পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মায়ের গল্প
May 13, 2017 | 10677
আমার মা সংসারে বাবার ভূমিকা পালন করে আসছেন বিগত ২৫ বছর ধরে। বাবার মৃত্যু হয় আমার জন্মের প্রায় দেড় মাস আগে। ভাইয়ার বয়স তখন মাত্র ৪ বছর।
দুই শিশু সন্তান সাথে নিয়ে একা একটি পরিবার চালানোর সাহস করতে অনেক বড় বুকের পাটা লাগে। বিয়ের মাত্র ৫ বছরের মাথায় স্বামীহারা একজন ২৮ বছর বয়সী মেয়েকে তার পরিবার বারবার পুনরায় বিয়ের প্রেশার দিবে;
এটাই আমাদের সমাজের রীতি। কিন্তু,
নতুন সংসারে তার ছেলেদের আদরের অভাব হতে পারে এই ভেবে আমার মা নামলেন বিশাল এক জীবন যুদ্ধে।
মা তখন সামান্য বেতনের সরকারি চাকুরি করতেন। মালিবাগে তার অফিসের উল্টা পাশেই একটা স্কুলে আমাকে ভর্তি করালেন। সকাল বেলা অফিসে ঢুকার আগে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যেতেন। স্কুল ছুটির পর আমি সোজা মা’মনির অফিসে চলে যেতাম। সেখানে তার কলিগরা আমাকে অনেক আদর করতো। অফিসে বেলা ১১ টার দিকে বেকারীর এক ধরণের বিস্কুট খেতে দেয়া হয়। আমি অনেকটা লোভ থেকেই বিস্কুট খেতে অফিসে যেতাম!
সারা দিনের অফিসের পর আম্মু বাসায় এসে আমাকে ও ভাইয়াকে পড়াতে বসাতেন। বড় ভাই একটু ডানপিটে স্বভাবের হওয়ার তার পেছনে বেশী সময় দিতে হতো। আমি মোটামুটি নিজেই পড়তে পারতাম।
সেসময়টায় আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই বাজে ছিলো। খিলগাওঁয়ে নানা বাড়ির পাশে একটি ভাঙ্গা ঘরে আমাদের থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। ঝড়-বৃষ্টি-ইদুরের উৎপাত সহ্য করে আমাদের সুখের সংসার চলতো। একদিন আম্মু আমাকে বুঝিয়ে বললেন:
“তুমি যদি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারো তাহলে যা চাও তাই কিনে দেবো!”
লোভাতুর আমি সেই টোপে বেশ ভালো করেই ফেসেঁ গেলাম। এর পর থেকেই শুরু হলো একের পর এক ফার্স্ট বয় হওয়ার ধান্ধা। প্রথম ভালো ফলাফল করি ক্লাস টু-তে। আমার আবদারগুলোও ছিলো অত্যন্ত অসাধারণ। প্রথমবার অনেক কান্না-কাটি করে আমি এক বক্স কেলাস চোকোস আদায় করি। দ্বিতীয় বার সম্ভববত চিকেন নাগেটস খেতে চেয়েছিলাম!
আমার কাছে এই সবই ছিলো তখন অত্যন্ত বড়লোকি আবদার। তাই প্রতি চার মাসে একবার যখন রেজাল্ট দিতো তখন আম্মুকে আমার এইসব বড়লোকি আবদার মেটাতে অনেক বেগ পেতে হতো। কারণ আমি নিজের চোখে দেখেছি,
একবার বাস থেকে নামার পর টাকা না থাকায় বৃষ্টি মধ্যে আমরা প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা হেটেঁ বাসায় এসেছি। তখন রিক্সা ভাড়া ছিলো মাত্র পাচঁ টাকা!
সেই দিন বৃষ্টির মাঝে আম্মুর সাথে ছাতা না থাকলেও আমার মাথার উপর ছায়ার অভাব ছিলো না। সকল ঝড়-বৃষ্টি-বন্যায় মা’মনি ছিলো আমার মাথার ছাতা। কোনদিন একটুকু রোদও লাগতে দেয়নি;
একটা আবদারও অপূর্ণ রাখেনি।
জন্মদিন সংক্রান্ত অনেক সুখ-দু:খের গল্প আছে আমাদের। ভাইয়ার জন্মদিন ১লা মে!
প্রতিবছর আমি এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কারণ,
ছোটবেলায় আম্মু এইদিন আমাদের দুইজনকে মগবাজারের চাং-পাই রেস্টুরেন্টে চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে যেতেন।
আমরা দুই ভাই ওদিন ভীষণ ভয়ে থাকতাম। কারণ,
যা চাইতাম আম্মু তাই অর্ডার দিতো। একদিন বিল চলে আসে প্রায় ৭০০ টাকা!
ওইদিন ভেবেছিলাম বিল দিতে না পেরে বাসন মেজে বাসায় আসতে হবে। কিন্তু,
মা থাকতে চিন্তা কি!
