনো মনে হয়, ভালোই হয়েছে বাবাকে দেখিনি। বাবার স্বাদ পেলে সেটা হারিয়ে যাবার কষ্টটাও নিশ্চয়ই অনেক হতো? আমার হীরা আমার জন্মের আগেই হারিয়ে গেছে। তাই হীরা হারানোর শোকে আমাকে পাথর হতে হয়নি।
মা’মনির কাছে একটা বড় স্যুটকেস ভর্তি বাবার স্মৃতিগুলো জমে আছে। সেখানে তার যুদ্ধকালীন ডাইরী, একটা ছোট্ট চাবুক, কিছু ছবি আর অনেক অনেক কার্ড অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। হয়তো মা’মনি কখনো কখনো অনেক যতনে স্যুটকেসটা খুলে দেখেন; কিন্তু আমাদের কখনোই দেখান না। বুঝতে পারি, স্মৃতির রোমাঞ্চ যতটা বেশি, তা হারিয়ে ফেলার শোকও ততই তীব্র!
মানুষ মরার পর আকাশের তারা হয়ে যায় এই থিওরীটা আমি সবসময়ই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এসেছি। আমার সবসময়ই মনে হতো, সন্ধ্যার সময় তারা হয়ে যাওয়া আমার বাবাটা সবার আগেই রাতের আকাশে দেখা যায়। সেই তারাটা দেখতে একটু লাল লাল। ভাবতাম, বাবার নিশ্চয়ই অনেক রাগ! পরে জানতে পারলাম সেটার নাম মঙ্গল গ্রহ। হাহা!
বাবাবিহীন একটা প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের বাবা-বেদনার উপাখ্যানটা অসম্ভব অযৌক্তিক! কিছুটা হাস্যকর। তাই, শুধু এটুকুই বলতে চাই:
Rest in peace dad/ baba/ father/
pops /abbu. I haven’t figured out what I would have called you if you had hung
in there a little longer! Maybe, I will take a lifetime to figure that out. I
hope that’s okay. See you in Heaven.
Happy Father’s Day everyone <3