বছরের একদিন অন্তত তার পকেটে টাকার অভাব হতো না।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আম্মু অনেক ব্যস্ত ছিলেন নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব নিয়ে। আমার জন্মদিনে রাত ৯:০০ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপরও সে আমাকে উইশ করলো না। বুঝতে পারলাম জীবনের ঝড়ে সে আমার জন্মদিনটাও ভুলে গেছে। সেটা নিয়ে তখন অনেক মন খারাপ করেছিলাম। এখন সেই রাগ গলে পানি হয়ে গেছে।
আমি যখন হাইস্কুলে তখন আম্মুর প্রোমোশন হলো। তার পোস্টিং ঢাকার বাহিরে। কখনো সোনারগাঁ,
কখনো মুন্সিগঞ্জ,
কখনো গাজীপুরে তাকে চাকুরী করতে হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৩+৩=৬ ঘন্টার পথ জার্নি করে এসে এই মহিলা আবার আমাদের জন্য রান্না করতেন। বলাই বাহুল্য কোন কোন রাতে তার আসতে অনেক দেরী হতো। সেদিন ক্ষুধা লাগলেও খাবার জুটতো না। তাই,
অনেকটা রাগ থেকেই আমি নিজে রান্না করতে শিখেছি। আমার রান্নাও আম্মুর থেকে মজার। এটা সেও স্বীকার করে।
যারা আমার বাসায় এসেছে তারা জানে আম্মুর সাথে মোটামুটি আমার বেশ কমেডিয়ান একটা রিলেশন। আমার অযাচিত পান্ডিত্ব জাহির করার স্বভাবকে উনি দুই পয়সার দামও দেন না। তার সাহস,
পরিশ্রম ও উৎসাহ ছাড়া আমার অস্তিত্বও থাকতো না।
দু:খের গল্পের শেষটা করতে হয় সুখ দিয়ে। ক্লাসিক বাংলা সিনেমা। তো,
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমাদের অভাবের অনেকটাই পরিত্রাণ ঘটলো। ভাইয়া আর আমি তখন নিজেদের খরচ চালাতাম। ভাইয়া একটা কল সেন্টারে পার্ট টাইম জব করতো। আর আমি উদ্ভাসের শামীর ভাইয়া হয়ে গেলাম। সুন্দর একটা বাসায় আমরা মুভ করলাম। সে সময়কার কিছু ঘটনা মনে পড়লে বেশ ভালো লাগে।
২০১৪ সালে আম্মুকে জোড় করে নিয়ে গেলাম ঈদের শপিং করতে। তাকে জুতো কিনে দিবো। বসুন্ধরা সিটির বাটার দোকানে তার এক জোড়া জুতা বেশ পছন্দ হলো। কিন্তু,
দাম ১৯০০ টাকা!
আমার মা তার জীবনে ৬৫০ টাকার বেশী দামের জুতা কেনেন নাই। তাই,
আমি বেশ জোর সেই জুতাটা কিনে দিলাম। ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশ মানসিক অশান্তিতে ভুগতে থাকলো।
আমি সাধারণত ঈদে কিছু কিনি না। জামা কাপড়ের প্রতি আমার তেমন কোন ফ্যাসিনেশন নেই। কিন্তু,
বাটার দোকান থেকে বের হয়ে আমার মা বেশ আবদার করলেন যে,
আমাকে একটা দামী পাঞ্জাবী কিনে দিবেন।
দামী হওয়াটা সেই পাঞ্জাবীর বড় ক্রাইটেরিয়া। যেই কথা,
যেই কাজ। আমরা গেলাম
Yellow এর দোকানে। আমার পছন্দ অনেকটা সাদা মাটা। যেই পাঞ্জাবী মনে ধরে সেইটাতে ডিজাইন বলতে কিছুই নেই। প্লেইন আর এক কালার। এক্কেবারে ভাগ্যবলে তখন বন্ধু আয়মানও সেখানে পাঞ্জাবী কিনছিলো। তারও চয়েস সেন্স আমার মতোই খারাপ!
আম্মা তখন অনেক বিরক্ত হয়ে বলেছিলো:
“তোরা দুইজনই অল্প বয়সে বুড়া হয়ে গেছিস!”
আমার মা আমার বাবা!
তিনি বেশ রাগতে পারেন। আস্তে কথা বলাটা তার সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যের অংশ নয়। কিছু উল্টা-পাল্টা দেখলেই অনেক ঝাড়ি শুনতে হয়। তখন,
মমতাময়ী মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সবকিছু থেকে রক্ষা করতেন নানু। আমার মা ছিলো আমার বাবা। আর,
নানু ছিলো আমার মা।
নানুর বয়স এখন ৮০ এর কাছাকাছি। তিনি পার্কিনসন ডিজিজের রোগী। প্রায়ই কারো কথা মনে রাখতে পারেন না। ঠিকমতো হাটতেঁও পারেন না। তার ছেলে ও ছেলের বউয়েরা নিজেদের জীবন নিয়ে বেশ ব্যস্ত। মায়ের খোজঁ তারা সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার রাখেন। আমি অবাক হয়ে দেখি,
আম্মু সকাল বেলা নানুকে বাথরুম করানো থেকে শুরু করে মুখে তুলে ভাই খাওয়ানো পর্যন্ত সবই করেন। এককালে তার মাত্র দুইটা বাচ্চা ছিলো। এখন নতুন একটা জুটেছে আমাদের দলে!
নিজের ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা-কে যিনি শিশুর মতো কোলে-পিঠে লালন পালন করেন তার পুন্য লিখে শেষ করা যাবে না। স্বামীহারা এক মহিলা তার দুই দুধের বাচ্চার একটাকে কর্পোরেট জায়ান্ট এবং অন্যটাকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন। তার সাথে যারা সারা জীবন খারাপ ব্যবহার করে এসেছে তিনি তাদের সংসারে এখন আর্থিক সহায়তা জোগান।
এই মানুষটা জান্নাতে না গেলে সেটাকে বেহেশত বলা যাবে না!